আলো নেভার পর (প্রথম অংশ)

আমি মানুষের মতো করে বাঁচতে চাই। একটা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন চাই। মানুষের অপমান আর নিতে পারছি না। আমার প্রায়ই মরে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, বাঁচতে হওয়ার চাইতে বড়ো শাস্তি আর হয় না।

আমার ছোটবেলাটা আর পাঁচজনের মতো ছিল না। সবার থেকে আমার কপালটা ভিন্ন হওয়ায় আমি এই সমাজের কাছ থেকে শুধুই উপহাস পেয়েছি। আপনি যদি আমার সাথে কথা বলতেন, তাহলে মনে হয় বুঝতেন, এই পৃথিবীতে আমার মতো অসম্মানিত আর কেউ কখনও হয়নি। মানুষ আমাকে দেখে আঙুল উঁচিয়ে শুধু হোহো করে হেসেছে……আর আমি এর জবাবে কিছুই করতে পারিনি। যে অপমান আমার প্রাপ্য নয়, সে অপমানেরও জবাব দিতে না পারার চাইতে কষ্টের আর কী আছে? সারাটা জীবন মাথা নিচু করে নীরবে শুধুই কেঁদেছি। আমাকে কাঁদতে হয়েছে। আমাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে কান্না করেই। আমার জন্মের দায় আমি চুকিয়েছি কেবলই চোখের জলে।

আমি কখনওই আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াব না। খুব শ্রদ্ধা করি যাঁকে কিংবা খুব ভাল লাগে যাঁকে, সে মানুষটির কাছে কখনও যেতে নেই। আপনার সাথে আমার তাই কখনও দেখা হবে না। এক মিনিট! ‘কখনও’ কথাটা তুলে নিচ্ছি। আপনাকে শুধু একটা কথাই বলব, নির্ভয়াকে না জানলে জীবনের অনেক কিছুই আপনার জানা হবে না। সেদিন আপনি আমাকে মজা করে আচার পাঠাতে বলেছেন, আমি সফল হতে পারলে আমি আপনার সামনে যাবই। আপনি আমার শহরে দুইবার আসার পরও আমি আপনাকে দেখতে পারিনি। আমার আবেগকে আমি সম্মান করি, পৃথিবীতে আর কেউ করুক বা না করুক। আমার আবেগের দুই পয়সাও দাম আর কারও কাছে না থাকুক, আমার কাছে তা অমূল্য। আমার আবেগের জন্য আমি জীবনও দিতে পারি। আমি আপনার সামনে যাইনি এ ভয়ে যদি আপনিও অন্যদের মতো আমার আবেগকে ছোটো করে দেখেন!

আবারও বলছি, আমার কথা না জানলে পৃথিবীর অনেক কিছুই আপনার জানা হবে না। কেন? কেননা, অন্য কেউই কখনও নির্ভয়া হয়নি, ওদের কাউকেই কখনও নির্ভয়া হয়ে বাঁচতে হয়নি। ওদের কারুরই প্রাণের মানুষ নিজের গর্ভধারিণী মা নাড়ি ছিঁড়ে দূরে সরে যায়নি কোনও দিনও। যার গর্ভধারিণী নাড়ি ছিঁড়ে চলে যায়, তার মতো অভাগা কে আছে! মা যখন সন্তানকে ছেড়ে চলে যায়, তখন সেই সন্তানের চেয়ে দুঃখী আর কে হয় পৃথিবীতে? যা-ই হোক, আপনি যতই মজা করুন না কেন, আমার শুধু একটা কথাই বলার আছে, আপনার পুরনো কিছু কথা আমি বারবার শুনি, পড়ি। সেই এক কথাই! বিগত তিনমাসে আমি ত্রিশবার সুইসাইড করতে গিয়েছি। আবার শক্ত হই। বাবা-মা ছাড়া যেই সন্তানটা কুকুরের মতো সবার লাথি খেয়েখেয়ে বড়ো হয়, তার জন্য পৃথিবীতে আর কী থাকতে পারে? তাই অন্য সবার মতো আমি আপনাকে আইডল মানি বা বিরক্ত করব, তেমন কিছু অন্তত আমার ব্যাপারে ভাববেন না। আপনি আমাকে ফেইক ভাবছেন হয়তো! ভাবতেই পারেন! আমি জানি, ফেসবুক ফেইক। তবুও আমি বলব, একবার স্রষ্টাকে জিজ্ঞেস করলেই আপনি নিজেই উত্তর পাবেন। সবাই ফেইক হয় না। সবাই অনুভূতি বিক্রি করে খায় না।

একটা কাঠামো তুললেই বাড়ি হয়ে যায়, কিন্তু ঘর হয় না। বাড়িকে ঘর বানাতে অনেক কিছু লাগে। ঘর নিয়ে মন্দাক্রান্তা সেনের একটা কবিতা আছে। সে কবিতায় ঘর মানে কী, তা খুব গুছিয়ে বলেছেন কবি। অতো কিছু সবার ভাগ্যে জোটে না। আর কিছু হোক না হোক, ঘরে হৃদয়ের কিছু বাঁধন লাগে। আমি যে কখনও তাও পাইনি! ঘর নিয়ে আমার চেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আর কারও নেই পৃথিবীতে, শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে একথা বলতে পারি। আমি সে ঘরের সন্তান, যে ঘরে মা-সন্তানের সম্পর্ক রাস্তার দুইজন লোকের সম্পর্কের চেয়েও নির্দয়। যেখানে হতভাগা সন্তান এক বর্বর মায়ের যোনিতে ভূমিষ্ঠ হয়, সেই মায়ের সন্তানের কষ্টগুলি অনন্ত কাল ধরে শুধু লোনা রাতের অব্যক্ত যন্ত্রণা হয়ে দুইগালে শুকিয়ে শুকিয়ে দাগ হয়ে থেকে যায়। ঘরমাত্রই যে স্বস্তির জায়গা হয় না, বরং কখনও ঘরের ট্র্যাজিক ড্রামাটি এমন এক ডিন্যুমেন্ট স্টেজে এসে পৌঁছে, যেখানে অনুভূতিগুলি ভোঁতা, অথর্ব হয়ে যায়, তার এক অসহায় শিকার আমি নিজে। তেমনই এক তীব্র যন্ত্রণাকে বয়ে নিতেনিতে আমি আজ বড্ড ক্লান্ত।

আমাকে আপনার চেনার দরকার নেই। ফেসবুকের কোনও কিছুকে চেনা বা জানতে যাওয়াও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ভয়ংকর একটা বিষয়। তাই ফেসবুকের একজন ফলোয়ার না, শুধু আপনার লেখার নিয়মিত পাঠক আর আপনার বক্তব্যের নিয়মিত শ্রোতা হিসেবে একটা কথাই বলতে চাই—প্রকৃতির সেই কাঙ্ক্ষিত বিচারের লোভে ২১ বছর সহ্য করেও আত্মহত্যা করতে পারিনি। জানি না কতদিন এই লোভটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব! তবে আপনার কাছে পাঠক ও শ্রোতা হিসেবে আমার অনুরোধ থাকবে, ইগ্নোরড চাইল্ডদের নিয়ে কিছু লিখবেন। কারণ, আনবর্ন চাইল্ডদের মতো তাদেরও অনেক কষ্ট থাকে। সমাজ এদের কথা শুনতে চায় না, মানতে চায় না। বরং কিছু চিরাচরিত নিয়ম আর রীতি ওদের উপর চাপিয়ে দিয়ে ওদের দমিয়ে রাখে। তারাও যে মানুষ, তারাও যে বাঁচতে চায় মাথা উঁচু করে, এটা কোনও মানুষ মনে আনতে চায় না। লেখকরাও তাঁদের লেখনীকে ওরকম অসহায় মানুষগুলির জন্য কাজে লাগান না। কেন কেউ ওদের কথা বলে না? সবসময় কি সন্তানই দোষী হয়? সব ক্ষেত্রে কি বাবা-মা সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারে? আমি যদি বলি, পারে না তাঁরা, তখন? এমন কিছুর দৃষ্টান্ত আমি নিজে। আমার বাবা মারা যান ২১ বছর আগে, যখন আমি সবেমাত্র কথা বলা শিখেছি। কিন্তু এখন যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে আমার বাবা-মায়ের কথা, আমি বলি, আমার বাবার আগে মা মারা গিয়েছেন। একজন আমার কাছে ফিজিক্যালি অ্যাবসেন্ট, অন্যজন মেন্টালি অ্যাবসেন্ট। মনটাই তো সব, তাই না? জানেন তো, সেই কবে থেকেই আমার ঘর নেই, শুধুই বাড়ি আছে। শৈশবমাত্রই আনন্দের কিছু নয়। সবার শৈশব একই রকমের হয় না। আমার মতো কারও কারও শৈশব বলতেই কিছু থাকে না।

আমি শুধু আপনাকেই জানাতে চাই আমার সব কথা। সবই! আমি বলবই। একটু সময় চাই। লেখাটা শুরু করার আগে একটা অনুরোধ জানাই। আমাকে ভুলে গেলেও আমার দুঃখগুলিকে কখনও ভুলে যাবেন না।

সময়টা ২০০০। বাবা মস্ত বড়ো ব্যবসায়ী। ভীষণ ব্যস্ত থাকত। নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করার সময় কই তার? সারাদিন শুধু টাকা আর টাকা। শহরের এক নম্বর ব্যবসায়ী। হঠাৎ একদিন ধরা পড়ল বাবার ক্যান্সার। কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হল, বাবা ডাক্তারের হাত ধরে বলল, স্যার, আপনি ভগবান। যত টাকা লাগুক, আমাকে বাঁচতেই হবে। আমার দুটো ছোটো মেয়ে আছে। আমার তখন ৬ বছর বয়স। আমার বোন ৩ বছর। সুস্থ বাবা হুইলচেয়ারে করে বাংলাদেশ আসল। আমি বাস টার্মিনালে অপেক্ষায় রইলাম কখন আসবে বাবা। সেদিন ভগবান আমার কথা শোনেনি। বাবা ফিরে এল প্যারালাইজড হয়ে। অনেকবার কাছে ডাকত, কী যে বলত, বুঝতাম না। অনেক আদর করার চেষ্টা করত, পারত না, বাবার হাত কাঁপত। আমাদের দুই বোনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কাঁদত। বাবার চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম, পারতাম না। বাবা কী বলতে চায়, বুঝিনি কখনও। তারপর ৩১ আগস্ট। সব শেষ। বাবাকে যেদিন শ্মশানঘাটে রেখে এলাম, সেদিন থেকেই আমার জীবনের আসল ট্র্যাজেডি শুরু।

আমাদের ঘরে এক লোক ঢুকল আমাদের অর্থসম্পদের লোভে। আমার মা ছিল অতি সুন্দরী। লোকটা ছিল আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সেই লোকটা, একসময় দেখলাম, আমাদের ঘরে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করল। জানেন, আমি এত ছোটো ছিলাম যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে এগুলি কী ঘটছে আমার সাথে! আমার বোনটা এত ছোটো ছিল যে, বাবার মৃত্যুর দিন ঘরভর্তি লোক দেখে বলে, আ……জ……কে বনভো………জ……ন। কত্ত মা……নু………ত! যখন আমি দেখলাম, আমার সাথে অস্বাভাবিক কিছু হচ্ছে, তখন আমি নিজের সবশক্তি দিয়ে সেই বর্বরতার প্রতিবাদ করলাম। আমি আমার নিজের চোখে নিজের গর্ভধারিণী মাকে সেই জানোয়ারটার সাথে অবাধ সঙ্গমে লিপ্ত হতে দেখলাম। সেই অমানুষটা আরও কিছু অমানুষ নিয়ে আসে, আমার ঘর হয়ে ওঠে মদের আড্ডা, তাসের ঘর, রীতিমতো বেশ্যালয়! এদিকে আমার আর বোনের অস্তিত্ব মৃতপ্রায়। আমি শুধু বুঝতাম একটা কথাই—যেকোনও মূল্যেই হোক, আমাকে বাধা দিতে হবে, নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে। একটা শিশু যখন তার মাকে একটা জানোয়ারের সাথে যথেচ্ছ যৌনাচার করতে দেখে, তখন তার মানসিক অবস্থাটা কেমন হয়, কল্পনা করতে পারেন? তার যাওয়ার কোনও জায়গা থাকে এই পৃথিবীতে?

প্রতিবাদ করায় আমার উপর নেমে আসে নিদারুণ মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার। আমার নতুন ঘর হয় রাস্তা। আমাকে কুকুরের সাথে একই রাস্তায় থাকতে হয়েছে রাত ২টায়। অনেক রাত গেছে যে রাতে আমি ক্ষুধার জ্বালায় ডাস্টবিন থেকে কুকুরের সাথে খাবার শেয়ার করে খেয়েছি। সময় করে রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ফ্রা লিপ্পো লিপ্পি কবিতাটা পড়বেন। ওখানে কুকুরের সাথে মানুষের সহাবস্থানের চিত্রটি কবি খুব তীক্ষ্ণতার সাথে ফুটিয়ে তুলিয়েছেন, যা আমার জীবনের সাথে যায়। একটি লাইন ছিল ওখানে, এরকম—And a face that looked up . . . zooks, sir, flesh and blood,/ That’s all I’m made of! আমি তো তা-ই ছিলাম, স্রেফ একটা রক্তমাংসঅস্থির দলা! জানেন, আমি যে একটা মানুষ, এটাই এই ২১ বছর কেউ ভাবেনি। আমি তখন বান্ধবীদের বাসায় বাসায় থাকতাম ১ মাস, ২ মাস, এভাবে করে। কিন্তু সময় তো আমার নিয়মে চলবে না। স্কুলে পরীক্ষা হত, আর আমি টেনেটুনে কোনওমতে পাস করতাম। আবার কোনও সহৃদয়বান মানুষ মাঝেমধ্যে বুঝিয়ে বলত………বাসা ছেড়ে মেয়েরা বাইরে থাকতে পারে না, ছেলেরা পারে। ওরা আমাকে বাসায় দিয়ে যেত। আবার কিছুদিন পর আমি প্রতিবাদ করলেই রাস্তায়………এক পর্যায়ে আমার ঘর যৌনপল্লীকেও ছাড়িয়ে যায়। এমন-কী আমার জন্মদাত্রী মা চাইল, আমি যেন ওই জানোয়ারদের সাথে শুই! সে যা করছে, আমিও যেন তা করি, তার জন্য আমাকে প্রতিনিয়তই মানসিকভাবে নির্যাতন সহ্য করতে হল, প্রায়ই মায়ের এবং অন্য জানোয়ারদের শারীরিক অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু আমি হার মেনে নিইনি। ওদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার চাইতে বরং আমি নিজেকে শেষ করে দেব, এটাই ছিল আমার জেদ, আমার শপথ।

শুরু হল আমার একার লড়াইটা। একজনও আত্মীয়স্বজনের সহানুভূতি ছাড়া বাঁচার লড়াই। আমার সেই বয়সটা ছিল ১৩ কি ১৪। ভগবান আমার দুর্ভাগ্য লিখতে যেমনি কার্পণ্য করেনি, তেমনি আমার চেহারা আঁকার সময়ও কোনও কার্পণ্য করেনি। তাই রাস্তায় সবসময় থাকা আমার জন্য নিরাপদ ছিল না। ছেলেরা উৎপাত করত। কিন্তু কোথায় যাব আমি? দেখতে দেখতে বৃত্তি পরীক্ষা চলে আসল। যার বাবার এত অঢেল টাকা ছিল, সে একদিন তার মামাকে বলল, আমাকে ৪০০ টাকা দিবে, মামা? কোচিংয়ে ভর্তি হব। মামা বলল, তুই কি বৃত্তি দেবার মতো ছাত্রী? টাকা চাস আবার! শুনে প্রচণ্ড জেদ হল। বান্ধবীর বাসায় তার মা পড়াশুনায় আমার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে সারারাত আমার পাশে বসে থাকত। আমি জুনিয়র বৃত্তি পেলাম। এসএসসি পরীক্ষা এল। শরীরে তখন জন্ডিস। সারা বছরের অত্যাচারে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেছে। দুটো টেস্ট পরীক্ষা দেয়ার পরই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এক শিক্ষকের টাকায় ডাক্তার দেখালাম। কিন্তু পরীক্ষাটা দেয়া আর হল না। মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়লাম। পরেরবার মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিলাম, এপ্লাস পেলাম। সেদিন আমি এত জোরে কেঁদেছিলাম যে সবাই ভেবেছিল আমি ফেল করেছি। যে মেয়েকে ক্ষুধা চেপে রাখতে হয় দিনের পর দিন, তার কাছে ওরকম একটা রেজাল্ট অবিশ্বাস্যই মনে হবে, এটাই স্বাভাবিক। এরপরই আমার যে দুইএকজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল, ক্ষুধা লাগলে যাদের কাছ থেকে খাবার পেতাম, যারা আমাকে বইকেনার টাকা দিত, তারা বলল, পড়াশুনাটা যেন বাদ না দিই কোনও কিছুর বিনিময়ে। এইচএসসি’তে পেলাম ৪.৮৮। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই ইংরেজিতে। স্যাররা আমার পাশে দাঁড়ান। সবাই মিলে আমাকে আত্মহত্যার পথ থেকে প্রতিদিনই একটু একটু বাঁচাতে থাকেন। এমন দিন যেত, যেদিন ভার্সিটির ডিন স্যারের রুমে কোনও অনুমতি ছাড়া ঢুকে যেতাম, তারপর অঝোরে কান্না করতাম। আমি বাবার আদর পাইনি, বাবারা কেমন হয়, আমি তা জানি না, তবে ডিন স্যারের কাছ থেকে যে স্নেহ আমি পেয়েছি, আমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমাকে তেমনই স্নেহ করত। জানেন, তাঁরা আমাকে এতটা সহ্য কেন করলেন, আমি জানি না। কেউ কখনও বকেনি পর্যন্ত!

আমি যখন রাস্তায় থাকতাম, সবাই মাকে বলত, আপনার মেয়ে কোথায়? সে বলত, ও আমার মেয়ে না। ওর বেঁচে থাকা না থাকায় আমি কিচ্ছু হবে না। বলুনতো, এমন একটা মানুষের চেয়েও বড়ো অভাগা পৃথিবীতে কেউ আছে? আমার বাসার টেবিলে, ফ্রিজে খাবার ভর্তি। আর আমি মানুষের বাসার দিকে খাবারের আশায় তাকিয়ে থাকতাম। যখন ক্ষুধা সহ্য করতে পারতাম না, তখন মানুষের দরোজায় দরোজায় গিয়েছি, ঘরের টুকটাক কাজ করে দিয়েছি একটু খাবারের আশায়। জানেন, আমার কোনও শৈশব নেই, কোনও কৈশোর নেই, কোনও যৌবনও নেই। যখন রাস্তায় দেখি, সবাই তাদের বাবা-মায়ের হাত ধরে হাঁটে, তখন আমি তাকিয়ে থাকি বোকার মতো। আপনাকেই কেন এত কিছু বলছি, জানেন? আপনি কিন্তু আমার কোনও ফ্রি প্যানাসিয়া না, আপনি আমার সুইসাইড করতে যাবার কয়েক সেকেন্ড আগে শোনা কণ্ঠটা, বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা সেই শক্তিটা। আপনি বলেন, পৃথিবীতে নোবডি হয়ে বাঁচার যন্ত্রণা সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা। আপনার এই কথার সম্মান তো আমি ছাড়া কেউ দিতে পারবে না এতটা ভালভাবে। আমি সেই নোবডি, যার থাকা না থাকায় তার মায়েরই কিছু এসে যায় না, সমাজ তো অনেক পরের কথা! তখন আমার কোনও ভাল জামা ছিল না, আমাকে দেখতে কাজের বুয়াদের মতোই দেখাত। আমাকে একজন একদিন প্রশ্ন করে, তুমি যে ওই বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর কর, তুমি কি ওই বাসার কাজের লোক? ওরা যখন কোথাও ঘুরতে যেত, তখন আমার বোনকে আমার মা বলত, ওইটাকে রাস্তায় দেখলে বলবি না আমরা কখন বাসায় থাকি, তাহলে সেই সুযোগে ঘরে আসবে খাবার খুঁজতে। মা একদিন আমাকে বলে, দেখিস না তোর জন্য আমার ঘরে কোনও জায়গা নেই? তুই কে? মরতে পারিস না তুই?

আমার বোন কখনও কখনও আমার সাথে কথা বলতে শুরু করে, যখন আমার বয়স ১৯ বছর। মা ওকে বলত, তোকে যেন ওর সাথে কথা বলতে না দেখি! একদিন মা তার প্রেমিকের জুতো দিয়ে পিটিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। রাত তখন বারোটা। জানেন, আমাকে যখন কেউ সুন্দর বলে, তখন আমি আয়নায় তাকিয়ে এখনও সেই জুতার আঘাতটা গালে দেখতে পাই। কেন দেখি এখনও? কখনওই, আমার একজনও আত্মীয় আমার পাশে দাঁড়ায়নি। একজনও না। আমি ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে বলে আমার কোনও বন্ধু নেই, আমার সাথে কেউ মিশে না। আমি ভার্সিটিতে গিয়ে কাঁদতাম বলে সবাই আমার নাম দিয়েছে—গডেস অব মেলানকলি! এর চেয়ে বড় অসম্মান কি পৃথিবীতে আর হয়? আপনিই বলুন! ভার্সিটিতে একজাম, যখন বাসায় থাকতাম, রাতজেগে পড়তাম, মাঝরাতে এসে মা লাইট বন্ধ করে দিত। আমি প্রচণ্ড রাগে আর কষ্টে ভোররাতেই গাড়ির অপেক্ষায় স্ট্যান্ডে গিয়ে বসে থাকতাম। কেউ ক্যাম্পাসে নেই। আমি একা বসে থাকতাম। বাসায় একটুও পড়াশুনা করতে দিত না। আমি রাস্তায় বসে কান্না করতাম, আর পড়তাম। আমাকে দেখে সবাই হাসাহাসি করত। ভার্সিটিতে সবাই ভালভাল খাবার নিয়ে যেত, আমি শুধু জল খেতাম। আপনি হয়তো জানেন, ক্ষুধার পেটে জলও অসহ্য। ভার্সিটির এক আপুর কাছ থেকে বই আনতাম। আর ডিন স্যার ছিলেন আমার ছায়া, আমার বাবার জায়গায়। সবসময় আমার পাশে থাকতেন আর বড়ো গলায় ‘মা’ বলে ডাকতেন। এখনও ডাকেন। তিনি আমার মাথার উপর ছায়া হয়ে ছিলেন। মিডটার্ম দিতে না পারলেও বলতেন, “তুমি যেদিন পারবে, সেদিন দিবে।” আমার মাস্টার্সের ভর্তিতে ১০০০০ টাকার দরকার ছিল। পুরো টাকাটাই স্যার দিয়েছেন। তিনি ছাড়া মাস্টার্সটা কমপ্লিট করা কোনওভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার ৩.৫৮ সিজিপিএটা আসলে তাঁর। আমাদের ক্লাস ৪টায় থাকলে তিনি ফোন দিয়ে জানাতেন ক্লাস হবে কি না। কারণ আমি বাসা থেকে থেকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার জার্নি করে যেতাম প্রতিদিন। তাই এমন যেন না হয়, আমি কষ্ট করে গিয়ে ফিরে এসেছি, তাই তিনি আগে থাকতেই জানাতেন। আমি একবার ডিপার্টমেন্টের দুইতলার সিঁড়িতে বসে পড়ছিলাম আর পড়েই যাচ্ছিলাম। তখন মানসিক আর শারীরিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে সিঁড়ির কাছেই মাথাঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। যখন সেন্স ফেরে, তখন দেখি, আমি ভার্সিটির হসপিটালে, আমার ভেইনে স্যালাইনদেয়া। পাশে ডিন স্যার বসা………এমন কিছু জ্যান্ত ঈশ্বরকেও জীবনে পেয়েছি।

আমি একদিন প্রচণ্ড ক্ষুধায় আমার মাকে বলেছিলাম, খুব ক্ষুধা লেগেছে। মা আমাকে বলেছিল, আগে থালপেতে ভাত চা, তারপর দিব। সেই দিন থেকে এখন পর্যন্ত আমি টিউশনি করি, মোটামুটি যা ইনকাম করি, তাতে অন্তত ক্ষুধা লাগে না আর। যখন আমার সামনে কখনও দামি খাবার আসে, তখন আমি সেই দিনটার কথা ভাবি। আমার হাতে সোনার বাউটি ছিল, আপনার ছেলের হাতে যেমন আছে। বাবা দিয়েছিল। গলায় সোনার চেইন ছিল, ড্রয়ারে রাখা ছিল আরও অনেক গহনা। একদিন আমি ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় আমার সমস্ত সোনার গহনা (বাবার দেয়া) খুলে নেয়, ড্রয়ারের সমস্ত গহনা সরিয়ে রাখে। আজ আমি তাই নিজের টাকায় গলার চেইন আর কানের দুল গড়ে সেগুলি পরে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকি। আর ওই দিনের কথা ভাবি।

আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল ওই জানোয়ারদের সাথে থাকতে। কিন্তু বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আমি তখন কী ধরনের এক শক্তি পেতাম, কোথা থেকে পেতাম জানি না। আমি নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। আপনি বলতেন না, ঈশ্বর কখনও উত্তর দেন চুপ করে থাকার মধ্য দিয়েই। আমি নির্মমভাবে ধর্ষিতা হতে পারতাম, সেটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এমন সময় আমি রাত ১২টায় রাস্তায় নেমেও ভাল মানুষের হাতে পড়েছিলাম। জানি না কেন। হয়তো আমি মারা যাবার পর আমার জন্য কাঁদার কেউ নেই বলেই সৃষ্টিকর্তা এতবার এতভাবে আমাকে বাঁচালেন। আপনি কি জানেন, আপনি কতবার আমার জীবনে মানুষরূপী অবতার হয়ে এসেছেন? সুইসাইড করব, সব ঠিক, ফোনটাকে শেষবারের মতো হাতে নিয়েছি, হঠাৎ আপনার লেখা! আমি পড়তে শুরু করলাম, লেখার মধ্যে ডুবে গেলাম, সে যাত্রায় বেঁচে ফিরলাম। এমন ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে।

কেউ যখন দেখে, একাধিক পুরুষের সাথে নিজের গর্ভধারিণী মা, সেই কষ্টটা একজন সন্তানের জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট। আমি জানি, অমন কষ্ট সহ্য করতে কেমন লাগে। একটা গল্প পড়েছিলাম, ‘অ্যা মাদার ইন ম্যানভিল’। সেখানে জেরি নামের একটি ছেলে লেখিকাকে তার মায়ের নামে মিথ্যে মিথ্যে গল্প বলে, অথচ জেরির মা অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমি এখন প্রায়ই ভাবি, আমার দুঃখের কথা তো কেউ শুনতে চাইবে না। কেউ চাইলেও সে আমার দুঃখটা বুঝতেই পারবে না! কী দরকার নিজের দুঃখের কথা বলার? আমাকে হয়তো সারাজীবনই জেরির মতো বানিয়ে বানিয়ে মায়ের মিথ্যে গল্প বলতে হবে। জেরির তো মা ছিল না, আমার তো আছে। তবু কেন আমাকেও ওরকম গল্প ফাঁদতে হবে? এইসব মনে এলে অস্থির লাগে, কেন এমন হল, বুঝতে ইচ্ছে করে। আর তখন ভাবি, ঈশ্বর সত্যিই কি আছেন?

রাস্তায় ছিলাম, কুকুরের সাথে থেকেছি, মানুষ আশ্রয় দিয়েছে, স্যাররা টাকাপয়সা দিয়েছে। বন্ধুবান্ধব ছোটো করেছে, করছেও। কারও দুর্বলতা নিয়ে অপমান করার সুযোগ পেলে সে সুযোগ কেউ ছাড়ে না। বাবা যেদিন মারা যান, আমাকে মন্ত্র পড়তে বলা হয়। এত ছোটো আমি, সহজ শব্দই উচ্চারণই করতে পারতাম না, সংস্কৃত মন্ত্র কীকরে বলব? কী যে বলেন ঠাকুরমশায়! আমি ঘরে আসি ৩১ আগস্ট ২০০২। সেইদিন থেকেই শুরু। সমস্ত আড্ডা, মদ, জুয়া, লাম্পট্য, একদম সব। ওদের যে নেতা ছিল, সে আরও দশজনকে নিয়ে আসত। ওরা সবাই মিলে আমার বাবার সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করে। সবই একেবারে। বাবা কত কষ্ট করে সে টাকা আয় করেছিল—খেয়ে না খেয়ে, নিজের শরীরের দিকে খেয়াল না রেখে, অবিশ্বাস্য রকমের পরিশ্রম করে, শেষে তো অসুখ বাঁধিয়ে মারাই গেল। মা আমার মামাকে দোকান নিয়ে দেয়। মামা দোকানে বসে মদ খায়, জুয়া খেলে, আর তার বোন ঘরে বেশ্যাগিরি করে। আর ওদিকে আমি রাস্তায় থাকি কুকুরের সাথে, লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে ক্ষুধা মেটাই। ভার্সিটির ম্যাম খাবার কিনে দেয়, ভার্সিটির স্যার মাস্টার্সের ১০ হাজার টাকা হাতে তুলে দেয়, এভাবেই আমার মাস্টার্স শেষ হয় ৩.৫৮ পেয়ে।

জানেন তো, সেই রাস্তায় থাকার দিনগুলি বড় যন্ত্রণার। কীভাবে নিজেকে রক্ষা করেছি, নিজেও জানি না। আঘাত সইবারও একটা বয়স লাগে। আমি কিছু বুঝতে উঠতে পারার আগেই যে ট্র্যাজেডিটা আমার জীবনে হল, আমি সত্যিই এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। জীবনের সব কথা কি আর লেখা যায়? আমাদের জীবনে যা ঘটে, খুব চেষ্টা করলে তার হয়তো শতকরা দশভাগ আমরা লিখে বলতে পারি, আমাদের জীবনের প্রায় পুরো অধ্যায়ই থেকে যায় সবার অগোচরে। একদিন। ওই লোকটি আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইল। ব্যর্থ হয়ে সে আমার মাকে বলল, তোমার মেয়ে আমাকে দেখলেই খারাপ কথা বলে। তারপর দেখলাম, আমার মা লোকটিরই জুতো দিয়ে আমাকে পেটানো শুরু করল, রাত তখন বারোটা। এরপর দুজন মিলে আমাকে মারতে মারতে ঘরের বাইরে নিয়ে আসল। আমি রাস্তায় নামলাম, রাত ২টা তখন। কুকুর দৌড়াচ্ছে, সাথে আমি। এক বাসায় দরোজা নাড়লাম। তিনি দরোজা খুললেন। সেই আন্টিকে আগে থেকে চিনতাম। পাশেই ছিল আমার জেঠুর বাসা। আমার কান্না শুনেই জেঠু দরোজাটা আরও ভালভাবে বন্ধ করল। বাবা বেঁচে থাকতে জেঠুর পরিবারের প্রায় পুরো খরচ বাবাই চালাত। বাবা জেঠুকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে দেবী শেঠির হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়ে নিয়ে এসেছিল। আর সেই জেঠুর কাছ থেকেই এমন আচরণ হয়তো আমার প্রাপ্যই ছিল। এখন ভাবি, যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, জেঠুর শরীরেও তো বাঙালিরই রক্ত!

আমার বোনের সাথে একবার ওই দলের এক লোক অসভ্যতা করতে চাইল, সেকথা আমার বোন আমাকে বলার পর আমি মাকে বললাম, ওই লোক যেন এই বাসায় আর কখনও না আসে। পরেরদিন দেখা গেল, সে আবার আসল। মা ওই লোককে বলল, আমি নাকি ওই লোকের সম্পর্কে বাজে কথা বলেছি। শোনামাত্রই ওই লোক আমাকে অনেক জোরে একটা চড় মারল কানের উপর। কান থেকে রক্ত বেরিয়ে গেল। আমার মাও তার সাথে যোগ দিল। যখন আমার মা একা পারত না, তখন আমার মামাকে ডেকে আনত আমাকে মারার জন্য। আমি আপন ভাগ্নি হওয়া সত্ত্বেও মামা আমাকে কখনও ভালোবাসতো না। একদিন শুধু একটা গ্রামার বই চাওয়ার অপরাধে আমাকে লাথি মেরেছিল, সেই থেকে আমি আর টাকা থাকলেও কখনও গ্রামার বই কিনি না। ওই বই দেখলেই আমার লাথির কথা মনে পড়ে যায়। অনেকটা আপনার মতই তখন মনে হয়, যে বইয়ের জন্য আমাকে লাথি খেতে হয়, সে বই আমার লাগবে না। এখনও আমি নিজের বাড়িতে ভাত পাই না, এমন-কী পড়তে পর্যন্ত দিতে চায় না। আমি কিছুদিন আগেও মায়ের হাত-পা ধরে বলেছি, আমার এখন বুকের বাঁপাশে ব্যথা করে, এত মানসিক, শারীরিক অত্যাচার আমি আর নিতে পারছি না, আমার সামনে চাকরির পরীক্ষা। আমি একটু পড়তে চাই। সে আমাকে বলে, তোর সার্টিফিকেটের মূল্য আমার কাছে নাই, এই ঘরে এসব চলবে না। কখন একটা মেয়ে কতটা খারাপ পরিস্থিতি হলে নিজেকে রক্ষার জন্য রাস্তায় নামে, তা নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝেছেন। আপনার সেই কথাটা বলতে চাই—হে ঈশ্বর, আয়ু চাই না, একটু বাঁচতে চাই। আপনার সাথে ফোনে কিংবা সামনাসামনি কথা বলার ইচ্ছে ছিল। জানি না সে সুযোগ হবে কি না কোনওদিন। আমি যেন সমস্ত অপমানের জবাব দিতে পারি, আমার জন্য সেই প্রার্থনা করবেন।

আমার কোনও বাসা নেই। আগে ক্যাম্পাসে খেতাম, এর আগে মানুষের বাসায়, আর এখন যেহেতু ২৫ বছরের একটা যুবতী মেয়ে, তাই বাধ্য হয়ে বাড়িতে থাকি। তাও সারাদিন মেন্টাল টর্চার চলতেই থাকে। বই পর্যন্ত পড়তে দেয় না! যাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়, তাকে বই পড়তে দিবে? হাহাহা। কী যে বলি না পাগলের মতো! কোথায় থাকব আমি? হোস্টেলে? নাকি অন্য কোথাও? এর সমাধান কী? সারাজীবন তো সমাধানই খুঁজলাম। কোনও আত্মীয়স্বজন দেয়নি সমাধান। জীবনের সমস্ত ক্ষতি আমারই হল। যখন ছোটবেলায় রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে, তখনই যখন কেউ সমাধান করতে আসেনি, এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। ভার্সিটিতে হল যখন হয়, তখন আমার অনার্স প্রায় শেষ। এখন ছাত্রীকে পড়াতে যাব, দেখা যায়, পড়ানোর পরও বসে থাকি। কারণ এখন আর রাস্তায় থাকা যায় না। আত্মসম্মানে বাধে। আর আমার জীবনের কোনও সমাধান হোক, সেটা যদি ভগবান চাইত, তাহলে নিশ্চয়ই আজ থেকে ছয় মাস আগে আমাকে আমার ভালোবাসার মানুষের বিয়েটা দেখতে হত না। এর কোনও প্রতিকার নেই, এটা আমাকে সহ্য করেই যেতে হবে। আমার প্রতিবারের জন্মদিনে দাউদ হায়দারের এই কথাটি স্ট্যাটাসে দিই: জন্মই আমার আজন্ম পাপ!

আপনার পোস্ট পড়ে সবাই কমেন্ট করে, আর আমি রীতিমত মুখস্থ করি। এতবার করে প্রতিটি লাইন পড়ি যে মুখস্থ হয়ে যায়। একটা কথাই বলব, আপনার পরোক্ষভাবে আমার পাশে দাঁড়ানোটা হয়তো আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করত। সবাই তো শুধু টিপস চায় চাকরির। আমি কিছুই চাই না। আমি শুধু আপনার লেখা পড়ে আর কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনে কিছু একটা করে সবাইকে এটা বুঝাতে চাই, ইচ্ছে থাকলে পথ তৈরি করে নেয়া যায়। আমি কথা বলতে চাই আপনার সাথে, দশ বছর আগের মানুষটার সাথে। আপনি কখনও সুযোগ পেলে বলবেন।

একদিন সাহিত্যের ক্লাসে স্যার সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমরা লিঙ্গুইস্টিকস রেখে মাত্র ১০ জন কেন সাহিত্যে এসেছ? আমি বাদে অন্যদের উত্তর ছিল, মুখস্থ রাখার ক্ষমতা নেই, তাই; কেউ বলল, ফাঁকি দিতে পারব, এরকমই ছিল উত্তরগুলি। আমি বললাম, স্যার, আমি না থাকলে হয়তো আপনার কিছু হবে না, কিন্তু আমি ছাড়া এই সাহিত্যঅঙ্গন অসম্পূর্ণ। আপনাকেও বললাম, আমাকে না জানলে, পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়মের বাইরেও যে একটা আলাদা জীবন আছে, সেই জীবনের কথা কিছুটা হলেও আপনার অজানা থেকে যাবে। আমার মাথার উপর আমার বাবার ছায়াটাও ছিল না। আমার উপর ওরা সবাই জোর প্রয়োগ করেছিল কিছু জানোয়ারদের খাবার হতে। আমাকে দিনের পর দিন মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু আমি মাথা নত করিনি। আপনি একটা কথা বলেন না, কঠিন মানুষের ক্ষেত্রে কঠিন পরিস্থিতি বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। আমি যে কত রাত নিজের ইজ্জত রক্ষার জন্য নিজের জীবনবাজি রেখেছি, তার সবটুকু লিখে বোঝানো সম্ভব নয়, কিছুটা লিখলে যদি ভুল লিখি, তবে নিজের সেই সংগ্রামকে ছোটো করা হবে। তাই আমি সেসব রাতের কথা লিখছি না।

জানি, আপনি আমাকে ভুলে যাবেন আজকের পরই। ভুলে যাবেন, আফসোস নেই। জানেন, মানুষ আমাকে রেখে যখন অন্য একটা মেয়েকে ঘরে তোলে, আর আমার অনুভূতির সাথে নাটক করে, তখন আপনার ওই কথাটা মনে হয়—হেরে বেঁচে যাওয়ার জন্য যার জন্ম, তাকে আজকাল আর কেউ মানুষ ভাবে না। তাই এই নোবডি বা সাব-হিউম্যান বিইংকে আপনি ভুলে যাবেন, ওতেও আমার কোনও আফসোস নেই। আমাকে তো কেউ মানুষই ভাবেনি কোনওদিন। একদিন এক বিরাট বড়লোকের বাসায় গিয়েছি তার মেয়েকে পড়াতে। যখন বিদায় দিল, তখন হাতে ৬০০ টাকা দিয়ে বলল, একটা ভাল ড্রেস কিনবে। এই ড্রেস পরে পড়াতে আসবে না আর। যার বাবার এত টাকা ছিল, তার মেয়েকে মানুষ ভিক্ষা দেয় আজ। আমি একজনকে ভালোবাসতাম। সে আমার ব্যাপারে সব জানত। কয়েকদিন ফেসবুকে অভিনয় করেছিল। ওর অন্য এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েই ছিল, আমি তার কিছুই জানতাম না। সে ভেবেছিল, ফেসবুক তো! কয়েকদিন মজা নিই। অসুবিধা কী? সেদিন আমি তার হাত-পা ধরে কেঁদেছি আমাকে ছেড়ে না যাওয়ার জন্য। ওকে পাবার পর আমার মনে হয়েছিল, এবার হয়তো আমি বাঁচার চেষ্টাটা করে দেখব। যে আমার সব কিছু জেনেও আমার হাতটা ধরল, সে নিশ্চয়ই আমায় কখনও ছেড়ে যাবে না। কিন্তু সুযোগ বুঝে সে-ই আমাকে চরম অপমান করে চলে গেল। আমাকে বলল, আমি কি তোমাকে বলেছি কখনও যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? এত স্বপ্ন দেখ কীকরে? নিজের অতীতটা ভুলে গেছ? এরকম আরও অনেক কিছুই শুনতে হল তার মুখ থেকে। জানেন, ও আমাকে আরও একবার বুঝিয়ে দিয়ে গেল, আমি আসলে মানুষ না………রাস্তার কুকুরের সাথে থাকাটাই আমি ডিজার্ভ করি।

আচ্ছা বলুনতো, ছেলে-মানুষদের মাথায় শুধু সেক্সটাই ঘুরে কেন? সত্যিই কি একটি ছেলে আর একটি মেয়ে কখনও শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না? বিছানায় যেতেই হয়? এমন কিছুই কি? যার সাথেই কথা বলি, ঘুরি, তাদের সবাই সব কিছু সেক্সে নিয়ে শেষ করতে চায়। অদ্ভুত না ব্যাপারটা? এমন সব মানুষজন ওসব কথা বলে, যাদের সাথে এটা যায় না, যাদের মুখ থেকে এটা শুনছি, তা কল্পনাই করা যায় না! সরাসরি বারবার মানা করলেও বলতেই থাকে। মানুষের শরীরটাই কি সব? সেদিন এক ফ্রেন্ড ইনবক্সে এমনভাবে আমার শরীরের বর্ণনা দিচ্ছিল, শুনে গা ঘিনঘিন করে উঠেছে। আর শুনতে পারছিলাম না। ব্লক করে দিলাম। ওরা কি বোঝেও না? আরেকজন ফ্রেন্ড, পেশায় ডাক্তার। হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে নাকি তার পড়াশোনা আছে। আমার ছোটবেলার বন্ধু। তাকে বললাম, ভাল লাগছে না কিছু, সবকিছুই কেন যেন অসহ্য লাগছে। সেও কথা নিয়ে গেল সেক্সের মধ্যে। তার সাথে টাইমপাস করলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে! এত গাধা হয় ছেলেরা! কী ভাবে ওরা মেয়েদের? বিরক্ত হয়ে লগ আউট করে নিলাম। শরীরের বাইরে যে মন বলেও কিছু একটা আছে, ছেলেরা কি সেটা বোঝেই না? ছেলেরা এমন হয়, অমন হয়, শুধু মানুষ হয় না!

জানেন, প্রতিদিন তিলেতিলে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, হয়তোবা শেষ হয়ে গিয়েছিও। দেড় বছর আগের আমি ছিলাম কিছু হলেই চ্যাঁচামেচি কান্নাকাটি করে যেন বাড়ি মাথায় তোলা মানুষ। আর আজ কষ্টটা বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা শিখতে গিয়ে নিজেকেই শেষ করে ফেলছি আমি। সবার সামনে হাসতে থাকা মানুষটা রুমের দরোজা বন্ধ করে যে কীভাবে ভেঙে পড়ে, তা কেউ জানে না। প্রতিরাতে মনে হয় সুইসাইড করি। নিজেকে বোঝাই, আর একটা দিন বেঁচে থেকে দেখি, সময় তো পাল্টাতেই পারে। আমি ভালভাবেই বুঝতে পারছি মেন্টালি কতটা সিক হয়ে পড়েছি। কোনও একদিন হয়তো আর মনে হবে না যে আর একটা দিন বেঁচে থেকে দেখি। একজন সাইকোলজিস্টের সাথে কথা বলা খুব জরুরি, কিন্তু সেটাও পারছি না। সুইসাইড না করেও-বা কী হচ্ছে? মরেই তো গেছি ভেতরে ভেতরে। কত দিন-মাস-বছর থেকে খড়কুটা আঁকড়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছি। খুব করে বাঁচতে চেয়েছি। যতই বাঁচতে চাই, মৃত্যুর দরোজা ততই যেন খুলে যায়!

(এ গল্পের আরেকটি অংশ আছে।)

Content Protection by DMCA.com