স্যার, ক্লাস নাইনে পড়ার সময় যখন রবি ঠাকুরের 'দেনাপাওনা' পড়লাম, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, ইনি কে? এত সুন্দর গল্প মানুষ লিখতে পারে! পরে স্যার ওঁর লেখা পড়তে শুরু করলাম। যেখানেই যা পেতাম, পড়ে ফেলতাম। একদিন পড়লাম, 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।' ভেবে দেখলাম, কথা তো সত্য। আমরা কেউই তো মরতে চাই না, সবাই বাঁচতে চাই। কিন্তু কেন বাঁচতে চাই? এক চালের দাম বাড়ানো বাদে বেঁচে থেকে কী হয় আসলে? রবি ঠাকুর অমন কথা লিখতেই পারেন। উনি বেঁচে ছিলেন বলেই আজ আমরা এত কিছু পেলাম। মন ভালো থাকলেও রবীন্দ্রনাথ, মন খারাপ হলেও সেই রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আমার মতন এমন সামান্য একজন মানুষের বেঁচে থেকে কী হয় আসলে? উত্তরটা কোথাও পেলাম না, স্যার। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বললেন, 'বাবা, বড়ো মানুষের কাছাকাছি থাকিস। ওঁদের স্পর্শ পেলেও শরীর থেকে কিছু পাপ দূর হয়।' শুনে ভাবলাম, এটা তো আমার উত্তর হলো না। আমি বেঁচে আছি কেন? এ পৃথিবীতে আমার কী কাজ? বড়ো হতে থাকলাম। পড়াশোনা বিশেষ করতে পারিনি, স্যার; তবে অনেক বই পড়েছি, গান শুনেছি। মা ভাটিয়ারী শুনতেন, আমি শুনতাম রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি। পরে পরে এক কাকার সঙ্গে মিশে গজল শুনতে শুরু করি। কাকা আধুনিক গানও শুনতেন। আমার পছন্দের তালিকায় ঢুকে পড়ল রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, আধুনিক গান, পুরনো হিন্দি গান, উর্দু গজল। গান শুনতে শুনতে রীতিমতো নেশাগ্রস্ত হয়ে যেতাম। আজও গান না শুনলে রাতে আমার ভালো ঘুম হয় না। প্রতিদিনই একটা বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা না পড়লে নিজের মধ্যে কেমন জানি পাপবোধ কাজ করে। মা বলেছিলেন, বড়ো মানুষের কাছে থাকতে। আমি স্যার কাছে থেকে দেখেছি, বড়ো মানুষ বই পড়ে, ভালো গান শোনে। আমার কোনও দুঃখ নেই, স্যার। গানের মধ্যে আমি সব দুঃখ রেখে দিই। বাড়িতে গেলে একা একা থাকি। সবার সঙ্গে মিশি না। যার কাছ থেকে কিছু শেখার নেই, যার সঙ্গে মিশলে মন খারাপ হয়, যার মন ছোটো, এইসব মানুষের সঙ্গে মিশে আমি কী করব, যদি সে আমার বাবাও হয়? আমি তাই একা একা থাকি, নিজের কিছু গরু-ছাগল আছে, সেগুলি নিয়ে মাঠে চরাতে যাই। সঙ্গে একটা বই থাকে, বেশিরভাগই নিই রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই। আমি বই পড়ি, মনের সুখে গান গাই, মোবাইলে ঢুকে ইউটিউবে গান শুনি। গরু-ছাগল ওদের মতো করে চরতে থাকে। মানুষ ভালো কাজে বাধা দেয়, গরু-ছাগল কখনও বাধা দেয় না, স্যার। আমার কোনও অভাব নেই, আমি শান্তিতে আছি। আমি তো এখন বুঝতে পারি, আল্লাহ্ আমাকে বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ দেননি যদিও, তবু একটা চাকরি তো দিয়েছেন। আমি তো কিছু করে খেতে পারি। আমি তো ভালো আছি, শরীরে কোনও রোগও নেই। আমার স্ত্রী, আমার তিন ছেলে-মেয়ে সবাই তো ভালো আছে, স্যার। কত কত মানুষ বড়ো বড়ো সার্টিফিকেট পায়, কিন্তু একটা চাকরি পায় না। আমার তো অনেক কিছুই পেয়েছি জীবনে। এদেশে সার্টিফিকেটের কোনও অভাব নেই, এক চাকরিরই অভাব। ঠিক না, স্যার? এখন আমিও বলতে পারি, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। আমি খুব বেশি মানুষের জন্য কিছু করতে না পারলেও কিছু মানুষের জন্য তো করি, স্যার। আমি বেঁচে না থাকলে ওদের কী হবে? আমি মরে গেলে গান কীভাবে শুনব? এত সুন্দর সুন্দর গান! আমার মৃত্যুর পর আমার লাশের পাশে যেন রবীন্দ্রসংগীত বাজে, এটাই আমার শেষইচ্ছা। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, স্যার। গ্রামে আমার ছোট্ট একটা ঘর আছে, হাঁস-মুরগি ডিম পাড়ে, খেতখামার আছে, গরু দুধ দেয়, কবুতরও পালি, স্ত্রী আমাকে নিয়ে সুখী, ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে; ছোটোখাটো হলেও তো আমি একটা চাকরি করি, স্যার! আবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, একদিন ইন্টারমেডিয়েটটাও পাশ করে ফেলব যদি সুস্থ থাকি আর আল্লাহ্ চান। এর বেশি মানুষের কী লাগে, স্যার? একজীবনে মানুষ কতটা খায়? স্যার, যখন মানুষজনকে ধনসম্পত্তির জন্য কামড়াকামড়ি করতে দেখি, তখন অবাক হয়ে ভাবি, আহারে, ওরা কত গরিব! অনেককে আবার দেখি, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। কী যে বিরক্ত লাগে, স্যার! আল্লাহ্ নিশ্চয়ই ওদের দেখে নিজেও বিরক্ত হন। ইসলাম শান্তির ধর্ম, আমার উচিত শান্তির পথেই থাকা, মানুষকে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করা। এটাই বেসিক কাজ। এটা যদি না করি, যত যা-কিছু চেঁচাই না কেন, বেহেশতে যেতে কোনোভাবেই পারব না। আমি যেমনি আমার ধর্ম ধারণ করি, আপনিও তো স্যার আপনার ধর্ম ধারণ করেন। আপনার মায়ের পেটে আমার জন্ম হলে কিংবা আমার জন্মের পর আপনার মায়ের পাশে আমাকে রেখে আসা হলে আমার নামটা সৈয়দ না হয়ে কোনও একটা হিন্দুয়ানি নামই হতো। তাই আমি কীভাবে বলি যে, অন্য সব ধর্মই ভুল? আমরা নিজেরা ভুল হতে পারি, কিন্তু ধর্ম তো সব একই, সব ধর্মই তো মানুষের মঙ্গলের কথা বলে। আগে স্যার মানুষ হতে হবে, তার পরে অন্য কিছু। আমি যতক্ষণই অফিসে থাকি, ততক্ষণই আমার রুমের সামনে মৃদু আওয়াজে সারাক্ষণ গান বাজতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, হেমন্ত-মান্না-কিশোর-লতা-আশা-আরতি-সন্ধ্যা প্রমুখের আধুনিক গান, পুরনো হিন্দি ক্লাসিক, উর্দু গজল। কী যে ভালো লাগে, লিখে বোঝাতে পারব না! গান-নির্বাচনের এত উঁচুমানের রুচি দশ বছরের চাকরিজীবনে খুব কম সহকর্মীর মধ্যে দেখেছি। সৈয়দের জন্য আমার সময়টা ভালো কাটে। ওঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তবে হ্যাঁ, ওঁর একটাই দোষ…চা-কফিতে চিনি বেশি দেন, বললেও মনে রাখতে পারেন না। মাঝে মাঝে আমি সৈয়দকে রুমে ডেকে গল্প করি। ওঁর কাছ থেকে অনেক শেখার আছে। উনি বলতে থাকেন, আমি চুপ করে শুনতে থাকি। শরীরে একধরনের শিহরন জাগে শোনার সময়। জীবন থেকে শেখা নানান কিছু সৈয়দ বলতে থাকেন। আমি চুপ করে শুনি, জীবনদর্শন শিখি। আমাকে উনি ভালোবাসেন, কেননা আমি লিখি, আমি অফিসের কাজ আর পড়াশোনার মধ্যেই ডুবে থাকি, কারও সঙ্গে কখনও বাড়তি গল্প-গীবত করি না। এটাই নাকি ওঁর মায়ের নির্দেশ। মায়ের সেই নির্দেশটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সৈয়দ আর কিছু পান না পান, জীবনে অনেক শান্তি পেয়েছেন, অনেক অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। 'স্যার, বই পড়ে যা পাওয়া যায়, বই না পড়ে তার চাইতে অনেক বেশি কিছু পাওয়া যায়, যদি বড়ো মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগটা গ্রহণ করি।' তবু সৈয়দ বই পড়েন; মাঝে মাঝে আমি রুমের গ্লাসডোর দিয়ে তাকিয়ে দেখি, গান শুনতে শুনতে সৈয়দ খুব মন দিয়ে বই পড়ছেন। আজ সৈয়দের কণ্ঠে পর পর দুটো গান শুনলাম। আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী... আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী... সত্যি বলছি, এত অপূর্ব রবীন্দ্রসংগীতের গলা অনেক নামকরা শিল্পীরও থাকে না। আমি শুনছিলাম চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে রেখে...মনে হচ্ছিল, আমার সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে-মুছে দূরে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে... সত্যিই, আমরা যা জানি কিংবা বুঝি, তা ভুলে গেলেও যেতে পারি। তবে আমরা যা অনুভব করি, তা কখনওই শরীর-মন থেকে চলে যায় না, খুব স্পষ্ট করে থেকে যায়।