দুর্গাপুরাণ ও দুর্গাপূজা

প্রকৃতির শ্যামলিমা, প্রস্ফুটিত শুভ্র শিউলির বর্ষণ-প্রাচুর্য, নির্মল নীলিমায় পুলকিত শরতের প্রতিচ্ছবি এবং এদেরই মঙ্গল-সম্ভারে সজ্জিত পূজাপ্রাঙ্গণ জগন্মাতার আগমনবার্তায় মুখরিত। ক্ষণস্থায়ী হলেও, দুঃখ-বেদনার স্তিমিত হৃদয়াবেগ অপূর্ব রসাবেশে পরিপূর্ণ। আনন্দময়ীর আগমনীগীতি-সঞ্জাত আশার উন্মাদনা সন্তানদেরকে বড়ো অধীর করে তুলেছে।




সর্বাধিষ্ঠাত্রীরূপে তিনি নিত্যা ও নির্গুণা, আবার জড় ও অন্তর্জগতে থেকে সকলের নিয়ন্ত্রণকারিণী এবং যুগে যুগে কল্যাণমূর্তি পরিগ্রহ করে তাঁর সন্তান-সংরক্ষণ ও অশুভ দমনের কথা সর্বশাস্ত্র-প্রসিদ্ধ। এই মহাশক্তির আরাধনার উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—শক্তিই জগতের মূলাধার। তিনিই মহামায়া, জগৎকে মুগ্ধ করে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তিনি পথ না ছাড়লে সচ্চিদানন্দকে লাভ করা যায় না। সেই আদ্যাশক্তির ভেতর বিদ্যা ও অবিদ্যা দুই-ই আছে—অবিদ্যা হলো দেবীর মায়াশক্তি, বিদ্যা তাঁর দয়া—অবিদ্যা মুগ্ধ করে এবং বিদ্যা ঈশ্বরপথে নিয়ে যায়। বিদ্যাকে লাভ করতে চাইলে আগে অবিদ্যাকে প্রসন্ন করতে হবে, তাই প্রবর্তিত হলো শক্তির পূজাপদ্ধতি।




চণ্ডীতে পাই, মহামায়ার স্বরূপজিজ্ঞাসু মহারাজ সুরথ ও বৈশ্য সমাধিকে মহর্ষি মেধা বলেছিলেন—দেবী ভগবতী মহামায়া বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন দৃঢ়চেতাদের মনই সবলে আকর্ষণ করে মোহাবৃত করেন, আর অবিবেকীদের কথা তো বলাই বাহুল্য! এজন্যই নানান কিংবদন্তীতে ও শাস্ত্রমুখে সকলকে ভগবতীর উপাসনায় নিরত হবার উপযোগিতা দেখতে পাওয়া যায়। শরৎকালেই দেবী বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই শুভাবির্ভাবের স্মরণে প্রতিবছর মহোৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে এবং এটাই সমগ্র বাংলায় ‘শারদীয়া মহাপূজা’ এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে ‘নবরাত্র উৎসব’ নামে খ্যাত।




যে-সকল পুরাণে দুর্গাপূজার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে বৃহন্নন্দিকেশ্বর, কালিকাপুরাণ ও দেবীপুরাণ অন্যতম। সব জায়গাতেই শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের পরিপ্রেক্ষিতে পূজাকাল ও বিধানাদি লিখিত হয়েছে। মূল রামায়ণে এর সমর্থন না থাকলেও দেবীভাগবত, মহাপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থে আমরা এর ইতিবৃত্ত পাই। জীমূতবাহনের (আনু. ১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) দুর্গোৎসববিবেক, কৃত্তিবাস ওঝার (আনু. ১৩৮১-১৪৬১)  রামায়ণ, বাচস্পতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ক্রিয়াচিন্তামণি, রঘুনন্দনের (১৫শ-১৬শ শতক) তিথিতত্ত্ব ইত্যাদি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা থাকায় অনুমান করা হয় যে, বাংলায় দুর্গাপূজা দশম অথবা একাদশ শতকেই প্রচলিত ছিল। এ সকল গ্রন্থকার নানান শাস্ত্রযুক্তির সাহায্যে দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ক্রম ও বিধি লিখে সকলের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন, নতুবা কেবলই পুরাণাদিতে উল্লিখিত বিষয়বস্তুর সাথে সংগতি রেখে পূজার কার্যক্রম নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়ত।




দেবীর এই শরৎকালীন শুভাগমনের সাথে জননী-দুহিতার মায়িক বা মায়ার সম্পর্ক যুক্ত হয়ে এটাকে অপূর্ব ভাবসম্পদমণ্ডিত ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। পৌরাণিক কাহিনি বলে, বুদ্ধিমত্তা ও সহজাত প্রতিভা-সহ তিনজগতের সবচেয়ে মন্ত্রমুগ্ধ অপ্সরা মেনকা নিজের কন্যা উমাকে শিবের গেহিনীরূপে দেখে অপার আনন্দে ভেসেছিলেন, কিন্তু সেই স্নেহপুতুলকে সবসময়ই তাঁর কাছে পাবার প্রবল প্রেরণায় স্বতঃই মায়ের অন্তর গভীর বেদনায় ভরে উঠত। স্বামিগৃহ হতে কন্যাকে বছরশেষে পিত্রালয়ে ফিরিয়ে আনার কাহিনি মেনকার খেদোক্তিতে এবং আগমনী গানে এত সরস হয়ে উঠেছে যে, সেটি একান্ত বাস্তববাদীর নীরস মনকেও মোহিত করে।




দেবীর আবির্ভাব সংক্রান্ত বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে।




দেবী শতাক্ষী—শ্রীশ্রীচণ্ডীতে এবং দেবীভাগবতে (৭/২৮) এই দেবীর আবির্ভাবলীলা বর্ণিত। লীলাভেদে তাঁর তিনটি নাম শতাক্ষী, শাকম্ভরী ও দুর্গা। দুর্গমাসুর জেনেছিলেন, বেদই দেবগণের বল। সেই বেদ বিনষ্ট করার সংকল্প নিয়ে তিনি ব্রহ্মার আরাধনা করলেন এবং তাঁর কাছ থেকে বেদ চেয়ে নিলেন; দেবতাদের পরাভূত করার বলও প্রার্থনা করলেন। দুর্গমাসুর সকল বেদের অধীশ্বর হওয়ায় মর্ত্যলোকে বেদ বিলুপ্ত হলো। যজ্ঞীয় হবির ভাগ না পেয়ে দেবগণও দুর্বল হয়ে গেলেন। দুর্গমাসুর দেবতাদের পরাজিত করে অমরাবতী অধিকার করলেন। দেবতারা তখন পৃথিবীতে গিরিগুহায় আশ্রয় নিয়ে পরমাশক্তির ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। যাগযজ্ঞ বন্ধ হওয়ার ফলে বৃষ্টি বন্ধ হলো। শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টিতে পৃথিবী তখন জলশূন্য। হোমানল-প্রদীপ্ত এবং সামগানে মুখরিত তপোবনগুলিতে সকল বৈদিক অনুষ্ঠান বন্ধ হলো এবং সেসবের অননুশীলনের প্রতিক্রিয়া প্রতিটি সমাজশরীরে প্রকাশিত হয়ে মানুষকে নীতিজ্ঞানহীন ও অলস করে তুলল; সেই সাথে বর্ষণ-বিধুর ঋতুর কঠোর প্রভাব স্পষ্ট হলো প্রতিটি কর্ষণবিহীন শস্যক্ষেত্রে।




শ্যামলা ধরণী ধারণ করল ধূসর মরুর ভয়াল চেহারা। বুভুক্ষু নর-নারী’র করুণ ক্রন্দনে এবং কল্যাণকামী ঋষিগণের কাতর প্রার্থনায় অনন্ত চক্ষুষ্মতী দেবী শতাক্ষী আবির্ভূতা হলেন শরতের শুভ্রাকাশে। অগণন চোখে নবরাত্রব্যাপী তাঁর করুণাশ্রু বর্ষাধারায় বিগলিত হয়ে জীবধরিত্রীকে পুনরায় প্রাণচঞ্চল করে তুলল। মৃত্যুভয়পীড়িত এই ঋতুতে মহামারীর প্রকোপ প্রতিহত করে দেবীর এই অপ্রাকৃত পুণ্যদর্শন সকলকে অকালমৃত্যুর হাত হতে পরিত্রাণ করেছিল বলেই এই অকাল-পূজার প্রবর্তন। তবে কোন স্মরণাতীতকাল হতে এর প্রচলন হয়েছিল, তা বলাটা কঠিন।




মহিষমর্দিনীরপে দেবীর তিন কল্পে তিন বার শরৎকালে আবির্ভাবের কাহিনি প্রচলিত। প্রথম কল্পে—শিবের বরে রম্ভাসুরের মহিষ নামে এক অমিতবলশালী পুত্র জন্মগ্রহণ করল। বড়ো হয়ে ক্ষমতার মত্ততায় সেই মহিষাসুর আস্তিক্যবুদ্ধি ভুলে অত্যাচারী হলো এবং দেবগণকে স্বর্গ হতে তাড়িয়ে দিল। তাঁদের স্বর্গবিচ্যুতিতে লোকসমাজে নানা বিপর্যয় দেখা দিল। সকলের সম্মিলিত প্রার্থনায় আবির্ভূতা হলেন রণরঙ্গিণী, অষ্টাদশভুজা, উগ্রচণ্ডা। দেবী উগ্রচণ্ডা আশ্বিনের মহানবমী তিথিতে মহিষাসুর নিধন করলেন।




দ্বিতীয় কল্পে—অত্যাচারিতের করুণ ক্রন্দনে জগন্মাতার পুনরাগমন হলো ষোড়শভুজা মূর্তিতে চারুশোভনা ভদ্রকালীরূপে। এই মূর্তিতে আর এক বার আমরা তাঁর দর্শন পাই দক্ষ যজ্ঞক্ষেত্রে (হিমালয়ের সানুদেশ কনখলে)—ওটা যেমন মর্মস্পর্শী, তেমনই ভয়ংকর। শিবপ্রাণা সতী পতিনিন্দা-শ্রবণে গতাসু হলেন। ধ্যানস্থ শিবের স্তিমিত চোখে জ্বলে উঠল করালাগ্নি—রুদ্রবিশানের প্রলয়ছন্দে আবির্ভূতা হলেন কোটিযোগিনী-সমাবৃতা নৃত্যপরা ভদ্রকালী (দেবী ভাগবত, ৩/২৭/৮-১০)। তাই তাঁর অন্য নাম দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী। আজও সেই দিব্যকাহিনীর স্মরণে বহু পূজাপ্রাঙ্গণে ধ্বনিত হয়— ওঁ দক্ষযজ্ঞবিনাশিনৈ মহাঘোরারৈ যোগিনীকোটি-পরিবৃতায়ৈ ভদ্রকাল্যৈ হ্রী ওঁ দুৰ্গায়ৈ নমঃ—(যিনি) ওঁকাররূপিণী ও দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী (তিনি) কোটি যোগিনীর দ্বারা পরিবৃতা (হয়ে) প্রলয়ঙ্করী মূর্তিতে ভদ্রকালীর রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন, তিনিই (সগুণ) পরব্রহ্মরূপা মহামায়া দুর্গা; (তাঁকে) প্রণিপাত করি।




তৃতীয় কল্পের আবির্ভাব হিমালয়স্থিত মহামুনি কাত্যায়নের নিভৃত আশ্রমপ্রাঙ্গণে। মহিষাসুর আবার জন্মগ্রহণ করেছে। দেবতাগণ তার অত্যাচারে জর্জরিত। সেই অসুরের বধোপায় নির্ধারণে সম্মিলিত দেববৃন্দের সরোষ ললাটে ফুটে উঠল বহ্নিদহন। দেখতে দেখতে সেই উজ্জ্বল প্রভা দশদিক আলোকিত করে ধীরে ধীরে রূপান্বিত হলো এক মহামহিমময়ী দেবী মূর্তিতে। মহর্ষির তপঃশক্তিতে তিনি অমিত দীপ্তিময়ী ও সমস্ত দেবতার অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিতা হয়ে আবির্ভূতা হলেন মহিষাসুরনিধনক্ষমা দশপ্রহরণা দুর্গা মহামুনি কাত্যায়নের আশ্রমে এবং তাঁর দুহিতৃত্ব স্বীকারে তিনি বিশ্ববন্দিতা হলেন কাত্যায়নী নামে।




কাত্যায়ন নিজেই সবার আগে নিবেদন করলেন এই কন্যারূপিণী মাতৃমূর্তিকে তাঁর অন্তরের পূজা ও প্রণতি। কন্যার পরাকাষ্ঠা বা চরমাবস্থা মাতৃত্বে, তাই কন্যারূপিণী জগদম্বার আরাধনায় এটাই মূলসূত্র। এই দর্শন থেকেই বাংলার শারদীয়া মহাপূজা এই যুগ্ম ভাষাশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। মনে হয়, এই বিবরণের পটভূমিকা হতেই এর উপকরণ সংগৃহীত হয়েছে, এবং সেজন্যই সম্ভবত কুমারীপূজা এর অন্যতম অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। সৌম্যা ও অসৌম্যতরা—ভক্তপরিপালিনীরূপে তিনি যেমন সৌম্যা, আবার তেমনি দৈত্যদের নিকট ততোধিক রুদ্ররূপিণী-অসৌম্যা। পূর্বতন ভীষণ রূপসমূহের সুসংস্কৃত এক অনুপম মাতৃমূর্তি—কঠোর ও কোমল ভাবের বিগলিত করুণাধারা। অসুরকে বধ করছেন, তবু হিংসার লেশমাত্র নেই, সদা সুপ্রসন্ন। শাসনে কঠোর হলেও অন্তর তাঁর স্নেহশীতল।




ত্রিকালোক্তা দেবী উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী ও কাত্যায়নী মহাষ্টমীতে আবির্ভূতা হয়ে মহানবমীতে মহিষাসুরকে বারবার নিধন করলেও, শেষোক্ত দশভুজা দুর্গারূপেই তাঁর পূজার সমধিক প্রচলন। কোনো কোনো স্থানে অন্য দুইটি মূর্তি নির্মাণ করেও পূজা করতে দেখা যায়। মহিষাসুরবধ বৃত্তান্তের ত্রিপথিকৃৎধারিণী এ শুভ মহাষ্টমী অশেষ কল্যাণ ও আনন্দের উৎস বলে স্বীকৃত হয়েছে। তাঁর এই অসুরবিনাশনের কীর্তি ভক্তিপূর্বক পাঠ বা শ্রবণ করলে সকলে পাপমুক্ত ও বিপন্মুক্ত হয়, এটা স্বয়ং তাঁরই স্বীকারোক্তি।




পুরাণান্তরে (দেবীপুরাণ, ২-২০ অধ্যায়) দেখা যায়, আশ্বিনেরই মহানবমীতে তিনি ঘোরাসুর-নিধনে নিযুক্ত হয়েছেন। স্মৃতি-নিবন্ধকার রঘুনাথ শিরোমণি এই পুরাণেরই উক্তি উদ্ধার করে বলেছেন—দেবীপুরাণ অনুযায়ী ষষ্ঠী থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত দেবী পূজিতা হবেন। সে কারণেই মনে হয়, আশ্বিনের ষষ্ঠী তিথিতেই জগদ্‌বাসী তাঁর দর্শন পেয়ে ধন্য হয়।—এবারের কেন্দ্র বিন্ধ্যাচল। অসুরাধিপতি দুন্দুভির অমিত বিক্রম ও নিষ্কলঙ্ক পৌরুষের সাথে, তার তপস্যাপ্রসূত আত্মবিশ্বাস যুক্ত হয়ে সমগ্র জগতে তাকে একাধিপত্য স্থাপনে সমর্থ করেছিল। একদিন কৈলাস ভ্রমণকালে সে আসুরিক বৃত্তির প্রভাবে পথভ্রষ্ট হলো। শিবাবাসে উপস্থিত হয়ে দেবীর দুর্লভ দর্শন পেয়ে সে দেবীর মর্যাদা রক্ষা করতে পারল না এবং এই গর্হিত আচরণের ফলে সে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করল৷




অসুরেরা সর্বদাই উন্নতিকামী ও শ্রমশীল। আবারও কঠোর তপশ্চর্যা ও ভগবদ্‌দর্শন এবং তাঁর বরে সর্বলোক জয় করে অসুরাধিপতির স্পর্ধা উচ্চসীমা অতিক্রম করল। বিন্ধ্যবাসিনী তখন ঘোরাসুর-নিধনে আবির্ভূতা হলেন অমিতসুন্দরী ক্রীড়ারতা বালিকারূপে। ভোগসামগ্রীর প্রাচুর্য ও সুপরামর্শের অভাবে আত্মবিস্মৃত অসুর দেবীকে ধরার জন্য লালায়িত হলে সে অচিরেই সসৈন্য নিহত হলো মহানবমীতে।




বীর্যবান কাশ্যপ মুনির পত্নী দানুর গর্ভজাত তিন বলশালী পুত্র শুম্ভ, নিশুম্ভ ও নমুচি। দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে ছোটোভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে ব্যথিত দু-ভাই বৈরশুদ্ধির জন্য নিযুক্ত হলো কঠোর তপস্যায়—সেই চিরাচরিত কাহিনি। শক্তিমান দু-অসুরের অত্যুগ্র অত্যাচারের প্রমত্ত প্রতাপ এবং অত্যাচারিতের ভক্তিবিনম্র স্তুতিগান পরমপাবনীকে লীলাচঞ্চল করল। আবার তাঁকে দেখছি হিমালয়ের কোলে মুনি মাতঙ্গের তরুছায়াময় আশ্রমকুটিরের স্নিগ্ধ প্রাঙ্গণে, রণাঙ্গনের কোলাহল-বিবর্জিত শান্ত পরিবেশে অনিন্দ্যশ্রী দশভুজা দেবী কৌশিকী রূপে।




পূর্বোক্ত আখ্যায়িকাসমূহের সাহায্যে আমরা দেখেছি যে, মহিষাসুর, ঘোরাসুর, শুম্ভ-নিশুম্ভ প্রভৃতি অসুরের সংহারের জন্য দেবী দুর্গা দশপ্রহরণা হয়ে শরতের আশ্বিনে উদ্‌ভূতা হয়েছিলেন। কৈলাস তাঁর নিত্য নিবাসস্থল এবং তিনি মূর্তি পরিগ্রহ করলেন হিমালয়স্থিত কাত্যায়ন ও মাতঙ্গের আশ্রমে এবং বিন্ধ্যাচলে। তাই আজও বোধনপূজার পুণ্যপ্রদোষে তাঁকে আহ্বান করা হয়—”আবাহয়াম্যহং দেবীং মৃন্ময়ে শ্রীফলেহপি” কিংবা “কৈলাসশিখরাদ্‌ দেবি বিন্ধ্যাদ্রের্হিমপর্বতাং” ইত্যাদি। কৈলাসশিখরে যে-মূর্তিতে তুমি নিত্যবিরাজিতা, মহিষাসুর ও ঘোরসুর বধার্থ যে-দশভুজা রূপে কাত্যায়নাশ্রমে বিন্ধ্যপর্বতে আবির্ভূতা হয়েছিলে, সেই মূর্তিতে তুমি এই বিল্বশাখায় ও মৃন্ময়ী মূর্তিতে আগমন করো। শরৎঋতু-সম্ভবা বলেই তাঁর অন্যতম নাম শারদা। ঘটনা-পরম্পরার বিচিত্র সমাবেশ দেখা গেলেও আশ্বিন মাসেই যে দশভুজার জন্মাবির্ভাব হয়েছিল, এতে কোনো মতদ্বৈধ নেই।




শ্রীশ্রীচণ্ডীর (১২/১২) ‘শরৎকালে মহাপূজা’—এই বাক্যে এটা প্রতীয়মান হয় যে, শারদীয়া পূজার মাধ্যমে সকলেই সব ধরনের ত্রিতাপনাশে (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক এই তিন প্রকার মনোকষ্ট দূর করতে) সমর্থ হয় এবং কোনো কোনো ভাগ্যবান মূর্তিমতী ব্রহ্মবিদ্যা দুর্গার আরাধনা করে তাঁর কৃপায় এই দুর্লভ ব্রহ্মানুভূতিও লাভ করে থাকেন। রাজ্যহৃত রাজা সুরথ এবং স্বজনপরিত্যক্ত বৈশ্য সমাধি, এই দুই জন মহর্ষি মেধার নিকট দেবীর মাহাত্ম্য শোনার পর তাঁরই আশ্রমসংলগ্ন নদীর তীরে দেবীর মৃন্ময়মূর্তি নির্মাণ করে কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত হলেন এবং তিন বছর সাধনার পর জগদম্বিকার দর্শনলাভে ধন্য হয়ে রাজা ফিরে পেলেন রাজ্য এবং মুমুক্ষু সাধক সমাধি সকল স্থানেই ব্রহ্মদর্শনের অধিকারী হলেন।




স্বামী সারদানন্দের 'ভারতে শক্তিপূজা' গ্রন্থে পাচ্ছি:




"প্রসিদ্ধি আছে, শক্তিপূজার ফল হাতে হাতে পাওয়া যায়, বিশেষত কলিতে; অন্য দেবতা সব নিদ্রিত; শক্তিপূজাসম্বন্ধীয় তন্ত্রসমূহ ভিন্ন অন্য শাস্ত্রসমূহের নির্বিষ ভূজগের ন্যায় বৃথাস্ফালন।




কথাটা সম্পূর্ণ না হউক, কতক সত্য বটে। কারণ, প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, মানুষ জড় বা মনোরাজ্যে যাহা কিছু অধিকার লাভ করিয়াছে, সব শক্তি আরাধনের ফলে। জড়শক্তি বলিয়া যাহা সাধারণ মানবের প্রত্যক্ষগোচর, তদারাধনার ফলেই তাহার শারীরবিজ্ঞান, ভূতবিজ্ঞান, রোগশান্তি, মহামারীর প্রতিবিধান, আহার-সংস্থান, ধনাগমের বিবিধ উপায়, যুদ্ধবিগ্রহের উপযোগী অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি করতলগত। তেমনি, মানসিক শক্তি বলিয়া যাহা পরিচিত, তদুপাসনায় মানবের মনোবিজ্ঞান, কবিত্ব, সংযম, বিবাহবিধান, সভ্যতা, নীতি, সমাজগঠন, রাজনীতি প্রভৃতি, এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উদ্‌বোধনে ব্রহ্মচর্য, সত্য, সন্তোষ, শমদমাদি সাধনসম্পত্তি এবং পরিশেষে সর্ববাধাবিনির্মুক্তিরূপ পরম পুরুষার্থও তাহার আয়ত্তীভূত! অবশ্য ঐ সকল বহুলোকের বহুকাল ধরিয়া বহুভাবে শক্তি উপাসনার ফলে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু মানুষ সর্বকালে যতটুকু শ্রদ্ধা-ভক্তির সহিত যে-কোনও শক্তির যে পরিমাণে উপাসনা করিয়াছে, সেই পরিমাণে ফলও হাতে হাতে পাইয়াছে। একালের উপাসকদেরও এ কথা প্রত্যক্ষানুভূত।




তবে অঙ্গহীন হইলে বা বিধি ও শ্রদ্ধা-বিরহিত হইলে পূজার সম্পূর্ণ ফললাভ অসম্ভব এবং সময়ে সময়ে বিপরীত ফলও ঘটিয়া থাকে।"




দেশে শক্তিপূজার বহুল প্রচার সত্ত্বেও এই মর্মন্তুদ দুর্দশার মূলে পাই স্বামী সারদানন্দের এই বাণীর শেষাংশের ইঙ্গিতটি। কেউ কেউ বলেন, যিনি জগজ্জননী, তাঁকে যে যে-রূপেই ডাকবে, তিনি কি তাতে সাড়া দেবেন না? সকলে সমানভাবে ডাকতে পারে না সত্য; মা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন যে, শিশুর অস্ফুট স্বর কার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য উত্থিত হচ্ছে—মাতৃনির্ভরতাই সরল শিশুর একমাত্র সম্বল; কিন্তু এ ক্ষেত্রে কি এটা আদৌ বর্তমান? যদি দেবীপূজায় আমাদের নিষ্ঠা বা নির্ভরতা কোনো একটিও না থাকে, তাহলে এটা কী করেই-বা সম্ভব হয়?




‘বাঙ্গালীর পূজা-পার্বণ' গ্রন্থে শ্রীঅমরেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, “সম্প্রতি 'সর্বজনীন পূজা’র প্রচলন বৃদ্ধি দেখিয়া যদি মনে করা যায় যে, আমাদের ধর্মবুদ্ধি আবার জাগিতেছে, তাহলে নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেওয়া হইবে। যেখানে কেবল আমোদ-প্রমোদ উপভোগের প্রবৃত্তি ও প্রমত্ততা সুপ্রকট, সেখানে ধর্মবুদ্ধির জাগরণ সম্পর্কে কোনো কথা মনে না আনাই ভাল। যেখানে প্রতিমা-প্রস্তুতির মধ্যে অধ্যাত্ম তত্ত্বের প্রকাশ ও প্রচেষ্টার পরিবর্তে তথাকথিত আর্টের বাহার-বিড়ম্বনা ফুটিয়া ওঠে, সেখানে যাহা হয়, তাহা পূজা নহে—পূজার বিদ্রূপাত্মক অভিনয় মাত্র।”




শারদীয়া মহাপূজা চারটি অবয়বযুক্ত—মহাস্নান, পূজা, বলিদান ও হোম—এই কয়টি অনুষ্ঠান (অবয়ব) সমন্বিত হলেই হয়—মহাপূজা এবং এক দুর্গাপূজা ছাড়া এই সবগুলির একত্র সমাবেশ আর কোনো পূজায় দেখা যায় না; সেজন্যই পূজা করার সংকল্প নির্ণয়কালে ‘মহাপূজা’ কথাটি উল্লেখ করতে হয়। পূজার সময়-নির্দেশক সাতটি কল্পারম্ভের উল্লেখ দেখা যায়; সেগুলির মধ্যে ষষ্ঠীকে শুরুর তিথি ধরে কল্পারম্ভের (ষষ্ঠী–নবমী) প্রচলন সমধিক। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস ও সপ্তমীর প্রাতে নবপত্রিকাশ্রয়ে দেবীর পূজাঙ্গনে আগমন হলে আনুষ্ঠানিক পূজা আরম্ভ হয়। এটা ছাড়াও সপ্তমী, মহাষ্টমী, সন্ধি, মহানবমী এবং বিসর্জন পূজা বিশেষ বিশেষ লগ্নে অনুষ্ঠিত হয়।




নবপত্রিকা বাংলা, অসম ও ওড়িশার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। ‘নবপত্রিকা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ।




রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ।
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।




অর্থাৎ: কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান।




একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল-সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়; স্ত্রীরূপের জন্য দুটি বেল দিয়ে করা হয় স্তনযুগল। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম 'কলা-বউ'।




মহাস্নান: সপ্তমী হতে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন দেবীর পূজারম্ভের আগেই সংগীত, নৃত্য ও বাদ্যাদি-সহ বিভিন্ন দিগ্‌দেশ (দিক বা জায়গা) হতে আনীত বহুবিধ সুরভিত ও সুদৃশ্য দ্রব্যসম্ভার ধীরে ধীরে অর্থপূর্ণ মন্ত্রোচ্চারণসহ দেবীকে নিবেদিত হয়। বিভিন্ন পুরাণে স্থানের উপচারগুলির মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। এতে বিভিন্ন স্থান হতে সংগৃহীত মৃত্তিকার দ্বারা দেবীর অঙ্গমার্জনাকে মৃত্তিকাস্নান বলা হয়।




পূজন: সব জায়গাতে ব্রহ্মদর্শনই শ্রেষ্ঠ পূজা, ধ্যানপর (ধানের মধ্য দিয়ে) উপাসনা মধ্যম, স্তুতি-জপাদি তৃতীয় স্তরের এবং প্রতীক বা প্রতিমা অবলম্বনে আরাধনাই চতুর্থ স্তরের। বাহ্যবস্তুর অবলম্বনে সাধক ক্রমে ক্রমে সেই উত্তম ব্ৰহ্মসদ্‌ভাব লাভ করে, সুতরাং বাহ্যপূজা হলেও বিবিধ অনুষ্ঠান, ধ্যান, উপাসনা, স্তবস্তুতি ইত্যাদির সহায়ে এই চারটি ক্রমের অনুবর্তন সমস্ত পূজায় অনুসৃত হয়।




সাত্ত্বিকাদি ভেদে পূজার উপচার বিভিন্ন হলেও এর বিধিতে প্রভেদ নেই। এই পূজায় সমারোহ নেই। রাজসিক পূজক ঘটা করে পূজা করেন। এতে তাঁর লোকমান্য হবার প্রবল স্পৃহা লক্ষণীয়। তামসিক সাধকের পূজা বিধিহীন।




সুস্থ দেহ ও স্থির মন আরাধনার প্রথম সোপান। এ দুইকে সবার আগে শুদ্ধ এবং সংস্কৃত না করলে এরা ইষ্টদেবতার অধিষ্ঠান হতে পারে না। পূজাস্থান, উপকরণ, প্রতিমা ও দেবতার মন্ত্রসমূহকে শোধন করলে পূজকের চিত্ত ধ্যানযোগ্যতা লাভ করে। পূজকের নিষ্ঠা, গৃহস্থের ভক্তি এবং ধ্যানসম্মত সুগঠিত দেবমূর্তি নির্মাণের দ্বারাই প্রতিমায় দেবতার আবেশ হয় বলে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্তব্য করেছেন। দেবীর যথাযথ অঙ্গসংস্থান ও আয়ুধাদির সন্নিবেশ না করে কেবলমাত্র প্রতিমাকে দর্শনীয় করা বাঞ্ছনীয় নয়। দেবীর অধিষ্ঠান বাইরে নয়, ভেতরে।




দেবীর জটামণ্ডিত মস্তক অর্ধেন্দুকলায় সুশোভিত, ত্রিনয়নভূষিতা কমনীয় পূর্ণচন্দ্রসদৃশ মুখকান্তি, অতসীপুষ্পাভ দেহদ্যুতি, দাঁড়াবার উন্নত ভঙ্গি এবং বিবিধাভরণে ভূষিত তাঁর দেহ তারুণ্য ও অমল দন্তশ্রেণীর বিমল আভায় মাতৃত্বের মাধুর্য বর্ষণ করে ত্রিভঙ্গিমঠামে (যে-অবস্থানে দেহে তিন ভঙ্গ বা বক্রতার সৃষ্টি হয়) মহিষাসুরকে মর্দন (পীড়ন) করছেন। মৃণালসদৃশ দশবাহুতে মায়ের বাম থেকে উপরে ডান দিকক্রমে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, তীক্ষ্ণবাণ ও শক্তি এবং বাম দিকে নিচ থেকে উপরের দিকক্রমে ঢাল, সচাপধনু, নাগপাশ, অঙ্কুশ ও ঘণ্টা বা পরশু—অস্ত্রশস্ত্রসমূহ। তাঁর পাদমূলে ছিন্নগ্রীব মহিষ এবং ওই স্থান হতে খড়গধারী মহিষাসুর অর্ধনিষ্ক্রান্ত হওয়ামাত্রই দেবীর ত্রিশূল তার বুকে বিদ্ধ হয়েছে। তার সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত, চোখদুটি লালবর্ণ ও বিস্ফারিত এবং দেবীর নাগপাশে তার কটিদেশ বেষ্টিত হওয়ায় ভ্রূকুটিকুঞ্চিত মুখ অতিভীষণাকার ধারণ করেছে। নাগপাশের দ্বারা তিনি অসুরের কেশগুচ্ছ ধারণ করলে সে রক্তবমি করতে লাগল। দেবীর পদতলে সিংহ এবং তাঁর দক্ষিণ-চরণ সরলভাবে তার উপর ন্যস্ত এবং কিছুটা উপরে অবস্থিত অন্য চরণের কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিটি তার উপর স্থাপিত। দেববৃন্দ-সংস্তুতা, উগ্রচণ্ডাদি অষ্টশক্তি-পরিবেষ্টিতা ধর্মার্থকামমোক্ষদাত্রী দেবী সমগ্র জগৎকে ধারণ করে অবস্থান করছেন।




ধ্যানান্তে দেবীকে নিবেদিত হলো হৃৎপদ্মাসন। সহস্রার (মস্তিষ্কের ঠিক উপরে অবস্থিত চক্র) হতে ক্ষরিত সুধাধারায় তাঁর শ্রীচরণযুগল ধৌত করে মন প্রদত্ত হলো অর্ঘ্যরূপে। এভাবে একে একে সমস্ত উপচার নিবেদন করে সাধক দেখলেন, তাঁর দেবার আর কিছুই নেই—তাই আত্মনিবেদন করে নিজেকে তিনি দেবীময় চিন্তা করতে লাগলেন। এইবার আত্মরূপিণী মহামায়াকে হৃদয়াষ্টদলপীঠ হতে বাইরে এসে পূজাগ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়ে যথাসাধ্য উপচারে তাঁকে পূজা নিবেদন করা হলে তাঁর আদেশ নিয়ে তাঁর সাথে আগত দেবপরিবার এবং অঙ্গ ও আবরণ দেবতাদের পূজা করা হলে (দেবীর বিভিন্ন অঙ্গে অধিষ্ঠিত দেবতা, এবং তাঁকে আবৃত করে যে-সকল দেবদেবীগণ বিদ্যমান রয়েছেন, তাঁরা আবরণ দেবতা) পূজা সমাপন হলো।




বলিদান: ‘বলি অর্থে উপচার বোঝালেও এর দ্বারা বিশেষত ‘পশুবলি’ বুঝতে হবে।’—কেন এই বিধি?—সত্যিই কি এটা দেবীর কাছে তৃপ্তিপ্রদ? এর দুইটি অর্থ; একটি মুখ্য, অন্যটি গৌণ ৷ দেবীভাগবতের টীকাকার শ্রীনীলকণ্ঠ লিখেছেন যে, দেবীপূজাতেই বলিদান সংগত, অন্য কোথাও নয়; কারণ ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিণী দেবী আমাদের স্বরূপনিরোধক এই ঘোর জীববুদ্ধি নাশ করে ব্রহ্মাকারা বৃত্তিতে প্রতিভাত হন—তাই তিনি বলিপ্রিয়া।




“কামক্রোধৌ ছাগবাহৌ বলিৎ দ্বত্বা প্রপূজয়েৎ।”—সাধক মানসপূজায় দেবীর নিকট বলি দিচ্ছেন তাঁর রাগ ও রোষকে। অন্তর্নিহিত পশুভাবের নিরোধে দৈবশক্তির বিকাশই যথার্থ পশুবলির অর্থ। অন্যমনের সাধকের বলিপ্রদান এর গৌণার্থজ্ঞাপক। যাঁদের বুদ্ধি মার্জিত নয় এবং যাঁরা মাংসাশী, তাঁরা পশুবলি দিয়ে পূজা করবেন। পশুবলির মধ্যে ছাগ ও মেষ প্রভৃতি সপ্তগ্রাম্য এবং মহিষাদি সপ্তঅরণ্যজ পশু উৎসর্গীকৃত হয়।




হোম: শারদীয়া মহাপূজা তিথি ও সময়সাধ্য, এটা যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হয় এবং হোমক্রিয়াই এর শেষ অঙ্গ। মহানবমীর পূজা সম্পন্ন করে প্রজ্বলিত অগ্নিতে দেবীর অধিষ্ঠান চিন্তা করে আহুতি দিতে হয়, কারণ অগ্নিই সকল দেবতার মুখস্বরূপ এবং আহুত দ্রব্য যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কর্তব্য। আচারভেদে বৈদিক ও তান্ত্রিক হোমের বিধান বর্তমান। প্রথমটি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ তাই অনেকেই অন্য পর্যায়ের হোম করে থাকেন। বৈদিক যুগের আহিতাগ্নি উপাসনার সাথে পরবর্তী যুগের প্রতিমা পূজার শেষে এই অনুষ্ঠান করে উভয়কালের আরাধনায় একধরনের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। পূর্ণাহুতি ও দেবীকে দক্ষিণান্ত করে (সবার শেষে দেবীতে মন নিবিষ্ট করে) পূজা সমাপন হয়।




দশমী: রাবণনিধনের পর শ্রীরামচন্দ্রের বিজয়-উৎসব এবং অযোধ্যাযাত্রা, দেবীর স্বগৃহে কৈলাসে প্রত্যাবর্তন এবং দুর্গা যুদ্ধের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলেই মহানবমী পর্যন্ত তাঁর পূজা করার পরে বিজয়া দশমীতে রাজাদের শত্রুজয়ের জন্য জৈত্রযাত্রা (শোভাযাত্রা) ও বলনীরাজন (সৈন্যদের সংবর্ধনা), অর্থাৎ জয়লাভেচ্ছু রাজন্যবৃন্দের সৈন্যসংবর্ধনার ব্যবস্থা দশমী কৃত্যের অঙ্গ। বর্তমানকালেও দেখা যায়, এই দিনে কারও অন্য কোথাও যাবার প্রয়োজন না থাকলেও এই দিনে পূর্ণ এক বছরের জন্য যাত্রা করে রাখেন—যাতে পরে তাঁরা কোন বার-তিথি না দেখেও যে-কোনো দিন যাত্রা করতে পারেন।




পূজা-অর্চা, আদর-আপ্যায়ন, লোকলৌকিকতার দিব্য-উন্মাদনায় অতিবাহিত তিনটি দিন দশমীর অনাকাঙ্ক্ষিত আবির্ভাবে মুহ্যমান। বিচ্ছেদবেদনা কাকে না ব্যথিত করে—বিশেষত দীর্ঘপ্রতীক্ষার পর যাঁকে পাওয়া যায়, তাঁর বিচ্ছেদবেদনা!




দেবীর তুষারধবল নিত্য-নিলয়ে ফিরে যাবার দিন আজ—দশমীর বিসর্জন তিথি। কোথায় সে তুহিনাচল কৈলাস?—এ যে আমাদের মানস-সরোবরের অতি সন্নিকটে, যেখানে ধ্যানমগ্ন সশক্তিক ধূর্জটির তপঃপ্রভাবে আমাদের অজ্ঞান-কুয়াশা দলিত ও ছিন্ন হয়েছে।




দর্পণ বিসর্জন হলো। সেই দর্পণেরই প্রতিচ্ছবিতে দেবীর আরাধনা হয়েছিল। এখন সেই প্ৰতিবিম্ব বিম্বগত হয়ে কারণে বা উৎসে প্রবেশ করল। সর্ববিপদবিনাশিনী ও শান্তিপ্রদায়িনী দুর্গাকে প্রদক্ষিণ করে একদা যে-উৎসবাঙ্গন বিত্ত ও বিজ্ঞানলাভেচ্ছু (সগুণ বা নির্গুণ পরমাত্মা বা ব্রহ্ম সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানলাভেচ্ছু) ভক্তবৃন্দের প্রার্থনায় মুখরিত হয়েছিল, তা স্তব্ধ হলো। সন্ধ্যাসমাগমে প্রতিমা উন্মুক্ত অম্বরতলে স্থাপিত। যে সুশোভিত বরণডালার মাঙ্গল্য-সম্ভারে তাঁর আগমনীর আবাহন-গীতি বেজে উঠেছিল, আজ তা-ই আবার প্রতিহৃদয়ে বিসর্জনের করুণ সুরে ভরে উঠল এবং মাতৃ-আগমনের নিরবচ্ছিন্ন চিন্তাধারার সুস্থির প্রতীতি নিয়ে এবং পরস্পরকে যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি জানিয়ে আমরা আবারও মায়ের আগমন-প্রতীক্ষায় দিন কাটাব।