চিত্রগুপ্তের খাতা

ভাই, জীবনটা মুভিই, কিংবা তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু—এখানে শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটাই নেই, বাকি সবই আছে। আপনি যা করবেন—ভালো কি মন্দ—তা ফেরত পাবেন; আপনি নিজে না পেলেও আপনার সন্তান পাবে, সে না পেলেও তার সন্তান পাবে। আই রিপিট, ফেরত পাবেনই! অদৃষ্টে সব লেখা হয়ে যায়, কিচ্ছু মোছে না ওখান থেকে।




সময়টা বোধ হয় ২০০৮-এর শেষের দিকে। একদিন আমার কোচিং সেন্টারে আমার খুব প্রিয় ছাত্রী ও আদরের ছোটোবোন মিথির মা একজন স্টুডেন্টকে ভর্তি করাতে নিয়ে এলেন। বললেন, "স্যার, ও শমীক, আমার দেবর। একটু অসুস্থ, তাই দেড় বছরের মতো পড়াশোনা করতে পারেনি। ওকে একটু কভার করে দিতে হবে।" আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আন্টি, আমাকে ক্ষমা করবেন। এই শেষ মুহূর্তে এত চাপ আমি নিতে পারব না।" তিনি আবার বললেন, "স্যার, ওর পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। এতদিন অসুস্থতার জন্য পড়তে পারেনি। আপনি একটু সাহায্য করুন। আমার এই অনুরোধটা রাখুন।"




মিথিকে আমি বোন ডেকেছি। ও আমাকে 'দাদাভাই' বলে ডাকত এবং এখনো ডাকে। পিচ্চিটা মায়ের পাশ থেকে চট করে বলে উঠল, "দাদাভাই, তুমি কাকুকে ভর্তি করাও। এটা আমার রিকোয়েস্ট।" পিচ্চিটার কোনো অনুরোধ আমি কখনও ফেলতাম না। বড়ো ভালোবাসতাম ওকে। বললাম, "ঠিক আছে, ওকে আমি নিচ্ছি, কিন্তু এমন কোনো দায়িত্ব নিচ্ছি না যে, ও রেজাল্ট ভালো করবেই। ওর বেসিক কেমন, আমি জানি না। এই সময়ে এমন জিরো-লেভেলের স্টুডেন্ট নেওয়া রিস্কি।" "দাদাভাই, তুমি অনেক ভালো! আমি কাকুকে কথা দিয়েছিলাম যে, আমি তোমাকে রাজি করাব‌ই…!" "অ্যাই পিচ্চি, চুপ থাক তুই! একদম চড় খাবি!" "সবসময়ই তো মারো, ওটা আর নতুন কী! হি হি হি…"




দেখলাম, শমীক মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। শুরু থেকে ও একটা কথাও বলেনি, আমিও কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমার মনের মধ্যে অনেক বিরক্তি কাজ করছিল। এস‌এসসি পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। এ সময়ে নতুন স্টুডেন্ট নেয় কেউ! কিন্তু সামনের দু-জন মানুষের কথা ফেলি কী করে!




আমার কোচিং সেন্টারের নাম ছিল 'পলস কোচিং হোম'। শমীক ক্লাস করতে আরম্ভ করল। জানলাম, একটা অ্যাক্সিডেন্টের পর ওর সিভিয়ার এপিলেক্টিক সিন্ড্রোম দেখা দেয়, চিকিৎসার জন্য ভেলোরে পড়ে থাকত। ওর বাবা ঠিক করেছিলেন, ছেলেকে ইন্ডিয়াতেই পাঠিয়ে দেবেন একেবারে। পরে আর তা হয়ে ওঠেনি।




আমার ধারণা হয়েছিল, ওকে বোধ হয় এমন শেষ মুহূর্তে আর কোনো স্যার নিচ্ছেন না বলেই ও এখানে পড়তে এসেছে। আবার এমনও হতে পারে, ওর বেশ কিছু কাছের বন্ধু (দিব্য, সৌম্য, প্রয়াস, শুভ, দীপ, রাসেল, সৌভিক, শান্তনু ইত্যাদি) আমার কাছে পড়ত; ওদের সাথে কথা বলেই শমীক পলস-এ ভর্তি হয়েছে।




খুব দেরিতে আসায় ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, অনেক বাড়তি খাটতে হবে এই ছেলের জন্য! কলেজিয়েট স্কুলে পড়ত শমীক, স্কুলের টার্ম পরীক্ষাগুলোও দিতে পারেনি অসুস্থতার কারণে। মিথি আর মাসির অনুরোধেই আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওকে নিয়েছিলাম। পরে শমীকের বাবার সাথেও আলাপ হয়েছিল। চমৎকার একজন মানুষ উনি।




শমীক সেইসময় প্রয়াস, সৌম্য, দিব্য-দের সাথে একই কাতারে ছিল না। বেশ আন্ডারপারফর্ম করত সব টেস্টে, মনে আছে। আসল ঘটনা হচ্ছে, ওদের সাথে এক কাতারেই ছিল শমীক এক-দেড় বছর আগেও, হঠাৎ নিজেকে ওভাবে দেখে কনফিডেন্স একদমই হারিয়ে ফেলে।




অল্প সময়ের মধ্যেই দেখি, শমীক ভিন্ন গ্রহের প্রাণী! ও অনেক মেধাবী একজন মানুষ। অনেক মানে, অনেক…! আমি বিস্মিত হতাম ওকে দেখে। বুঝে নিয়েছিলাম, ওর এখন একটা জিনিস‌ই দরকার, আর তা হচ্ছে সাহস। খুব কৌশলে, ওকে বুঝতে না দিয়েই, ওর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে লাগলাম। শিক্ষক হিসেবে, কোন স্টুডেন্টের কখন কী লাগবে, এটা আমি খুব স্পষ্টভাবে ধরে ফেলতে পারতাম।




'ও পারবে', এটুকু বলার মতো মানুষ ওর জীবনে তখন তেমন একটা ছিল না। আমরা যখন জিরো, তখন একটু আত্মবিশ্বাস দেবার জন্য পাশে কাউকেই পাই না; আর যখন আমরা হিরো, তখন পাশে থাকার মানুষের কোনো অভাব হয় না—অথচ তখন অত 'শুভাকাঙ্ক্ষী' না হলেও আমাদের চলে।




শমীক বেশ ভালোভাবেই কাম-ব্যাক করল; বলা যায়, একদম রাজার বেশে! ও তো রাজাই ছিল; মানুষ আসলে রাজাই থাকে—শুধু পরিস্থিতির কারণে টের পায় না। শমীক সাধারণ কোনো মানুষ ছিল না, মেধাবীও ছিল না—হি ওয়াজ অ্যা জিনিয়াস! মাত্র অল্প কয়েক দিনের চেষ্টাতেই শমীক এসএসসি'তে গোল্ডেন এপ্লাস পেল। পরবর্তীতে সাস্ট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করল। এখন আমেরিকার বস্টনে থাকে, পিএইচডি করছে।




এগোতে মানুষের বেশি কিছু লাগে না, সে এগোতে পারবে—এটুক বিশ্বাস করিয়ে দেবার জন্য সঠিক সময়ে একজন গুরু লাগে। গুরুর পা এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ।




শমীক তখন আইবিএ'তে; সামারের সেমিস্টার-ব্রেকে প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে পড়ে যায় একটা পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে। ওই সময়টায় শমীক সারাদিনই পড়ে থাকত আমার পেইজে আর ইউটিউব চ্যানেলে। ওর কথাতেই বলি: "স্যার, তখন আপনার কথাগুলো আমার পাশে না থাকলে আমি বোধ হয় ডিপ্রেশনে মারাই যেতাম!" আজ ইনবক্সে নক করে আরও বলল, "...আপনি আসলে এত বিখ্যাত মানুষ হয়ে গেলেন পরে, কাছে ঘেঁষতে একটু ভয়ই লাগত! তবে আপনার পেইজ ফলো করি বহু বছর ধরে। আমার অনেক ডাউনফেইজে আপনার কাছ থেকে কী যে মোটিভেশন পাই, বলে বোঝাতে পারব না।…সৌম্য যেবার বিসিএস-এ সেকেন্ড হলো, আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। ওই ট্র্যাকে না গেলেও, ওর সাথে আপনার পুরো শো-টা মন দিয়ে শুনেছি।"




শমীক ভাবে, এসএসসি'র ওই ধাক্কা ওকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল এইচএসসি অবধি। ওর হারিয়ে যাবারই কথা ছিল—হারায়নি কেবল গুরুদের আশীর্বাদে।




ভাবতে খুব আনন্দ হয়…ওর গুরুদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ভাবছেন, ওর আজকের অবস্থানের পেছনে আমার সেদিনের 'মহত্ত্ব' ভূমিকা রেখেছে? যদি এমনটা ভেবে থাকেন, তবে ভুল ভাবছেন। অদৃষ্টের খেলা বড়ো বিচিত্র। আমাদের সমস্ত ভাবনার শেষ যেখানে, ঠিক সেখান থেকেই ঈশ্বরের মাস্টারপ্ল্যানের শুরু।




গতকাল আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু হরিসাধন দত্ত স্যারকে নিয়ে যে-লেখাটি লিখেছি, তা আপনারা অনেকেই পড়েছেন। আপনাদের সাথে শমীক দত্তের বাবাও পড়েছেন এবং পড়ার পর নিজের ফেইসবুক ওয়ালে শেয়ার করেছেন। কেন করেছেন, জানেন? কারণ, উনি হচ্ছেন হরিসাধন দত্ত স্যারের জামাতা—স্যারের একমাত্র সন্তান কৃষ্ণা দত্তের স্বামী। অমন সুপণ্ডিত শ্বশুরকে নিয়ে তাঁর ভীষণ গর্ব হয়েছে, তাই আনন্দে শেয়ার করেছেন।




আজ সকালের আগ পর্যন্ত শমীককে আমি হরিসাধন দত্ত স্যারের নাতি হিসেবে চিনতাম না। আমি লেখাটি না লিখলে শমীক‌ কখনোই জানতে পারত না যে, আমি ওর দাদুর ছাত্র। স্যার মারা যান ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। শমীক ওর দাদুকে আমার কথা জানাতে পারেনি—ও তো জানত‌ই না ব্যাপারটা, জানাবে কী করে! জানলে স্যার নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন।




কেউ কিছু জানত না, তবু একজন জানতেন সবই। তিনি তো সব কিছুর নীরব সাক্ষী। তাঁর হিসেবে যে কখনও কোনো ভুল হয় না! হরিসাধন স্যার তাঁর পায়ের কাছে কৃপা করে বসতে দেবার জন্য কখনোই আমার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেননি। স্যারকে গুরুদক্ষিণা দেবার সামর্থ্য থাকলেও সৌভাগ্য আমার তখন হয়নি। ঈশ্বর ঠিকই আমার অজান্তেই এই সৌভাগ্য আমাকে দান করেছিলেন—কেউ কিছু টের পায়নি যদিও। কালকের লেখাটি না লিখলে কেউ কোনোদিনই কিছু টের পেত না। অবশ্য, টের পাবার‌ই-বা কী প্রয়োজন! জগতের সকল মহাযজ্ঞ চলতে থাকে নীরবে, আড়ালে।




তখন আমার ধারণা ছিল, শমীক বড়ো অসময়ে এসেছে। আজ বুঝলাম, শমীক একদমই ঠিক সময়ে এসেছিল। ঈশ্বরের কাজ ঈশ্বর সময়মতোই করেন। তাঁর বিচার নিখুঁত ও রহস্যময়, তবে সাধারণত ধীর। আমরা জানি না জানি, বুঝি না বুঝি, মানি না মানি—সবই পূর্বপরিকল্পিত—কোথাও একচুলও এদিক-ওদিক হয় না।




গতকাল পোস্ট-করা লেখাটি দেখে শমীক আজ ওর নিজের ওয়ালে কিছু কথা লিখে পোস্ট করেছে। সেটি তুলে দিয়ে আমার এই লেখার ইতি টানছি:




জীবনের গুরুতর এক মুহূর্তে জামালখানের দু-রুমের কোচিংটায় যাওয়া। কোচিংটা আমার জন্যে একটু অদ্ভুতই ছিল। বাংলা, ইংরেজি থেকে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, হায়ার-ম্যাথ সব এক পাচকই সামলাতেন; সামলাতেন মানে ভালোই সামলাতেন। সেই মাস্টারশেফের ডেরা থেকে বহু ভালো পদই বেরিয়েছে। তবে এই লেখা সেসব নিয়ে নয়।




রামকৃষ্ণ নদীতে ভেসে-যাওয়া নানারকম কাঠের কথা বলে গেছেন। কাঠের মধ্যে কাঠি হয়—নিজে ভেসে থাকে, কিন্তু অন্যের ভার নেবার ক্ষমতা তার নেই; আর হয় বাহাদুরি কাঠ। গুচ্ছের লোক তার ওপর চড়ে চলে যায়, কিন্তু কাঠ ডোবে না…ভেসে থাকে, অন্যকে ভাসিয়েও রাখে। সেই মাস্টারশেফ 'বাহাদুরি কাঠ' ছিলেন। শিষ্যদের বর্তাতে বর্তাতে নিজেও বর্তে যান, মানে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষদেরই একজন হয়ে ওঠেন।




তবে মাস্টারশেফ সুশান্ত স্যার যে আমার দাদুর ছাত্র ছিলেন, আজকের আগে জানা ছিল না। দাদুকে নিয়ে স্যার যা যা লিখেছেন, সেসবের বাইরে একটা ছোট্ট কথা বলে যাই। গীতায় তিলপরিমাণ‌ও আসক্তি ছাড়া কাজ করে যাবার কথা আছে। কখনও হজম হয়নি ব্যাপারটা। আমি নিজে প্রচণ্ড রেজাল্ট-ড্রিভেন মানুষ; কিন্তু কোনো অ্যাকাডেমিক পজিশন, পদ-অর্থের মোটিভ ছাড়া ওরকম পর্বতপ্রমাণ পড়াশোনা করতে দাদুর মতো বেশি লোক দেখিনি।




সত্যিকারের স্কলার হিন্দু বাঙালিদের প্রায় সকলেই দেশভাগের পর বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। দাদু বাংলাদেশ আঁকড়ে-রাখা যুক্তি-না-মানা সেই গুটিকয় পাগলের একজন, যাঁরা দেশটা ছাড়েননি। কেন ছাড়েননি, দেশপ্রেমের অবভিয়াস উত্তরের বাইরে এর আরেকটা ব্যাখা সম্ভবত—কোনো বিষয়েই কোনো আসক্তি না থাকা। নিজের সামর্থ্যে না কুলোক, খুব করে চাই, এই বিরল প্রজাতির পণ্ডিতেরা আবার সংখ্যায় বাড়ুক!