একজন বাবা-মা হিসেবে আপনার প্রথম যে সাফল্যটা, সেটা আসে তখনই, যখন আপনার সন্তান একজন ভালো মানুষ হয়। সে যদি ভালো মানসিকতার মানুষ হয়, ভালো ভালো চিন্তা করতে পারে এবং তার নিজের সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা অর্জন করতে পারে, তবে সেটাই হচ্ছে বাবা-মা হিসেবে আপনার প্রধান সাফল্য। সন্তানকে পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড করা, এটা কোনও সাফল্যের মধ্যেই পড়ে না। কারণ পরীক্ষা দিলে কেউ-না-কেউ ফার্স্ট-সেকেন্ড হবেই—এটা নিয়ে এত হইচই করার কিছু নাই। আজকের ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়তোবা দশ বছর পর কোনও র্যাংকিং-এর মধ্যেই পড়বে না, তা-ও হতে পারে! আজকে যে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়, হতেই পারে, দশ বছর পর গিয়ে তাকে কেউ চিনবেই না, সে হারিয়েও যেতে পারে। হতেই পারে এরকম। বহু দেখেছি! বহু…বহু! আপনি যখন আপনার সন্তানকে বলেন, 'অমুকের ছেলেটা পরীক্ষায় ফার্স্ট হলো, তুমি কেন হতে পারলে না!', তখন যদি আপনার সন্তান আপনাকে উলটো বলে, অমুকের বাবা/মা আমার বাবা/মা না, আমি তো তার ঘরে জন্মগ্রহণ করি নাই! আমি যদি তার ঘরে জন্মগ্রহণ করতাম, আমি যদি তার সন্তান হতাম, তাহলে আমিও ফার্স্ট হতাম! আপনার মুখটা তখন আপনি কোথায় লুকাবেন, বলুন?! যে ছেলেটা ফার্স্ট হয়েছে, তার বাবা/মা যিনি, আপনি কি সেই বাবা/মা? আপনার ছেলে আপনার ছেলে, আপনার মেয়ে আপনার মেয়ে, তাই না? আপনি কি আদৌ জানেন যে তার বাসায় সে কী কী সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে? আপনি কি জানেন, তার বাবা-মা তাকে কীভাবে গাইডলাইন দিয়েছে? আপনি কী করে শিওর হলেন যে আপনি যেভাবে করে স্টুডেন্টটাকে পড়াচ্ছেন, আপনি যেভাবে করে আপনার সন্তানকে পড়াচ্ছেন, আপনি যেভাবে করে তার শিক্ষাটা দিচ্ছেন, সেটা এনাফ? আপনি কী করে শিওর হলেন, সত্যি করে বলুন তো? আপনি ওসব জানেনই না! কোন অবস্থানে কোনটা এনাফ, কোন অবস্থানে কোনটা এনাফ না---এগুলো তো আপনি কখনোই বুঝতে পারবেন না। তাই এমনও তো হতে পারে, আপনি তাকে যেভাবে গাইডলাইন দিয়েছেন, যেভাবে করে গাইড করেছেন, সেখানে কোনও গলদ ছিল। হতেই পারে! আপনি কেন সব দোষ তার উপর চাপাচ্ছেন, দোষ তো আপনারও থাকতে পারে। হয়তোবা সে ছোটো, তাই আপনার মুখে মুখে কথা বলতে পারে না, ওরকম করে কথা বললে সে মার খায়, আপনি তাকে পেটান বা বকাঝকা করেন, এইজন্য ভয়ে বলতে পারে না। কিন্তু ওখানেও তো একটা ঝামেলা থাকতে পারে; আপনি কী করে শিওর হলেন যে নেই, তাই না? মনে রাখবেন, একটা স্টুডেন্টের ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট হলো, তার বেসিকটা কতটা স্ট্রং, সেটার দিকে খেয়াল রাখা। সে কতটুকু জানে, সে কতটুকু পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, সেটা অধিক জরুরি। তার মানসিক পরিপক্বতা কতটুকু, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সে কতটা ডিসিশন দিতে পারে, সে কতটা অ্যানালিটিক্যালি ভাবতে পারে, সেটা বেশি ইম্পর্টেন্ট। আমি অনেক অথর্ব ফার্স্টবয়কে চিনি, যারা পড়াশোনার বাইরে আর কিছুই জানে না! মিশতে জানে না, কোনও ক্রিয়েটিভিটি নাই, কোনও আউট-নলেজ নাই, বেসিকটাও তেমন স্ট্রং না। সে শুধু ততটুকুই জানে, যা তার ফার্স্ট হবার জন্য জরুরি। আপনার সন্তানকে সেভাবে গড়ে তুলবেন না, সেই ফরম্যাটে গড়ে তুলবেন না। আপনি তাকে সব দিক দিয়ে পারফেকশনের কাছাকাছি নিয়ে যাবার চেষ্টা করুন। সে ফার্স্ট হতে পারল না তো কী হয়েছে?! ভেবে দেখুন তো, যারা আপনার বয়সি, যাদের আপনি দেখছেন আপনার আশেপাশে, তাদের মধ্যে আপনি কাদেরকে সুপিরিয়র মনে করেন? তাদের মধ্যে আপনি কাদেরকে ভালো অবস্থানের মানুষ মনে করেন? যাদেরকে মনে করেন, তাদের মধ্যে কয়জন স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতো? হিসেব করে দেখুন। তাই আপনার সন্তান আজকে কীরকম আছে, সেটা ইম্পর্টেন্ট না। আজ থেকে দশ বছর, পনের বছর, বিশ বছর পরে সে কোথায় কীরকম থাকবে, সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে পৌঁছোতে হলে তাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে, তার মানসিক পরিপক্বতা থাকতে হবে, তার বেসিকটাকে স্ট্রং করতে হবে, তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকতে হবে, তার শারীরিক সক্ষমতা থাকতে হবে, তার কনফিডেন্সটাকে হাই করতে হবে। আপনি আপনার সন্তানকে যদি সবসময়ই অথর্ব বলেন, মূর্খ বলেন, গাধা বলেন, তাহলে কিন্তু তার কনফিডেন্স কমতে থাকবে। যে মানুষটার কনফিডেন্স কম, সে লাইফে কখনও ভালো কিছু করতে পারে না। So confidence is sometimes more important than knowledge. হ্যাঁ, নলেজ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এই কনফিডেন্সটা। সেই কনফিডেন্সটা গড়ে তোলার প্রধান উৎস হচ্ছেন আপনি, আপনারা, সন্তানের বাবা-মা। এই জায়গাটাতে আপনি স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করুন। সে কোথায় যাবে কোথায় যাবে না, তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে কেমন হবে না, সেটা নিয়ে ভাবুন। সে আজকে ফার্স্ট হলো, না কি সেকেন্ড হলো, তা doesn’t matter at all. সবচেয়ে অথর্ব, সবচেয়ে গাধা, সবচেয়ে ব্যর্থ মানুষটাও লাইফে কখনও কখনও ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়ে এসেছে। কী এসে যায়?! ওই ফার্স্ট-সেকেন্ডে তার কাজ কী? ওই ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়াটা, সে বড়ো হলে তার লাইফে কতটুকু প্রভাব ফেলে? আদৌ কি প্রভাব ফেলে? আপনি দেখুন, আপনার সন্তান কি ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং পারে! আপনি দেখুন, আপনার সন্তান সঠিক গ্রামারে লিখতে পারে কি না! আপনি দেখুন, আপনার সন্তান সঠিক স্পেলিং-এ লিখতে পারে কি না! আপনি দেখুন, আপনার সন্তান ম্যাথে ভালো কি না! আপনি দেখুন, আপনার সন্তান বিজ্ঞানে ভালো কি না! আপনি দেখুন, একটা ব্যালেন্সড নলেজবেইজ আপনার সন্তানের মধ্যে আছে কি না! সেইসব আপনি দেখুন। আমি তো মনে করি, স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হবার চাইতে সাঁতার শেখা গুরুত্বপূর্ণ, ফিটনেস ঠিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আমি এটাই মনে করি। কেননা এটাও একটা মানুষের খুব জরুরি দিক। একটা মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে সব দিকেই কিছু-না-কিছু নলেজ থাকতে হয়। সব দিকেই কিছু-না-কিছু ফিটনেস লাগে। শুধুই ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়াটা কোনও ফিটনেসের মধ্যেই পড়ে না। ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া খুব তুচ্ছ একটা বিষয়, যা কেবল পড়াশোনা করলেই হয়। একটা স্টুডেন্টের প্রধান কাজ পড়াশোনা, কিন্তু একমাত্র কাজ পড়াশোনা নয়, আরও অনেকগুলো বিষয় থাকে। আপনার সন্তানটি ফার্স্টবয়, কিন্তু কারও সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না। এক্ষেত্রে হবে কী? এক্ষেত্রে হবে যে, সে বড়ো হয়ে অনেক সুযোগ হারাবে, যেগুলো তার গ্র্যাব করা দরকার ছিল। আপনি তাকে সেটা শেখান। তাকে সেটা শেখানোর পর সে যদি ফার্স্ট-সেকেন্ড হতে পারে, তার যদি ওই লেবেলের নলেজ থাকে, তবে that’s very nice, that’s very good. কিন্তু যদি সেইগুলোকে আপনি নিশ্চিত করতে না পারেন, সন্তানকে শুধুই ফার্স্ট-সেকেন্ড করলেন, তবে অন্যদিক দিয়ে তাকে আপনি পিছিয়ে রাখলেন। It doesn’t mean anything. এটার কোনও মূল্য নাই, এটা কোনও কিছুই মিন করে না আসলে। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখলে আপনারা এই ম্যানিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। সন্তানকে ফার্স্ট-সেকেন্ড করা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাকে ভালো মানুষ, যোগ্য মানুষ, যথার্থ মানুষ, মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তার নলেজটা সব দিকেই ডেভেলাপ করুন, শুধু এক দিকে না। এটা যদি করতে পারি, তাহলে আমরা ভালো একটা জেনারেশন উপহার পাবো। মেধাবী পশু কিন্তু দিনশেষে পশুই থেকে যায়। খুব মেধাবী খারাপ মানুষ হবার চাইতে অল্প মেধাবী ভালো মানুষ হওয়াটা বেশি জরুরি। এটাই আমি মনে করি।