যাবার আগে

পরিচয়: পল্লবী, ৩৪ বছর ৪ মাস ১৮ দিন বয়সি বিবাহিতা নারী, দেখতে অষ্টাদশী গড়নের... 'সুন্দরী'
ঠিকানা: গোরস্থান (বাসার ঠিকানা দিলাম না। এই নোট যখন আপনার হাতে পৌঁছবে, তখন গোরস্থানই হবে আমার স্থায়ী ঠিকানা।)




প্রিয় পৃথিবী,




সবাই শত বোঝানোর চেষ্টা করলেও ওদের সামনে যা আমি মেনে নিইনি, তা হচ্ছে, আমি সত্যিই জানি, তুমি খুব সুন্দর… এতটাই যে, আমার মতন দু-চারটে পল্লবী রোজ রোজ মরে গেলেও তোমার এখানে ঠিকই সূর্য ওঠে, রাত্রি নামে, হাসনাহেনা ফোটে, লোকে চুটিয়ে প্রেম করে, আমার প্রাক্তন প্রেমিকেরা ঠিকঠাক সহবাস করে। আমি না থাকলেও তোমার কোনও অসুবিধেই হবে না; আমার স্বামীর, প্রাক্তনদের, বন্ধুদের… কারুরই কোনও অসুবিধে হবে না। কষ্ট হবে শুধু আমার মেয়েদুটোর। তবু, প্রিয় পৃথিবী, তুমি যে সময়ের সাথে সাথে আমার বাচ্চাদেরকেও ঠিক সামলে নেবে, বুকে জায়গা দিয়ে দেবে, আমি তা বিশ্বাস করি। একমাত্র তোমার উপর আস্থা রেখেই চলে যাওয়া যায় ঠাণ্ডা মাথায়।




কেন করছি এই কাজ? ৩৪ বছর কিন্তু খুব কম সময় নয়, লোকে যদিও বলে, “হেই দিনকার ছুড়ি পলা (ভালোবেসে ওরা আমায় পলা ডাকে), তার আবার দুই-দুইডা ডাগর ডাগর মাইয়্যা! কয়দিন গেলেই এই পলা নানী হইব! আহা! কী কপাল, কী কপাল!” কথা শুনলে মনে হতো, নানী হবার জন্যই যেন আমি বসে বসে দিন গুনছিলাম! দুটো মেয়েকে একা ফেলে যাবার চিন্তা করলে আগে খুব ভয় হতো। ওদের নিরাপত্তার কথা ভাবতাম খুব, নিজেকে বলে-কয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে আত্মহত্যার তারিখ পিছিয়ে দিয়েছি এতদিন। জানোই তো, ভয় পেতে পেতে একসময় ভয় মরে যায়! মানুষ শুধুই নিজের জন্য না বাঁচলেও দিনশেষে মানুষকে শুধুই নিজের জন্য কাঁদতে হয়।




যখন প্রথম মা হই, সন্তান কোলে নিয়ে মাতৃত্বের যে অহংকারে আমি সারাক্ষণই ডুবে থেকেছি, সেই অহংকারই ধীরে ধীরে ভয়ে বদলে গেল কন্যাসন্তানের মা হবার কারণে। ধীরে ধীরে মেয়ে বড়ো হতে থাকল, আর আমি বুঝতে থাকলাম, পারমিতার দারোয়ান আঙ্কেলের মতনই আমার প্রতিবেশী রশীদ চাচা আদর করার নামে আমার গায়ে হাত দিতো। বাসের কন্ডাকটর কিংবা কোনও পুরুষযাত্রী যেমন অধিকার মনে করেই আমার গা ছুঁতো বিশ্রীভাবে, সেটা এই যুগে এসেও কোনও-না-কোনও কায়দায় পারমিতার বেলাতেও ঘটে। মেয়েদের সাথে সবই ঘটে, কেননা মেয়েদের সাথে সবই ঘটানো যায়।




আমার মায়ের লাশ দেখতে এসে আমার বাবার বন্ধু কী এক অদ্ভুত বাজে দৃষ্টি ছুড়েছিল আমার মৃত মায়ের মুখের দিকে, আর মায়ের মাথার কাছে বসে থাকা ছোট্ট আমার শরীরের দিকে, সেটা মনে পড়লে এখনও বমি পায়। আমি আমার পারমিতা আর পুষ্পিতাকে এসব ‘মুখ বুজে মেনে নিয়ে’ বেঁচে থাকা শেখাতে পারব না। ওরা যে আমার‌ই মেয়ে, চোখের সামনে ওদের প্রতিনিয়ত এমন সম্মানহীন হতে কীভাবে দেখব!




একটা কথা বলি পৃথিবী তোমাকে? মেয়েরা কখনোই, কোনও অবস্থাতেই তোমাদের এই দেশ, এই সমাজে নিরাপদ নয়, এমনকী লাশ হয়ে গেলেও... না! আমি ঠিক জানি, এমন অপরিচিত অনেক পুরুষই আজ সন্ধ্যায় আমার লাশ দেখতে বাসায় আসবে। কেন আসবে? ওমা, একজন অল্পবয়স্কা বেশ সুন্দরী ‘মেয়েছেলে’কে ইচ্ছেমতো দেখার সুযোগ ওরা কেন ছাড়বে, বাপু? আর তা ছাড়া, লোকমুখে যখন শুনবে, মরহুমা সুন্দরীর মেয়েদুটো আরও বেশি সুন্দরী, ও-বাড়িতে গেলে ওদেরকেও নিশ্চয়ই দু-চোখ ভরে চেখে দেখা যাবে, তখন আর না এসে পারবে ক-জন? মরাবাড়ির মেয়েদের পোশাক-আশাকেরও তো ঠিক থাকে না, কীরকম জানি আলগা হয়ে যায়… এ-ই তো সুবর্ণ সুযোগ!




খারাপ লাগল শুনে, পৃথিবী? এসব তো তোমার এখানে সৃষ্টির শুরু থেকেই হয়ে আসছে। একে তো ‘মেয়েছেলে’ হয়ে জন্মেছি, তার উপর আবার দু-দুটো সুন্দরী ‘মেয়েছেলে’-কে জন্ম দিয়েছি। তাহলে এই দেশে আমি আত্মহত্যা করব না তো কে করবে, বলো? প্রতিদিনই তো নারীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোনও-না-কোনও একভাবে মারা যায়। তা-ই যদি হয়, তাহলে কি নিজের হাতে মরাটাই অধিক সম্মানের নয়?




পৃথিবী, তোমাকে এসব বলে গেলাম। এ আমার অভিযোগ নয়, অভিজ্ঞতা। আমি জানি, এগুলো কেউই শুনতে চাইবে না, কেউই এসব নিয়ম পালটাতে পারবে না। যে নিয়ম সমাজের 'পৌরুষ' বাঁচায়, তা কে-ইবা পালটায়!




হে ঈশ্বর, আমায় কথা দাও, আর কোনও জন্মেই আমাকে এই নারীজন্ম দেবে না? কেউ কোনোদিনই আর কোনও নারীকে পেটে ধরতে পারবে না… কথা দাও! দেবে না?