#রাম_নবমী
গোস্বামী তুলসীদাসজি রচিত ‘রামচরিতমানস’ সমগ্র হিন্দুস্থানের অতি আদরের বস্তু, মাথার মণি এবং অনেকের কাছেই প্রাণের চেয়েও প্রিয়। হিন্দি ভাষাভাষীর ঘরে ঘরে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আয়োজিত পূজায় ও কীর্তনে এই পবিত্র গ্রন্থের সশ্রদ্ধ পাঠ হয়ে থাকে। মহাপুরুষের স্পর্শে এই মহাগ্রন্থ ভক্তিরসে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে; এমনকী নিরক্ষর জনসাধারণও এই গ্রন্থের পাঠ শুনে এবং নিজেরাও পাঠ, কীর্তন ইত্যাদি করে পরম আনন্দ লাভ করে, দুঃখে সান্ত্বনা পায় এবং ভক্তিসুধায় উদ্বেলিত হয়। হিন্দির তেমন প্রচার না থাকায় এ পর্যন্ত বাংলাভাষী অঞ্চলে এটির প্রভাব অতটা বিস্তার লাভ করতে পারেনি।
রামায়ণ যে কেবল ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সমাবেশ, তা নয়—মানুষের জীবনে বিভিন্ন অবস্থায় যে-সমস্ত সংশয় এসে উপস্থিত হয়, সেগুলি যেভাবে দূর করে নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হয়—নানান মতে ও পথে বিভিন্ন আখ্যানের মধ্য দিয়ে তার বিভিন্ন সমাধানের সন্নিবেশ রামায়ণে ঘটেছে।
সনাতন ধর্মদর্শনের সুন্দরতম দিকটি হচ্ছে: এখানে মানুষকে তার নিজের কর্তব্যকর্ম পালনের বিষয়টি সবচাইতে বেশি শেখানো হয়েছে—বার বারই বলা হয়েছে: কর্মই ধর্ম; এবং এ কারণেই অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিষয়ে নাক গলানোর সময় ও সুযোগ কোনোটিই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নেই। নিজের ঘরে নেই কাজ তো পরের ঘরে খই ভাজ!—এমন নীতি সনাতন-ধর্মদর্শনের কোনো মত বা পথই (school of thought) কখনোই সমর্থন করে না। ভিন্ন পথ ও মতকে শ্রদ্ধা ও সহ্য করার দীক্ষাদান সনাতনধর্মের অবিচ্ছেদ্য তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক ভাগ বা অংশ। মানুষ মাত্রেরই পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি কর্তব্য পালন করেই চলতে হয়। এই কর্তব্যগুলি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে, কিন্তু এই সব কিছুরই সামঞ্জস্য বিধান করে সে অনুযায়ী কাজ করার মধ্য দিয়েই প্রকৃতপক্ষে ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে এবং সর্বতোভাবে মানুষের কল্যাণ হয়ে থাকে—এটাই রামায়ণের মহান আদর্শ। রাজধর্ম কী, রাজার সাথে প্রজার সম্বন্ধ কীরকম, গণমতের স্থান কোথায় ইত্যাদি বিষয়ও সেখানে নানাভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
সাধনালব্ধ জ্ঞান ও শক্তি বহুজনের হিতার্থে প্রয়োগ করলেই তা মনুষ্যোচিত হয়ে থাকে—ভোগলোলুপ হয়ে দশদিকের ধনসম্পদ শোষণ ও জনসাধারণের মাঝে দারুণ দুঃখ উৎপন্ন করলে যে-রাক্ষসভাব (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ৯/১২ নং শ্লোকে বিধৃত মর্মের অর্থানুযায়ী) জমাট বেঁধে যায়, রাবণ তারই প্রতিমূর্তি—তার শক্তি যতই প্রচণ্ড ও আড়ম্বরপূর্ণ দেখা যাক না কেন, সেটির পরিণাম কেবল ধ্বংসই। অধর্ম যখন বিরাট মূর্তি ধারণ করে, তখন ভগবান ধর্মসংস্থাপনের জন্য অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। (গীতা, ৪/৭-৮) তাঁর দৈবীস্পর্শে দুর্বল, অশিক্ষিত, নীচ ব্যক্তিও শৌর্যে, বীর্যে, জ্ঞানে ভরপুর হয়ে মহাশক্তি প্রকাশ করতে পারেন।
গীতার শিক্ষা: সত্যপালন ও সে অনুযায়ী আচরণ করতে হলে সংসারের দুঃখ-শোক মাথায় করে নিতে হয় এবং এটিই যে মানুষ হিসেবে কর্তব্য ও ধর্ম—এই আদর্শই রামের জীবনাখ্যানে উজ্জ্বলরূপে পরিস্ফুট হয়েছে। তুলসীদাসজি সত্যপালন ও ভক্তির অতি কোমল-কঠোর মূলসূত্র দিয়ে পরিবার, সমাজ, রাজা ও রাজাধিরাজকে বেঁধে নিয়েছেন। ভগবদ্ভক্তিই মানুষের জীবনে লাভ করার একমাত্র বস্তু, এ দ্বারাই সামঞ্জস্য ও সমতাবিধান সহজ হয় এবং এটা লাভ করলে বিশ্বের সব কিছুই পাওয়া হয়ে যায়।
বিভিন্ন সনাতন শাস্ত্র ও সাহিত্যগ্রন্থে অষ্টসিদ্ধির কথা আছে। অষ্টসিদ্ধি (আটটি জ্ঞান) বলতে বোঝায় আট প্রকারের দৈবজ্ঞান, যা অর্জন করতে পারলে একজন সাধক প্রত্যেক বিষয়েই পরম জ্ঞান লাভ করতে পারেন। গণপতিকে সিদ্ধিদাতা বলে অভিহিত করা হয় এবং গণপতি-ভজনার সময় এই অষ্টসিদ্ধির উল্লেখ করা হয়। ভক্ত তুলসীদাসজি বিরচিত হনুমানচালিসার একত্রিশতম চৌপাঈতে লেখা হয়েছে:
অষ্টসিদ্ধি নবনিধি কে দাতা।
অস বর দীন্হ জানকী মাতা।।
(তুমি অষ্টসিদ্ধি ও নবনিধির শক্তিদান করতে পারো,
যা তুমি বররূপে পেয়েছ জানকী-মাতার কাছ থেকে।।)
অনুবাদ: সীতা-মাতার বরে আপনি অষ্টসিদ্ধি এবং নবনিধির দাতা। (মাতা সীতার বরে হনুমানজি কেবল অষ্টসিদ্ধির ও নবনিধির অধিকারীই (অধিকারী তিনি আগেই ছিলেন) নন, তিনি এই দুই বরের দাতাও; অর্থাৎ হনুমানজির আরাধনায় এই আট সিদ্ধি এবং নয় নিধির প্রাপ্তি ঘটে।)
রুদ্রের অবতার হবার কারণে হনুমান আজন্ম অষ্টসিদ্ধি ও নয় নিধি প্রাপ্তবান ছিলেন। সীতাদেবী তাঁকে আশীর্বাদ করে অষ্টসিদ্ধি ও নয়টি নিধি প্রদানের ক্ষমতা দেন। উল্লেখ্য, সীতাদেবীকে অন্বেষণ করতে হনুমান যখন লঙ্কায় পৌঁছান, তখন তিনি শত্রুশিবিরে প্রবেশ করার জন্য ‘অণিমা’ নামক সিদ্ধির প্রয়োগ করেন। তিনি যখন সীতার সমীপে পৌঁছান, তখন তিনি আবার অণিমা শক্তির প্রয়োগ করে সূক্ষ্মরূপ ধারণ করেন, যাতে সীতা-মাতা তাঁকে দেখে ভয় না পান। আবার ‘মহিমা’ নামক আরেক সিদ্ধি প্রয়োগ করে হনুমান রাক্ষসদের বোকা বানান এবং রাক্ষসসৈন্যদের যুদ্ধে পরাজিত করেন। হনুমান ‘গরিমা’ নামক সিদ্ধিরও প্রয়োগ করেন, যখন তিনি লঙ্কেশ রাবণের সামনে আসার জন্য স্বেচ্ছায় মেঘনাদের হাতে ধরা দেন। বন্দি হয়ে রাবণের রাজসভায় এসে ‘গরিমা’ নামক সিদ্ধি প্রয়োগের উদ্দেশ্য ছিল: পরম শক্তিশালী রাক্ষসরাজ রাবণকে রামচন্দ্রের সেবকের শক্তির প্রদর্শন করানো; রাবণের মনে ভীতির উদ্রেক করানো; তাঁকে এটা ভাবানো যে, প্রভু শ্রীরামের দাসের শক্তি যদি এত হয়, তাহলে স্বয়ং প্রভুর শক্তি কতটা হতে পারে। ‘মহিমা’ সিদ্ধির প্রয়োগ তিনি এমনভাবে করেন যে, পরমবীর রাক্ষসরাজ রাবণ হনুমানের লেজটি ওঠাতেও ব্যর্থ হন।
শাস্ত্রোল্লেখিত অষ্টসিদ্ধি হলো: অণিমা, মহিমা (বা কামাবসায়িতা), গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিত্ব (বা ঈশিতা) ও বশিত্ব (বা বশিতা)। প্রত্যেক সিদ্ধিই প্রকৃতি বা চরিত্রের কিছু কিছু গুণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং যে-সাধক এই আটটি সিদ্ধি আয়ত্ত করতে পেরেছেন, তিনি অষ্টসিদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সকল গুণের অধিকারী হতে পারেন। নীচে এই আট প্রকারের সিদ্ধি সম্পর্কে বলা হলো:
অণিমা: এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হলে একজন সাধক তাঁর নিজের দেহকে ইচ্ছেমতো সংকুচিত করার ক্ষমতা লাভ করেন; তবে অণিমা দ্বারা দেহের আকৃতি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধি প্রাপ্তবান হলে সাধক নিজের দেহকে এমনকী পরমাণুসদৃশ (শূন্য আকার) করতেও সক্ষম হন। এই সিদ্ধির সবচাইতে উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ দেখা যায় রামায়ণের সুন্দরকাণ্ডে, যেখানে সীতামাতাকে অনুসন্ধানের জন্য হনুমান লঙ্কায় প্রবেশ করেন। এ সময় যখন সীতামাতার খোঁজে হনুমান লঙ্কার এদিক-ওদিক ঘুরছেন, তখন তিনি অণিমার প্রয়োগ ঘটিয়ে দেহকে এতটাই সূক্ষ্ম করে ফেলেন যে, লঙ্কার রাক্ষসপ্রহরীরা তাঁকে দেখতে পাননি।
মহিমা: ইচ্ছেমতো বা খামখেয়ালিভাবে যে-কোনো জড়রূপ ধারণ করার ক্ষমতা, নিজের ঐশ্বর্যশক্তি ও তেজশক্তির প্রভাবকে ক্ষমতাবদ্ধ করা—এ ধরনের সিদ্ধি অর্জনকে বলে মহিমা বা কামাবসায়িতা প্রাপ্ত হওয়া। এর সাহায্যে একজন সাধক তাঁর দৈহিক আকৃতিকে বৃদ্ধি করতে পারেন। এই সিদ্ধির প্রাপ্তি না হলে ‘অণিমা’ সিদ্ধির প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয় না, কারণ অণিমা দেহকে কেবলই সংকুচিত করতে সাহায্য করে; আর মহিমার প্রয়োগ করে সংকুচিত দেহ পুনরায় বিরাট করা সম্ভব হয়। রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে লক্ষণ রাবণ কর্তৃক নিক্ষেপিত শক্তিশেলে মূর্ছা গেলে হনুমান মহিমার প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজেকে বিরাটকায় করেছিলেন সঞ্জীবনীবুটি-সহ সুমেরু পর্বতকে নিয়ে আসার জন্য। লক্ষণের জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি এই সিদ্ধির প্রয়োগ ঘটান। হিন্দুশাস্ত্রে মহিমা প্রয়োগের আরেকটি নিদর্শন পাওয়া যায় ভগবান বিষ্ণুর বামন অবতারের বর্ণনায়। রাক্ষসরাজ বলির দর্প-নিরসনের জন্য ভগবান বিষ্ণু বামন রূপ গ্রহণ করেন। রাক্ষসরাজ বলি যখন বামনকে ত্রিপাদ জমি দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, তখন বামন অবতার মহিমা প্রয়োগ করে বিশাল আকার ধারণ করেন এবং স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল তাঁর তিন পদের দ্বারা দখল করে নেন।
গরিমা: এই সিদ্ধি সাধককে তাঁর শরীরের ওজন পরিবর্তনে সক্ষম করে। এর দ্বারা সাধক দেহের ওজনকে স্বল্প থেকে অনেক ভারী করতে পারেন। দেহ এ সময় এতটাই ভারী হয়ে যায় যে, শরীরকে অথবা শরীরের কোনো অঙ্গকে আর নাড়ানো বা সরানো সম্ভব হয় না। শ্রীরামের সেনাপতি তথা কিষ্কিন্ধ্যার যুবরাজ অঙ্গদ যখন রামের দূত হয়ে রাবণের রাজসভায় আসেন, তখন তিনি তাঁর পদকে এমনভাবে রাখেন যে, রাবণের কোনো সভাসদই তাঁর সেই পদকে সরাতে পারেননি। অঙ্গদ তখন গরিমার প্রয়োগ করেছিলেন। গরিমা প্রয়োগের আরেকটি নিদর্শন পাওয়া যায় মহাভারতে। ভীমের শক্তিমত্তা-সম্পর্কিত অহংকার নিরসনের জন্য হনুমান একটি বৃদ্ধ বানরের রূপ ধরে ভীমের যাবার পথ আটকে শুয়েছিলেন। ভীম তাঁর সামনে এলে হনুমান ভীমকে তাঁর লেজ তুলে চলে যেতে বলেন, কিন্তু মহাশক্তিধর ভীম অনেক চেষ্টা করেও ওই লেজ তুলতে ব্যর্থ হন। সে সময়ে হনুমান গরিমা প্রয়োগ করেছিলেন।
লঘিমা: এ হলো গরিমার ঠিক বিপরীত সিদ্ধি। গরিমা ও লঘিমার সম্পর্ক অনেকটা অণিমা ও মহিমার সম্পর্কের মতোই বিপরীতমুখী। লঘিমা সাধকের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এর প্রয়োগে সাধক তাঁর শরীরের ওজন এতটাই হাল্কা করে নিতে পারেন যে, তিনি আকাশে (শূন্যে) উড়তে বা জলের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পর্যন্ত সমর্থ হন। হনুমান এই সিদ্ধির প্রয়োগ করেই সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। হনুমান ছাড়াও অন্যান্য কিছু দেব ও রাক্ষস এই সিদ্ধির প্রয়োগে সক্ষম ছিলেন।
প্রাপ্তি: পূর্বের চারটি সিদ্ধির থেকে প্রাপ্তি পুরোপুরি পৃথক। সাধক এর সাহায্যে যে-কোনো স্থান থেকে যা ইচ্ছে, তা-ই প্রাপ্ত হতে পারেন; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জ্ঞান নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসার শক্তি অর্জন করেন। অণিমা, মহিমা, গরিমা ও লঘিমা দেহের আকৃতি বা ওজনের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু প্রাপ্তি এগুলির সদৃশ নয়। প্রাপ্তি প্রয়োগ করে সাধক তাঁর ইচ্ছেমতো কোনো বস্তু তৎক্ষণাৎ লাভ করতে পারেন । এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা সাধক শূন্য থেকেই তাঁর আকাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভ করতে পারেন। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র (পুরাণ গ্রন্থাদি) পাঠ করলে আমরা অনেক দেব-দেবী আর রাক্ষস-দানবকে দেখতে পাই, যাঁরা এই সিদ্ধির প্রয়োগে দক্ষ ছিলেন; যেমন দেবতাদের আমরা দেখি শূন্য থেকে কোনো বস্তু প্রাপ্ত করে বররূপে ভক্তকে দিতে। আবার রাক্ষসেরা শূন্য থেকে অস্ত্র-শস্ত্র প্রাপ্তি করতেন।
প্রাকাম্য: এটি এমন একপ্রকার সিদ্ধি, যা সাধককে জীবনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, কোনো বাসনা চরিতার্থ করতে এবং কখনও নিরাশ না হবার জন্য শক্তি জোগায়। এ ছাড়াও, এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা সাধক মুহূর্তের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে নিজের ইচ্ছেমতো অন্য কোনো স্থানে গমন করতে ও জলের নিচে বেঁচে থাকতে সক্ষম হন। প্রকৃতপক্ষে প্রাকাম্য সিদ্ধির প্রয়োগ সাধককে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। হিন্দুশাস্ত্রে বহু ঋষি-মুনি, দেব-দেবী, রাক্ষস এবং ‘চিরঞ্জীবী’দের উল্লেখ আছে, যাঁরা এই সিদ্ধি আয়ত্ত করে জলের তলায় জীবন নির্বাহ করতে বা নিজেদের জীবনের দৈর্ঘ্য ইচ্ছেমতো বৃদ্ধি করতে সক্ষম। (‘চিরঞ্জীবী’ হচ্ছেন ‘অমর’দের একটি দল, যাঁরা হিন্দুসাহিত্য অনুসারে ‘কলিযুগ’ নামে পরিচিত বর্তমান যুগের শেষ না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন বলে বিশ্বাস করা হয়।)
ঈশিতা: এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা সাধক প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যে-কোনো স্থানে কিছু অদ্ভুত জিনিস সৃষ্টি করতে পারেন বা তাঁর ইচ্ছে অনুসারে কোনো জিনিস ধ্বংসও করতে পারেন। সৃষ্টিরাজ্যে নতুন কিছুর আর্বিভাব ও পুরোনো কিছুর তিরোভাব করার সিদ্ধি অর্জনকে বলে ঈশিতা। যখন কোনো সাধক এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হন, তখন তিনি তাঁর ইচ্ছেমতো পৃথিবীকে আবর্তিত করতে বা বৃষ্টি আনতে পারেন। ঈশিতা প্রয়োগের দ্বারা প্রকৃতির প্রত্যেক ঘটনা সাধকের ইচ্ছের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। পৌরাণিক হিন্দুশাস্ত্রে আমরা অনেক দেব-দেবীকে দেখতে পাই, যাঁরা এই সিদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে কোনো বৃক্ষের বৃদ্ধি ঘটাতে পারতেন বা বৃষ্টি নামাতে পারতেন।
বশিতা: অষ্টসিদ্ধির অন্তিম সিদ্ধি হলো ‘বশিতা’, যার প্রয়োগের দ্বারা সাধক অন্যের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা মানুষ ছাড়াও মনুষ্যতর জীবেরও মনকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই এই সিদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে বন্য জানোয়ার এবং মানসিক ভারসাম্যহীনদের মনকে বশ মানানো সম্ভব—এমনকী জড় উপাদানগুলিকেও কেবল ইচ্ছে অনুসারেই সাধক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন—সৃষ্টির প্রতিটি জীবকে নিজের বশীভূত করা তাঁর একটি দৃষ্টিপ্রক্ষেপের ব্যাপার মাত্র! ভগবান বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের দ্বারা এই সিদ্ধির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা বশিতা প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্রুদ্ধ জানোয়ার বা মানুষকে শান্ত করেছেন।