সমান্তরাল

আপনি যে মানুষটিকে পেয়ে অবহেলা করছেন, তাকে পেতে হয়তো অন্য কেউ খোদার কাছে দু-হাত তুলে মোনাজাত ধরে।

বারবার কল করে খোঁজখবর নিচ্ছে বলে যাকে বিরক্ত হয়ে "অ্যাই, বারবার কল করবে না তো! বিজি আছি।" বলে কলটা কেটে দিচ্ছেন, তার একটিমাত্র ফোনকল পেতে কেউ একজন হয়তো অধীর অপেক্ষায় বসে থাকে।

একের পর এক যার মেসেজ সিন করে কিংবা আনসিন ফেলে রাখছেন, টুংটাং মেসেজের শব্দে বিরক্ত হয়ে ভ্রূ কুঁচকে ফেলছেন, তার একটিমাত্র রিপ্লাইয়ের অপেক্ষায় কেউ হয়তো সারাক্ষণই নেট অন করে রাখে, তার কাছ থেকে পাওয়া একটিমাত্র টুং-করে-বেজে-ওঠা মেসেজের শব্দে অন্য কারও হয়তো খুশিতে বুকটা ধক্ করে ওঠে। আপনি যাকে অপেক্ষা করান, সে-ও কাউকে অপেক্ষা করায়।

দিনের পর দিন অবহেলা, অযত্ন সয়েও সে কাছিমের মতন মাটি কামড়ে আপনাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাইত। তারপর একদিন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। একদিকে আপনার পাওয়া অবহেলা আর অযত্ন, অন্যদিকে অন্য কারও দিক থেকে আসা যত্নে আর প্রার্থনায় ধীরে ধীরে মানুষটা বদলাতে শুরু করে। মানুষ, মানুষ বলেই, বদলায়।

বিপরীতমুখী সমান্তরাল দুটি রেখার মতন আপনার প্রতি তার অনাগ্রহ এবং একই সাথে অন্যজনের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে শুরু করে। এই বাস্তব দৃশ্যটি সহ্য করা সহজ নয়।

অযত্নে পড়ে-থাকা ডোবায় হঠাৎ ফুটে-ওঠা জলপদ্মের মতন তার অন্তরেও যত্ন-করা মানুষটির প্রতি কেমন যেন অনুভূতি তৈরি হতে থাকে। ভোরে ঝরে-পড়া শিশিরফোঁটার মতন সে-ও তার দিকে ঝুঁকে যায়। একদিকে আপনার দিকের পাল্লাটি হালকা হতে থাকে, অন্যদিকে সমানুপাতিক হারে ওই মানুষটির প্রতি তার কীরকম যেন একটা মায়া তৈরি হতে থাকে।

রোজ রোজ ইবাদতে দু-হাত তুলে প্রার্থনার ফরিয়াদ একদিন খোদা কবুল করে ফেলেন। দুটি মানুষের ভেতরে ভালোবাসা হয়ে যায়। ফার্স্ট প্রায়োরিটিতে থাকা আপনি মানুষটা একদিন তার জীবনে হয়ে যান নেহায়েত অপ্রয়োজনীয় তৃতীয় কেউ। দূরে সরে যাবার আগে আপনি টেরই পাবেন না যে, ক্রমশ দূরে সরছেন।

এবার সে আপনাকে আর দিনরাত টেক্সট করে না, যখন-তখন ফোন করে যত্ন নেয় না, আপনার কণ্ঠস্বর শুনে তার বুকে শিহরন আর জাগে না।

তারপর, কোনো এক ধবধবে সাদা ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে আপনি চোখে অন্ধকার দেখতে পাবেন, কেননা মায়ের মতন যত্ন-নেওয়া মানুষটার কাছ থেকে ফোনকল কিংবা টেক্সট আর আসে না।

তখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল তপ্ত দুপুরে হাজার মানুষভর্তি উঠোনেও আপনার কেমন জানি বিচ্ছিরি রকমের একা লাগবে, এই অন্ধকার অনুভূতি কাউকে ঠিক বোঝাতে পারবেন না।

কী যেন হারিয়ে ফেলেছেন, কাকে যেন হারিয়ে ফেলেছেন…বুকের ভেতরে হাড়-রক্ত-মাংস-কলজে সবই থাকার পরও নিজের বুকটাকেই আপনার কাছে মরুভূমির মধ্যচর মনে হবে।

তাকে ফেরাতে চাইবেন, সে ফিরবে না। তার কাছে মাফ চাইবেন, সে হেসে জবাব না দিয়ে চলে যাবে। আপনি পেছন থেকে হাঁ করে চেয়ে দেখবেন, আপনার সমস্ত সুখ এক বারও পেছন না ফিরেই হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। যত্নের সুখ এক বার যে পেয়ে যায়, দ্বিতীয় বার অযত্নে সে আর কিছুতেই নিজেকে ফেরায় না। যেখানে ঘরে পালা কুকুর-বেড়ালটাও যত্ন পেলে কোল ছাড়ে না, সেখানে মানুষ তো আরও ভয়ানক রকমের যত্নলোভী।

তারপর একদিন বুঝে যাবেন, আপনি হেরে গেছেন, খুব জঘন্য রকমের বাজেভাবে হেরে গেছেন। মানুষ চলে যায় না বলে এমন নয় যে, সে চলে যেতে পারে না। যার কাছে পুরো পৃথিবীর অর্থ‌ই এক আপনি, সে যখন একদিন চলে যেতে শেখে, তখন দেখবেন, আপনার পুরো পৃথিবীটা হঠাৎ করেই শূন্য হয়ে গেছে।