রাধাতত্ত্ব (অন্ত্যপর্ব)

পূজ্যপাদ শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী মহোদয় প্রণীত 'প্রেমাস্তোজ-মরন্দাখ্য স্তবরাজঃ' নামে একটি স্তব আছে, শ্রীরাধার মহাভাবাদি বিষয়ে পূর্বের অংশটি সেই স্তব হতে গৃহীত। সেই স্তবটি এই প্রসঙ্গে আস্বাদনীয়—




শ্রীরাধিকায়ৈ নমঃ।।
মহাভাবোজ্জ্বলচ্চিন্তারত্নোদ্‌ভাবিতবিগ্রহাং।
সখীপ্রণয়সদ্‌গন্ধঃ বরোদ্বর্তন সুপ্রভাং।। (১)
কারুণ্যামৃতবীচীভিস্তারুণ্যামৃতধারয়া।
লাবণ্যামৃতবন্যাভিঃ স্নপিতাং গ্লপিতেন্দিরাং।। (২)
হ্রীপট্টবস্ত্রগুপ্তাঙ্গীং সৌন্দর্য ঘুসৃণাঞ্চিতাং।
শ্যামলোজ্জ্বলকস্তূরী বিচিত্রিত কলেবরাং।। (৩)
কম্পাশ্রু পুলক স্তম্ভ স্বেদ গদ্‌গদরক্ততা।
উন্মাদোজাড্যমিত্যেতৈ রত্নৈর্নভিরুত্তমৈঃ।। (৪)
ক্লপ্তালঙ্কৃতি সংশ্লিষ্টাং গুণালীপুষ্পমালিনীং।
ধীরাধীরাত্বসদ্বাস পটবাসৈঃ পরিষ্কৃতাং।। (৫)




মহাভাবস্বরূপ উজ্জ্বল চিন্তারত্ন দ্বারা যাঁর শরীর অতি পবিত্র হয়েছে এবং সখিগণের প্রণয়রূপ উদ্বর্তন অর্থাৎ কুঙ্কুমাদি (জাফরান বা জাফরান ফলের নির্যাস, যা প্রসাধনী হিসাবে ব্যবহৃত হয়) দ্বারা যাঁর কান্তি সুন্দর হয়েছে। (১)




পূর্বাহ্ণে কারুণ্য অর্থাৎ দয়ালুতারূপ অমৃততরঙ্গ, মধ্যাহ্নে তারুণ্য অর্থাৎ যৌবনরূপ অমৃতধারা এবং সায়াহ্নে লাবণ্য অর্থাং কান্তিরূপ অমৃতবন্যা দ্বারা যিনি স্নান করার মধ্য দিয়ে ইন্দিরা অর্থাৎ লক্ষ্মীদেবীকেও গ্লানিযুক্ত করছেন। (২)




লজ্জারূপ পট্টবস্ত্র (পূজাদি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে পরিধেয় রেশমের কাপড়বিশেষ) দ্বারাই যাঁর অঙ্গ আচ্ছাদিত এবং যিনি সৌন্দর্যরূপ ঘুসৃণ অর্থাৎ কুঙ্কুম দ্বারা সুশোভিত তথা শ্যামবর্ণ উজ্জ্বল অর্থাৎ শৃঙ্গার-রসরূপ যে-কস্তুরী, তার দ্বারা যাঁর কলেবর বিচিত্রিত হয়েছে। (৩)




অপর, কম্প, অশ্রু, পুলক, স্তম্ভ, স্বেদ, গদ্‌গদ অর্থাৎ অস্ফুট ধ্বনি, রক্ততা, উন্মত্ততা ও জড়তা—এই নয়টা উত্তম রত্ন দ্বারা যিনি অলংকার রচনা করে পরিধান করেছেন, তথা সৌন্দর্যমাধুর্যাদি সমস্ত গুণই যাঁর পুষ্পমালাস্বরূপ এবং ধীরাধীরাত্ব (সুগন্ধি চূর্ণবিশেষ) ভাবরূপ সদ্‌গন্ধকেই যিনি পটবাস (বস্ত্রগৃহ, তাঁবু) অর্থাৎ কর্পূরাদিরূপে ব্যবহার করেছেন। (৪, ৫)




প্রচ্ছন্নমানধম্মিল্লাং সৌভাগ্য তিলকোজ্জ্বলাং।
কৃষ্ণনামযশঃ শ্রাববতংসোল্লাসি কর্ণিকাং।। (৬)
রাগতাম্বুলরক্তৌষ্ঠীং প্রেমকৌটিল্যকজ্জলাং।
নর্মভাষিত নিঃস্যন্দ স্মিতকর্পূরবাসিতাং।। (৭)
সৌরভান্তঃপুরে গর্বপর্যঙ্কোপরিলীলয়া।
নিবিষ্টাং প্রেমবৈচিত্ত্য বিচলত্তরলাঞ্চিতাং।। (৮)
প্রণয়ক্রোধসচ্চোলীবন্ধ‌গুপ্তীকৃতন্তনাং।
সপত্নীবক্ত্রহৃচ্ছোষি যশঃশ্রীকচ্ছপীরবাং।। (৯)
মধ্যতাত্মসখীস্কন্ধ লীলান্যন্তকরাম্বুজাং।
শ্যামাং শ্যামস্মরমোদমধূলী পরিবেশিকাং।। (১০)
ত্বাং নত্বা যাচতে ধত্বা তৃণং দন্তৈরয়ং জনঃ।
স্বদাস্যামৃতসেকেন জীবয়ামুং সুদুঃখিতং।। (১১)




প্রচ্ছন্ন মানই যাঁর ধম্মিল্ল অর্থাৎ সম্বন্ধ কেশপাশ, যিনি সৌভাগ্যরূপ তিলকে উজ্জ্বল এবং শ্রীকৃষ্ণের নাম ও যশঃ শ্রবণই যাঁর সুন্দর কর্ণভূষণ। (৬)




অনুরাগরূপ তাম্বুল রক্তিমায় যাঁর ওষ্ঠ রঞ্জিত, প্রেম কৌটিল্যই যাঁর কজ্জল (কাজল, অঞ্জন), উপহাসবাক্য বলাই যাঁর হেতু, মধুর হাস্যরূপ কর্পূর দ্বারা যিনি সুবাসিত হয়েছেন। (৭)




সৌরভ অর্থাৎ কীর্তি স্বরূপ অন্তঃপুরমধ্যে যিনি গর্বরূপ পর্যঙ্কে আনন্দে শয়ন করে প্রেমবৈচিত্ত্য অর্থাৎ বিপ্রলম্ভরূপ চঞ্চল তরল (হার মধ্যস্থিত মণি) দ্বারা শোভা পাচ্ছেন। (৮)




সপ্রণয় ক্রোধসম্ভূত রক্তিমারূপ সচ্চোলীবন্ধনে অর্থাৎ কাঁচলি (বক্ষাবরণ) দ্বারা যিনি স্তনযুগলকে আবৃত করেছেন এবং সপত্নীগণের কুটিলতম মুখ ও হৃদয়ের শোষণকারিণী যশঃশ্রী অর্থাৎ যশঃ সম্পত্তিই যাঁর উৎকৃষ্ট কচ্ছপীর অর্থাৎ বীণার রব হয়েছে। (৯)




মধ্যতা অর্থাৎ যৌবনরূপ স্বীয় সখির স্কন্ধদেশে যিনি নিজের লীলারূপ করপদ্ম অর্পণ করেছেন এবং যিনি শ্যামা অর্থাৎ বিশেষ গুণযুক্তা স্ত্রী তথা যিনি শৃঙ্গাররস দ্বারা কন্দর্প-মত্ততারূপ মধু পরিবেশন করছেন। (১০)




অতএব এই আমি দন্তে তৃণ ধারণ করে প্রণতি পুরঃসর (সহকারে) প্রার্থনা করছি যে, এই সুদুঃখিত ব্যক্তিকে স্বীয় দাস্যরূপ অমৃত দান করে জীবিত করুন। (১১)




নমুঞ্চেচ্ছরণায়াতমপি দুষ্টং দয়াময়ঃ।
অতোগান্ধর্বিকে! হা হা মুঞ্চৈনং নৈব তাদৃশং।। (১২)




প্রেমাস্তোজ মরন্দাখ্যং স্তবরাজমিমং জনঃ।
শ্রীরাধিকাকৃপাহেতুং পঠংস্তদ্দাস্যমাপ্লুয়াৎ।। (১৩)




হে গান্ধর্বিকে! দয়াময় ব‍্যক্তি যখন শরণাগত দুষ্টজনকেও পরিত্যাগ করেন না, তখন তুমি এই আশ্রিত দুই জনকে ত্যাগ কোরো না। (১২)




যে-ব্যক্তি শ্রীরাধার কৃপার কারণস্বরূপ এই 'প্রেমাস্তোজ-মরন্দাখ্য স্তবরাজঃ' নামক স্তবরাজ পাঠ করেন, তিনি সেই শ্রীরাধিকার দাস্যলাভে সমর্থ হন। (১৩)




যাহার সৌভাগ্যগুণ বাঞ্ছে সত্যভামা।
যার ঠাঞ্চি কলাবিলাস শিখে ব্রজরামা।।
যার সৌন্দৰ্যাদিগুণ বাঞ্ছে লক্ষ্মী পার্বতী।
যার পতিব্রতা ধর্ম বাঞ্ছে অরুন্ধতী।।
যার সদ্‌গুণের কৃষ্ণ না পান পার।
তার গুণ গণিবে কেমনে জীব ছার।।




ব্যাখ্যা: শ্রীকৃষ্ণের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে একা শ্রীরাধাই সমর্থা। এই বিষয়ের প্রমাণ গোবিন্দলীলামৃতের ১১ সর্গের ১২২ শ্লোকে শ্রীরাধা ও কুন্দলতার উক্তি প্রত্যুক্তি, যথা—শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়োৎপত্তি স্থান কে? এই প্রশ্নের উত্তর—কেবল‌ই শ্রীমতী রাধিকা। শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তমা কে? এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর—অনুপমগুণা একা শ্রীরাধিকাই, অন্য কেউ নয়। এঁর কেশে কুটিলতা, চক্ষুতে তরলতা ও কুচে নিষ্ঠুরতা; সুতরাং শ্রীরাধাই শ্রীকৃষ্ণের বাঞ্ছাপূরণে সমর্থা, অন্য কেউই নয়। যাঁর সৌভাগ্য-রূপ-গুণ সত্যভামা বাঞ্ছা করেন, যাঁর কাছে ব্রজরামাগণ বিলাসের ক্রমসমূহ শেখেন, যাঁর সৌন্দর্যাদি গুণ লক্ষ্মী এবং পার্বতীও বাঞ্ছা করেন, যাঁর পাতিব্রত্য ধর্ম বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতী অভিলাষ করে থাকেন, শ্রীকৃষ্ণ যাঁর সদ্‌গুণসমূহের অন্ত (শেষ) প্রাপ্ত হন না, অধম ও অসার জীব কী প্রকারে তাঁর গুণগণ গণনা করবে!




'বিলাস' অর্থ: উজ্জ্বলনীলমণির অনুভাব প্রকরণের ৩৭ অঙ্কে, যথা—
গতিস্থানাসনাদীনাং মুখনেত্রাদি কর্মণাং।
তৎকালিকন্তু বৈশিষ্ট্যং বিলাসঃ প্রিয়সঙ্গজঃ।।




অর্থ: গতি, স্থান, আসন, মুখ ও নেত্রাদি কর্মসমূহের, প্রিয়তমের সঙ্গম জন্য, বিশেষ সেই মুহূর্তে উৎপন্ন যে-বিশিষ্টতা, তাকে বিলাস বলে।




প্রেম কী? বৈষ্ণবাচার্যগণ এই প্রেমতত্ত্ব নানাপ্রকারে অতিবিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁদের সেই ব্যাখ্যা ও বর্ণনার সাথে পরিচিত হওয়া যাক।




পূজ্যপাদ শ্রীল রূপগোস্বামীকৃত 'উজ্জ্বলনীলমণি' গ্রন্থাবলম্বনে লিখছি।




সর্বথা ধ্বংসরহিতং সত্যপি ধ্বংসকারণে।
যদ্‌ভাববন্ধনং যুনোঃ স প্রেমাপরিকীর্তিতঃ।।




ধ্বংসের বিভিন্ন কারণ থাকা সত্ত্বেও সর্বতোভাবে ধ্বংসরহিত, কিছুতেই ধ্বংস হচ্ছে না—যুবক-যুবতীর ভেতর এই প্রকারের যে-ভাববন্ধন, তার নাম প্রেম।




বঙ্কিমচন্দ্রের 'চন্দ্রশেখর' উপন্যাসে শৈবলিনীর প্রেমের কথা আছে। শৈবলিনী প্রতাপকে ভালোবাসতেন, বালিকা-বয়স হতেই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার প্রেরণায় শৈবলিনী স্বামীর ঘর ত্যাগ করেছেন এবং অশেষ প্রকারের কষ্ট সহ্য করেছেন, অতিভয়ংকর বিপদ-আপদের সম্মুখীন হয়েছেন।




প্রথমে মনে হবে, এটা প্রেম। কিন্তু যখন মহাপুরুষের সম্মোহনবিদ্যার প্রভাবে তাঁর সেই ভাববন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল, যে-হৃদয় প্রতাপের জন্য এত করেছে, সেই হৃদয়েরই গতি আবার ফিরল, তখন বোঝা গেল, এটা ধ্বংসরহিত নয়, অতএব প্রতাপের সাথে শৈবলিনীর যে-ভাববন্ধন বা ভালোবাসা, তা প্রেম নয়।




এ পৃথিবীতে মানুষকে উপলক্ষ্য করে মানুষের হৃদয়ে প্রকৃত প্রেমের উদয় হয় না। প্রেম নিত্যাশ্রয়ী, অর্থাৎ হৃদয়ে যে-শ্রীভগবান নিত্য অধিষ্ঠিত, তাঁর জন্যই জাগ্রত হয়। যদি কখনো সত্যপ্রেমের উদয় হয়, তাহলে দেহরক্ষা অসম্ভব। এই জন্যই শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে এমন বলা হয়েছে—




অকৈতব কৃষ্ণপ্রেম,
যেন জাম্বুনদ হেম,
সেই প্রেম নৃলোকে নাহি হয়।
যদি হয় তার যোগ,
না হয় তবে বিয়োগ,
বিয়োগ হৈলে কেহ না জীয়য়।।
(কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃতের গীত’, মধ্যলীলা, ২/৪৩)




বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর লেখা 'প্রেমসম্পুট' নামক বৈষ্ণব গ্রন্থে প্রেম‌ সম্বন্ধে বলা হয়েছে—




লোকদ্বয়াৎ স্বজনতঃ পরতঃ স্বতোবা
প্রাণপ্রিয়াদপি সুমেরুসমা যদি স্যুঃ। ক্লেশান্তদপ্যতিবলী সহসা বিজিতা
প্রেমৈব তান হরিরিভানিব পুষ্টিমেতি।।




ইহলোক বা পরলোক হতে; স্বজন হতে, পরজন হতে বা নিজের কাছ হতে; যিনি প্রাণপ্রিয়, তাঁর কাছ হতে—যদি সুমেরু পর্বতের সমান‌ও ক্লেশরাশি এসে উপস্থিত হয়, তাহলে, সিংহ যেমন হাতিদের পরাজিত করে, ঠিক তেমনি প্রেম সেই সমস্ত ক্লেশকে পরাজিত করে পুষ্টিলাভ করে।




বৈষ্ণব কবিতায় শ্রীরাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার আলোচনায় এই সংজ্ঞাটি যদি সবসময় মনে রাখা যায়, তাহলে আমরা বৈষ্ণব কবিতার ভেতরের কথা ও আধ্যাত্মিকতা আস্বাদন করতে পারব।




শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত হতে যে-অংশ উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে আছে—প্রেম আনন্দ-চিন্ময়-রস; আর আছে—প্রেম হ্লাদিনী শক্তির সার। প্রেম যে শক্তি বা শক্তিসার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ শক্তি জড়ীয় নয়, মানবীয় নয়; এ শক্তি চিন্ময়, ঐশ। সেই শাশ্বত-চিরায়ত উচ্চারণ—Love is Divine—মৃত্যুময় জগৎ—প্রেমই এখানে অ-মৃত। জগতে সকলই নশ্বর—একমাত্র প্রেমই অবিনশ্বর ও নিত্য। আমার যতক্ষণ আত্মতৃপ্তির বা আত্মসুখের বোধ থাকে, ততক্ষণ, প্রেম কী, তা আমি বুঝতেই পারি না। আত্মসুখদুঃখ বোধ পরিত্যাগ করলে প্রেমের আবির্ভাব হয়, অথবা প্রেমের আবির্ভাব হলে আর আত্মসুখদুঃখের বোধ থাকে না। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতেই আছে—




'আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা' তারে বলি কাম। 'কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা' ধরে প্রেম নাম।।
কামের তাৎপর্য নিজ সম্ভোগ কেবল।
কৃষ্ণসুখ তাৎপর্য হয় প্রেম মহাবল।।
অতএব কাম প্রেমে বহুত অন্তর।
কাম অন্ধতম প্রেম নির্মল ভাস্কর।।




নিজেন্দ্রিয় তৃপ্ত করার ইচ্ছের নাম কাম। এই কাম প্রেমের বৃত্তি নয়, বরং ঘোর স্বার্থহেতু রজোগুণের বৃত্তি। হ্লাদিনীসার যে-প্রেম, সে কেবল কৃষ্ণসুখের উদ্দেশ্যেই ঘটে থাকে। লোকলীলায় রসিকশেখর কৃষ্ণ নবকিশোর; তাঁর হ্লাদিনী শক্তিগণ পরমরসময়ী নবকিশোরী; সুতরাং তাঁদের অর্থাৎ গোপীরূপা হ্লাদিনীশক্তিগণের কৃষ্ণসুখকে তাৎপর্যপূর্ণ প্রেমের কামাকারে প্রতীয়মান হওয়াই উচিত—প্রবল-প্রগাঢ় প্রেমের একমাত্র উদ্দেশ্য কৃষ্ণকে সুখদান করা। প্রেমের এই মধুর-ভাবে সব রসের সমাবেশ হয়, তাই প্রেমসেবার পূর্ণতম আনন্দ আস্বাদন করা যায়। হনুমানাদি যেমন দাস্যভাবের, শ্রীদামাদি যেমন সখ্য-ভাবের, নন্দ-যশোদাদি যেমন বাৎসল্য-ভাবের আদর্শ; তেমনি ব্রজগোপী ও মহিষীগণ মধুর-ভাবের আদর্শ।




এই কামানুগা মধুরভাব দুই অংশে বিভক্ত—সম্ভোগেচ্ছাময়ী, তদ্‌ভাবেচ্ছাময়ী। যাঁরা রুক্মিণী প্রভৃতি মহিষীদের ভাবানুগত, তাঁদের ভক্তিকে সম্ভোগেচ্ছাময়ী ভক্তি বলে; এই ভক্তিতে মহিষীদের মতো কিছু পরিমাণে স্বসুখ-বাঞ্ছা, মহিম-জ্ঞান এবং লোকধর্ম-সাধন প্রভৃতি ভাব বিদ্যমান। অপরদিকে, যাঁরা লোক-বেদাদি যাবতীয় ধর্ম পরিত্যাগ করে, ঐহিক-পারত্রিক সকল সুখ-সাধনে জলাঞ্জলি দিয়ে নিষ্কাম ভাব ও পরমপ্রেমময় স্বভাবের অনুসরণ করেন, তাঁদের সেই ভক্তিকে তদ্‌ভাবেচ্ছাময়ী বলে; এটা ব্রজবাসী শ্রীরাধিকাদি গোপীদের অন্তরে নিত্য বিরাজমান রয়েছে। অতএব মহিষীদের ভাব হতে সাধারণী কিংবা সমঞ্জসা রতি উৎপন্ন হয় এবং গোপীদের ভাব হতে সমর্থা রতির উদয় হয়।




রতি তিন প্রকার—সাধারণী, সমঞ্জসা ও সমর্থা। সাধারণী রতি সম্ভোগেচ্ছামূল হওয়ায়, তা তিরস্কৃত হয়েছে। মহিষীদের রতি সমঞ্জসা, কেননা সেটি লোকধর্মরক্ষায় বিবাহবিধি দ্বারা উদ্‌বুদ্ধ। গোকুলদেবীদের রতি সমর্থা, কারণ তা লোক ও ধর্মকে অতিক্রম করে প্রকাশিত। সমর্থা যে অসমঞ্জসা, তা নয়। পরম পারমার্থিক বিচারে সমর্থাই অতি সমঞ্জসা। সাধারণী রতি মণির মতো, সমঞ্জসা রতি চিন্তামণির মতো এবং সমর্থা রতি জগৎ-দুর্লভ কৌস্তভের মতো অনন্যলভ্যা।




কৃষ্ণকে সাক্ষাৎ দর্শন করার পর সম্ভোগেচ্ছা হতে, অতি গাঢ় নয়, এমন যে-রতি উদিত হয়, তা-ই সাধারণী। এই রতির গাঢ়ত্ব অল্প, তাই সম্ভোগেচ্ছাই এর নিদান। সম্ভোগেচ্ছা হ্রাস হলে এ রতির হ্রাস হয়ে যায়। গুণাদি শ্রবণ হতে উৎপন্ন পত্নীভাবাভিমানস্বরূপা গাঢ় রতিই সমঞ্জসা। কখনো কখনো তাতে সম্ভোগেচ্ছা উদিত হয়, সমঞ্জসা রতি সম্ভোগেচ্ছা হতে পৃথক হলে তা থেকে উত্থিত ভাব দ্বারা কৃষ্ণকে বশ করা দুর্ঘট হয়।




রতিমাত্রেরই সম্ভোগেচ্ছা আছে। সাধারণী ও সমঞ্জসা রতির সম্ভোগেচ্ছা স্বার্থপর প্রকৃতির। সেই সম্ভোগেচ্ছা হতে নিঃস্বার্থ লক্ষণ কোনো বিশেষ ভাবপ্রাপ্ত সম্ভোগেচ্ছার সাথে তাদাত্ম্য অর্থাৎ একই ভাবপ্রাপ্ত রতিই 'সমর্থা'। সম্ভোগেচ্ছা দুই প্রকার—প্রিয়জন দ্বারা নিজ-ইন্দ্রিয়-তর্পণ সুখময়ী ইচ্ছা এবং নিজের দ্বারা প্রিয়জন-ইন্দ্রিয়-তর্পণ সুখভাবনাময়ী ইচ্ছা। প্রথম ইচ্ছেটিকে কাম বলা যায়, কেননা তা স্বসুখোন্মুখী। দ্বিতীয় ইচ্ছেটি হিতোন্মুখী হওয়ায় তা প্রেমোন্মুখী। সাধারণী প্রিয়জন রতিতে প্রথমোক্ত ইচ্ছেই প্রবল। সমঞ্জসাতে তা প্রবল নয়। শেষোক্ত লক্ষণই সমর্থা রতির সম্ভোগেচ্ছার বিশেষ ধর্ম। অবশ্য সে ইচ্ছে দুর্বার হলেও সমর্থার হৃদয়ে তা নিতান্ত দুর্বল।




এই বিশেষ ক্রমে রতিই বলবর্তী হয়ে তেমনি করে বিশিষ্ট সম্ভোগেচ্ছাকে ক্রোড়ীকৃত করে রতি ও সম্ভোগেচ্ছার একাত্মতা লাভ করে। সেই রতি সব উপায়ে সামর্থ্যপ্রযুক্ত 'সমর্থা' নাম প্রাপ্ত হয়। পূর্বোক্ত অভিযোগাদির মধ্যে অন্বয় অর্থাৎ সম্পর্ক অথবা তা হতেই হোক বা রতির স্বাভাবিক স্বরূপ হতেই হোক, এই সমর্থা রতিজাত হ‌ওয়ামাত্র সকল বিস্মরণ-করণ ক্ষমতাযুক্ত হয়ে অতিগাঢ়রূপে প্রতীয়মান হয়। ব্রজললনাদের সমর্থা রতি কেবল কৃষ্ণসুখের জন্য। সম্ভোগে যে আপন সুখ আছে, তা-ও কৃষ্ণসুখের অনুকূল বলে স্বীকৃত। সুতরাং সম্ভোগেচ্ছা ও কৃষ্ণসুখময়ী রতি সবচাইতে অদ্ভুত রূপে চমৎকার শ্রী ধারণ করে নিজ থেকেই সম্ভোগেচ্ছাকে পৃথক সত্তায় থাকতে দেয় না। সমঞ্জসাতে নিজের সুখে ওই রতি কখনো কখনো পর্যবসিত হতে পারে।




রতি প্রৌঢ়াভাব প্রাপ্ত হয়ে মহাভাব দশাকে লাভ করে। সমস্ত বিমুক্ত পুরুষ তার অন্বেষণ করেন এবং গীতায় উল্লিখিত পাঁচ ধরনের ভক্ত, যাঁর যতদূর সাধ্য, তা পেয়ে থাকেন।




স্যাদ্দৃঢ়েহয়ং রতি প্রেম্না প্রোদ্যন্ স্নেহ ক্রমাদয়ং।
স্যান্মনঃ প্রণয়ো রাগোহনুরাগো ভাব ইত্যপি।।
(উজ্জ্বলনীলমণি, স্থায়ীভাব প্রকরণ, ৪৪)




অর্থ: এই মধুরা রতি বিরুদ্ধভাব দ্বারা অভেদ্য রূপে দৃঢ় হয়। তখন তার নাম 'প্রেম'। সেই প্রেম ক্রমে ক্রমে নিজ মাধুর্য প্রকাশ করে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ ও ভাবরূপ ধারণ করে। রতি, প্রেম, স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ ও ভাব এক বস্তুরই ক্রমোন্নতি। ‘ভাব’ শব্দটি এ স্থলে মহাভাব।




স্নেহাদি ছয়টি প্রেমের বিলাসক্রম। এ কারণেই পণ্ডিতগণ ‘প্রেম’ শব্দটি দ্বারা তাকেই উদ্দেশ করেন, যার মধ্যে যে জাতীয় কৃষ্ণপ্রেম উদিত হয়, তার ফলে কৃষ্ণেরও সেই জাতীয় প্রেম উদিত হয়ে থাকে।




গাঢ়ত্ব, গুরুত্ব ও অতিশায়িতার কারণে প্রেম তিন প্রকার—প্রৌঢ়, মধ্য ও মন্দ।




বিলম্ব বা কিঞ্চিৎ অনুপস্থিতির কারণে নায়িকার চিত্তবৃত্তি না জানার জন্য অন্যজনের মনে ক্লেশদায়ক প্রেমকে প্রৌঢ় প্রেম বলে। মধ্য প্রেমে নায়ক এক নায়িকার সঙ্গে মিলিত হয়েও অন্য নায়িকার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে অর্থাৎ দু-জনের মধ্যে সমভাব পোষণ করে, তাকে মধ্য প্রেম বলে। আর সর্বদা ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও সান্নিধ্যের দরুন যাতে ত্যাগ বা আদর কিছুই থাকে না, তাকে বলে মন্দ প্রেম। প্রৌঢ় প্রেমে অনুপস্থিত নায়িকার জন্য নায়ক প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু মধ্য প্রেমে নায়ক অন্য কান্তার অনুভব সহ্য করে। আর মন্দ প্রেমে আদর বা উপেক্ষা কোনোটারই প্রাবল্য থাকে না। প্রৌঢ় প্রেমে থাকে বিচ্ছেদের অসহিষ্ণুতা, মধ্য প্রেমে-'কৃচ্ছৎ সহিষ্ণুতা' অর্থাৎ কোনোমতে কষ্টেসৃষ্টে সহ্য করা যায়, মন্দ প্রেমে কখনোবা বিস্তৃতিও জন্মে।




যেখানে বিশ্লেষের অসহিষ্ণুতা, সেখানে প্রৌঢ় প্রেম। যেখানে বিশ্লেষকে কষ্টে স‌ওয়া যায়, সেখানে মধ্য প্রেম। যেখানে কখনো কখনো বিস্মরণ হয়, সেখানে মন্দ প্রেম।




আত্মেন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তির জন্য যে-কাজ করা যায়, তাকে কাম বলে; আর ঈশ্বরেন্দ্রিয়ের প্রীতির জন্য যা করা যায়, তাকে প্রেম বলে। সমস্ত কাজ নিজ সম্ভোগের স্বরূপে প্রয়োগ না করে কৃষ্ণ-সুখ-তাৎপর্যে প্রয়োগ করলে, তা হতে সমর্থারতির উদয় হয়; পরে তা-ই গাঢ় হয়ে প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু মহিষীদের কিছুটা স্বসুখ-বাঞ্ছা থাকায় তা আর সমর্থা রতিতে পরিণত হতে পারে না। বিশেষত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একটু উঁচু-নিচু ভাব আছে, লোকধর্ম-সাধনের ইচ্ছে আছে এবং তা স্বাভাবিকী বিধায় তাতে তেমন উদ্দাম-উচ্ছ্বাস নেই। কিন্তু গোপীদের ভাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা স্বামী-পুত্র, ঘর-বাড়ি, জাতি-কুল, বেদবিধি, ধর্ম-কর্ম, লজ্জা-শরম পরিত্যাগ করে কুলটার মতো ভগবানে আসক্ত হয়ে থাকেন। কুলটা রমণী যথাযথভাবে সংসারধর্ম পালন করে, কিন্তু তার মনটা সবসময় উপপতির (ঈশ্বরের) চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। ‘উপপতি’ এখানে আক্ষরিক অর্থে নয়, ভাবার্থে।




প্রেমভক্তি-প্রচারক চৈতন্যদেব বলছেন—
পরব্যসনিনী নারী ব্যগ্রাপি গৃহকর্মসু।
তদেবাস্বাদয়ত্যন্ত র্নবসঙ্গ রসায়নমিতি।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ১/১৬৪)




পরাধীনা রমণী গৃহকাজে থাকলেও চিত্তমধ্যে যেমন নবসঙ্গম-রসের আস্বাদন করে, তেমনি বিষয়কর্মে লিপ্ত থেকেও নব-কিশোর শ্রীকৃষ্ণের প্রেমরসের আস্বাদন মনে মনে অনুভব কোরো। তাই ভক্তিমার্গে এমন অবিধি-সম্মত শাস্ত্রাচার, সমাজনিয়ম প্রভৃতি বিচ্ছিন্নকারী পরকীয়াভাব গৃহীত হয়েছে। সুতরাং স্বকীয়া মহিষীদের সম্ভোগেচ্ছাময়ী মধুরভাব হতে, পরকীয়া গোপীদের তদ্‌ভাবেচ্ছাময়ী মধুর-ভাবের গোপিকানিষ্ঠ ভাব, সোজাকথায়—গোপীভাব শ্রেষ্ঠ। রাধিকাদি গোপীগণ গোপীভাবের আদর্শ।




গোদাবরীতটে রায় রামানন্দ শ্রীগৌরাঙ্গদেবকে বলছেন—এর মধ্যে অর্থাৎ মধুর-ভাবের মধ্যে রাধার প্রেমই সাধ্যশিরোমণি, তাই গোপীভাব শ্রেষ্ঠ। তাঁরা স্বামী, পুত্র, কুল, মান, কিছুই চান না—চান কেবল শ্রীকৃষ্ণকে। কবিরাজ গোস্বামী লিখছেন—




আর এক অদ্ভুত গোপীভাবের স্বভাব।
বুদ্ধির গোচর নহে যাহার প্রভাব।।
গোপীগণ করে যবে কৃষ্ণ–দরশন।
সুখবাঞ্ছা নাহি, সুখ হয় কোটিগুণ।।
গোপিকা–দর্শনে কৃষ্ণের যে আনন্দ হয়।
তাহা হৈতে কোটিগুণ গোপী আস্বাদয়।।
তাঁ সবার নাহি নিজসুখ–অনুরোধ।
তথাপি বাড়য়ে সুখ, পড়িল বিরোধ।।
এ বিরোধের এক মাত্র দেখি সমাধান।
গোপিকার সুখ কৃষ্ণসুখে পর্যবসান।।
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/১৮৫-১৮৯)




গোপীভাবের আর-এক অদ্ভুত স্বভাব এই যে, তার প্রভাব বুদ্ধির গোচর হয় না। গোপিকাগণ যখন কৃষ্ণদর্শন করেন, তাতে তাঁদের সুখবাঞ্ছা না থাকলেও, তবু তাতে তাঁদের কোটিগুণ সুখোৎপত্তি হয়। অপরদিকে, গোপিকাদর্শনে শ্রীকৃষ্ণের যেমন আনন্দ হয়, গোপীগণ কৃষ্ণদর্শনে তার চাইতে কোটিগুণ বেশি আনন্দ অনুভব করেন। যদিও গোপীগণের নিজসুখের অনুরোধ বা আকাঙ্ক্ষা এখানে নেই, তবু তাঁদের সুখবৃদ্ধিপ্রাপ্তি হয়, এ বিষয়ে বিরোধ উপস্থিত হলো। এ বিরোধের একমাত্র সমাধান এটাই দেখা যায় যে, গোপিকার সুখ কৃষ্ণসুখেই পর্যবসান হয় বা পূর্ণতা পায়।




গোপীদের কৃষ্ণদর্শনে সুখের বাঞ্ছা নাই, কিন্তু কোটিগুণ সুখের উদয় হয়—এ বড়োই চমৎকার কথা! গীতায় বর্ণিত নিষ্কাম কর্মের সমান্তরালে উদিত এই ভাব অনুভব করা পাণ্ডিত্য বুদ্ধির‌ সাধ্যাতীত, তাই অনেকেই গোপীভাবের নাম শুনে হাসিঠাট্টা করেন। গোপীদের দেখে কৃষ্ণের যে-আনন্দ হয়, তা হতে গোপীদের কোটিগুণ বেশি আনন্দের উদয় হয়। কেন? গোপীদের সমস্ত সুখ‌ই যে কৃষ্ণমুখে পর্যবসিত! কৃষ্ণ সুখী হয়েছেন দেখে গোপীদের সুখ; অর্থাৎ তাঁদের স্বকীয় ইন্দ্রিয়াদির সুখ নেই, কৃষ্ণের সুখেই সুখ।




এভাবে কৃষ্ণময় সর্বভূতের সুখে সুখী হতে হবে। ভালো কাজ করেছি বলে আনন্দিত হলে হবে না, আমার কাজে বিশ্বরূপ ভগবানের সুখ হয়েছে বলেই তাতে আমারও সুখ। এজন্যই গোপীভাব শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত হয়েছে। গোপীদের নিজের বলে কিছুই নেই—রূপ, যৌবন, শোভা-সৌন্দর্য, লালসা-বাসনা—সমস্তই সেই শ্যামসুন্দরের জন্য। তাঁরা কাজ করেন, সন্তান পালন করেন, ঘরের কাজ করেন, কিন্তু প্রাণ নিরন্তর সেই ভগবানের প্রেমরসে মজে থাকে। তাঁরই কথা, তাঁর কাজের‌ই আলোচনা, তাঁরই নামগানে পরিতুষ্ট—এমনভাবে যে-ভক্ত সাধনা করেন, তিনিই পরম মুক্ত। নিজেকে দাস-ভাবে আর পরমপুরুষ ভগবানকে প্রভু-ভাবে চিন্তা করে তাঁতেই চিত্ত অর্পণ করে, তাঁরই প্রেমে লীন থাকলেই নিরবচ্ছিন্ন এবং বিশুদ্ধ আনন্দ লাভ করা যায়।




এই গোপীভাবনিষ্ঠ মধুররসাত্মক ভক্তি হতে মধুরা রতির উদয় হয়। এই রতি হলে ভগবানের সাথে ভক্তের বিলাসের সূত্রপাত হয়—




মিথোহরে মৃগাক্ষ্যাশ্চ সম্ভোগস্যাদিকারণং।
মধুরাপরপৰ্যায়া প্রিয়তাখ্যোদিতা রতিঃ।
অস্যাং কটাক্ষভ্রূক্ষেপপ্রিয়বাণীস্মিতাদয়ঃ।।
যথা গোবিন্দবিলাসে।।
চিরমুৎকণ্ঠিতমনসো রাধা মুরবৈরিণোঃ কোহপি।
নিভৃতনিরীক্ষণজন্মা প্রত্যাশা পল্লবো জয়তি।।
(ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, দক্ষিণ, ৫ লহরী, ২০)




অর্থ: হরি এবং মৃগাক্ষী রমণীর পরস্পর স্মরণ, দর্শন প্রভৃতি অষ্টবিধ সম্ভোগের আদিকারণের নাম প্রিয়তা। এই প্রিয়তার আর একটি নাম মধুর। এতে কটাক্ষ, ভ্রূক্ষেপ, প্রিয়বাক্য এবং হাসি প্রভৃতি হয়ে থাকে। যথা গোবিন্দবিলাসে। চিরকাল উৎকণ্ঠিতমনা রাধা শ্রীমাধবের নির্জন নিরীক্ষণজনিত প্রত্যাশাপল্লবযুক্ত হোক।




মধুরা রতিই শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর প্রেয়সীদের সম্ভোগের আদিকারণ। এই মধুরা রতি যখন গোপীদের মতো সম্পূর্ণরূপে স্বসুখ-বাসনাশূন্য হয় এবং সম্ভোগ-বাসনা যদি শ্রীকৃষ্ণের সম্ভোগবাঞ্ছার সাথে একতাভাব প্রাপ্ত হয়, তখন এটা ‘সমর্থা’ বলে অভিহিত হয়ে থাকে। এই সমর্থা-রতি প্রেমবিলাসে ক্রমশ পরিপক্ব হয়ে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ ও ভাবে পর্যবসিত হয়। অতঃপর ভাব আরও উৎকৃষ্টদশা প্রাপ্ত হলে ‘মহাভাব’ নামে বর্ণিত হয়। এটাই গোপীভাবনিষ্ঠ সমর্থারতির চরম বিকাশ। গোপীভাবনিষ্ঠ সমর্থারতি প্রৌঢ় মহাভাবদশা প্রাপ্ত হলেই তা ‘প্রেম’ বলে কীর্তিত হয়।




কামগন্ধ-শূন্য যে-অনুরক্তি, তার নাম প্রেম। এই ভাব যেখানে আছে, সেই স্থানেই প্রেম আছে বলা যেতে পারে। যা আত্মেন্দ্রিয়ের প্রীতি-ইচ্ছা, তা-ই কাম। অতএব আত্মেন্দ্রিয়ের প্রীতি-ইচ্ছা-পরিশূন্য হয়ে যাতে অনুরক্তি হয়, তাতেই প্রেম হয়। আমি তাঁকে ভালোবাসি, তাঁর যে-কাজ, তা-ই আমার চোখে ভালো। তিনি রূপ ভালোবাসেন, আমি রূপের উৎকর্ষ করব না কেন? তিনি ফুলমালা ভালোবাসেন, তাই বনে বনে ভ্রমণ করে আমার এত বনফুল তোলা, তাই এ মালা গাঁথা।




কৃষ্ণের বিরহে কাতর রাধা বলছেন—মালায় তো আমার কোনো প্রয়োজন নেই, যাঁর জন্য মালা গাঁথা, সে কই? সে যদি না আসবে, তাঁর গলায় যদি এ মালা না দুলবে, মালার সুবাসে সে যদি পুলকিত না হবে, তবে এ মালা গাঁথা কেন? সে আনন্দিত হলে, তবেই তো আমার আনন্দ। নতুবা জগতে আমার আর কী আনন্দ আছে? সে সুখী হলে, তবেই আমার সুখ।—এটাই প্রেম, নিষ্কাম প্রেম। দেশের, দশের, সমাজের, ধনীর, দরিদ্রের, সুন্দরের, কুৎসিতের উপকার করে—তাদের যে-আনন্দ, সেই আনন্দের প্রতিঘাতই আমার আনন্দ। এটাই ব্যষ্টিভাবের আনন্দ, আর সমষ্টিভাবের আনন্দ ঈশ্বরানন্দ। ভগবানকে সেবা করে; ভগবানকে সৌন্দর্য উপভোগ করিয়ে, ভগবানকে বুকে নিয়ে, আনন্দের পূর্ণতম যে-ভাব, তা-ই প্রেম।




ভগবানে এমন প্রেম জন্মালে, তখন ফুল ফুটলে, মৃদুবাতাস ব‌ইলে, সুবাস ছুটলে, কোকিল ডাকলে, ভ্রমর গুঞ্জন করলে, সেই মুখ মনে পড়ে। আবার মেঘের গর্জনে, বিদ্যুতের চমকে, অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকারে, হতাশার দীর্ঘশ্বাসে, দারিদ্র্যের কশাঘাতে তাঁকে মনে পড়ে বলেই বুঝতে পারা যায়, এরাও তাঁরই বিস্তৃতি। এদের সেবাতেও তাঁরই সেবা। প্রেম জন্মালে, তখন মানুষের সমস্ত বৃত্তি তাঁরই আশ্রিত হয়ে পড়ে। ভক্ত তখন আত্মচিত্তে বলেন, আমি জ্ঞান চাই না, শক্তি চাই না, মুক্তি চাই না, বিত্তাদি কিছুই চাই না—চাই কেবল তোমাকে। তুমি আমার প্রাণের প্রাণ, তুমি আমার বিশ্বের প্রাণ—তুমি এসো, আমার হৃদয়-নিকুঞ্জে উদিত হও। একবার আমাকে 'আমার' বলে সম্বোধন করো।




মনের ঠিক এমন অবস্থার নাম প্রেম। কিন্তু নিজেকে ক্ষুদ্র, হীন ও সান্ত; ঈশ্বরকে বিরাট, বিপুল ও অনন্ত ভাবলে তিনি দূরে থাকেন—কাজেই তাঁর সাথে প্রেম আর হয় না। তাঁর উপর ভক্তের একাত্মভাব-মান-অভিমান, সোহাগ-আদরের ছায়া প্রভৃতি ওতপ্রোত ভাব না থাকলে প্রেমের স্ফুরণ হয় না। যশোদার শাসন, নন্দের বাধাবহন, গোপবালকের উচ্ছিষ্টভক্ষণ ও স্কন্ধে বহন এবং গোপবালাদের পা ধরে মানভঞ্জন—এ সমস্তই ব্রহ্মভাবলুব্ধ ভক্তের পরম আদর্শ। মহিমজ্ঞানে প্রেম সংকুচিত হয়। ভাবানুযায়ী ভগবানকে আত্মসম কিংবা নিজের চেয়ে ছোটো ভাবতে না পারলে প্রেম হবে না। তাই গোপীভাবের আদর্শ হয়ে প্রেমের সাধনা করতে হবে। প্রেমের সাধনাই শ্রেষ্ঠ সাধনা। প্রেমের বশে ভগবান আকৃষ্ট হন; সে আকর্ষণে তিনি স্থির থাকতে পারেন না। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য প্রভৃতি ভাবের সাধনায় ভগবান তার প্রতি-শোধ দিতে পারেন, কিন্তু গোপীপ্রেমের প্রতি-শোধ দিতে পারেন না।




তোমায় ভালোবাসি, তুমি ছাড়া আর কিছু জানি না—এতে কি কোনো প্রার্থনা আছে? প্রার্থনা নেই, তবে তিনি পূরণ করবেন কী? প্রতি-শোধ দেবেন কী? চাই তো তোমাকে, দিতে হলে তাই নিজকেই দিতে হয়। তাই ভগবান গোপীপ্রেমের তথা রাধাপ্রেমের কাছে সবসময়ই ঋণী। রাধা আছে বলেই কৃষ্ণের থাকা। (তাই তো ‘রাধাকৃষ্ণ’ শব্দবন্ধের উৎপত্তি।) এই ঋণ পরিশোধ করার জন্যই ভগবানের 'গৌরাঙ্গ অবতার' বলে ভক্তসমাজে কীর্তিত হন। মহাপ্রভুর আগমন তাই ভগবানের‌ই আগমন—ঋণশোধের প্রয়াসে।




ভগবানের সাথে প্রেম করা বড়ো কঠিন ব্যাপার; এর জন্য সব ভুলতে হয়। ধর্মাধর্ম, ভালো-মন্দ, জাতি-কুল, সুখ-দুঃখ সমস্ত ভুলে তাঁতেই আত্মসমর্পিত হতে হবে। কিন্তু ভালো-মন্দ ত্যাগ করতে হবে, এটা মাথায় রেখে ত্যাগ করলে চলবে না! ভালো-মন্দ জ্ঞান থাকলে তো আর প্রেম হলো না, কিংবা যথার্থ প্রেম হলে সে জ্ঞান থাকতেই পারে না। শাস্ত্রে যা বলে, লোকে যা বলে, সমাজ যা বলে, তা শুনলে প্রেমলাভ হয় না। ভগবান যাতে সুখী হন, তা-ই করতে হবে। বিধি-নিষেধ মানলে কি আর প্রেম করা চলে? প্রেমভক্তি ভগবানের প্রতি অনুরক্তির বিকাশ; নিজকে ভুলে, ধর্ম-কর্ম-জাতি-কুল-মান ভুলে বাঞ্ছিতের অনুসরণ করাই প্রেমভক্তি। এই ভাব গোপীদের ছিল, সেজন্য‌ই ভগবদ্‌-আরাধনায় গোপীভাবই শ্রেষ্ঠ।




প্রেমস্বভাবলুব্ধ সাধক গোপীভাব অবলম্বন করে ভগবানকে প্রেমাস্পদ করে নিজের হৃদয়-নিকুঞ্জে ভগবানকে প্রেমফুলশয্যায় শয়ান করিয়ে প্রেমগানে প্রবুদ্ধ হন। আর বাইরে শ্রীগুরুকে ভগবানের স্বরূপ মনে করে দেহ-মন সমর্পণ করে পরিচর্যা করেন। নতুবা মাটির, পাথরের বা পিতলের মূর্তি গড়ে তুলসী-চন্দনে প্রেমাস্পদের পূজা করেন, ক্রমশ প্রেমসঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অনন্তভাব, অনন্তমূর্তি, অনন্তবীর্য ভাবনা বা ধারণায় আনতে পারেন। জগৎ যাঁকে দিবানিশি পাদ্য-অর্ঘ্য নিয়ে পূজা করছে, প্রকৃতিরূপা রাধা যাঁর প্রেমকামনায় সর্বত্যাগিনী-উদাসিনী-যোগিনী, সেই নিত্যসহচর নিত্যসখা নিত্যপ্রেমাস্পদের সন্ধান মেলে এভাবেই। তখন—




কৃষ্ণময়ী—কৃষ্ণ যার ভিতরে বাহিরে।
যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে॥




(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৮৫)




সব স্থানেই, সব বস্তুতে প্রেমাস্পদের প্রেমময় মূর্তি দেখা যায়।




তখন আত্মদর্শী যোগীর মতো প্রেমিকও প্রতি ফলে, প্রতি ফুলে, প্রতি পাতার মর্মর শব্দে, প্রতি পাহাড়ে, প্রতি ঝরনায়, প্রতি নদ-নদীতে, প্রতি নর-নারীতে, প্রতি অণু-পরমাণুতে সেই সচ্চিদানন্দের বিকাশ দেখেন, সেই শ্যামসুন্দর চিদ্‌ঘনরূপ আর ভুলতে পারেন না, জগৎ তথা রাধাকে নিয়ে রাধাবল্লভের উপাসনা করেন। তিনি প্রেমময়, প্রেমের আকর্ষণে তিনি ভুলে থাকতে পারেন না। অতএব, ভাবাবলম্বনে যত প্রকারের সাধনোপায় আছে, তার মধ্যে প্রেমসাধ্য গোপীভাবের সাধনই শ্রেষ্ঠ। কারণ এটাই মানুষের সাধারণ সম্পত্তি, এটাই মানবজীবনের সারবস্তু।




এই আকর্ষণ ভগবানে বিন্যস্ত হলেই মানুষ জ্বালা হতে অব্যাহতি পায়। তখন আমি কে, তিনি কে, সে জ্ঞান জন্মে। জগৎ কী, সন্তানবাৎসল্য কী, সোনার বা লোহার বাঁধন কী, সব ভ্রম‌ই দূর হয়। হৃদয়ে দৃঢ়ভক্তি ও অহেতুকী প্রেম সম্পন্ন হয়। তখন দিব্যজ্ঞান জন্মে, বিশিষ্টরূপে বুঝতে পারা যায় যে, দারা-পুত্র, ধনৈশ্বর্য কিছু নয়, দেহ কিছু নয়, ঘটপট-আমি-আমার কিছু নয়, সবই তিনি—সেই আদি-অন্তহীন, চরাচর বিশ্বব্যাপী বিশ্বেশ্বর সত্য। সত্যস্বরূপের সত্যজ্ঞানে অসত্য দূরে যায়, অচঞ্চল আলোকাধার-মণ্ডল-মধ্যবর্তী সেই নিত্য ও লীলাময় প্রেমাস্পদ পরমপুরুষের অসমোর্দ্ধ প্রেমমাধুর্যে প্রেমিক অনন্তকালের জন্য ডুবে যান—প্রেমিক-প্রেমিকা বা ভগবান-ভক্ত রাধাশ্যামের মহারাসের মহামঞ্চে আনন্দে মেতে এক হয়ে যান।




প্রেম যখন পরম উৎকর্ষের অবস্থায় আরোহণ করে, তখন তা চিৎ-দীপদীপন। 'চিৎ' শব্দে প্রেম-বিষয়ের উপলব্ধি বোঝায়। 'প্রেক্ষোপলব্ধিশ্চিৎ সম্বিৎ'—অমরকোষে এই অর্থ আছে। প্রেমবিষয়ের যে-উপলব্ধি বা সম্যক জ্ঞান, তা দীপের মতো, অর্থাৎ তার দ্বারা আমার ভেতরের ও বাইরের সকল প্রকারের অন্ধকার বা সংশয় দূরীভূত হয়। প্রেম যখন পরমোৎকর্ষ লাভ করে স্নেহের অবস্থায় উপস্থিত হয়, তখন তা দ্বারা সেই চিৎ-দীপের দীপন হয়ে থাকে, সেই চিৎ-দীপ তখন উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে—তৈলাদি স্নেহ পদার্থের দ্বারা দীপ যেমন উজ্জ্বল হয়, ঠিক তেমন। স্নেহের দ্বারা হৃদয়ও দ্রব হয়। দীপ উজ্জ্বল হলে তার উষ্ণতাযোগে যেমন অনেক পদার্থ গলে যায়, তেমনি প্রেম স্নেহ-অবস্থায় উপস্থিত হলে, হৃদয় সবসময়ই দ্রব-অবস্থায় থাকে।




মানুষে মানুষে ভালোবাসা হয়। কিন্তু এই ভালোবাসা রক্ষা করতে হলে দেখা-শোনা প্রয়োজন। অনেক দিন দেখা-শোনা না হলে ভাববন্ধন শিথিল হয়ে যায়, শেষে হৃদয় শুকিয়ে যায়, প্রেম আর থাকে না। দৃষ্টির আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়ে যায়—এটাই প্রাকৃত জগতের নিয়ম। এখন স্নেহের অবস্থা দেখা যাক। স্নেহ আমার ভেতরে জেগেছে, আমার যিনি প্রেমাস্পদ বা প্রেমের বিষয়, তিনি আলোর মতো আমার ভেতরে রয়েছেন। তিনি আসুন আর না আসুন, দেখা হোক আর না হোক, তিনি আদরই করুন আর অনাদরই করুন, স্নেহ তো আমার ভেতরেই আছে। সেই স্নেহের সাহায্যে আমার হৃদয়ের দীপের সারাক্ষণই উদ্দীপন হচ্ছে, যতই সময় যাচ্ছে সেই মূর্তি আমার হৃদয়মধ্যে ক্রমেই অধিক উজ্জ্বল হচ্ছে—অদর্শন তার উজ্জ্বলতা কমাতে অক্ষম, স্নেহ ভেতর হতে তার উজ্জ্বলতা বরং বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই প্রেক্ষ বা প্রেম-বিষয়ের দ্বারা, তাঁর উজ্জ্বলতা যত বাড়ছে, আমার হৃদয়ও তত বিগলিত বা দ্রবীভূত হচ্ছে। এটার জন্য আর বাইরের কোনো সাহায্যের বা কারণের প্রয়োজন নেই। এই অবস্থার নাম স্নেহ।




আচার্যগণ প্রৌঢ়, মধ্য ও মন্দ ভেদে প্রেমের তিন প্রকার অবস্থা বর্ণনা করেছেন। এই অবস্থা তিনটি দুই দিক হতে আলোচনা করা যায়—নায়কের দিক হতে, আর নায়িকার দিক হতে। এই প্রেম, একটি বিশেষ প্রকারে পুষ্ট বা পরিণত অবস্থায় উপস্থিত হলে তার নাম হয়—স্নেহ।




আরুহ্য পরমং কাষ্ঠাং প্রেমা চিদ্দীপদীপনঃ।।
হৃদয়ং দ্রাবয়মেষ স্নেহ ইত্যভিধীয়তে।
অত্রোদিতে ভবেজ্জাতু স তৃপ্তিদর্শনাদিষু।।




প্রেম চরম সীমায় উন্নীত হয়ে গাঢ়তাবশত চিত্তকে উদ্দীপ্ত এবং হৃদয়কে দ্রবীভূত করলে তাকে স্নেহ বলে। স্নেহের আবির্ভাব ঘটলে শুধু দর্শনাদিতে তৃপ্তি ঘটে না। স্নেহের লক্ষণ—দর্শনে অতৃপ্তি ও চিত্তদ্রবতা। কনিষ্ঠ, মধ্যম ও শ্রেষ্ঠ ভেদে স্নেহ তিন প্রকার। অঙ্গস্পর্শে রেহ উপজিত হলে কনিষ্ঠ, দর্শনে মধ্যম এবং শ্রবণ হেতু ঘটলে শ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হয়। অন্যভাবে, স্নেহ দু-প্রকার: ঘৃত স্নেহ ও মধু স্নেহ। অত্যন্ত আদরময় স্নেহকে ঘৃত এবং 'ইনি আমারই' এমন স্নেহকে মধু স্নেহ বলা হয়।




গৌরব হইতে আদরের জন্ম। সুতরাং আদর ও গৌরব পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ‘ইনি গুরু’ এই বুদ্ধিব নাম 'গৌরব'। তা হতে উদিত হয় যে-ভাব, তা-ই 'সম্ভ্রম'; তাকেই আদর বলে। আদর ও গৌরব পরস্পর আশ্রয় করে থাকে। সুতরাং আদর আছে বলেই গৌরব আছে।




প্রিয় ব্যক্তিতে নিজের আত্মার অনুরূপ স্নেহ হলে তাকে মধুস্নেহ বলে। সেই স্নেহ স্বয়ং মাধুর্যময় এবং তাতে নানা বসের সমাহার বা মিলন আছে। তাতে উন্মাদকতা বা ধর্মবশত উষ্ণতা আছে; এজন্য মধুর সমান বলে একে মধুস্নেহ বলা যায়।




রতির উদ্‌ভব দুই প্রকার। তার আমি, এই একপ্রকার ভাবনাময়ী রতি। তিনি আমার, এটা অন্যপ্রকার ভাবনাময়ী রতি। ঘৃতস্নেহে ‘আমি তাঁর’, এই ভাব বিদ্যমান। মধুস্নেহে ‘তিনি আমার’, এই ভাব বিদ্যমান। চন্দ্রাবলীতে ঘৃতস্নেহ, আর শ্রীরাধায় মধুস্নেহ।




স্নেহফুৎকৃষ্টতাব্যাপ্তা মাধুর্য্যং মানয়ন্নবম্।
যো ধাবয়ত্যদাক্ষিণ্যং স মান ইতি কীর্ত্যতে।।




যে-স্নেহ নিজে উৎকর্ষ পেলে নবমাধুর্য অনুভব করায় এবং নিজে অদাক্ষিণ্যধারণ করে, তাকে মান বলে।




স্নেহ গাঢ় হয়ে উৎকর্ষ প্রাপ্ত হলে মাধুর্যকে নব নব আস্বাদে অনুভব করায়। সেই অবস্থায় বাহ্যিক বক্রতা বা কৌটিল্য প্রকাশ পায়। এ স্তরে ভাবের স্নেহ অপেক্ষা গাঢ়ত্ব ও চিত্তদ্রবতার আধিক্য প্রকাশ পায়। ‘অহেরিব গতি প্রেমণঃ স্বভাবকুটিলা ভবেৎ’-প্রেমের গতি স্বভাব-বক্র। অবশ্য তাতে প্রেমের স্বাদ ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়।




মান দু-প্রকার: উদাত্তমান ও ললিতমান। ঘৃত স্নেহ গাঢ়ত্ব প্রাপ্ত হলে হয় উদাত্তমান, আর মধু স্নেহ পক্বতায় ললিতমান। উদাত্ত মান আবার দু-প্রকার: দাক্ষিণ্যোদাত্ত মান ও বাম্যগন্ধোদাত্তমান। অন্তরে দাক্ষিণ্য, কিন্তু প্রকাশে অদাক্ষিণ্য—দাক্ষিণোদাত্তের লক্ষণ; আর যেখানে অন্তরে বাম্যতা নেই, কিন্তু বাইরে বাম্যভাব প্রকাশ—সেখানে বাম্যগন্ধোদাত্ত মান।




মানো দধানো বিভ্রম্ভং প্রণয়ঃ প্রোচ্যেতে বুধেঃ।।




মান গাঢ়তা প্রাপ্ত হয়ে বিশ্রম্ভলাভ করলে তাকে বলে প্রণয়। বিশ্রম্ভ শব্দের অর্থ: অভেদ মনন। বিশ্রম্ভ দু-প্রকার: মৈত্র্য ও সখ্য। সম্ভ্রমহীনতা ও সাধ্বস (স্বাধীনতা) হচ্ছে সখ্যের লক্ষণ। গৌরবময় বিশ্রম্ভকে মৈত্র্য বলে। এক্ষেত্রে নায়িকা স্বাধীনভর্তৃকার মতো আচরণ করে। মৈত্রোর সঙ্গে উদাত্তমান যুক্ত হলে সুমৈত্র্য এবং সখ্যের সাথে ললিতমান যুক্ত হলে সুসখ্য মান হয়। আচার্যগণ বিষ্ণুপুরাণ, শ্রীমদ্‌ভাগবত প্রভৃতি লীলাগ্রন্থের বর্ণনা হতে এ সকল অবস্থা দেখিয়েছেন।




দুঃখমপ্যধিকং চিত্তে সুখত্বে নৈব রজ্যতে।
যতন্তু প্রণয়োৎকর্ষাৎ স রাগ ইতি কীর্ত্ততে।।




প্রণয় যখন উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়ে অধিক দুঃখকেও সুখ বলে মনে করায়, তাকে রাগ বলে।




রাগ দু-প্রকার: নীলিমা ও রক্তিমা। নীলিমা রাগ আবার নীলী ও শ্যামা, এই দু-প্রকার। যে-রাগ ব্যয় হয় না, বাইরেও যার প্রকাশ নেই অর্থাৎ ঈর্ষা-মানাদিকেও প্রকাশ করে না, তাকে বলে নীলী রাগ। আর যে-রাগ কিছুটা প্রকাশ পায়, চিরকালের সাধ্য এবং ভীরুতার ভাণ, তাকে শ্যামা রাগ বলে।




রক্তিমা রাগ কুসুম্ভ ও মঞ্জিষ্ঠাজাত। যে-রাগ অন্য রাগের কান্তি প্রকাশ করে, তা কুসুম্ভরাগ। আর যে-রাগ অন্যরাগের অপেক্ষা রাখে না, সর্বদা বেড়ে যায়, নষ্ট হয় না, তাকে মঞ্জিষ্ঠা রাগ বলে।




সদানুভুতমপি যঃ কুর্মান্নবনব প্রিয়ম্।
রাগোভবন্নবনবঃ সোহনুরাগ ইতীর্যতে।।




যে-রাগ নিত্যনতুন বৈচিত্র্যধারণ করে প্রিয়তমকে নতুন নতুন রূপে অনুভব করায়, তাকে অনুরাগ বলে। অনুরাগের ক্রিয়া হচ্ছে—পরস্পর বশীভাব, প্রেমবৈচিত্ত্য, বিপ্রলম্ভে ও বিস্ফুর্তি ইত্যাদি।




অনুরাগঃ স্বসংবেদ্যদশাং প্রাপ্য প্রকাশিতঃ।
যাবদাশ্রয়বৃত্তিশ্চেদ্‌ ভাব ইত্যভিধীয়তে।।




অনুরাগ যখন স্বসংবেদ্য দশা এবং যাবদাশ্রয় বৃত্তি প্রাপ্ত হয়, তাকে ভাব বলে। স্ব-সংবেদ্য অর্থ ‘নিজের দ্বারা নিজের অনুভবের যোগ্য’। যাবদাশ্রয় বৃত্তি অর্থ ‘যে যে আশ্রয় আছে, তাদের সকলের উপরে ক্রিয়া (বৃত্তি) যার’। এককথায় বলতে গেলে, অনুরাগ নিজেকে অনুভবের অবস্থায় পৌঁছে সিদ্ধ ও সাধক ভক্তগণেও ব্যাপ্ত হয় অর্থাৎ যার অনুরাগে তাঁরাও বিবশ হয়ে থাকেন, তাকে বলে—'ভাব'।




শ্রীরাধিকা অনুরাগের আশ্রয় এবং কৃষ্ণ তাঁর বিষয়। শ্রীনন্দনন্দন মূর্তিমান শৃঙ্গাররূপে বিষয়তত্ত্বের ইয়ত্তা। শ্রীরাধা আশ্রয়তত্ত্বের ইয়ত্তা। তাঁর অনুরাগই স্থায়ী ভাব; সেই অনুরাগ তাঁর ইয়ত্তা বা চরম সীমা পর্যন্ত প্রাপ্ত হয়ে যাবদাশ্রয় বৃত্তি হয় এবং সেই অবস্থায় স্বসংবেদ্য দশা অর্থাৎ তাঁর প্রেয়সীজনবিশেষের সংবেদ্য দশা প্রাপ্ত হয়ে সংলগ্ন সুদ্দীপ্তাদি সাত্ত্বিকভাবের দ্বারা প্রকাশমান হয়। তাঁর অবস্থাগত অনুরাগ মহাভাব হয়।




বরামৃতস্বরূপশ্রীঃ স্বঃ স্বরূপং মনো নয়েৎ।।




পরম আলৌকিক অমৃতময় সৌন্দর্য যাঁর স্বরূপ এবং যাঁর প্রতি নিজের মনকে আকৃষ্ট করায়, এমন ভাবকে বলে মহাভাব। মহাভাব কৃষ্ণের মহিষীগণেও অতি দুর্লভ; কেবল রাধা প্রভৃতি গোপীগণের অনুভববেদ্য। ভাবের পরাকাষ্ঠা হলো মহাভাব। মহাভাব দু-প্রকার: রূঢ় ও অধিরূঢ়। সেখানে শুভ প্রভৃতি অষ্টসাত্ত্বিক ভাব প্রকটিত হয়, সেখানে রূঢ় মহাভাব। রূঢ়াখ্য মহাভাবে নিমেষের জন্যও অদর্শনে অ-সহতা, আসল-জনতা হৃদ্‌ বিলোড়ন, সর্বদা বিস্মরণ, কল্পের ক্ষণতা-বোধ, কৃষ্ণসুখেও আর্তির আশঙ্কা প্রভৃতি অনুভাবের লক্ষণ দেখা যায়।




মহাভাব রূঢ় অপেক্ষাও এক অনির্বচনীয় বিশিষ্ঠতা লাভ করলে তাকে অধিরূঢ় মহাভাব বলে। সুখ-দুঃখের অনির্বচনীয়তাই এখানে প্রধান।




অধিরূঢ় মহাভাব দু-প্রকার: মোদন ও মাদন। মোদনে উদ্দীপ্ত সাত্ত্বিক ভাবের উদ্দীপ্ত অতিশায়িতা প্রকাশিত। মুদ্‌ ধাতু হতে মোদনে শব্দ নিষ্পন্ন। মুদ্ ধাতুর অর্থ হর্ষ; সুতরাং মোদনে হর্ষ—মিলনজনিত বা সম্ভোগজনিত আনন্দ সূচিত করছে। আর মদ্ ধাতু হতে মাদন শব্দ নিষ্পন্ন। মদ্ ধাতুর অর্থ মত্ততা। সুতরাং মাদন শব্দে দিব্যমধু বিশেষবৎ মত্ততা জনকত্ব—শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলনজনিত আনন্দোন্মত্ততা বোঝায়। ভাব আর মহাভাব, এদের মধ্যে বিশেষ প্রভেদ নেই। যেমন ভগবান আর স্বয়ং ভগবান। শ্রীজীবগোস্বামী তাঁর টীকায় এমন বলেছেন। এই অবস্থা কেবলমাত্র ব্রহ্মদেবীগণের মধ্যেই সম্ভব, মহিষীগণের মধ্যেও এ অবস্থা হয় না। আগেই বলা হয়েছে, শ্রীমতী রাধিকা মহাভাব-স্বরূপিনী।




সেই মহাভাব হয় চিন্তামণি সার।
কৃষ্ণবাঞ্ছা পূর্ণ করে, এই কার্য তার।




‘মোদন’ বিচ্ছেদে ‘মোহন’ নামে কথিত। মোহনে সাত্ত্বিকভাবগুলি কৃষ্ণের সঙ্গে বিরহ দশায় সু-উদ্দীপ্ত হয়। মোহনের অনুভাব—অসহ্য দুঃখেও কৃষ্ণসঙ্গ-লিপ্সা, ব্রহ্মাণ্ড ক্ষোভকারিতা, মৃত্যুর পরেও স্ব-ভূত অর্থাৎ দেহস্থ ভূতসমূহের দ্বারা কৃষ্ণ-সঙ্গের তৃষ্ণা, দিব্যোন্মাদ প্রভৃতি। মোহন ভাব হতে দিব্যোম্মাদ হয়ে থাকে।




এতস্য মোহনাথাস্য গতিং কামপ্যুপেয়ুষঃ।
ভ্রমাভা কাপি বৈচিত্র্যী দিব্যোন্মাদ ইতীর্য্যতে।।




দিব্যোন্মাদ এক অনির্বচনীয় বৃত্তিবিশেষ। এতে চিত্তের ভ্রান্তি ঘটে। প্রেম-বৈবশ্যের ফলেই দিব্যোন্মাদ জন্মে। প্রেমবৈবশ্যবশত কোনো এক বিষয়ে সমস্ত চিত্তবৃত্তির একাগ্রতা বা কেন্দ্রীভূততা এবং অন্যবিষয়ে অনুসন্ধানহীনতা জন্মে। অন্যবিষয়ে অনুসন্ধানহীনতা হতেই সেই বিষয়ে ভ্রমাভা বৈচিত্র্যের উদ্‌ভব হয়ে থাকে।




দিব্যোন্মাদের উদ্‌ঘুর্ণা, চিত্রজল্প প্রভৃতি ভেদ বর্তমান। উদ্‌ঘুর্ণা অর্থে ভ্রমময় চেষ্টা এবং চিত্রজল্প অর্থে প্রলাপ বোঝায়। চিত্রজল্পের আবার প্রজল্প, পরিজল্প, বিজল্প, উজ্জল্ল, সংঙ্গল্প, অবজয়, অভিজল, আজল্প, প্রতিজল্প, সুজল্প, এই দশ প্রকারের ভেদ দেখা যায়। শ্রীরাধার মতো মহাপ্রভুর জীবনেও এই দিব্যোন্মাদ অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছিল। শ্রীমদ্‌ভাগবতের ভ্রমরগীতায় এই অবস্থাগুলি পরিদৃষ্ট হয়।




এটা ছাড়া আর একটি অবস্থা আছে, তার নাম মাদন।




সর্ব্বভাবোদ্‌গমোল্লাসী মাদনোহয়ং পরাৎপরঃ। রাজতে হ্লাদিনীসারো রাধায়ামেব যঃ সদা॥




হ্লাদিনীসার প্রেম। এই প্রেম যদি রতি হতে মহাভাব পর্যন্তের উদ্‌গমনে উল্লাসশীল হয়, তা হলে তাকে মাদন বলা যায়। এই মাদন পরাৎপর অর্থাৎ মোহনাদি ভাবাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, সতত এটা শ্রীরাধান্তেই বিরাজিত, অন্য কোথাও এটার উদয় হয় না। শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তী তাঁর আনন্দচন্দ্রিকা টীকায় বলেছেন, মাদনে বিরহাভাবাৎ—মাদনে বিরহ নেই।




আসৃষ্টেরক্ষয়িষ্ণুং হৃদয়বিধুমণিদ্রাবণং বক্রিমাণং
পূর্ণত্বেৎ প্যুদ্বহন্তং নিজরুচিঘটয়া সাধ্বসং ধ্বংসয়ন্তং।
তন্বানং সং প্রদোষে ধৃত নব নবতা সম্পদং মাদনত্বা-
দদ্বৈতং নৌমি রাধাধনুজবিজয়িনোরম্ভুতং ভাবচন্দ্রঃ।।




শ্রীরাধাকৃষ্ণের অদ্‌ভুত ভাবচন্দ্রকে প্রণাম করি। এই ভাবচন্দ্র প্রাকৃতী ও অপ্রাকৃতী সৃষ্টিকে অভিব্যাপ্ত করে ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান অর্থাৎ সর্ববকালব্যাপিনী। এটার কখনও ক্ষয়ের সম্ভাবনা নেই। (ধ্বংসের সম্ভাবনা নেই—এটা প্রেমের লক্ষণ) এই প্রেমচন্দ্র হৃদয়রূপ চন্দ্রকান্তমণিকে দ্রবীভূত করেন। (দ্রবীভূত করা স্নেহের লক্ষণ) এই ভাবচন্দ্র পূর্ণ হয়েও বক্রভাব ধারণ করেছেন। (এটা মানের লক্ষণ) এই ভাবচন্দ্র স্বীয় কান্তিসমূহের দ্বারা ভয়রূপ অন্ধকার ধ্বংস করছেন। (প্রণয়) এই ভাবচন্দ্র প্রদোষে-সন্ধ্যায় অথবা প্রকৃষ্টরূপ দোষে বা অপরাধে অর্থাৎ কালদেশকৃত দুঃখরূপ-দোষে সুখবিস্তার করেন। (রাগের লক্ষণ) এই ভাবচন্দ্র মাদন অর্থাৎ নিখিলবিশ্বের আনন্দবিষয়ক। এই ভাবচন্দ্র দ্বিতীয়রহিত, এটা অপেক্ষা অদ্‌ভুত আর কিছুই নেই। (মহাভাব) শ্রীরাধাতত্ত্ব সম্বন্ধে এটাই প্রাথমিক কথা।




সাধ যায় ইহ চন্দ্রম কিরণে, কুসুমিত কুঞ্জবিতানে।
বসন্তবায়ে প্রাণ মিশাওব বাঁশিক সুমধুর গানে।
প্রাণ ভৈবে মঝু বেণুগীতময়, রাধাময় তব বেণু। জয় জয় মাধব জয় জয় রাধা, চরণে প্রণমে ভানু।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু যে সাধনতত্ত্ব প্রবর্তিত করেন, তার শেষ কথা শ্রীরাধাতত্ত্ব। শ্রীল রামানন্দ রায় মহাশয়ের সাথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর যে-কথোপকথন হয়, তার শেষ কথা এই—




রায় কহে রাধা-প্রেম সাধ্য-শিরোমণি।
যাহার মহিমা সর্বশাস্ত্রেতে বাখানি।




মানবজীবনে ধর্মসাধনার দ্বারা যে চরম ফল লাভ করা যাবে, তা শ্রীরাধার প্রেম বা শ্রীরাধাতত্ত্বের সাথে প্রকৃত পরিচয় বা শ্রীরাধারানীর করুণালাভ। রায় রামানন্দের সাথে শ্রীমহাপ্রভুর যে-কথোপকথন, তাতে সাধনার নিম্নলিখিত স্তরগুলি নির্ধারিত হয়েছে:
১। স্বধর্মাচরণ, ২। কৃষ্ণে কর্মার্পণ, ৩। স্বধর্মত্যাগ, ৪। জ্ঞানমিশ্রভক্তি, ৫। জ্ঞানশূন্যভক্তি, ৬। প্রেমভক্তি, ৭। দাস্যপ্রেম, ৮। সখ্যপ্রেম, ৯। বাৎসল্যপ্রেম, ১০। কান্তাপ্রেম, ১১। রাধাপ্রেম সাধ্যশিরোমণি।




স্বধর্মাচরণে ধর্মজীবনের আরম্ভ আর শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যের পরিচয়লাভই ধর্মজীবনের চরম পরিণতি। এই মাধুর্যের পরিচয় কী প্রকারে পাওয়া যায়? শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বলছেন:




কর্মতপ যোগজ্ঞান, বিধিভক্তি জপধ্যান,
ইহা হৈতে মাধুর্য দুর্লভ।
কেবল যে রাগমার্গে, ভজে কৃষ্ণ অনুরাগে
তারে কৃষ্ণ মাধুর্য সুলভ।




এই রাগ ও রাগমার্গ কী, তা না বুঝলে শ্রীরাধাতত্ত্ব বোঝা যাবে না।




প্রেমরস–নির্যাস করিতে আস্বাদন।
রাগমার্গ ভক্তি লোকে করিতে প্রচারণ॥
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/১৫)




ব্রজের নির্মল রাগ শুনি’ ভক্তগণ।
রাগমার্গে ভজে যেন ছাড়ি’ ধর্ম–কর্ম॥
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/৩৩)




রাগমার্গে ভক্ত ভক্তি করে যে প্রকারে।
তাহা শিখাইব লীলা–আচরণ–দ্বারে॥
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৪/২৬৫)




শাস্ত্রবাক্য অনুসারে ভগবানকে ভয় করে, পাপ ও নরক ভয় করে, স্বর্গবাসের অন্তরায় ভেবে কর্ম করাকেই বিধিমার্গ বলে। শ্রুতি, স্মৃতি প্রভৃতি এই বিধিমার্গের প্রযোজক। সকল দেশের ধর্মশাস্ত্রই এই বিধিমার্গ। কেউ বলছেন, এই বিরাট বিপুল বিশ্ব ঈশ্বরসৃষ্ট। ঈশ্বর আমাদেরকে মানুষ করে এই কর্মক্ষেত্র সংসারে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমরা এখানে এসে তাঁর প্রচারিত শাস্ত্রবাক্য মেনে কাজ না করলে, তিনি আমাদেরকে অনন্তকাল নরকে পাঠাবেন। কেউ বলছেন, যাগ-যজ্ঞ-উপবাস-ব্রত ইত্যাদি শাস্ত্রবিহিত কাজ না করলে নরকে পতিত হবে, এমন যে-স্বর্গসুখ, তা অদৃষ্টে ঘটবে না। অতএব, ঈশ্বরাদিষ্ট বিধিবিহিত কাজ করো, এই কর্মফলের ভয়ে, এই স্বর্গ-নরকের আশায় ও ভয়ে, এই ফলাকাঙ্ক্ষায় শাস্ত্রের বিধি অনুসারে যে-ঈশ্বরোপাসনা করা যায়, তাকেই বিধিআচার বা বিধিমার্গ বলে। আর প্রাণের অনুরাগে, আনন্দের রসে মত্ত হয়ে, আকুল আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে যে-ঈশ্বরোপাসনা করা যায়, তাকেই রাগমার্গ বলে।




এই রাগমার্গের সাধনা প্রচার করতেই অবতারের আবির্ভাব। যখন যে-ধর্মের সংস্থাপন প্রয়োজন, তখনই তার পূর্ণ আদর্শের প্রয়োজন, আদর্শ ভিন্ন মানুষ শিক্ষালাভ করতে পারে না, তাই ভগবান শরীরী হয়ে ইচ্ছাদেহ ধারণ করে ব্রজধামে লীলা করেছিলেন।




ঐশ্বর্যজ্ঞান-মিশ্রিত জগতঐশ্বর্য-শিথিল প্রেমে ভগবানের প্রীতি হয় না। কারুরই হয় না। আপনার স্ত্রী যদি আপনার সাথে কথা বলার সময় "মহাশয়, আপনি কেমন আছেন?" ইত্যাদি বাক্য প্রয়োগ করেন এবং সবসময়ই ভয়ে ভয়ে, খাতিরে খাতিরে চলেন, কেননা আপনি তাঁর বাহক, পালক, অলঙ্কারদাতা ইত্যাদি—এইসব ভেবে যথাশাস্ত্র বিধি অনুসারে চলেন, তবে কি তিনি আপনার প্রেমের ভাগী হতে পারেন? অথচ স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ, সেখানে উঁচুনিচু ভাব থাকে থাকুক, কিন্তু সে সংস্কার সূত্রপ্রোথিত মাত্র। আপনার উপর তাঁর একাত্মভাব, মান, অভিমান, সোহাগ-আদরের ছায়া প্রভৃতি ওতপ্রোত ভাব না থাকলে আপনার প্রেমের স্ফুরণ হয় কি? ঠিক একই ভাবনায় ঈশ্বরকে ভাবতে না পারলে, তাঁরও তেমন প্রীতি ও প্রেম হয় না। নিজেকে ক্ষুদ্র, হীন ও শান্ত; ঈশ্বরকে বিরাট, বিপুল ও অনন্ত এমন ভাবলে, তিনি দূরে থাকেন, কাজেই তাঁর সাথে প্রণয় হয় না। তাঁকে ডেকে না পেলে, তিনি কাছে না এলে, গোপবালার মতো করে আকুল-আহ্বান প্রাণের গানে বের হবে—
বঁধু কি আর বলিব তোরে,
অপল বয়সে পীরিতি করিয়া রহিতে না দিলি ঘরে।




তখনই বোঝা যাবে, প্রাণের ঠাকুর ঈশ্বর প্রাণের সঙ্গে মিশে এসেছেন। ডেকে যখন তাঁকে না পাওয়া যাচ্ছে, তখন তাঁকে দেখার জন্য প্রাণে প্রবল আকাঙ্ক্ষার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। তখন গোপীভাবের সাধক তাঁর অশ্রু চোখেই মুছে বলছেন,
সাগরে মরিয়া
সাধিব মনের সাধা,
আপনি হইব
কামনা করিয়া
শ্রীনন্দের নন্দন
তোমাকে করিব রাধা।




আমি এত ডাকছি, এত সাধছি, এত কাঁদছি, তবু তুমি প্রাণের কাছে আসছ না। তুমি না এলে, তুমি না কথা বললে, তুমি না পাশে দাঁড়ালে, আমার প্রাণ যে কী করে, তা তো তুমি জানো না! জানবে কি করে? তোমার যে অনেক আছে, আর আমার তো কেবলই তুমি! তাই তো ইচ্ছে করে, এবার মরে তুমি হব, তোমাকে আমি করব। তাহলে বুঝতে পারবে, প্রেম করে দেখা না পেলে, তোমাকে ডেকে কাছে না পেলে, প্রাণে কী যে জ্বালা জ্বলে!




এভাবে যে-ঈশ্বরানুসরণ, তার নামই রাগমার্গ। এই রাগমার্গের সাধনা প্রবর্তনের জন্য‌ই ব্রজলীলা। ব্রজগোপীগণ এই রাগমার্গের সাধিকা। তাঁরা স্বামী, পুত্র, কুল, মান কিছুই চায় না, চায় কেবলই কৃষ্ণকে। কিন্তু তার মধ্যেও একটা কথা আছে। একেবারে কুল ছেড়ে, সংসার ছেড়ে, বৈধ-বিচার ছেড়ে বনে বনে ভ্রমণ করা বা বাঞ্ছিতের পাশে পাশে ঘুরে বেড়ানোও ঠিক রাগের পথ নয়। একসময় শ্রীগৌরাঙ্গদেবকে রূপসনাতন একটা চিঠি লেখেন। রূপসনাতন তখন গৌড়েশ্বরের কর্মচারী, কিন্তু জন্ম-জন্মান্তরের সাধন-প্রতিভায় তাঁর প্রাণে রসের উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, এদিকে আবার সংসারবন্ধনও আছে। প্রাণের পিপাসায় তিনি গৌরাঙ্গদেবকে অনেক করে লিখলেন যে, বিষয়-শৃঙ্খলও ছিঁড়তে পারছি না, আবার ভগবানের প্রেমের জন্য প্রাণ আকুল হয়ে উঠছে। প্রভু! আমি এখন কী উপায় করি? উত্তরে শ্রীচৈতন্য লিখে পাঠালেন,




বরব্যসনিনী নারী ব্যগ্রাপি গৃহকর্ম্মশু। তদেবাস্বাদয়ত্যন্ত র্নব-সঙ্গরসায়নং॥




পরাধীনা রমণী ঘরের কাজে লিপ্তা থাকলেও চিত্তমধ্যে যেমন নব-সহবাস-রসের আস্বাদন করে, একইভাবে বিষয়কর্মে লিপ্ত থেকো, কিন্তু সেই নবকিশোর কৃষ্ণের প্রেম-রসের আস্বাদন মনে মনে অনুভব কোরো।




বৈধদৃষ্টিতে উপমাটা অত্যন্ত হেয় বলে বোধ হয়। কিন্তু রাগমার্গে উপমাটি সুন্দর। চৈতন্যদেব বিধি দেননি যে, স্ত্রীগণের বেলায় এরূপ অনুরাগই শ্রেষ্ঠ, তিনি লিখলেন, সেরূপ ভাব।




জীব প্রকৃতি হয়ে পরমপুরুষ ভগবানকে পতিরূপে ধারণা করে, নিজের রতিরস, বাসনা প্রভৃতি নিয়ে, গোপীদের মতো তাঁর চরণে হৃদয় ঢেলে দিয়ে যে-সাধনা করেন, তারই নাম গোপীভাব।




গোপীগণের নিজের বলে কিছুই নেই; রূপ বলুন, যৌবন বলুন, শোভা, সৌন্দর্য, লালসা-বাসনা যা-কিছু বলুন, সমস্তই সেই কালাচাঁদের জন্য। তাঁরা কাজ করেন, সন্তান পালন করেন, ঘরের কাজকর্ম করেন, কিন্তু নিরন্তর প্রাণ সেই ভগবানের প্রেম-রসে মজে থাকে। তাঁরই কথা, তাঁরই কাজের আলোচনা, তাঁরই নামগানে পরিতুষ্ট—এভাবে যে-সাধক সাধনা করেন, তিনিই পরম মুক্ত। নিজেকে স্ত্রীরূপে আর পরমপুরুষ কৃষ্ণকে পুরুষরূপে ভাবনা করবেন, তাঁতেই চিত্ত অর্পণ করে, তাঁরই রসতত্ত্বে লীন থাকবেন। আর এতেই নিরবচ্ছিন্ন এবং বিশুদ্ধ আনন্দ লাভ করা যায়।




সেই রস আস্বাদন করলে জীব সেই ভাব বা তত্ত্ব প্রাপ্ত হয়ে যায়। সেই রস আস্বাদনের সমস্ত কাজই ভগবানের সৃষ্টিকাজ; জীব সেই বাসনাবিদগ্ধ হয়ে, রসের পিপাসু হয়ে ঘুরে মরছে। গোপীভাবের সাধনায় সেই রসরতিজ্ঞান হয়, হৃদয়ে তার প্রকাশ পায়।




যথোত্তরমসৌ স্বাদু বিশেষোল্লাসমষ্যপি। রতির্বাসনয়া স্বাদ্বী ভাসতে কাপি কস্যচিৎ।।
(ভক্তিরসামৃত)




উত্তরোত্তর স্বাদভেদে উল্লাসময়ী এই মধুরা রতি বাসনাবিশেষে স্বাদযুক্ত হয়ে কোনো জায়গায় কারও সম্বন্ধে প্রকাশিত হয়।




আর এর বিকাশ‌ই হয় রাধাতত্ত্বে।