সত্যিকারের বন্ধু চিনতে হলে

এ জীবনে বড়ো একটা বিপদে পড়েছিলাম, অনেক বড়ো বিপদ! আমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারতাম, চাকরি হারাতে পারতাম। প্রচণ্ড রকমের মনের শক্তিতে ক্রমাগত লড়াই করে আমি নিজেকে বাঁচিয়েছি। তখন আমি মানুষ চিনতে শিখেছি। আমাদের বিপদগুলো মানুষ চিনতে সাহায্য করে; কারা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় মানুষ, কারা মোটেও প্রয়োজনীয় নয়---এটা চিনতে খুব সাহায্য করে। যে কখনও বড়ো কোনও বিপদে পড়েনি, মানুষ চিনতে তার এখনও অনেক দেরি আছে।




তো আমি তখন যে ভয়ংকর অবস্থায় ছিলাম, সেটা মানুষ চিনতে খুব হেল্প করেছিল আমাকে। মানুষ চেনা যায় কীভাবে? এর উত্তরটা একটা গল্পের মাধ্যমে দিই! এই ধরুন, আমি যে এখন বেঁচে আছি, আমার আশেপাশের অনেকগুলো মানুষকে আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি! তারা আমাকে তোয়াজ করবে, তারা আমার তারিফ করবে, কেননা আমার চোখ তাদের দেখতে পাচ্ছে, আমার অনুভব তাদের বুঝতে পারছে। তাই তারা আমাকে ভালো বলবে, তারা আমার আশেপাশে থাকবে, আমাকে অনেক কিছুই বলবে তারা।




যদি আমি মারা যাই, তখন তো আমাকে আর "আমি" বলা হবে না! তখন তো আমি লাশ হয়ে যাব! আমাকে তখন, লাশ বা মৃতদেহ যেটাই বলুন না কেন, সেটা বলা হবে। তো লাশের তো কোনও অনুভূতি থাকে না, লাশ তো চোখে দেখতে পায় না! তখন আমার পাশে কে এল কি এল না, এটা আমি দেখতে পাবো না। তখন আমার সম্পর্কে দুটো ভালো কথা কে বলল কি বলল না, সেটা আমি শুনতে পাবো না। তখন কেউ আমার পাশে থাকল কি থাকল না, সেটা আমি বুঝতেই পারব না।




এর আগ পর্যন্ত, মানুষ আমাকে খুশি করার জন্য, আমাকে এটা বোঝানোর জন্য যে আমি তোমার সঙ্গে আছি, কিংবা কোনও এক স্বার্থে বা কোনও একটা কারণে বা চক্ষুলজ্জা থেকে আমার পাশে আসে। কিন্তু, লাশের কাছে এ পৃথিবীর কার‌ও কোনও চক্ষুলজ্জা নেই, লাশের কাছে কার‌ও কোনও স্বার্থ নেই, লাশের কাছে কার‌ও কিছুই নেই। সম্মান দেখানো দূরে থাক, লাশের পাশে না দাঁড়ালেও তো চলে!




আমি যদি এই মুহূর্তে মারা যাই, তখন আমার পাশে না এলেও চলে, আমার পাশে না দাঁড়ালেও চলে; তা সত্ত্বেও কিছু মানুষ ঠিক‌ই পাশে চলে আসবেন। কিছু মানুষ আমার লাশটা কাঁধে নিয়ে শ্মশান পর্যন্ত যাবেন, কিছু মানুষ আমার জন্য কাঁদবেন, কিছু মানুষ প্রতিবছর আমার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার জন্য অশ্রু বিসর্জন করবেন।




আপনি একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন, আপনার মৃত্যুর পর আপনার পাশে এসে দাঁড়াবেন, আপনার লাশটা শ্মশান পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবেন, এমন মানুষ কে কে আছেন! আপনি অবাক হয়ে যাবেন, আপনারা যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তাঁদেরকে বলছি...আপনি অবাক হয়ে যাবেন, এই ধরনের মানুষ খুঁজলে, আপনি খুব বেশি হলে তিন থেকে চার জন পাবেন। ম্যাক্সিমাম পাঁচ/ছয়/সাত জন, এর বেশি কিছুতেই পাবেন না, যাঁরা পার্থিব কোনও কারণ ছাড়াই আপনার লাশ দেখে অঝোরে কাঁদবে।




আপনার ফেইসবুকে দশ লক্ষ ফ্রেন্ড-ফলোয়ার থাকতে পারে, কিন্তু আপনি যখন চরমভাবে বিপন্ন, তখন মন থেকেই আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে, এমন মানুষ আপনি তেমন কাউকেই পাবেন না। আমি আমার নিজের চরম বিপদের সময় তেমন কাউকেই পাশে পাইনি, যদিও তখন আমার অনেক ফলোয়ার এবং সো-কল্‌ড ওয়েল‌উইশার ছিল। আমার আগের আইডিটা ছিল, যেটাতে তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষীরা গমগম করত! এখনকার আইডিটা খুব একটা বেশি জমজমাট আইডি না, তবে আগের আইডিটা খুব জমজমাট ছিল। সেই আইডিটা ডিজঅ্যাবেলড হয়ে গেছে, কিছু অতি‌উৎসাহী বরাহশাবকের সমস্ত জীবনের একমাত্র অর্জন হিসেবে পারমানেন্টলি ডিজঅ্যাবেলড হয়ে গেছে। সেখানে আমার অনেক ফলোয়ার ছিল, আড়াই লাখের উপর সুপারঅ্যাকটিভ ফলোয়ার ছিল! খেয়াল করুন, আইডিতে, পেইজে নয় কিন্তু! আইডিতে আড়াই লাখ ফলোয়ার হওয়া টাফ ব্যাপার। বাংলাদেশে সেসময় আমার চাইতে বেশি ফলোয়ার হাতেগোনা মাত্র দু-একজনের ছিল।




আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না, আমি যখন বিপদে পড়েছিলাম, তখন আমি সেই আড়াই লক্ষ মানুষের মধ্য থেকে তিনজন মানুষও পাইনি আমার পাশে থাকার জন্য! সত্যিই পাইনি! দিনের পর দিন যাদের উপকার করে গেছি বিনা অর্থে ও বিনা স্বার্থে, তাদের বেশিরভাগই সেসময় চুপ থেকেছে; তাদের কেউ কেউ চরম ক্ষতিও করেছে। এবং, মজার বিষয় হচ্ছে, তখন যাঁরা থেকেছেন পাশে, তাঁদের অনেককে আমি তার আগে চিনতামও না!




আমার একটা বন্ধু আছে, ওর নাম হচ্ছে রুবেল। তো সে যে আমাকে এতটা ভালোবাসে, তা আমি জীবনে কখনও জানতেই পারতাম না বিপদে না পড়লে! সে যে আমার এতটা ভালো বন্ধু, সেটাই তো আমি জানতাম না! আমার জন্য সে তার জীবনকে বিপন্ন করেছিল, সে তার সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমার পাশে থাকতে চেয়েছিল। এমন একজন দেবদূততুল্য মানুষকে আমি কখনও কাছের মানুষ ভাবিইনি! তাই "কাছের মানুষ" ব্যাপারটা সবসময়ই গোলমেলে! আমার কাছে সবচাইতে মজার কৌতুকটি হচ্ছে: দাদা, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি!




এ কারণেই আপনাকে আমি বলি, আপনি যদি এখন মারা যান, আপনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে, এমন মানুষ কারা আছেন, আপনি একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন। তারাই হচ্ছে আপনার জন্য সবচাইতে দরকারি মানুষ। তারাই হচ্ছে আপনার বন্ধু। এর বাইরে আর কাউকেই মনে জায়গা দেবার কিছু নেই। যারা আপনার সাথে পড়াশোনা করেছে, তারা কিন্তু সবাই বন্ধু নয়, তারা স্রেফ ক্লাসমেট! আমরা বেশিরভাগ মানুষই ক্লাসমেটকে বন্ধু মনে করি! ক্লাসমেট সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা "বন্ধু" শব্দটা ব্যবহার করি। এটা সত্যিই বোকার মতো একটা ভুল! ক্লাসমেট আর বন্ধু ভিন্ন জিনিস। যে মানুষটা মৃত্যুর পরেও আপনার পাশে থেকে যাবে, সে-ই হচ্ছে বন্ধু।




আপনি একটু ভাবুন না, আপনার মৃত্যুর পর কারা আপনার সঙ্গে থেকে যাবেন! আপনার সবচাইতে বিপদের মুহূর্তে, যখন আপনার পাশে না থাকলেও কিছু এসে যায় না, তখন পাবেন ক-জনকে! আমি যখন বিপদে পড়েছিলাম, তখন সুশান্ত পালের চাকরিটা আদৌ থাকবে কি না কেউ জানত না; সবাই ভেবেছিল, চাকরিটা বুঝি এবার চলে যাবে! তখন তো সুশান্ত পাল হারিয়ে যাবে! এরকমটাই সবার মাথায় ছিল। দ্যাট ইজ, তখন আমার পাশে থাকলেও কারও কোনও বেনিফিট হচ্ছে না, কারও কোন ধরনের উপকার হচ্ছে না, আমি তো আর কারও কাজে লাগব না! অনেকের মনেই আনন্দের কোনও সীমা ছিল না তখন!




তা সত্ত্বেও, কোনও কিছু পাবার আশা না করেই আমাকে ভালোবাসে বিধায় আমারে পাশে ছিল যারা, তাদেরকে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনও ভুলতে পারব না। তারাই আমার বন্ধু। তারা ছাড়া বাকি সবাই হচ্ছে আমার জন্য স্রেফ পরিচিত মানুষ। বন্ধু এবং পরিচিত’র মধ্যে পার্থক্য আছে। যাদের আমি চিনি, তাদের প্রায় সবাই-ই আমার জন্য পরিচিত মানুষ, কিন্তু বন্ধু নয়। যারা স্রেফ পরিচিত---বন্ধু নয়, জীবনে তাদের যত কম জায়গা দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।




যখন আমি ভালো কোনও কিছু খাই, তখন আমার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। মনে হয়, ইস্, তাদেরকে কিছু খাওয়াতে পারতাম! তাদেরকে দু-পিস দিতে পারতাম! যখন মিষ্টি খাই, তখন মনে হয় একপিস মিষ্টি বন্ধুকে দিতে পারতাম! ভালো একটা খাবার খেলে মনে হয়, তাকে যদি দিতে পারতাম! এরকমটা কিন্তু আমার মনে হয়। এবং আপনাদের বলি, আপনারা যদি এই ছোট্ট একটা মাইন্ড-এক্সারসাইজ করেন, তাহলে কারা আপনার বন্ধু আর কারা বন্ধু নয়, সহজেই জানতে পারবেন। এবং, নিশ্চিত থাকতে পারেন, যারা একবার আপনার বিপদে পাশে ছিল না, পরবর্তী বিপদেও আপনি তাদেরকে পাবেন না, তারা পাশে থাকবে না। এটাই নিয়ম! এটাই নিয়ম! এটাই নিয়ম! হ্যাঁ, আমি এটাই হতে দেখেছি। যে মানুষটা আপনার বিপদের দিনে পাশে থাকে না, তার প্রশংসায় কিংবা নিন্দায় আপনার সত্যিই কিছু এসে যায় না। আপনি বিপদে পড়লে যে মানুষটা গা বাঁচিয়ে চলে, তার দিকে কখনও ফিরেও তাকানোর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।




তাই যাদেরকে আপনি বন্ধু বলে বলে সমানে চেঁচাচ্ছেন, তাদের সবাই আপনার বন্ধু নয়। যাদেরকে আপনি কাছের মানুষ বলে বলে খুশিতে চেঁচাচ্ছেন, তাদের সবাই আপনার কাছের মানুষ নয়। আপনি চোখটা বন্ধ করলেই দেখবেন, তাদের তেমন কেউই কোথাও নেই! তাদের মধ্যে যে দু-একজন আছে, তাদের কখনও ছাড়বেন না! আপনার জীবনে যা-ই আসুক না কেন, তাদেরকে আপনি দেবতার আসনে বসান, তাদেরকে দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করুন! তারা আপনার জন্য অনেক কিছু! এমনকী তারা যদি আপনাকে দুটো গালমন্দ করে, আপনার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার‌ও করে, আপনার সম্পর্কে বাজে কথাও বলে, তার পরেও তাদেরকে অন্ধের মতো করে ভালোবাসুন। ভুল মানুষের কাছ থেকে স্যালুট পাবার চাইতে বরং ঠিক মানুষের চড় খাওয়া ভালো। তারা সেটা ডিজার্ভ করে, কেননা যখন আপনি মারা যাচ্ছিলেন, ডুবে মরছিলেন, তখন তারা পাশে ছিল। যখন আপনি চরম বিপদে পড়েছিলেন, তখন তারা পাশে ছিল। তাদেরকে কখনও ভুলবেন না। তাদের নিজের সবটুকু দিয়ে দিন। অনেক আনন্দ আছে এতে। বেঁচে থাকার মধ্যে একধরনের আনন্দ পাবেন।




এ পৃথিবীতে সবচাইতে আনন্দের বিষয়টি হচ্ছে: কৃতজ্ঞ হতে জানা। কৃতজ্ঞ হতে শিখুন। দেখবেন, অনেক ভালো লাগছে আপনার! অকৃতজ্ঞ সিংহ হয়ে গর্জন করার চাইতে কৃতজ্ঞ কুকুর হয়ে পা চাটাও অধিক সম্মানের ও স্বস্তির।