দেখতে আমি একেবারেই সুশ্রী নই। মানে, সাধারণভাবে সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তা আমি একেবারেই নই। আর মাঝেমধ্যে তা-ও যদি একটু ওই দেখবার যোগ্য হইও-বা, সে-ও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, তারপর আরকি! তো এ নিয়ে মাঝে মাঝে একটু কষ্ট হলেও, রাগ হলেও, আক্ষেপ করি না। ভগবান যেটুকু দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেছেন, সেটুকুই দিয়েছেন। সবাইকেই তা-ই দিয়েছেন। তাই এ নিয়ে তাঁর সাথে আমি কখনও কখনও ঝগড়াঝাঁটি করলেও, পরমুহূর্তেই আবার ক্ষমা চেয়ে ঠিক করে নিই। তবে আমার এই সুন্দরী না হবার কারণে আমি জীবনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। শিখেছি, কখনও একটু ভালো দেখতে লাগে, আবার কখনও দেখবারও অযোগ্য হয়ে যাই, শুধু দেখতে এরকম বলে। আমি যখন একটা ভালো ছবি আপলোড করি বা একটু ভালো দেখতে লাগে আমাকে সাময়িকভাবে, তখন, এই কিছুদিন আগেও যখন আমি এর তুলনায় খারাপ দেখতে ছিলাম, তখন যে মানুষটা আমাকে দূরছাই দূরছাই করত, সেই মানুষটাই আমাকে ওই একটু অপেক্ষাকৃত ভালো ছবি আপলোড করবার পরে, আমি খেয়েছি কি না, এর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলবার পরেও নাকি ‘হুম’ লিখে রিপ্লাই করে। ভাবা যায়! আসলেই হাসি পায় এদের এমন কাণ্ডজ্ঞান দেখলে। আরে ভাই, মানুষটা তো আমি একই, আর তুমিও মানুষটা একই! আমার সাথে যদি সেই তুমিই এমন বার বার গিরগিটির মতো রং বদলাতে চাও, তাহলে আমি কী বুঝে নেবো, এইটুকুও তোমরা কেন বোঝো না? এই শ্রেণিতে কিন্তু মৌসুমি প্রেমিকদের দল না শুধু, অনেকেই আছে। এমন অনেক আত্মীয়স্বজন, পরিচিত লোকজন, অভিভাবক গোছের কেউ কেউ, বন্ধুবান্ধব (অবশ্য এদের আসলে মুখোশধারী বলাই ভালো), এমনকি কপালদোষে অনেক সময় নিজের বিয়ে-করা বরও থাকে! এসব মানুষকে আমি কখনও কিছুই বুঝতে হয়তো দিই-ই না! আমি আমার কর্তব্যটুকু করে যাই। তবে ওদের মনে ঠাঁইও দিই না। বের করে দিই সোজা। ঝগড়া ঝামেলা বিবাদ করছি না বলে যে ওদের ভালোবাসছি…এটা ভাবাটা বিরাট একটা ভুল! তবে তার পরেও কিছু মানুষ থাকেন, যারা আমাকেই কেবল আমি বলেই মূল্যায়ন করেন। যদিও ওঁদের সংখ্যাটা হাতেগোনা! তাতে কী! দুষ্ট গরুর চেয়ে আমার শূন্য গোয়ালই ভালো! আমি এখন অনেক স্ট্রিক্ট একজন মানুষ হয়ে গিয়েছি। এটা হবার জন্য আমার জীবন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমার ঈশ্বরের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমার জীবনটাকে এরকম কিছু অপূর্ণতা, কখনও কিছু প্রাপ্তি এবং যুগপৎ কখনও কিছু অপ্রাপ্তি না দিলে হয়তো জীবনটাকে এতটা ভালো করে বুঝতামই না। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই মুখোশধারী মানুষগুলোকে চিনতাম না। তবে এটা অবশ্যই ঠিক, প্রত্যেকটা মানুষের মতো আমিও নিজেকে পরিপাটি, ফিটফাট এবং আমাকে আমার মতো করে সুন্দরী দেখতে পছন্দ করি। তার জন্য আমাকে আমার নিজের যতটুকু যত্ন নিতে হয়, নিই; চেষ্টা করতে হয়, করি। কিছুদিন ওসব রুটিনমাফিক হয়, ফিট থাকি, আবার দেখা যায়, তাল মেলাতে পারি না। তখন আবার সব শুরু থেকে শুরু করতে হয়। তবুও আমি নিজের মতো করে ভালো থাকি। এতে আমার আত্মবিশ্বাসটা বাড়ে। তাই আমি এভাবেই আমার নিজেকে পরিপাটি দেখতে চাই। কোনওভাবেই অন্য কোনও মানুষের কাছে নিজেকে ইমপ্রেসিভ করে তুলতে একেবারেই নয়, বরং নিজের কাছেই নিজেকে ইমপ্রেসিভ করে তুলতে এমন পরিপাটি থাকতে চাওয়া। আমি সুন্দরী নই, এটাতে যেমনি আমি স্পষ্টভাষী, তেমনি আমি স্মার্ট, এটুকু আত্মবিশ্বাসও আমার রয়েছে। আমাকে দেখে একটা মানুষের ভালো লাগবে না, এটা যেমনি জানি, তেমনি আমার সাথে কথা বললে বা আমাকে বুঝলে আমাকে ভালো লাগলে লাগতেও পারে, এটুকুও আমি নিশ্চিতভাবে জানি। না, একেবারে আত্মাভিমানে ফুলে ফেঁপে অহংকার আমি করছি না। যেটা সত্য, সেটাই বললাম। আপনারা আমাকে মূল্যায়ন করেন নিজেদের ইচ্ছেমতো, আর আমি নিজে আমাকে মূল্যায়ন করলেই দোষ ধরেন! আপনি আর আমি তো একই মানুষ! আমাকে আমার চাইতে ভালো আর কে চেনে! অথচ দেখুন, সেই আমায় নিয়ে আমার চাইতে আপনাদেরই চর্চা করার অধিকার অনেক বেশি! অদ্ভুত না ব্যাপারটা? আমি নিজের ঢাক নিজে পেটাই! আরে বাবা, নিজের ঢাক নিজে না পেটালে অন্য কেউও পেটাবে না। তবে হ্যাঁ, ফাঁকা কলসি বাজে বেশি, এমন হওয়াটা নিশ্চয়ই বিপদজনক। তবে তাই বলে নিরীহ ভদ্রলোক হয়ে আত্মসম্মান বা আত্মরক্ষাটুকুও করব না…এত লক্ষ্মীমন্ত মেয়েও আমি নই। হ্যাঁ, কথায় না বলে কাজে করে এর জবাব, আমি মনে করি, দেওয়াটাই শ্রেয়। আমি সৎ, সঠিক পথে পরিশ্রমী আর আত্মবিশ্বাসী হলে, সঠিক সময়ই সব উত্তর দিয়ে দেবে। বিউটি, স্মার্টনেস, পারসোনালিটি কখনওই এক ব্যাপার নয়! আমি কষ্ট একটু হয়তো পাই আমার বিউটি নেই বলে, তবে হাজার গুণে বেশি তার থেকে খুশি হব, যদি আমি আমার মধ্যে স্মার্টনেস আর সাথে একটা স্ট্রং পারসোনালিটি বিল্ডআপ করতে পারি। স্মার্টনেস জিনিসটা গায়ের রং আর চেহারায় হয় না। এটা যার মধ্যে থাকে, তাকে দেখলে ও মিশলে অনুভব করা যায়। হ্যাঁ-কে হ্যাঁ, না-কে না, পাপকে পাপ, ভালোকে ভালো কোনও রকমের শর্ত ছাড়া বলতে পারার ক্ষমতা থাকা চাই। নিজের কাছে সব কাজের জন্য পরিষ্কার থাকা চাই, তবে অবশ্যই সেটা, নিজের পক্ষেই যায়, এমন কোনও বানোয়াট যুক্তি দাঁড় করিয়ে নয়, যদিও অমন করাটাই হিউম্যান-নেচার। তবে এটাকে অতিক্রম করতে হবে। অন্যায় করলেও সেটা স্বীকার করার সৎসাহস রেখে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তার পুনরাবৃত্তি আটকানোর চেষ্টা করতে হবে। তার পরেও তো কথা আছেই। নিয়তি এবং অনেক ব্যাখাতীত ঘটনা থাকেই, যেগুলি ওসব হিসেবের বাইরে। তবুও বাস্তববাদী হতেই হবে। আবেগ এবং স্বপ্নকে বাস্তবতার সাথে সঠিক সমন্বয় করতে পারা না-পারার খেলাই হলো জীবন। জীবনের নাটকীয়তায় নিজের প্রকৃত অস্তিত্বকে খুঁজে পাওয়াটা একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। তবে আমি সুন্দরী নই বলে একেবারে সৌন্দর্যের বিরুদ্ধেই একতরফা স্লোগান গাইছি, ব্যাপারটা তা নয় কিন্তু! শুধু এই তথাকথিত সৌন্দর্য, যা পুরোপুরিই বাহ্যিক, তা নিয়ে কিছু রঙ্গতামাশার কথা বললাম আরকি! মনের সৌন্দর্য নিয়ে লোকে ভাবে না অত। যে দু-একজন ভাবে, তারা নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ নয়। এই সৌন্দর্যের সংজ্ঞা সাধারণের কাছে একরকম, আর অসাধারণের কাছে আরেক রকম। তবে এই অসাধারণের সংখ্যা এখন হাতে গুনে বলা যায়, এমনই হয়ে গেছে অনেকটা। যদিও লেখক কিংবা বক্তা হবার ছলনায় সবাই অসাধারণ হয়ে ওঠে আরকি! সত্যি বলতে কী, এই চাইল্ডিশ বিহেভিয়ারটা এই মডার্ন সিভিলাইজেশনে এসে আসলেই বেমানান! আমি এটা বলছি না যে আগে দর্শনধারী তার পরে গুণবিচারী হওয়াটা পাপ! তবে তাই বলে সুযোগসন্ধানী হওয়াটা কি ঠিক? গিরগিটির মতো রং বদলে কি আর মানুষের দলে থাকা যায়! না হলেন প্রকৃত গিরগিটি, না হলেন প্রকৃত মানুষ! তবে দিনশেষে আপনি হলেনটা কী? আমি নিজেও তো তথাকথিত অনেক সুন্দর এবং সুন্দরীকে দেখি, তাই বলে ওই তথাকথিত অসুন্দরকে অসম্মান যে করি, তা তো নয়! কিংবা তাদেরকে তাদের গুণ নয়, বরং সো-কল্ড সৌন্দর্য দিয়ে বিবেচনায় আনছি, তা-ও তো নয়! হতে পারে, আমি সুন্দরী নই বলেই অমনটা করছি না! তবে হ্যাঁ, সত্যিই আমি তথাকথিত সুন্দরী নই! পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদাভাবে সুন্দর। শুধু জহুরির চোখ থাকতে হয় তাকে খুঁজে নেবার জন্য। মনের সৌন্দর্যই বড়ো সৌন্দর্য। অবশ্য আমি যাদেরকে উদ্দেশ্য করে লিখলাম এটা, তাদের পক্ষে এসব বোঝা সম্ভবই নয়। কারণ বোঝার মতো মনটাই তাদের নেই। শিক্ষিত হলেই স্বশিক্ষিত হওয়া যায় না! আবার শিক্ষা ছাড়া মূর্খতাও রোধিত হয় না। সব কিছুরই সঠিক সমন্বয়টা বড্ড প্রয়োজন! পরিপূরক হবার এটাই প্রধান শর্ত! গণিত বলতে শুধু গণিতই বোঝায় না, জীবনকেও বোঝায়। শুধু বোঝার ক্ষমতা তৈরি হতে হয় মনের মধ্যে। কে কী বলল না বলল, এত ধার আমি বরাবরই ধারি না। শুধু যে মানুষগুলো আমার কাছের এবং যারা সৎ, তাদের কথা ছাড়া। আর ওসব মুখোশধারীর কথা আমলে আনার তো প্রশ্নই আসে না! একটা কথা আছে---সমালোচনা যদি সত্যি হয়, তবে শুধরে নাও। আর যদি তা প্রকৃত অর্থেই নিন্দাপ্রচার হয়, তবে তা ইগনোর করো। কাউকে সম্মান দিতে পারা না গেলেও বিনা কারণে বা বিনা অপরাধে তাকে অসম্মান করবার কোনও অধিকার কারও নেই। কারও উপকার করতে পারা না গেলেও তার ক্ষতি করা ঠিক নয়। এসব কথা কাউকে বোঝাতে হলে যদি গলা তুলতে হয় তো…হ্যাঁ, আমি গলা তুলেই তবে কথা বলব। আমি সুন্দরী নই, তা বলে আমি আনস্মার্ট নই! নিজের আত্মসম্মানটুকু অন্তত কোনও ভুল মানুষের কাছে বিকিয়ে দেবো না, এটুকু আত্মবিশ্বাস ভগবান আমার সাথে করে দিয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন! আমি এজন্য সত্যিই ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ। এমনি এমনি তো আর একথা বলা হয় না---যা হয়, ভালোর জন্যই হয়! ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন।