ঠিক কবে, কখন ওর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, এখন আর তা স্পষ্ট মনে নেই। স্মরণশক্তিকে অবশ্য তার জন্যে দোষ দেওয়া চলে না। অসাধারণত্ব বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছুই ছিল না অতসীর। বলার মতো ছিল দুটো চোখ। অদ্ভুত সুন্দর ভাষাময় সে চোখদুটো দেখে আমার কেবলই মনে পড়ত ‘বনলতা সেন’ কবিতাটা। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ!’
অতসী মোটেও সুন্দরী নয়, তবু কেমন একটা আলগা লাবণ্যে যেন ঢলো-ঢলো করত ওর শ্যামলা মুখখানি। তার সেই উপমাবিহীন চোখজোড়া মনে পড়ে। প্রথম দেখাতেই আমার ওকে ভালো লেগেছিল। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মা, তুমি এত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? খুব একটা তো কুৎসিত নয়। তা ছাড়া মামা যেভাবে…!”
একটা ছেলে তার মায়ের কাছে এর বেশি কীই-বা বলতে পারে। অতসী আমার মামার মেয়ে এবং একমাত্র মেয়ে। আর আমার মা, মামার একমাত্র বোন এবং তাঁরও সবেধন নীলমণি এই আমি।
আমার মামা মস্ত ধনী লোক। তাঁর সন্তান ওই একটিই। ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি, মামা আমাকে খুব বেশি স্নেহ করেন। ওই শোনা পর্যন্তই। তাঁকে কখনও নিজচোখে দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। কারণ কার্যোপলক্ষ্যে বিলেত গিয়ে বিদেশিনীর পানিগ্রহণ করলেন তো করলেনই, দেশে আর সহসা ফেরেননি। ওখান থেকেই চিঠিপত্র আসত, আমাদের খবরবার্তা নিতেন এবং প্রয়োজনমতো অর্থসাহায্যও পাঠাতেন।
তারপর হঠাৎই, একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে ফিরে এলেন মামা এবং এসেই বিছানা নিলেন। জানা গেল, ওই বিদেশিনী মহিলা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। মামা স্ত্রী-বিয়োগের শোকটা সামলে উঠতে পারলেন না, একেবারে চলৎশক্তিহীন হয়ে বিছানায় পড়লেন। তাঁর ওই সতেরো-আঠারো’র তরুণী মেয়ে অতসী। মামার সমস্ত সম্পত্তির মালিক ও-ই। কালো মেয়েটার চিন্তায় যেন মুষড়ে পড়েছিলেন মামি খুব বেশিই—এ সবই অবশ্য মায়ের মুখে শোনা।
তখনও, অতসী বা তার বাবা, কারও সাথেই দেখা হয়ে ওঠেনি। আমি হলে থাকি। ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সময় হয়ে ওঠে না। তবু ওদের না দেখেও ওদের সম্পত্তির সগর্ব বর্ণনা আমার মায়ের মুখে শুনে শুনে একটা কথা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বাবা-মা’য়ের একান্ত ইচ্ছে, অতসী যেন তাঁদের বউমা হয়, নইলে মামা সাহেবের অতখানি বিপুল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবার আশঙ্কা। কিন্তু অতখানি আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরাসরি সেকথাটা কেন জানি তবু মা মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে ভরসা পেতেন না, একটা প্রবল দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাক্যটিকে এভাবে শেষ করতেন: “আহা, দাদার এত কষ্টের টাকাপয়সা কিনা বারোভূতে লুটেপুটে খাবে!” আমি বলতাম, “কেন লুটে খাবে?”
“খাবে না!” মা যেন ঝংকার দিয়ে উঠতেন। “খাবে না তো কী হবে, শুনি। দাদা তো ওই মরতে বসেছে। তারপর ওই মেয়ে যাকে বিয়ে করবে, তার চৌদ্দপুরুষ লুটেপুটে খাবে না?”
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, “খাক, নাহয় ফেলে দিক। শত হোক, সে তো মামার জামাতা! তাতে তোমার এত দুঃখ হয় কেন, মা?”
মা ভাঙাগলায় বলতেন, “হয় কি আর সাধে? সাতটা নয়, পাঁচটা নয়, ও-ই তো আমার একটা ভাই। তার রক্তজল-করা পয়সা পরে নষ্ট করবে, আর বোন হয়ে অমি তা-ই চেয়ে চেয়ে দেখব, কিচ্ছুটি বলত পারব না?”
অথচ ইচ্ছে করলেই মা এসব সম্পত্তির মালিক হতে পারেন এবং কী প্রকারে, তা অন্তত আমার না বোঝার কথা নয়; তবু আমি নীরব হয়েই থাকতাম। এবং কেন যে মা হয়েও সন্তানকে এই মনোগত বাসনাটি তিনি ব্যক্ত করতে পারেন না, সেদিন তা জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে।
সেদিন আমি অতসীদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম, মামার অসুখের বাড়াবাড়ি হচ্ছিল শুনে। সেদিন তাকে দেখব বলে গেছি। এর আগেও দু-চারবার গিয়েছি, সেদিনও গেলাম। বিকেল তখনও পরিপূর্ণ রমণীয় হয়ে ওঠেনি। সোনালী রোদের একপরত মিহি আস্তরণ তখনও গাছের পাতায়, লনের সবুজ ঘাসে ঝিলমিল করছিল। আমি দেখলাম তাকে। ধানিরঙা শাড়ি জড়ানো, কপালে কুমকুমের টিপ, আশ্চর্য ডাগর-ছাঁট কালো চোখের অধিকারিণী সে, সেই শ্যামাঙ্গিনী। মামার শিয়রের ধারে খাটের স্ট্যান্ড ধরে সে দাঁড়িয়েছে। আমি নরম স্বরে তাকে ডাকলাম। সে চমকে মুখ তুলল। তারপর অন্য দরজা দিয়ে দ্রুতপায়ে পালিয়ে গেল। আমি মনে মনে মুচকি হাসলাম। না হেসে পারি কী করে! এর আগেও বোধ করি দু-একবার ওর সাথে দেখা হয়েছে, আর ঠিক ওরকমটাই করেছে। ও কেন জানি আমাকে দেখলে ওরকম করে! আমি বাঘ না ভালুক যে, ওকে খেয়ে ফেলব!
যে কিনা জীবনের সতেরোটা বসন্ত বিলেতে কাটিয়ে এসেছে, তার আর যা-ই হোক, আড়ষ্টতা শোভা পায় না। তবু মনে করলাম, কী জানি, হয়তোবা ওর ভারি লজ্জা! কিন্তু এত লজ্জা কীসের? ওর মা ছিলেন শ্বেতাঙ্গিনী, তার উপর শুনেছি, তাঁর রূপের সুনাম ছিল। অথচ সে হয়েছে কালো। তাই বলে কি এত সংকোচ তার? কিন্তু তার দ্বিধা-বিস্ফারিত ধরনের লজ্জা-মেশানো ওই দুটো কালো হরিণচোখের দৃষ্টি আমার ভারি মিষ্টি লেগেছিল। আজ আর বলতে লজ্জা নেই—আমি বুঝি ওর চোখের প্রেমেই পড়েছিলাম।
কখনও সে আমার সামনে এসে দাঁড়তে চায় না। কথা বলেনি ভুলেও কোনোদিন। অথচ সেই অন্তঃপুরবাসিনীর দু-খানি হাতের মমতাময় স্পর্শ, আন্তরিক আপ্যায়ন আমি ঠিকই অনুভব করতে পারতাম। অতসী চাকরের হাতে আমার জন্যে চা পাঠাত, কিন্তু একপলকেই বুঝতে পারতাম আয়োজনটা আসলে কার। আর কোন সুষমাময়ী চায়ের ট্রেতে রজনীগন্ধার স্টিক সাজিয়ে দিতে জানে! হাতমোছার টিস্যু কিনে ওতে সেন্ট লাগাবার রুচি থাকে কার! এসবের মাধ্যমেই আমার মনে সে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে।
আমি মামার অনাত্মীয় পুরুষ হলে নাহয় কথা ছিল। আমি কি তার আপনজন নই? তাই সেদিন যখন দ্রুতপায়ে হরিণীর ছন্দ তুলে অতসী পালিয়ে গেল, আমি মুচকি হেসে ফন্দি আঁটলাম। মামার সঙ্গে বৈষয়িক কথাবার্তা শেষ করে ড্রয়িংরুমে এসে দেখি, চিরাচরিত নিয়মে নাস্তার প্লেট। পাশেই রজনীগন্ধা ফুলের স্বল্প সমারোহ। সেসব উপেক্ষা করে একটা ইংরেজি ম্যাগাজিনে চোখ ডোবালাম আমি। চাকর ছেলেটা এসে তাড়া দিল। চা নাকি জুড়িয়ে জল হয়ে যাচ্ছে। আমি সেকথা কানেই তুললাম না। বললাম, “অ্যাই শোন, তোর আপামণিকে একবার ডাক তো এদিকে।”
ছেলেটা যেন কিছু বুঝতে পারেনি। বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে ধমকে উঠলাম। “কী হলো? শুনতে পাসনি! তোর আপামণিকে ডাকতে বললাম না?”
হ্যা... হ্যায়... হ্যায়ত... তোতলানো কথাটা শেষ করতে ওর কতটা সময় লাগত জানি না, কিন্তু তার আগেই পর্দা নড়ে উঠল। নিঃশব্দ পায়ে অতসী এসে দাঁড়াল। ওর চোখের পাপড়ি নড়ছে না। বললাম, “এসো, অতসী। এখানে এসে বসো। তোমার সঙ্গে তো আলাপই হলো না।”
সে তবু দাঁড়িয়েই থাকে। “এসো, অতসী। এসো না!” আমি অনুরোধ করলাম।
অতসী এলো। বসল। বললাম, “কী হলো? আমার সঙ্গে কথা বলবে না?”
অতসী নির্বাক। ওর চোখদুটো কীরকম ছলছল করছে।
“অতসী!” গাঢ় কণ্ঠে আমি ডাকলাম।
অতসী নড়ে উঠল। ড্রয়ারটা টেনে খুলল। একটা পেনসিল বের করল। একটুকরো কাগজ নিয়ে নিচু হয়ে খসখস করে কী যেন লিখল। এরপর মুখ তুলল। আমার চোখে চোখ রাখল। ওর চোখের পাপড়ি কাঁপল। দেখলাম, ক-ফোঁটা জল চিকচিক করছে।
“অতসী, কাঁদছ কেন?” বিস্ময়াহত আমি।
অতসী ঝট করে উঠে দাঁড়াল। আমার হাতে কাগজটা গুঁজে দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। ক-মুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। তারপর কাগজে চোখ রাখলাম। চোখের পলক পড়ল না কিছু সময়। আমি স্তম্ভিত। অতসী লিখেছে ইংরেজিতে: “আমি কথা বলতে পারি না।”
সমস্ত রাতেও দু-চোখের পাতা এক হলো না আমার। অতসী বোবা! অতসী বোবা বলেই কি ওর চোখদুটো অত ভাষাময়! অতসীকে মন থেকে তাড়াতে চাইলাম। দেখি, তা হবার নয়। ভাষাহীনা মেয়েটার সেই অপলক চোখদুটো মনের মধ্যে কেমন করে যেন চেয়ে থাকে।
মামা মারা গেলেন। যাবার আগে অতসীর হাত দু-খানি আমার হাতেই গুঁজে দিলেন। বিনা আড়ম্বরে অতসী আমার বউ হলো। আমি বড়োলোক হলাম। প্রেসটিজ-জ্ঞান টনটনে হয়ে উঠল—কেবল আমার মায়ের নয়, আত্মীয়স্বজনদেরও। সমাজে মানমর্যাদা বলেও তো একটা কথা আছে। বোবা বউ নিয়ে চলে কী করে? আমারও মোহ ভাঙতে বেশি দেরি হলো না।
যে ভালোবাসে কি বাসে না, সে কথাটাই এক বারের জন্যও মুখ ফুটে বলতে পারে না, কেবল সুন্দর দুটো চোখ মেলে আয়নার ছবি হয়ে থাকে, তাকে অসহ্য না লেগে যায়? আমার বিরক্তি ধরে গেল।
তা ছাড়া মৌসুমীর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো—আমার বন্ধুর বোন। সে আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েছে। আমার বন্ধু, মৌসুমীর দাদা হারুন আমাকে বলে ‘হোপলেস’। এভাবে নিজের জীবন কেউ নষ্ট করে! এখনও সময় পালিয়ে যায়নি, আমি কেন আমার ভালো বুঝতে শিখছি না? সত্যিই তো! হারুন কি ভুল বলছে? মৌসুমী কত সুন্দর! তার গলার স্বর কী মিষ্টি! অতসী বিলেতে থেকেও যা হতে পারেনি, মৌসুমী এখানে থেকেই তা-ই। কী অনাড়ষ্ট, জড়তাহীন! একদিনে সে কত সহজে আমার আপন হয়ে গেল। মৌসুমী ঠিক যেন একটা কথার পায়রা। সে আমাকে ভালোবাসে। প্রতিমুহূর্তেও আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। মুঠোফোনে অশ্রান্ত আলাপে রাত রীতিমতো ভোর করে দিই। অতসী নিঃশব্দে বিছানায় পড়ে থাকে। আমি আমার ব্যর্থ রাতগুলোকে কথার মালায় সাজিয়ে তুলি। মৌসুমী আমাকে ফোনের মধ্যে গান শোনায়। আর অতসী? সে কাছেও টানে না, দূরেও ঠেলে না, কেবল কেমন এক বিচিত্র দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে।
চরম কথাটা একদিন অতসীকে বলেই ফেললাম।
যেমন থাকে, তেমনই চেয়ে রইল।
বললাম, “যাচ্ছি বিয়ে করতে।” আশ্চর্য! মাথা দুলিয়ে সে সায় দিল।
বললাম, “তোমার খারাপ লাগবে না, অতসী?”
সে হাসল। অতসীর দাঁতগুলো খুব সুন্দর। হাসিটাও ভারি মিষ্টি। আমি অবাক হলাম। অতসীকে কখনও উচ্ছল হতে দেখিনি। কিন্তু আমার বিয়ের আয়োজনে সে কীরকম লাস্যময়ী হয়ে উঠল।
একটার পর একটা দিনের পৃষ্ঠা ঝরে পড়ছিল। আর আমিও যেন কেমন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলাম। অতসীর নির্বাক চোখদুটো অপলক বিস্ফারিত দৃষ্টি ছুড়ে ছুড়ে আমার বুকের ভেতর কোথায় যেন একটি সূক্ষ্ম যন্ত্রণার কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকত। আমার ভালো লাগত না। পারতপক্ষে অতসীর মুখোমুখি হতাম না, অথচ কী আশ্চর্য, সে একটুও অভিমান করেনি, একফোঁটা কাঁদেনি পর্যন্ত! বরং বাড়িতে এরকম একটা উৎসবের ঘটা দেখে সারাক্ষণই ব্যস্ত হয়ে ফিরেছে। তবু তার ওই কর্মক্লান্ত, স্বেদসিক্ত মুখের হাসিটানা ঠোঁটদুটো দেখে আমার সমস্ত স্বস্তি-শান্তি উধাও হতে বসেছিল।
সেদিন আমার গায়েহলুদ হলো।
এর আগে অতসীর সঙ্গে বিয়েতে একফোঁটাও উৎসব হয়নি বাড়িতে। কোনোরকমে বধূবরণ সেরেছিলেন মা। আত্মীয়স্বজনেরা সবাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তেমন কেউই আসেননি গরজ করে। তাঁদের কথা হলো: “একটা মাত্র ছেলে, তার জন্যে কিনা বোবা বউ! ছিঃ!” অতএব, এবার সবাই কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। আমার মতামতের ধারই ধারলেন না কেউই। বাড়িতে যেন রীতিমতো রেশন-চৌকি বসে গেল আর কি! ব্যাপার দেখে অতসীকে মনে হলো, খুব মজা পেয়েছে। কেবল আমিই বিষণ্ণ লজ্জায় নির্বাক হয়ে রইলাম।
বরযাত্রী বেরোবে রাত্রি আটটায়, তারই প্রস্তুতি চলছিল। মা আমাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিলেন। এটা ভেবে দুঃখ পেলাম যে, অসহায় মেয়েটার কথা কেউ ভাবছে না। ভাববারই যে কেউ নেই তার! তাকে কেউ গোনাতেই ধরছে না যেন! যাবার মুহূর্তে কেন জানি না মন যেন কেমন করে উঠল। ভয়ে ভয়ে অতসীর ঘরে পা দিলাম।
কিছুদিন ধরেই আমাদের বিছানা পৃথক করে দেওয়া হয়েছিল। ভেবেছিলাম, এবার নিশ্চয়ই অতসীর চোখে জল দেখব। শত হলেও সে তো রক্তেমাংসে গড়া মানুষ। কথা বলতে পারে না বলে কি দুঃখব্যথাও থাকবে না তার?! কিন্তু ফ্লোরোসেন্ট টিউবের আলোর বন্যায় ভেসে-যাওয়া অত্যুজ্জ্বল ঘরটাতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চন্দনচর্চিতা যে-মেয়েটা জলের গ্লাসে ঠোঁট রেখেছিল, তাকে দেখে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম।
এ কি আমার ভাষাহীনা লজ্জাবিধুরা বধূ অতসী! মনে হলো, ও-ই বুঝি আমার বিয়ের কনে। সম্পূর্ণ একটা নববধূর সজ্জাই অতসীর সমস্ত অবয়বে। কপালের টিকলিটা পর্যন্ত পরতে ভুল করেনি। আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। দেবীর মতোই রূপসী লাগছে আজ তাকে। জলের গ্লাস নামিয়ে রেখে আবারও লিপস্টিক ঘষল ঠোঁটে অতসী। আমার চোখে চোখ রেখে দুষ্টু হাসি হাসল। এগিয়ে এসে প্রথম বাসর রাতের মতো আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
আমি সব ভুলে অতসীকে বুকে টেনে নিয়ে বললাম, “অতসী, এখন কী হবে বলো! আমি যাব না। কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যেতে পারব না, অতসী।” এবার অতসীর চোখে বর্ষা এল। আমার শক্ত আলিঙ্গনের মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছিল রোরুদ্যমানা অতসী। কয়েক মুহূর্ত পরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অতসী অশ্রুভেজা চোখ তুলে আমায় মিনতি করল। ইঙ্গিতে পথ দেখাল। সে আমাকে যেতে বলছে।
আমি বললাম, “না, অতসী! এ হতে পারে না। তুমি কেন এতদিন আমায় বাধা দিলে না বলো তো?” অতসী ম্লান হাসল। আমি লক্ষ করলাম, তার চন্দনচর্চিতা কপাল ঘেমে উঠেছে। কী একটা অসহ্য ঘুমে যেন অতসী টলছে। ও যেন প্রাণপন চেষ্টা করেও চোখদুটোকে খুলে রাখতে পারছে না। তবু বার বার তর্জনী তুলে খোলা দরজাটাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমি এসে তার কাঁধে হাত রাখলাম।
“অতসী তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?” মাথা নেড়ে সে ‘না’ বলল। চোখদুটো এখন সম্পূর্ণ বন্ধ অতসীর। ঠোঁটদুটো থরথর কাঁপছে। অতসী বুঝি কিছু বলার চেষ্টা করছে। অতসী! অতসী! আমি ডাকলাম হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে। কিন্তু তার বুঝি শক্তিতে আর কুলোল না। আমার বুকের উপর সংজ্ঞাহীন অতসীর মাথাটা এলিয়ে পড়ল। সমস্ত বাড়িতে মুহূর্তে একটা হুলস্থুল পড়ে গেল। ডাক্তার এলেন। কিন্তু হায়! সব বুঝতে পেরে অতসী সাত পাতা স্লিপিংপিল একসাথে গুলিয়ে খেয়েছে, তাকে ফেরানো কি এত সহজ!
অভিমানী অতসী আর ফিরল না। অতসী জানে কি না জানি না, কিন্তু আমি তো সত্যিই ফিরেছিলাম। আমার দ্বিতীয় বিয়ের কনে…সে-ও অতসীই হয়েছিল। বরযাত্রীকে সেদিন আর ফিরে যেতে হয়নি, কারণ অতসী যে-কথাটা মুখ দিয়ে কোনোদিনই উচ্চারণ করতে পারেনি, সেই কথাটাই সেদিন তার শেষবাসরের রাতে আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম…অতসী আমাকে ভালোবাসে।