মেমোরিজ ইন মার্চ (২০১০)

আমার চোখে, আমার হৃদয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের সেরা ৩টি স্ক্রিপ্টের একটি ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’। শেষ কবে কোন বাংলা সিনেমা এতটা স্পর্শ করেছে, মনে পড়ছে না। সিনেমার গানগুলি, বিশেষ করে……..সখি হাম মোহন অভিসারে জাউঁ…/বোলো হাম এতক সুখ কাহাঁ পাউঁ?……….গানটি, আমরা যারা গান ভালোবাসি, তাদের জন্য অসামান্য উপহার। ঋতুপর্ণকে ভালোবাসা জানাই, প্রণাম জানাই।

‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ নিখাদ প্রেমের গল্প। নিছকই প্রেমের নয়, ভালোবাসার। ভালোবাসার মানুষটা মারা গেছে। রোড অ্যাক্সিডেন্টে। দৃশ্যে দেখছি: ক্লিনিকের বারান্দা। ডেডবডি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জুতোর ফিতে খুলে গেছে। একটা মানুষ ট্রলির পেছনপেছন দ্রুতপায়ে আসছে, জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছে। মৃত মানুষের জুতোর দরকার নেই, কিন্তু ভালোবাসার মানুষের তো আছে। ভালোবাসার মানুষ কখনো মরে যায় না।………….আমার এক বন্ধুর বাবার মৃত্যুর পর যখন শবদেহ চিতায় পোড়ানো হচ্ছে, তখন বন্ধুটি দৌড়ে গিয়ে যাঁরা আগুন দিচ্ছিলেন, তাঁদের হাত থেকে জ্বলন্ত কাঠ কেড়ে নিয়ে মৃত বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেকরতে চিৎকার করে বলেছিল, বাবার চুল পুড়ে যাচ্ছে তো! বাবা গরম সহ্য করতে পারে না।……..মৃত মানুষের চুল পুড়লে ব্যথা লাগে না, তবু কারো তো লাগে, যার কাছে মানুষটি এখনো মৃত নন।

মুভির দৃশ্যটা দেখে খুব কেঁদেছি, আর বারবারই মনে হয়েছে, আমার মৃতদেহের জুতোর ফিতে বেঁধে দেয়ার কেউ কি আছে আদৌ?……………জীবনে ভালোবাসার চাইতে বড় উপহার আর নেই।

মানুষ চলে যায় স্মৃতি পেছনে ফেলে। তার সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলি, তার ব্যবহৃত জিনিস, তার প্রিয় যা কিছু আছে, সবই মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখে। কার কাছে? তার কাছে, যে মানুষটাকে ভালোবাসতো। বিচ্ছেদ কি সুখের স্মৃতি ম্লান করে দেয়? মনে তো হয় না। হয়তো এখন সে পাশে নেই, তবু যে সুন্দর মুহূর্তগুলি সে আমায় উপহার দিয়েছে, সেগুলিও কি নেই? স্মৃতির উষ্ণতা গায়ে মেখে মানুষ বাঁচতে পারে। নানান পার্থিব কিংবা অপার্থিব অস্তিত্ব, হয়তো খুব ক্ষুদ্রই, তবু মানুষটা ওইসব নিয়েই বেঁচে ছিল, স্মৃতির পাখিরা খুব দামি—অন্তত তার কাছে, তাকে যে ভালোবাসতো………না, ভুল হল………ভালোবাসতো নয়, ভালোবাসে। ভালোবাসার দিনগুলিতে যা কিছু ছিল—কোনো জিনিস, কোনো জায়গা, কোনো সুর, কোনো অভ্যেস কিংবা বদভ্যেস, কোনো স্বভাব, কোনো পছন্দ কিংবা অপছন্দ—তা কিছু নিয়েও মানুষ বেঁচে থাকে।………..এর নাম জীবন তো, একভাবে না একভাবে কেটেই যায়!

আমার মৃত্যুর পর আমি যেখানে বসে চাকরি করছি, সে জায়গাটা নিমিষেই কেউ না কেউ এসে পূর্ণ করবে। আরও স্পষ্ট করে বললে……..দখল করবে। অফিস ভালোবাসার জায়গা নয়। যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে আমার জন্য কোনো স্থান শূন্য কেন থাকবে? তবে শূন্য কি থাকবে না কোথাও? আমার দেহের মৃত্যুতেই সব শেষ? আমার এতদিনের অস্তিত্ব? আমার বেঁচেথাকা? আমার এত স্মৃতি? সব শেষ? না। কিছু মানুষ তাদের হৃদয়ে শূন্যতা বাঁচিয়ে রাখে খুব যত্নে। ভালোবাসা শূন্যতার দাবি রাখে।

সিদ্ধার্থ ও অর্ণবের ভালোবাসার গল্পের শুরুটা দেখা যাক।

অর্ণব বলছে: একদিন। গভীর রাতে। ফোন এল। ঘুমঘুম কণ্ঠে বললাম, কী হয়েছে?

উত্তর পেলাম, তোমার কলার টিউনটা আমার ভাল লাগে।

ভাবলাম, ড্রিংক করে বাজে বকছে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে এটা বলার জন্য ফোন করেছ? নাকি অন্য কিছু বলবে?

আমাকে তোমার কলার টিউনটা দাও। সে বলল।

ঠিক আছে। দেবো। ফোনটা কেটে আবার ফোন করো। স্টার প্রেস করো, ডায়াল করো। টিউনটা তোমার। ব্যস্‌!…………ফোনের ওই প্রান্তে ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ খেয়াল করলাম।

কিছু সময় কাটল।……..প্রমিজ করো, কখনো তোমার টিউনটা বদলাবে না, টিউনটা আর কাউকেই দেবে না।

তার কথাটা শুনে আমার মধ্যে কী যেন হয়ে গেল। আমি জানি না, ওটাকে কী বলে। হয়তো আমি একটা ইডিয়ট, তবু আমার অনুভূতিটা ছিল সত্য।

হ্যাঁ, সেইরাত দুইজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি করেছিল। সম্পর্ক হয় মানুষে মানুষে, নারীতে পুরুষে, পুরুষে নারীতে নয়। বেঁচেথাকার সময়টাতে কেউ যদি এমন কারো দেখা পায়, যে পাশে থাকলে তার সুখের অনুভূতি হয়, দুঃখ দূরে সরে হাসির ফোয়ারা ঝরে, তবে তাদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সে সম্পর্ক সমাজসিদ্ধ হোক না হোক, ওতে কী এসে যায়? জীবনসিদ্ধ তো! মানুষের অনুভূতি, বোধ, ভাললাগা, আনন্দ কি যন্ত্রণা, অভ্যেস, সবকিছুকেই ধারণ করতে পারে, আশ্রয় দিতে পারে যে সম্পর্ক, সে সম্পর্কই তো মানবীয় ও প্রার্থিত, তাই না? তাকে অস্বীকার করার মানে তো জীবনকেই অস্বীকার করা। ঋতুপর্ণ ঘোষের কলমে সঞ্জয় নাগের লেন্সে তীব্র ভালোবাসার এক নীরব আখ্যান ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’।

এখানে ভালোবাসায় মনের যাপন বড় হয়ে উঠছে শরীরের যাপনের চেয়ে, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও নির্ভরশীলতা ভালোবাসাকে নিয়ে গেছে বোধ থেকে অনুভূতিতে। যে ভালোবাসা আসে মায়ের কাছ থেকে, তেমন নিঃস্বার্থ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা অন্য কোনো মানুষের কাছ থেকে এলে, তা থেকে মন কীকরে নিজেকে সরিয়ে রাখে? এমনও দেখা যায়, সন্তান হারানোর ব্যথা মায়ের যতটা তীব্র, সে সন্তান যার ভালোবাসার মানুষ, তার ব্যথাও কোনো বিচারেই কম তীব্র নয়, যদিও হৃদয়ের ব্যথার কোনো তুলনামূলক পরিমাপ হয় না। ভালোবাসা সম্পূর্ণই অনুভূতির ব্যাপার, সে নিরিখে ভালোবাসা হতে পারে পুরুষে পুরুষে, নারীতে নারীতে। এর পোশাকি নাম সমপ্রেম, তবে সে নাম যতক্ষণ পর্যন্ত ভালোবাসার দাবির প্রতি সুবিচার করতে সক্ষম, ততক্ষণ পর্যন্ত নামে কিছু এসে যায় না।

তবে বাস্তবতা হল এই, সমাজ ও সমাজের মানুষ কিন্তু কনসেপ্টের বাহ্যিকতা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। কীরকম? মুভির একটা ডায়লগ দেখা যাক।

সিদ্ধার্থের মা আরতিকে অর্ণব জিজ্ঞেস করছে: আপনার কাছে কোনটা বড়? আপনার ছেলে মৃত, এটা? নাকি সে সমপ্রেমী ছিল, এটা?

আরতি বলছেন: দেখো, আমার ছেলে বেঁচে নেই, এটা আমার পক্ষে কোনোভাবেই কিছুতেই সহজভাবে নেয়া সম্ভব নয়। আর সে সমপ্রেমী ছিল, এটা আমি মেনে নিচ্ছি কিংবা সত্যিই মেনে নেয়ার চেষ্টা করছি, এমন মিথ্যে দাবি আমি যতই করি না কেন, মা হিসেবে বলতে গেলে আমি বলবো, মন থেকে আমি কখনোই এটা মেনে নিতে পারব না যে আমার ছেলে সমপ্রেমী।

আরেকটা দৃশ্যে সিনেমায় অর্ণবকে বলতে শুনি……….ওরা কি একটা বৃত্তে বন্দী হয়ে জীবন কাটাবে, নাকি আমাদেরই মতো করে বাঁচবে, এটা ঠিক করে দেয়ার আমি কে? হয়তো ওদেরকে ওদের মতো করে বৃত্তবন্দী হয়ে কাটাতে দেয়াই সবার জন্য ভাল। যদি আমরা কাউকে, সে যেমন, তেমন করেই গ্রহণ করতে না শিখি, তবে আমরা এ পৃথিবীতে বাঁচবো কীকরে?

এ সিনেমা অনেকগুলি উত্তর তৈরি করেছে। সেসব উত্তরকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সাহসটা ঠিক আসে না। সিনেমার আসল সৌন্দর্য এখানেই।

আমি দূরে চলে যাচ্ছি। যাবার আগে আমার কিছু স্মৃতি তোমার কাছে রেখে যাই?

……………ঋতুপর্ণের এমন আকুতি, আমরা যারা ঋতুপর্ণকে ভালোবাসি, তাঁর কাজকে ভালোবাসি, তাদের চোখে জল আনে। মৃত্যুর আগে তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন: মনে রেখো আমায়।…………..এমন একজন অপূর্ব স্রষ্টাকে ভুলে থাকা যায়? নাকি আদৌ সম্ভব?