আসুন, কিছু কার্টেসি শিখি। "তোমরা কয় ভাই-বোন?" প্রশ্নের উত্তরে কেউ যদি বলে, ওরা দুই/তিন/চার বোন, তাহলে তাকে পালটা "ভাই নেই?" প্রশ্নটা করবেন না। এমন ধরনের প্রশ্ন করাটা একধরনের ছ্যাঁচড়ামো। সে ভাইয়ের কথা উল্লেখ করেনি মানে, তার ভাই নেই, এটা বুঝতে রকেট-সায়েন্টিস্ট হতে হয় না—মিনিমাম লেভেলের আইকিউ থাকলেই চলে, যতটুকু আইকিউ একটা ছাগলেরও থাকে। ওরা হয়তো বোনেরা মিলে সুখেই আছে, আপনার "আহারে, ভাই নেই?"-মার্কা আনস্মার্ট কথাবার্তা ওদের মধ্যে আফসোসের জন্ম না দিলেও বিরক্তির উদ্রেক নিশ্চয়ই করবে। আপনার জন্মই কি হয়েছে লোকজনকে বিরক্ত করার জন্য? কারও বাবা নেই জানতে পারলে "তাহলে তোমরা চলো কীভাবে?" জিজ্ঞেস করাটা রীতিমতো বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে। মহাজ্ঞানী বাঙালি অবশ্য কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে নিজের অজান্তেই বেয়াদবি করে, অন্যকে বিরক্ত করে। কথা হচ্ছে, যদি তার বাবার অবর্তমানে বাবার মতোই সব কিছুর দায়িত্ব আপনি নিজে নিতে না পারেন, তাহলে "বাবা নেই তো চলো কী করে?" জাতীয় প্রশ্ন আপনার মূর্খতারই প্রমাণ দেয়। যেভাবেই চলে চলুক, আপনার বা আপনার বাপের টাকায় তো আর চলে না, তাই না? আপনার এই একটি প্রশ্ন হয়তো ছেলেটি বা মেয়েটির সেই রাতে চরম বিষণ্ণতায় ডুবে যাবার কারণ হবে, যা আপনি জানতেই পারবেন না কখনও। আপনার এই সামান্য প্রশ্নটিই তার মনের ভেতরে বাবা না থাকার অসীম আফসোস ঢুকিয়ে দেবে। হয়তো সারারাত সে কষ্টে ঘুমোতেও পারবে না, যার খোঁজ আপনি জানবেন না। যার জন্য কিছু করতে পারবেন না বা পারলেও করবেন না, তার এই ক্ষতিটা না করলে হতো না? আপনি কি মানুষ? কেউ যদি এখনও বিয়ে না করে থাকে, তবে তাকে "বিয়ে করছেন না কেন?" এবং কেউ বিয়ে করতে দেরি করলে তাকে "কবে বিয়ে করবেন?" জাতীয় প্রশ্ন করা রীতিমতো গোঁয়ারতুমি এবং অনধিকারচর্চা। সে বিয়ে করছে না বলে কি আপনার রতিক্ষমতা কমে যাচ্ছে? না কি নির্লজ্জের মতন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, "বিয়েতে কিন্তু আমাকে দাওয়াত দিতে ভুলো না!"? আপনার পকেটে পয়সা নেই? না থাকলেও অসুবিধে কোথায়? ভিক্ষে করেও তো একবেলার খাবার জোটাতে পারেন। অহেতুক তাকে বিরক্ত করছেন কেন? কেউ বিয়ে করবে কি করবে না, বিয়ে করাটাকে সে আদৌ প্রয়োজনীয় মনে করছে কি না, এসব তো তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাকে বারবার এমন প্রশ্ন করে বিরক্ত ও বিব্রত করছেন কোন যুক্তিতে? না কি আপনার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই? না কি বুদ্ধি আছে ঠিকই, কিন্তু আপনি একটা বেআক্কেল ও বেয়াদব? হয়তো সে কোনো এক ব্যক্তিগত কারণে এখনও বিয়ে করেনি, কিংবা কখনও করবেই না। এমনও তো হতে পারে, বিয়ের প্রতি তার মোটেও আগ্রহ নেই। জীবনটা তো তার, আপনার নয়। সে তার জীবনটা আপনার গ্রামারে না সাজিয়ে তার নিজের গ্রামারে সাজাতে চায়। হতেও তো পারে, বিয়ে করে আপনি যতটা সুখহীনতায় ডুবে আছেন, তার ইচ্ছেই নেই ওরকম করে পরিবারের লোকজনকে খুশি করার জন্য চির-অসুখের জীবন বেছে নেবার! বিয়ে না করে সে মরে যাক, ধ্বংস হয়ে যাক—তাতে আপনার সমস্যা কোথায়? কেউ নিজের পছন্দসই সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়লে তাকে গায়ে পড়ে বেহায়ার মতন "ওমা, বিসিএস দাওনি? সরকারি চাকরিতে যাওনি কেন?" অথবা "ব্যাবসা কেন করছ না? অমুক সেক্টর তো ভালো না, তমুক সেক্টর তো তোমার জন্য সুইটেবল না!" এমন আজাইরা জ্ঞান ঝেড়ে নিজেকে বলদ হিসেবে মেলে ধরবেন না। তার চাইতে বরং চুপচাপ থাকলে, আপনি যে একটা বলদ, এটা কেউ জানতে পারবে না। যার জীবন, তার যাপন। সে আপনার খায়ও না, পরেও না। ব্যক্তিত্ব কী, তা বোঝাটা আপনার জন্য একটু কঠিন হয়ে যাবে জানি; লজ্জা কী, অন্তত তা বোঝার চেষ্টা করুন। লাইফের যুদ্ধটা যেহেতু ওঁর, ডিসিশনগুলোও ওঁর। উনি হয়তো সেই সেক্টরেই বেশ ভালো আছেন, যতটুক ভালো আপনি নিজেও নেই আপনার সেক্টরে। সবার কি আর শুধুই বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য জন্ম হয়? এমনও তো হতে পারে, আপনার এমন মন্তব্য কারও আত্মসম্মানবোধে আঘাত করবে। হতেও পারে, প্রিয় কোনো সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষমেশ তিনি আর পেরে ওঠেননি; সেই না পারার ক্ষতটা আপনি নতুন করে উসকে দিচ্ছেন! উপকার করতে পারেন না, আসেন কষ্ট বাড়াতে, না? অমানুষ কোথাকার! আরে ভাই, মানুষ যেহেতু হয়েছেন, সেহেতু পয়সার পাশাপাশি একটুআধটু মনুষ্যত্ব আর কাণ্ডজ্ঞানও পকেটে রাখুন, দরকারি কয়েকটি এটিকেট মেনে চলুন। আপনার এইসব মূর্খতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা কিছু মানুষের জীবনকে জটিল করে দেয়; বাঁচতে ওদের খুব কষ্ট হয়। আপনি তো বলেই খালাস! সবাই তো আর আজেবাজে কথা হজম বা উপেক্ষা করতে পারে না। পশু এবং মানুষের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেগুলি না জানলে গুগল করে জেনে নিন। সেন্স না থাকলে যেমন মানুষ হয় না, তেমনি কমনসেন্স না থাকলেও মানুষ কখনো কখনো পশুরও অধম হয়ে যায়। পশুতে আর মানুষে এতটুকু পার্থক্য অন্তত রাখুন। আমাদের নলেজ আর সার্টিফিকেটের চাপে পড়ে কমনসেন্স সারাক্ষণই কান্নাকাটি করে। আসুন, কিছু কার্টেসি শিখি। অত শিখতে না পারলেও অন্তত এটা শিখি যে, যা কেউ আমার সাথে করলে আমি কষ্ট পেতাম, তা আমি কারও সাথে কখনোই করব না।