আমরা এখন খুব গরীব। আমাদের পকেটে পয়সা আছে, সে পয়সা খরচ করবার কোনও উপায় নেই। আমাদের হাতে সময় আছে, সে সময় ইচ্ছেমতো খরচ করবার রাস্তা নেই। ভেবে দেখুন, আজ আমাদের দারিদ্র্য কোথায় এসে ঠেকেছে! আমাদের একটি টাকাও নিজেদের খুশিমতো খরচ করবার সামর্থ্য আজ আমাদের নেই। হঠাৎ করেই, আমরা এতটাই গরীব হয়ে গিয়েছি! আমাদের এখন অবসর আছে, সে অবসরে আমরা বড়োজোর পাশের রুম থেকে একটু ঘুরে আসতে পারি। আমাদের ঘরের জানালায় যে পাখিটা এসে প্রতিদিন বসে, ওকে আমরা আগে কখনও দেখিনি। আমাদের বারান্দায় প্রতিদিনই কোত্থেকে যেন কয়েকটি শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ে। বাড়ির কাজের মাসিই এতদিন তা দেখতেন। আজ উনিও ছুটিতে, আমরাও ছুটিতে। অতএব, সেই মড়মড়ে শুকনো পাতার শরীর আমাদের হাতের তালুতে আমরা ক্রমাগত পিষে চলেছি। এর নাম ক্রোধ নয়, অভিমান নয়; এর নাম অসহায়ত্ব, কিংবা অখণ্ড অবসর। আমরা আজ বুঝতে পারছি, বেঁচে থাকতে হলে কখনও কখনও কবিতা পড়তে জানতে হয়, গান শুনতে জানতে হয়, সিনেমা দেখতে জানতে হয়। এসব আমাদের কেউ কখনও বলেনি। কেন বলেনি? একটাই কারণ: আমরা যে গরীব! গরীবদের সব জানতে নেই। আজ আমরা বিশ্রাম নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকাটাও যে একটি কাজ, তা আমাদের মাথায় আগে কখনও আসেনি। আমাদের অবুঝ শিশুটি, যার কাছে বহুদিন ধরে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি ভেঙে চলেছি নানান ব্যস্ততায়, সে হঠাৎ হঠাৎ আমাদের রুমের দরোজায় উঁকি মেরে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ফিক্ করে হেসে ওঠে! যদিও ওর চোখে-মুখে ইচ্ছেপূরণের খুশি, তবু আমাদের ভেবে নিতে ভালো লাগছে, আহা, আমার সন্তানের হাসি! …এর বেশি কিছু আমরা আপাতত ভাবছি না। দুঃসময়ে বেশি ভাবা বারণ। এই সময়টা একদিন আরেকটা সময়ের মধ্যে ঠিকই মিশে যাবে। সেদিন আমরা প্রিয় শহরটাকে আবারও ধুলোয় এবং হইহুল্লোড়ে ভরিয়ে দেবো। আমাদের চলার পথে পথে কিছু আলো, কিছু অন্ধকার ছড়িয়ে থাকবে, এবং আমরা পুরনো অভ্যস্ততায় বলে উঠব, বাঁচতে আর ভালো লাগে না! অথচ দেখুন, যে মানুষটি জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে হয়ে আত্মহত্যা করে চলছিল অনেক দিন ধরেই, সেই মানুষটি পর্যন্ত আজ মৃত্যুভয়ে কেমন কুঁকড়ে আছে!