এক। কষ্টকে পরাজিত করে, দূরে ছুড়ে মেরে বা লুকিয়ে রেখে, এমনকি সঙ্গী বানিয়ে হলেও, বেঁচে থাকতে হবে। সব কিছুর পরও, প্রয়োজনে একধরনের বাধ্যতায় নিজেকে জড়িয়ে রেখে হলেও বেঁচে থাকতে হবে। কোনও একজনের কারণে না-হলেও, অন্য কারও-না-কারও জন্য বেঁচে আমাদের থাকতেই হবে। এই বেঁচে-থাকাটা খুব জরুরি। সামনে দিকে তাকান। নতুন উদ্যমে নতুন আলোয় নিজেকে ভাসিয়ে নেবার দিনগুলি দেখা এখনও বাকি পড়ে আছে। আজকের এই অন্ধকারে গুমরে গুমরে প্রতিদিনই একটু একটু করে মরে-যেতে-থাকা দিনগুলিও একদিন-না-একদিন জ্যান্ত হয়ে উঠবে। অপেক্ষা করুন, ঠিকই উঠবে! অন্তত একটু চেষ্টা করেই দেখা যাক না! হ্যাঁ, যাকে বলে শেষচেষ্টা! কষ্ট হচ্ছে খুউব? হতে দিন! তবুও এখনই কোনও কিছুর বিনিময়েই যেন হঠাৎ করেই চলে-যাওয়াটা না হয়…এটাই একমাত্র কামনা! একেবারে বাজেভাবে হলেও বেঁচে থাকুন! বেঁচে থেকে দেখুনই না কী হয়! জীবনে অনেক ভুল তো করলেন, ধরে নিন, এই বেঁচে-থাকার চেষ্টাটাও একধরনের ভুল। দেখবেন, এই ভুলটাই একদিন আপনাকে অনেক ভালো রাখবে। সেদিন এই অধমের কথাটা মিলিয়ে নেবেন নাহয়! এখন আসি আসল কথায়। এমনি করে হাতে পায়ে ধরে বলে বলে যে মানুষটা প্রতিদিনই কাউকে-না-কাউকে বাঁচিয়ে রাখছে, তার জন্যই বেঁচে-থাকাটা যেন নিতান্ত এক দায়! সে মানুষটার জন্য---নিজেকে কোনওমতে ভালো রাখাটা এখন রোজকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অন্তত তিরিশটা বছর দাঁতে দাঁত চেপে কামড়ে ধরে সব সহ্য করে হলেও, আরও একটু, হ্যাঁ, আরও একটু বেশি বেঁচে নেওয়াটা এখন রীতিমতো নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। ভাবতে পারেন, আরও তিরিশটা বছর নিজের আয়ুকে কায়ক্লেশে বয়ে বেড়ানো! মাত্র ১৫ বা ১৬ বছর বয়স থেকে যে মানুষটা জীবন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে, আজও সে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, এবং সেই তাকেই নাকি কমপক্ষে আরও তিরিশটা বছর বাঁচতে হবে! আবার সেও নাকি প্রতিদিনই কাউকে-না-কাউকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়! এসব কী যে আত্মকপটতা, তা ভাবা যায়! জীবনের নাট্যমঞ্চটা সত্যিই এই নিপুণ অভিনয়ের বড্ড অভাববোধে ভুগবে! আমি আমার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছি! আর কত! দুই। সত্যিই কাউকে ভালোবাসলে, কখনওই, কোনও পরিস্থিতিতেই, না তাকে ভুলে যাওয়া যায়, না তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা যায়! এ যে ভালোবাসা! এ বড়ো সহজ বস্তু নয়! কষ্ট শুধু একটাই…বিচ্ছেদের নাম করে দূরত্বটা রয়ে যায় যদিও, তবু তাকে করা না যায় ঘৃণা, থাকা না যায় ভুলে! হাজার হোক, ভালোবাসার বিপরীত শব্দটাই তো ঘৃণা, তবু জীবনের ক্ষেত্রে, ওই শব্দটা একই সাথে একই বাক্যে কখনওই স্থান পায় না; পায় যদি, তবে বাক্যটাই তার বাক্য হবার সমস্ত যোগ্যতা হারায়! তখন সেই বাক্যের কোনও অস্তিত্বই আর কিছু থাকে না! তাই এ মিলন একরকম অসম্ভবই! আর যদি কেউ সেই সহাবস্থানটা জোর করে হলেও মিলিয়ে দেখায়, তবে কী আর বলার থাকে! সেখানে ভালোবাসা বলে কিছুই ছিল না, পুরোটাই ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি! তিন। একেক জনের ভালোবাসার ধরন একেক রকম। একেক জনের ‘পাশে আছি।’ এমন অভিব্যক্তির প্রকৃত অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ একেক রকম। এসব কেউ প্রকাশ করতে পারে, কেউ-বা পারে না। তবে প্রকাশ করুক বা না-ই করুক, ভালোবাসাটা কিন্তু রয়েই যায়! ভালোবাসি! এমন বলা হোক বা না-ই হোক, ভালো ঠিকই বাসা হয়! সবার সামনে ‘পাশে আছি।’ বলা না গেলেও, সবার আড়ালে যদি কোনও দিন, কিংবা সবার সামনেও যদি কোনও দিন কোনও বিপদে পাশে থাকতে হয়, সেদিন সময়ই সব উত্তর ঠিকই দিয়ে দেয়। সময়ের চাইতে ভালো উত্তরদাতা আর কে আছে! যা চোখে দেখা যায়, তা সত্যি হয় না সবসময়। যা সত্যি হয়, তা প্রকাশ পায় না সবসময়। মনের ভেতর কিছু সত্যি, সত্যি হিসেবেই থেকে যায়। ওসব প্রকাশ পায় না, কিংবা ওসবকে প্রকাশ পেতে দেওয়া হয় না। প্রকাশ পাক না পাক, ওসব কিন্তু হারিয়ে কখনওই যায় না। দূরে থাকা হোক কিংবা কাছে…থেকে-যাওয়াটা ঠিকই হয়ে যায়।