মেরি আওয়াজ হ্যি প্যাহচান হ্যায়

: আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবন অনেক চেষ্টা করে লুকিয়ে রেখেছেন, এর কারণটা জানতে পারি?
: আসলে এর তেমন কোনও কারণ নেই। প্রত্যেকটা মানুষেরই নিজস্ব জীবন আছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে কী, আমি বার বার টিভির সামনে আসা, কথা বলা এসব থেকে দূরে থাকি। ফিল্ম ইন্ড্রাস্টিতে সাধারণত যেসব ফাংশন হয়, আমি সেগুলোতে যাই না। এই কারণে মানুষ আমাকে অহংকারী ভাবে, কিন্তু আসলে সেটা সত্যি নয়। আমি আসলে ঘাবড়ে যাই, নার্ভাস হয়ে যাই, এমনকী আমার নিজের স্টেজশোগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার, আমি নার্ভাস হয়ে যাই।




আর আমার ব্যক্তিগত জীবন তো আসলে তেমন কিছু নয়। (এই কথাটি বললেন মুচকি হেসে।)




: আপনার তো আধ্যাত্মিকতার সাথেও একটা ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
: জি হ্যাঁ। বলতে পারেন আধ্যাত্মিকতার সাথে এই সম্পর্কটা আমার ছেলেবেলা থেকেই। আর গানের সাথে যুক্ত থাকার কারণেই যেন আমি সেই বিষয়টাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।
আমি অল্পবিস্তর সংস্কৃতচর্চা করেছি, উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। আর আমি ঈশ্বরে খুব বিশ্বাস করি, পূজা-পাঠ করতেও ভালোবাসি।




: আপনি কী চান? লোকে কীভাবে আপনাকে মৃত্যুর পরে স্মরণ করবে?
: মেরি আওয়াজ হ্যি প্যাহচান হ্যায়।' (আমার আওয়াজই আমার পরিচয়।)




নিজের বিখ্যাত গানের লাইন দিয়ে মুচকি হেসে এই প্রশ্নের উত্তর এভাবেই দিলেন লতা মঙ্গেশকর। তিনি আরও বলেন...




আমি কখনও কারও জন্য খারাপ চিন্তা করিনি, কার‌ও ক্ষতি করিনি। আর গানের মাধ্যমে আমি দেশের সেবা করতে চেয়েছি। জানি না, কতটা পেরেছি, কিন্তু ইচ্ছা আছে অনেক।




: আপনার জীবনে কোন‌ও অনুশোচনা আছে?
: না, জীবন যেভাবে চলার, সেভাবেই চলছে। চলার কথাও এভাবেই!




লতা মঙ্গেশকর রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দর দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পারিবারিকভাবেই তিনি ছিলেন ধার্মিক, মানুষের মনের ঈশ্বরের উপর ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আমাদের পাশে দাঁড়াতে তৎক্ষণাৎ এক লক্ষ টাকার চেক লিখে দিয়েছিলেন অভ্যাগতদের, এক‌ইসঙ্গে বেশ কিছু গানের রয়্যালটি তখনই লিখে দেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নামে।




একটা পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে লতা মঙ্গেশকরের হাতে পুরষ্কার তুলে দেবার সময় অমিতাভ বচ্চন বলেন, 'আমি দেশের বাইরে যখন যাই, মানুষ আমার দেশকে নিয়ে যখন কথা বলে, তখন তারা দৃঢ়তার সাথে বলে, 'তোমাদের দেশে দুটো সম্পদ আছে, এক হচ্ছে তাজমহল, আর দুই হচ্ছে লতা মঙ্গেশকর।''




জয়া বচ্চন বলেন, 'কোন‌ও অভিনেত্রী নিজেকে সে পর্যন্ত তারকা ভাবতে পারত না, যতক্ষণ না লতা মঙ্গেশকর তার জন্য গান করেন!'




সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী একবার লতা মঙ্গেশকরের গান শুনে বলেন, 'ঈশ্বর গান গাইলে নিশ্চয়ই এভাবে গাইতেন।'




লতা মঙ্গেশকরকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেবার জন্য একবার স্টেজে আমন্ত্রণ জানানো হয় উপমহাদেশের আরেকজন গুণী শিল্পী এ আর রহমানকে। পুরস্কার দেবার সময় এ আর রহমান আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, 'আজ আমার বাবা বেঁচে থাকলে তাঁর জন্য এই দিনটি অনেক বড়ো একটি দিন হতো, কারণ আমি মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা (তিনিও একজন সংগীত পরিচালক ছিলেন) তাঁর রুমে লতাজির একটা সাদা শাড়ি-পরা ছবি টাঙিয়ে রেখেছিলেন। উনি যখন সকালে ঘুম থেকে উঠতেন, ওই ছবিটির দিকে তাকিয়ে সংগীত রচনা করতেন।'




বড়োদের শ্রদ্ধা জানাতে সবাই পারে না, তার জন্য নিজেকেও বড়ো মানসিকতার হতে হয়। চারপাশে তাকিয়ে দেখুন। অনেককেই পাবেন, যাদের হৃদয়ে বড়োদের জন্য কেবলই ঘৃণা, দ্বেষ রয়েছে। একজন লতা মঙ্গেশকরের পায়ের ধুলো মাথায় রেখে যাঁদের পথচলা, তাঁদের পায়ের ধুলো মাথায় রাখার যোগ্যতাটুকুও যাদের নেই, সেইসব অপদার্থ, মূর্খ, অথর্ব, নোংরা লোকগুলোর যদি বোঝার ক্ষমতা থাকত, যে পথে লতাজি হেঁটে চলে গেছেন, সে পথের ধূলিকণা হবার সৌভাগ্যটুকু তার সারাজীবনেও হবে না! পায়ের জুতো যখন মাথার টুপির দিকে তাকায়, তখন সে ওখানেও ধূলি-কাদা দেখতে পায়।




লতাজির পথ অনুসরণ করলেন সন্ধ্যা, বাপ্পি... আমাদের বোধের অভিভাবকেরা একে একে বিদায় নিচ্ছেন। সত্যিই একধরনের শূন্যতা অনুভব করছি। গাড়িতে কোথাও যাবার পথে যখন ওঁদের গানগুলো বাজে, চোখের জল টপটপ করে পড়তে থাকে। ভাবি, আমি কাঁদছি কেন? এঁরা কে হয় আমার? মন সাক্ষ্য দেয়, এঁরাই আমার সব হয়! আমার অনুভব গড়ার মহান শিক্ষকেরা ওপারে ভালো থাকুক।