মিনু বরং হাঁটতে না শিখুক!

আমি এমন একজন মানুষকে চিনি, যিনি আত্মহত্যা করতে গিয়ে ফিরে এসেছেন তাঁর পোষা বেড়ালটার কথা ভেবে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী ভেবে ফিরে এসেছেন? মা-বাবা-ভাই-বোন কেউই আপনাকে ফেরাতে পারেনি, কিন্তু বেড়ালটা তো মানুষই নয়, তবে ফিরলেন যে? বেড়ালের জন্যও মানুষ ফেরে...তা-ও আবার মুক্তির পথ থেকে?!




হাতে-থাকা আধফোঁকা সিগারেটটা টানতে টানতে তিনি বলতে লাগলেন...দেখুন, যেদিন দেখলাম, আমাকে ছাড়া বাঁচতে পৃথিবীর কারুরই কোনও অসুবিধে হবে না, সেদিন থেকে নিজেকে মুক্ত ভেবেছি; মনে হয়েছিল, এটাই সুবর্ণ সুযোগ মরে যাবার। যার থাকা না থাকায় কারুর‌ই কিছু এসে যায় না, তার থাকার দরকার‌ই-বা কী!




সবার সাথে কথা বলে-টলে মনে মনে বিদায় নিয়ে ছাদে গিয়ে যেই-না লাফ দেবো, তখনই মনে পড়ল, আরে...আমার বেড়ালটা তো আমি ছাড়া কিছু খায় না। হাফ-প্যারালাইজড বেড়ালটার পি কিংবা পু করার ক্ষমতাটুকুও নেই। আমি না থাকলে ওকে কে খাওয়াবে, কে পরাবে, কে গোসল করাবে, পি করাবে...? আমি চলে গেলে বেচারা বাঁচবে কীভাবে?!




পরক্ষণেই মনে হলো, সুইসাইড নোট পড়ে সবাই জেনে যাবে আমার মৃত্যুর কারণ, কিন্তু বেড়ালটা ম্যাঁও ম্যাঁও করে আমাকে খুঁজবে আর খুঁজতেই থাকবে; ক্ষুধা পেলে কেউই ওকে খেতে দেবে না, পি-পু করলে কেউই পরিষ্কার করবে না। বুঝলাম, আমার আয়ুর উপর একটা নিরীহ প্রাণ নির্ভর করে, কারও কিছু এসে না গেলেও, এই বেড়ালটার অনেক কিছু এসে যায় আমার থাকা না থাকায়। আমার মৃত্যু এই বেচারারও মৃত্যুর কারণ হবে। আমি কী করে মারব আমার ভালোবাসার প্রাণটিকে! ভালোবাসি যে, মারি কী করে!




না, সেদিন আর লাফ দিইনি এসব ভেবে। এখন বুঝি, এই প্যারালাইজড বেড়ালটা কী অনায়াসে আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিল! আহা, একেকটা জীবন, একেকটা পিছুটান!




এই তো সেদিন মিনু বাচ্চা ফুটিয়েছে; ওর বাচ্চা হবার পর আমি আজকাল অফিস থেকে সময়ের আগেই বাসায় ফিরি। আমি বসে থাকলে বাচ্চাগুলোর কেউ ঘাড়ে, কেউ কোলে, কেউবা পায়ের কাছে এসে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। এখন আমি আর আত্মহত্যার কথা ভাবি না। ওদের নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকি যে ভাবার সময়ই তো পাই না। যাদের মা একদিন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল, আজ তারাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।




মিনু এখন বেশ সেরে উঠেছে। ইদানীং আমার বরং আরও অনেককাল বাঁচতে ইচ্ছে করে। মিনুকে চারপায়ে দৌড়োতে দেখলে বড়ো সাধ জাগে, মিনু আমাকে ছাড়া পি-পু আর খাওয়া-দাওয়া করতে শিখে যাবে একসময়। এই সাধ আমাকে আরও কয়েকটা বছর বাঁচতে ইচ্ছে জাগায়।




না, থাক! মিনু বরং হাঁটতে না শিখুক, ও আমাকে ছাড়া বাঁচতে না শিখুক! ও আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেলে...সেদিন ছাদ থেকে লাফ না দিয়ে যেমন আমি ফিরে এসেছিলাম, শিখে গেলে হয়তো আমার আর অমন কোনও পিছুটান থাকবে না। মরার জন্য ছাদে উঠে হয়তো আর ফিরে আসব না।




ফিরতে আমি পারিই...তবে কেন ফিরব? কার জন্য? কার কাছে? কে আমার পথ চেয়ে আছে? যাকে কেউই পিছু ডাকে না, সে কি আর ফেরে ভুল করেও!




হ্যাঁ হ্যাঁ, মিনু প্যারালাইজড‌ই থাকুক, ও আর কখনোই হাঁটতে না শিখুক! মিনু হাঁটতে শিখে গেলে যে আমিই হাঁটতে ভুলে যাব! বাঁচার ইচ্ছেটাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আমার যে এমন কাউকে লাগবেই, আমি না থাকলে যার বাঁচতে কষ্ট হবে, যাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমি খুব করে চাই!