বশির কাকার কুরবানি

 
বশির কাকা। গ্রামের সবচেয়ে খিটখিটে আর কর্কশ মানুষটি। পাড়ার সবাই ওঁকে “পাথর কাকা” বলে ডাকে। গোটা পাড়ায় এমন কোনও মানুষ নেই, যার সাথে কাকার বিবাদ নেই।

জন্মের পর থেকে বশির কাকাকে কেউ কোনোদিনই হাসতেও দেখেনি, কাঁদতেও দেখেনি। ওঁর মা যেদিন মারা যান, সেদিন পাড়া-প্রতিবেশি সবাই এসে কান্নাকাটি করলেও বশির কাকা উঠোনের এককোণে বসে নির্ভার চিত্তে বিড়ি টানতে টানতে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় অল্প মুড়ি আর দুইটা বিস্কুট খেয়ে লুঙিতে গোছা মারতে মারতে অন্যদের সাথে কবর খুঁড়তে চলে গেলেন।

আপনজন বলতে বশির কাকার দুই বোন ছিল। তারা বিবাহিত। কাকা বিয়ে করেছিলেন এককালে। বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে প্রথম বছরই বউটা বাচ্চাসহ মারা যায়। তারপর এত চেষ্টা করেও কেউ বশির কাকাকে বিয়ে করাতে পারেনি।

কাকার হালচাষ করে চলে। সম্পদ বলতে একটাই গরু আছে, সাদাকালো রঙের। বশির কাকার দিনের চার ভাগের তিন ভাগই কাটে ওই গরুর সাথেই। কখনও কখনও বশির কাকা মধ্যরাতে উঠেও গরুর পিঠে হাত বোলাতে থাকেন আর আশপাশ থেকে মশা-মাছি তাড়ান। বড়ো আদরের গরু তাঁর। বশির কাকার গলা খাঁকারি শুনলেও গরুটা বুঝে যায়, হাম্বা হাম্বা ডাকতে ডাকতে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর দু-জন দু-জনকে গলা জড়িয়ে ধরে গর্গর করতে থাকে। বিকেলবেলায় বশির কাকাকে প্রায়ই দেখা যায়, গরুর পিঠে মাথা রেখে দু-জন মিলে নির্বিঘ্নে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
 
প্রতি কুরবানিতেই বশির কাকা গরুটাকে বিক্রি করতে নিয়ে যান। কিন্তু প্রতিবছরই বিড়ি টানতে টানতে আবার ফেরত নিয়ে আসেন বিক্রি না করেই। এভাবে টানা ছয় বার কুরবানির হাটে তুলেও গরুটাকে বেচেননি বশির কাকা। হাতে টাকা নিয়েও আবার টাকা ফেরত দিয়ে গরু নিয়ে চলে এসেছেন।
 
পাশের বাড়ির জসিম মিয়া। বেশ পয়সাকড়ি কামান। এ বছর বশির কাকার মোটাতাজা গরুটাকে দেখে ভালোই লোভ হল তাঁর। দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনতে চাইলেন। বশির কাকারও ভীষণ টাকার দরকার পড়ে গেল এ বছরই। কিছু না ভেবেই বড়ো আদরের গরুটা বেচে দিলেন জসিম মিয়ার কাছে।
 
বিক্রির পর থেকে প্রতিদিনই বশির কাকা জসিম মিয়ার বাড়িতে গিয়ে গরুটাকে খাইয়ে আসেন, বশির কাকা ছাড়া ওই গরু আর কারও হাতেই খায় না। খাওয়াতে গিয়ে কখনোবা রাতে গরুটার সাথেই একসাথে ঘুমিয়ে পড়েন কাকা।
 
বশির কাকাকে আসতে দেখলেই গরুটা লেজ আর কান খাড়া করে কাকার দিকে ছুটে যায় যতটুক যাওয়া যায়। তিড়িংবিড়িং করে নাচতে থাকে সে। কাছে এলেই জিহ্বা দিয়ে বশির কাকার সারামুখ-গা চাটতে থাকে। বশির কাকার আসতে একটু দেরি হলেই গরুটা হাম্বা হাম্বা করে চিৎকার করতে থাকে।
 
পাথরের মতো শক্ত যে মানুষটার সাথে কোনও কাকপক্ষীরও মিলমহব্বত নেই, সেই পাথরমানবের জন্য একটা জন্তু অধীর হয়ে অপেক্ষা করে থাকে। যে মানুষটা কারও মরামুখও দেখতে যায় না, সে মানুষটাই একটা গরুর মুখ না দেখে এক দিনও থাকতে পারে না। এমন গভীর ভালোবাসা অসীম কষ্ট দেবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
 
কুরবানির আগের দিন রাত থেকে বশির কাকা গরুটাকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। সারারাত তিনি ঘুমাননি। পরম আদরের গরুকে জড়িয়ে ধরে সারাগায়ে-মুখে বার বার চুমু খেয়েছেন।
 
সবাই ধরেই নিল, বশির হুট করে বলে বসবে, গরু আমি বেচব না। এই নেন টাকা। অবশ্য আগে থেকেই জসিম মিয়া বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, গরু আমি কিছুতেই ফেরত দেবো না, বশির…সে যত যা-ই করিস তুই!
 
কুরবানির দিন যখন গরু কুরবানি করতে নিয়ে যাবার জন্য রশি খোলা হচ্ছিল, তখন বশির কাকা জসিম মিয়ার হাতটা খপ করে ধরে লুঙির গোঁজের ভেতর থেকে টাকা বের করে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, গরু আমি বেচব না, ভাই! আমার গরু আমারে দিয়ে দেন, আমি চলে যাই। এই অবলাটা ছাড়া আমার আর কেউই নাই, ওরে ছাড়া আমি বাঁচতে পারমু না, ভাই! ও যে আমার সন্তান!...বলেই  হু হু করে ডুকরে কেঁদে উঠে জসিম মিয়ার পায়ের কাছে বসে পড়লেন।
 
সবাই স্তম্ভিত হয়ে দেখল, যে মানুষ কখনও কারও কাছে নত হয়নি, যে মানুষ কখনও কারও পাশটাও ঘেঁষে না, সেই দুর্মুখ মানুষটাই আজ একজনের পা ধরে বসে আছে…তা-ও একটা গরুর জন্য!
 
যতই গরুটার হাত-পা বাঁধা হচ্ছে, বশির কাকার বিলাপ ততই বেড়ে যাচ্ছে, আর ততই গরুটা আকুল হয়ে বশির কাকার দিকে ছুটে আসতে চাইছে। পুকুরে ডুবে যেতে যেতে মানবশিশু যেমনি দু-হাত তুলে বাবাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকে, তেমনি গরুটাও ছলছল মায়াভরা চোখে বশির কাকার দিকেই অপলক চেয়ে আছে…যেন ওই জলভরা চোখদুটো চিৎকার করে বলছে, বাবা, ও বাবা, আমাকে বাঁচাও, আমাকে কাছে নাও…!
 
বশির কাকা হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে গরুটার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখন তাঁর আর কিছুই করার নেই, চোখের সামনে ভালোবাসার ধনকে হারিয়ে যেতে দেখা ছাড়া!
 
সে-বারই প্রথম বশির কাকাকে সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছে। সে-বারই প্রথম সবাই বুঝেছে, বশির কাকা পাথর নন, তাঁরও জলের ধারার মতন নরম একটা মন আছে, যা হয়তো তিনি কাউকে কখনও দেখাননি।
 
কেউ হয়তো তাঁর ততটা কাছের হতে পারেনি, যতটা হয়েছিল সেই আদরের গরুটা। কাউকে হয়তো তিনি ততটা ভালোবাসেননি, যতটা বেসেছিলেন একটা অবলা প্রাণীকে। মানুষ যাকে সত্যিই ভালোবেসে, চোখের সামনে তাকে হারিয়ে যেতে দেখলে সে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না, তখন বুক ফেটে প্লাবনের মতো কান্না আসে।
 
সেদিনের পর অনেক বছর কেটে গেছে। খোদা বশির কাকার অত বড়ো কুরবানি কবুল করছেন কি না জানা নেই। তবে আজও মধ্যরাতে গোয়ালঘর থেকে বশির কাকার হু হু বিলাপ ভেসে আসে। আজও মাঝে মাঝে ভরদুপুরেও হঠাৎ হঠাৎ মাথানিচু করে বশির কাকাকে চোখ মুছতে দেখা যায়।
 
বড়ো বিচিত্র জিনিস এই ভালোবাসা, পাথরকেও কাঁদিয়ে ছাড়ে! বছরের পর বছর কেটে যায়, ভালোবাসা তবু মৃত মায়ের ছবির মতো হৃদয়ের দেয়ালে শক্ত করে লেপটে থাকে।