আলো নেভার পর (শেষ অংশ)

একেক সময় মনে হয়, কাউকে সামনে বসিয়ে গড়গড় করে সব কথা বলি। কিন্তু, সেই ‘কেউ’টা কই? একাকিত্বের যন্ত্রণাটাও যে এতটা পোড়ায়, জানতাম না আগে। “একজন পাশে দরকার। এমন একজন, যাকে দেখতে ভাল লাগে। যার পাশে বসতে ভাল লাগে। যার কথা শুনতে ভাল লাগে। এমন একজন, যে কথা বলতে বলতে চোখ ফিরিয়ে নিলে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, তুমি চোখ ফিরিয়ে নিলে কেন? খবরদার, আর কখনও এরকম করবে না।” হুমায়ূন আহমেদের ‘তিথির নীল তোয়ালে’ উপন্যাসে এই লাইনগুলি আছে। পড়েছেন লেখাটা? জীবনে সত্যিই এমন একজন দরকার, যার প্রতি শুধু আমার অধিকার থাকবে। যাকে ভালোবাসার আগে ভাবতে হবে না, তাকে ভালোবাসার অধিকার আমার আছে কি নেই। আর………আমি আসলে বোঝাতে পারছি না। কেউ কখনও বুঝেনি, আপনিও হয়তো বুঝবেন না। নিশ্চয়ই মনেমনে বলেও ফেলেছেন এর মধ্যেই, বিয়ে করে ফেলুন! কিন্তু………সেদিন আপনি একটা কথা লিখেছিলেন, “প্রতিটি মানুষের জীবনেই এমন একজন আসে, যার জন্য সে আর কখনওই অন্য কারও প্রেমে পড়তে পারে না।” আমি হয়তো আর কখনওই কারও প্রেমে পড়তে পারব না। প্রেমে না পড়ি, তাকে ভাল লাগতে হবে তো! আমার কারও প্রতিই কোনও আকর্ষণ কাজ করে না। মানে, অবস্থাটা দাঁড়াচ্ছে,একাকিত্বের মধ্যে থাকতে আমার অসহ্য লাগছে, আবার পাশে কাউকে চাচ্ছিও না। এমন একটা দ্বৈতসত্তা নিয়ে বেঁচে আছি। কোনও মানে হয়? অবশ্য, আমি যে অবস্থায় আছি, তাতে আমি চাইলেও কী আর না চাইলেও কী! আমি আসলে অযথাই বকবক করে যাচ্ছি। হয়তো আপনি এসবের কিছুই বুঝতে পারছেন না। আর বুঝলেও-বা কী! কিছুই না। দীর্ঘসময় ধরে চাপাকষ্ট সহ্য করে থাকতে থাকতে কিছু কথা বলে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাকে বলব? কে শুনবে আমার কথা? কেনই-বা শুনবে? তাই………আচ্ছা, যদি কখনও মরে যাই, সত্যিই যদি সুইসাইড করে বসি, একটা কবিতা লিখবেন আমার জন্য? কিংবা দুই লাইন? আমাকে জিতিয়ে দিয়ে লিখবেন কিছু?

আর কয়টা অভিজ্ঞতা শুনবেন? আপনার কথাটাই আবার বলি, মৃত্যুর প্রহর গোনাও আমার কাছে এখন বিলাসিতা। আর আমার বোধে এখন মায়ের এখন একটাই সংজ্ঞা: যে গর্ভধারিণী সব কিছুর পরও তার সন্তানকে ছেড়ে দেয় না, সে-ই মা। অনেকেই হয়তো হাসবে আমার কথা শুনে। যার চলে যায়, সে-ই শুধু বোঝে বিচ্ছেদে কী যন্ত্রণা! আপনাকে একটা দুটো বই পড়তে বলি। একটি জর্জ এলিয়টের সাইলাস মারনার, আরেকটি টমাস হার্ডির টেস অব দ্য ডার্বারভিল। এই দুটো বই সময় পেলে পড়বেন। ভাল লাগবে। লাগবেই!

আমাকে অনেকেই বলে, কীরে, পূজা দেখতে যাবি না? আমি বলি, দুর্গা আমার মা নয়গো, মা কি এমন করে? তাই না, বলুন? আমার সহপাঠীদের সব আছে। মা, বাবা, বয়ফ্রেন্ড, স্বামী, সুখ, টাকাপয়সা। আর ঘর তো আছেই! অন্য কিছু দূরে থাক, আমার তো কোনও ঘরই নেই। আমি যখন ক্যাম্পাসের রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে যেতাম, ওরা মায়ের হাতের রান্না খেত, আমি ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর তখন ওরা আমার খাবারের দিকে তাকিয়ে হাসত আর বলত, তুই তো খালি পলিথিনে করে ভাত নিয়ে আসিস। কেউ কেউ বলে, তুই তো টিউশনির টাকায় পেট চালাস। টিউশনি না থাকলে তো খেতেও পাবি না! শুনলে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। তবুও আপনার কথাই বলি, অন্যকে কষ্ট দিয়ে বাঁচা এক ধরনের পাপ। প্রকৃতির বিচার বলে কিছু থাকলে এ পাপের শাস্তি পেতেই হবে। আমি সত্যিই অপেক্ষায় আছি। জানি না আর কতদিন বাকি! কতদিন?

আর কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে কাউকে ভালোবাসতাম কি না, উত্তরে বলি, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন! জানেন, আমার জীবনে ওই দুদণ্ড, মানে ৪৮ ঘণ্টাই ছিল বেঁচেথাকার মিথ্যে আশ্রয়। আহত পাখির মতো আমি ওর হাত-পা ধরে কেঁদেছিলাম আমাকে ছেড়ে না যাওয়ার জন্য। আমার চোখে, জীবনানন্দের বনলতা সেন কোনও নারী নয়, বরং পৃথিবীর সকল আহত হৃদয়ের আশ্রয়, ভরসার জায়গা। সে সকল হৃদয়ের, যাদের বাড়ি আছে, ঘর নেই। যাদের মানুষ আছে, বোঝার মানুষ নেই। যাদের গর্ভধারিণী আছে, মা নেই। তাই না, বলুন? আমার এখন একটাই পরিচয়: সাব-হিউম্যান বিইং। সেদিন, ২ তারিখ আপনার জন্মদিন ছিল। নক করলেই হয়তো ভাববেন আমার কিছু টিপস চাই চাকরির। বিরক্ত হবেন, আমাকে ভুল বুঝবেন। তাই নক করিনি। শুভ জন্মতিথি! মানুষ নাকি যাঁকে সম্মান করে, তাঁর জন্মদিনকে জন্মতিথি বলে! তাই আপনাকে বললাম, শুভ জন্মতিথি! আমার ভার্সিটির এক ম্যাম আমাকে এভাবে বলতেন। বলতেন, শুভ জন্মতিথি, নির্ভয়া! জানেন, শুধু এরকম একটা কথা শোনার লোভে আমি চলন্ত বাসের সামনে দাঁড়িয়েও ফিরে এসেছি। ভেবেছি, বেঁচে থাকলে তো সামনের জন্মদিনেও ম্যাম ওরকম করে বলবেন! আজ মনে হয়,কত স্যার, কত ম্যাম কত কিছু পড়ালেন ক্লাসে, সেসবের কিছুই তেমন আর মনে পড়ে না, তবু ওই ম্যামকে মনে আছে, কখনওই ভুলে যাব না। ম্যামের ছোট্ট একটা কথা শোনার লোভে নির্ভয়া একদিন বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জানেন, মানুষকে ভালোবাসতে হয়, ঘৃণা করতে হয় না। একটু ভালোবাসা পেলে অনেক মানুষেরই আর কিছু লাগে না। পৃথিবীতে সবাই লোভী হয় না, অনেকেই আছে, যাদের চাওয়া সত্যিই খুব অল্প।

একজন ভুল করে, অন্যজন তা দেখে শিক্ষা নেয়। আমার বোন কিন্তু আমার পরিস্থিতি দেখে কোনও শিক্ষাই নেয়নি, বরং নিজেকে নিজেই একটা কমফোর্ট জোনে নিয়ে গেছে। সে মায়ের কোনও আচরণের কিংবা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একবিন্দুও প্রতিবাদ করেনি। নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমার মায়ের সাথেই থেকে গেছে। কখনও ভাবি, সে ঠিকই করেছে। কী দরকার আমার পথে হাঁটার? ওরকম কুকুরের মতো বাঁচার? আপনি প্রায়ই বলেন না, আপনার জীবন থেকে অবিশ্বাস্য রকমের অর্থ আর সময় হারিয়ে গেছে? আমারও তা-ই। ২১টি বছর। ২১টি নির্দয় শীত কিংবা ২১টি হলেও-হতে-পারত বসন্ত। আমি যখন পিছনে ফিরে তাকাই, তখন আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। আমাকে ডাক্তার বলে দিয়েছেন টেনশন ফ্রি থাকতে! হাসিখুশি থাকতে। ডাক্তার তো এরকমই বলবেন, এটাই স্বাভাবিক! উনি তো আর আমাকে চেনেন না, আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। জানলে উনি নিজেই চিন্তায় পড়ে যেতেন, এরকম অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যিই কি হাসা যায়! আপনার কণ্ঠটা একবার শোনার খুব ইচ্ছে ছিল। আমাদের ভার্সিটিতে আপনি এসেছিলেন, সবার সাথে কথা বলেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেকেই আপনাকে দেখেছে, আপনার কথা শুনেছে। আমি পারিনি দেখতে। একদিন কথা বলবেন আমার সাথে? পাঁচ সেকেন্ডের জন্য হলেও?

২৭ মে ২০১৯। সেদিন ওর বিয়ে হয়ে যায়। খুব কেঁদেছিলাম, মনে আছে। বাচ্চাদের মতো অনেক জোরে শব্দ করে কেঁদেছিলাম। এরপর থেকে আমার কান্নার শব্দ কেবল আমিই শুনি। কাউকে শুনিয়ে কাঁদার সত্যিই কোনও মানে নেই। কান্নার দাম কেউ দেয় না, কেবলই বিরক্ত হয় মনেমনে। কান্না ব্যক্তিগত ব্যাপার, দেখিয়ে কাঁদলে লোকে করুণাই করে বেশি। আগে যখন ভার্সিটিতে সবার সামনে কাঁদতাম, তখন সবাই আমাকে নিয়ে কী মজাটাই না করত! বলত, ও তো গডেস অব মেলানকলি, সারাদিনই কাঁদে! নিজের কষ্টের জন্য এত বড়ো উপাধি আমার আগে হয়তো কেউ কোনওদিন পায়নি। কেউ যদি একবার জানতে পারত, আমার কষ্টের উপর আমার নিজের কোনও হাত ছিল না! বাবা যখন মারা যায়, তখন বাবাকে বাঁচাতে আমি কী-ইবা করতে পারতাম? ছয় বছরের একটা মেয়ে কারও জন্য কী করতে পারে? নিজের যে কষ্টের দায় নিজের নয়, তার জন্য নিজেকে ছোটো হতে দেখতে কার ভাল লাগে, বলুন? এখন যদি দেখি, কোনও ছোটো বাচ্চা রাস্তা পার হতে পারছে না, আমি ওর হাতটা ধরে পার করে দিই। কারণ, আমার তখনই মনে হয়, আমার ছোটো হাতদুটো কেউ ধরেনি সেই দিন। বাবার মৃত্যুর সময় কত্ত ছোটো ছিলাম আমি! ওই বয়সে কি এতটা ধকল নেয়া যায়! ভগবান একবারও ভাবল না আমার কথা! আর কিছু নয়, আমার সাথে একটু দয়া দেখিয়ে কেউ তখন কথা বলেনি। খিদে চেপে কান্না করেছি দিনের পর দিন। আমাকে কুকুরের মতো সবাই লাথি মেরেছে। হাত বাড়িয়ে কাউকেই পাইনি তখন! শুধুই হাতড়ে মরেছি অন্ধকারে। আমার সাথে আমি একাই ছিলাম! আর কেউ নয়!

একদিন আমার সব সার্টিফিকেট রাস্তার মাঝে ফেলে চলে এসেছিলাম। ভুলে। আমি প্রায় সবসময়ই ডিস্টার্বড মুডে থাকি। কোথায় কী রেখেছি, মনেই করতে পারি না। সেদিনও পারছিলাম না। ভাবলাম, সবই শেষ আমার! যেটার জন্য নিজের শেষ রক্তবিন্দুটাও জল করে দিলাম, সেই সার্টিফিকেটও চলে গেল। আপনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না, সেদিন আমি সারা রাস্তায় পাগলের মতো শুধু দৌড়াতে থাকি। আমার মনেই ছিল না পুঠিয়া থেকে রাজশাহী পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় না। আমার সে কী দৌড়! একসময় প্রায় ৬ ঘণ্টা পর ভার্সিটি থেকে আমি সব সার্টিফিকেট অক্ষত অবস্থায় পাই। সেখানের অফিসের দাদারা পেয়ে গুছিয়ে রাখে। এক ক্লাসমেট গিয়ে নিয়ে আসে। এমনি করেই, আপনার কথায়— ঈশ্বর কখনও উত্তর দেন চুপ করে থাকার মধ্য দিয়েই।

ছোটবেলায় অনেক আদর পেয়ে বড়ো হয়েছি। বোধহয় হামাগুড়ি দেয়ারও সুযোগ পাইনি অতোটা, মানুষের কোলেকোলে থেকেছি সবসময়ই। তখন বাবা বেঁচে ছিল। যার বাবা আছে, তার চেয়ে বেশি সৌভাগ্য আর কার আছে? যতদিন বাবা বেঁচে ছিল, সবাই অনেক আদর করত, সমীহ করে চলত। আমি কাঁদার উপক্রম করলেও সবাই কী যে ব্যস্ত হয়ে পড়ত আমাকে শান্ত করতে! বাবা ধনী ছিল, সবাইকে সাহায্য করত, দুইএকটা পরিবারের খরচ চলত বাবার টাকায়। দুই অকৃপণ হাতে সবার জন্য পয়সা ঢালছে, এমন একজন মানুষের সন্তানকে সবাই বুকে টেনে নেয়। তাকে অনাদরে রাখার কথা কেউ মাথাতেও আনতে পারে না, তাকে হেয় করবে, সে স্পর্ধাই কারও নেই। বাবা মাথার উপর ছায়ার মতো, বটগাছের মতো। বাবা চলে গেল আর আমার জায়গা হল রাস্তার কুকুরদের সাথে। যে শিশুটি একসময় সবার কোলেকোলেই ছিল, সেই শিশুটিই এখন মানুষের পায়ের কাছেও আর জায়গা পায় না। বাবার মৃত্যুর পর বাবারই ঘামঝরানো টাকাপয়সা উড়িয়ে সবাই খুব আনন্দে ছিল, আর আমি? কুকুরের অর্ধেকখাওয়া খাবারও খেয়েছি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে। কোনওমতে এক বেলার খাবার জুটলে কখনও জানতামই না যে পরের বেলায় আদৌ খেতে পারব কি না। সামান্য এক পিস বনরুটি কিনে ক্ষুধা মেটানোর সামর্থ্যটুকুও যার ছিল না, সেই মেয়ে আমি—একজন মৃত ধনী মানুষের সন্তান। কত ছোটো ছিলাম আমি, আর সেসময়ই কিনা আমাকে কিছু জানোয়ারের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। যাদের বাবা মারা যায়, তাদের খুব তাড়াতাড়িই বড়ো হয়ে যেতে হয়। তাদের শৈশবের মৃত্যু হয় বাবার মৃত্যুর সাথসাথেই! কেউ তাদের আদর করে না, কাছে টেনে নেয় না, সবাই শুধু কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেয়। তাদের আপন বলতে আর কেউ থাকে না। পৃথিবীর পথ চেনানোর মানুষটাই যার নেই, নিজ চেষ্টাতেই পথ চিনে চলতে তার বড়ো কষ্ট হয়। কোন পথে আঘাত আসবে, কোন পথে যেতে নেই, এসব তাকে কেউ বলে দেয় না। আর যদি সেই সন্তানটি হয় মেয়ে, যার বয়স মাত্র ৬, ভাবতে পারেন, কতটা অসহায় হয়ে একেবারে পথে নেমে যেতে হয় তাকে? যার বাবা নেই, তাকে আঘাত করা সহজ, তাকে দূরে ঠেলে দেয়াও সহজ, তাকে অগ্রাহ্য করা আরও সহজ। বাবারা একটা ঘরের মতো, একটা গাছের মতো, একটা ছাদের মতো। যার বাবা মরে যায়, তার আশ্রয়, সম্মান, নিরাপত্তা সবই মরে যায়। বাবা ছিল আমার কাছে আকাশের মতো, বাবা চলে গেল আর অমনিই আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তবু, ভগবানের আমার কাছ থেকে বাবাকে কেড়েনেয়াটাকে আমি স্বাভাবিক ট্র্যাজেডি বলেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরের ঘটনাগুলি আমি কী হিসেবে মেনে নেব? আমার নিজেরই মা আমাকে আর আর আমার বোনকে বিক্রি করে দিতে চাইত, এখনও চায়, এটাও আমাকে মেনে নিতে হচ্ছে। কেন? কোন অপরাধে?

তবে কী জানেন, যাদের বাবা নেই, ওদের বড়ো হতে হয় না, ওরা যেন বড়ো হয়েই জন্মায়, দুনিয়ার নব্বইভাগ বাস্তবতা আর সত্যমিথ্যা ওরা বর্ণপরিচয়ের আগেই শিখে যায়, লাখলাখ বই পড়ে মানুষ যা শিখে………এই স্বার্থপর পৃথিবী আর নিষ্ঠুর জীবন, দুই মিলে বাবাহীনদের তার দশগুণ হাতেকলমে শিখিয়ে ফেলে। মাঝেমাঝে মনে হয়, বাবাকে বলি, বাবা, চলে গেছ, ভালই করেছ। তোমাকে ধন্যবাদ, চলেযাওয়ার জন্য! দিনের পর দিন আমি যে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করেছি, তার খোঁজ আমার ঈশ্বর জানে শুধু। মাকে আমি বলতাম, ওই লোকগুলি যেন একটুও আমার গায়ে হাত না দেয়, যদি দেয়, তবে আমি কী করতে পারি, চিন্তাও করতে পারবে না। এত ছোটো বয়সে এত শক্তি আমি কোথায় পেতাম, জানি না। সবসময়ই দা, ছুরি, ইট এগুলি নিজের কাছে রাখতাম। থেমে গিয়েছি অনেকবার, নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা ভেবেছি অনেক অনেকবারই, কিন্তু আপনাদের মতো কিছু অবতারের কথায় আমি এখনও বেঁচে আছি। আপনার মতো করে উত্তর দিলে বলতে হয়, আবারও বলতে ইচ্ছে করছে, তাই বলছি—হে ঈশ্বর, আয়ু চাই না, বাঁচতে চাই। এখনও সবার জন্য যে আয়ুটা অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি, সেটা নিয়ে আছি। বাড়তি আর ফেলেদেয়ার মতো কিছু না হলে ঈশ্বর আমাকে তা দেবেই-বা কেন? আমি যে ভাঙা কুলো, কেবল ছাই ফেলতেই আমাকে লাগে!

আমি আবারও বলছি, আপনি আমাকে ভুলে যাবেন। আমার কথা মনে থাকবে না আপনার। মনে করিয়ে দিই, আমাকে ভুলে গেলেও কোনওআফসোস নেই, কিন্তু আমার যন্ত্রণাগুলিকে ভুলেও ভুলবেন না। আপনি আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা শুনেশুনে হয়তো বিরক্তই হচ্ছেন। তবু আমি বলব। আমাকে বলতেই হবে। আমার কথা কেউ কখনও শুনতে চায়নি, জানি, আপনিও ওদেরই দলে, তবু আমি বলতে চাই। কেন চাই? কাউকে আমার কথাগুলি শোনানোর কোনও দায় আমার কখনও ছিল না, এখনও নেই, তবে আপনাকে বলার এক ধরনের দায় অনুভব করছি, তাই বলছি। সে দায়টা কীসের? এই যে এখনও দিব্যি বেঁচে আছি, সে বেঁচেথাকার দায়।

তখন আমি এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি। হঠাৎ আমার বায়োলজিক্যাল মা ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমার হাতে কামড়ে দেয়। এতটাই জোরে কামড় বসিয়ে দেয় যে হাতের মাংস বেরিয়ে আসে, হাত থেকে দরদর করে রক্ত ঝরতে থাকে। কী করব ভেবে না পেয়ে আমি আমার বান্ধবীর বাসায় যাই। সে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যায়! ডাক্তার দেখে বলে, এটা কত বছর বয়সের মানুষ কামড়েছে? এবং সম্পর্কে উনি তোমার কে হয়? আমি তখন চুপ করে ছিলাম। আর পাশ থেকে আমার বান্ধবী বলছিল, ৪০ বছরের কেউ কামড়েছে! আজও, আমি যখন এই হাতে কলম ধরি, তখনও সেই ৯ বছর আগের কামড়ের দাগটাকে সমস্ত হাত জুড়ে দেখতে পাই কেন জানি! লিখতে গেলে, কোনও কিছু ধরতে গেলে আমার হাতটা আজও ব্যথা করে। এদিকে আমার মেরুদণ্ডের হাড়ও বাঁকা হয়ে গিয়েছে নাকি! আমাকে অনেক আঘাত করা হত, হয়তো সেখান থেকেই কিছু হয়েছে। ডাক্তার ফিজিওথেরাপি নিতে বলেছেন। টিউশনির টাকা না পেলে সেটা সম্ভব নয়। এক সপ্তাহ থেরাপি নিতে হবে, না কমলে বড় পর্যায়ে যাবেন, বলেছেন। আসলে ছয় মাস আগের ওই ঘটনাটার কারণে, আমি যতটুকু ঠিক ছিলাম, এখন তাও নেই। আমি মেন্টালি খুবই ডিস্টার্বড! খুউব বেশি! আমি সামনের চাকরির পরীক্ষাগুলিও দিতে পারব না এরকম হাতব্যথা নিয়ে। সত্যিই, জন্মই আমার আজন্ম পাপ!

ভাবছেন, কী কষ্টেই না বেঁচে আছে মেয়েটা! দাদা, ভাববেন না আমার জন্য! যে মারা যাবার পর কাঁদার কেউ নেই, তাকে মরতে দিন। আমি এই ব্যথা হাত নিয়েই টিউশনি করি। আমি ঠিকমতো কলম ধরতে পারি না। ওদের বলি, তোমরা লেখো। জানেন, ওর বিয়ে হবার দুইমাস আগে যখন শেষবার কথা বলেছি, ও বলেনি যে ওর বিয়ে। কোন বলল না, জানি না। তবে বলেছিল, কিছু টাকা পাঠিয়ে দিই? আমি নিইনি। জানেন, আমি ইচ্ছে করলে অনেক আরামে জীবন কাটাতে পারতাম, যদি আমার মায়ের পথে থাকতাম। তাহলে আমার সব হত! আমার সংসার করতে অনেক ইচ্ছে করত। যে কটা দিন ওর সাথে আলাপ ছিল, আমি আরেকবার বাঁচতে চেয়েছিলাম। ওই যে বলে না, আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ……একটু শান্তির অপেক্ষায় রইলাম, যদিও আমার অপেক্ষাগুলি কেবল অপেক্ষাতেই আটকে থাকে!

আপনি আপনার অনেক লেখাতেই দেকার্তের যে ফিলোসফিটা বলেন, আমার খুব ভাল লাগে। আই থিংক, দেয়ারফোর আই অ্যাম, সেটাকে আপনি আপনার মতো করে নতুনভাবে বলেছেন, পিপল থিংক, দেয়ারফোর আই অ্যাম। আমাদের সিলেবাসে একটি নভেল ছিল, টেস অব দ্য ডার্বারভিল. সেখানে শেষ অনুচ্ছেদের প্রথম কথাটি ছিল: ‘Justice’ was done, and the President of the Immortals, in Aeschylean phrase, had ended his sport with Tess. টেস ছিল একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ, যাকে নিয়ে ঈশ্বরও খেলনার মতোই খেলেছেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সমস্ত দুর্ভাগ্যের অন্তিম যাত্রা হয়। তাই শেষ অনুচ্ছেদের the President of the Immortals, in Aeschylean phrase, অংশটার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন গড নিজেই! আপনার কিছু কথা, কিছু লেখা আমার মুখে হাসি এনে দেয়। এই হাসিটাকে যদি ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের মতো একটু বিস্তৃত করে বলি, তবে বলতে হয়, ভালোবাসা মানুষকে খুব স্বার্থপর করে দেয়।।………তাই, আমিও আমার সেই হাসিটুকুর স্বার্থে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি আপনি রিপ্লাই দিলেন কি না, দেখতে! এক জীবনে তো মাত্র এতটুক স্বার্থপর হওয়াই যায়! সেদিন আপনি রিপ্লাই দেয়ার পর আমি চোখে জল নিয়ে হেসেছি। আপনি দেখতে পাননি! আমার খুব মন খারাপ হলে ছোট্ট একটা রিপ্লাই দেবেন? প্লিজ, সবার মতো করে আপনিও চলে যাবেন না! সবাই আমাকে রেখে চলে যায়! অবশ্য, চলে গেলেও আমি ঠিক শ্বাস নিয়ে যাব। যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, সব কিছুর মধ্যেও শ্বাস নিতে আমি শিখে গেছি। এ পৃথিবীতে শ্বাস নিতে হয়। এটাই নিয়ম!

প্রায়ই ভাবি, যদি আমারও একটা ঘর থাকত সবার মতো! আচ্ছা, আমি ভাল একটা চাকরি পেলে কি আমার একটা ঘর হবে? সেই ঘরে কি আমি নতুন কোনও বাবা-মা পাব? নতুন বাবা-মা আমাকে ভালোবাসবে? আরেকটা বোন পাব? ওকে অনেক আদর করতে পারব? সেই ঘরে কি আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারব? আমি ছোটবেলা থেকে সবার ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকি, রাস্তায় বাবা-মা সন্তানের হাত ধরে থাকলে আমি আমার শূন্য হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি! আচ্ছা, এ অনুভূতিটা ঠিক কীরকম হয়?

আমি ভেবেছিলাম, এই ইগ্নোরড সাব-হিউম্যান বিইংয়ের সাথে একবার হলেও আপনি কথা বলবেন। একবার হলেও তাকে জানবেন আর ভাববেন, সত্যিই এতটা অন্যায় বহন করার মতো ক্ষমতা এই নিষ্পাপ মুখটির আছে কি না! কেন জানি মনে হয়, আপনি আমাকে শুধু স্যোশাল মিডিয়ার একজন ভাবেন। যেই মানুষটার জন্য আজ সারাদিন না খেয়েও টিউশনি করে এসে এক অদম্য সাহসিকতা নিয়ে পাঁচ মাস পর আবার নতুন করে বই হাতে নিয়েছি, পাশে শুধু একটি জলের বোতল রেখে, সেই মানুষটি যখন ফেসবুকের বাইরে আমাকে স্থান দেয়নি, তখন আজকের যে অনুভূতি, সে তো নিজেই বোবা! হয়তো ভাবছেন, তাতে আমার কী, ভাই! আপনি খেলেন কি না খেলেন, ওতে আমার কী এসে যায়! ঠিকই বলেছেন আপনি! আমার কোনও কিছুতেই কারও কিছু হয় না। তবু জীবনের সবকিছু তো আর হিসেব করে হয় না। বিয়ন্ড বলে তো কিছু থাকেই, তাই না? আমার সেই হিসেবহীনতার মানুষ যদি আপনাকে বানিয়ে ফেলি নিজের অজান্তেই, সেখানে আমার কী দোষ?

ভেবে বসবেন না যেন আমি রাগ করে ওসব কথা বলছি। প্রথম কথা, রাগঅভিমান নিশ্চয়ই সবার সাথে করা যায় না। আপনি মোবাইলে টেক্সট দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছেন, কেমন আছি। যদি বলি, ভাল নেই, কী করতে পারবেন আমার জন্য? ভাত খেতে বসলে আমার কথা মনে পড়বে? কোনও আড্ডাতে বসে মনে পড়বে আমি কী করছি? পড়বে না। আর যে মানুষটা আমাকে ফেসবুকের বাইরে, ফলোয়ারের বাইরে আর কিছু ভাবতেই পারল না, তার কাছ থেকে নীরবে চলে যাওয়াই শ্রেয়। আর এই ফলোয়ারের মেসেজের শেষ লাইনটা হাতে সময় থাকলে পড়বেন। সেটা হল, আপনার জীবনের সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষী, কাছের মানুষ, দূরের মানুষ, এদের সবার মধ্যে কেউ কি কোনওদিন আপনাকে বলেছিল, “প্লিজ, সবার মতো আপনিও চলে যাবেন না।”? ডোন্ট লিভ মি! খুব সহজ একটা কথা, কিন্তু ভারটা অনেক বেশি। সবাইকে এমন কথা বলা যায় না। সবাই এমন করে আপনাকে বলবেও না। আমি বলেছিলাম। বলিনি? মানুষ কতটা অসহায় হলে অন্য একজন মানুষকে এই কথাটা বলতে পারে, এমন আকুতি আপনার মতো কেউ সহজেই বোঝার কথা। যা-ই হোক, আমার একটি অসুস্থ শৈশব আছে, কৈশোর আছে। আমি কখনও সকালে সূর্যোদয় দেখার আনন্দ কিংবা চান্নি পসর রাতের সৌন্দর্য দেখার আনন্দ পাইনি। আমি এক পরাজিত সৈনিক, যার নষ্ট গল্পটা মেসেঞ্জারের মতো সস্তা জায়গায়ই কেবল বলা যায়। আর কখনও আমি আপনাকে নক করে দুঃখের কথা বলব না। নিশ্চিন্তে থাকুন। আসলে সবাই আপনাকে খুব জ্বালায়, ওরা ভুলেই যায় ফেসবুকের বাইরে আপনার একটি ব্যক্তিগত জীবন আছে, কিছু হতাশা, পাওয়া না পাওয়া আছে। ওরা ওদের স্বার্থে আপনাকে চায়, আপনার জন্য না। আপনি কখনও না থাকলে ওরা আপনার লেখাকে, আপনার কাজকে মিস করবে, আপনাকে না। তবু, আপনি নেই, এটা দুইএকজন মানুষ অনুভব করবে। ওদের মধ্যে এই নোবডিটাও থাকবে, আপনি উপর থেকে দেখে মিলিয়ে নিয়েন।

ভাবলাম, আপনাকে অন্তত আমার দুঃখের ঘ্যানঘ্যানানি পড়া থেকে মুক্তি দিই! আর শেষ বাক্যটা—কেউ কি বলেছিল কখনওই—প্লিজ, সবার মতো আপনিও চলে যাবেন না? বলেনি তো? বলবে না। লোকে শ্মশানে যাওয়ার আগেই সবাইকে ছেড়ে দেয়, নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, হাল্কা হয়ে যায়। আমি আপনাকে থাকতে বলেছি, অনেক সাহস লাগে ওটা বলতে। আমার এই অনুভূতি আপনি বুঝবেন না।

আপনিই তো বলেন, খুব পছন্দের কারও কাছে যেতে নেই। এখনও চোখ বুজলে আমার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে, যখন ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে আমি সবার মাঝে দাঁড়িয়ে আপনার সকল কথার যৌক্তিকতাকে তুলে ধরেছিলাম। আপনি ভুল ছিলেন না, সেটা গড়গড় করে বলতাম। কিন্তু শোনার মতো যাদেরকে সেদিন পাইনি, তারাও আজ একটা চাকরির লোভে আপনার ফলোয়ার। জীবনটা কত অদ্ভুত, তাই না? যাকে পছন্দ করি না, তাকেই ছাড়তে পারছি না! হয়তো এটাই ওদের শাস্তি! আপনি লক্ষলক্ষ ফলোয়ার পাবেন, অনেক আপনজন পাবেন, কিন্তু কেউ বলবে না, প্লিজ,আপনিও সবার মতো চলে যাবেন না। কেউ বলবে না। মিলিয়ে নিয়েন। আপনি এত সিনেমাকে এত সুন্দর করে বিশ্লেষণ করেন, সেই আপনিই আমার জীবনের সিনেমাটা কেন জানতে চাইলেন? অনেক সিনেমাই তো দেখেছেন, সত্যি করে বলুনতো, আমার সিনেমা কি অনেক বড়ো সিনেমাকেও হার মানায় না? ওদের গল্পটা হয়তো লেখকের কলমের কালি থেকে এসেছে, আর আমার গল্প তো আমাকে শরীরের রক্ত দিয়ে লিখতে হয়েছে! আপনি সত্যিই কি বুঝতে পারছেন না আমার অনুভূতি? দরকার নেই আপনার আমার সাথে কথা বলার। জেনে রাখুন, আপনি লক্ষ ফলোয়ারের মাঝে একজনও ফলোয়ারকে পাবেন না যে আমার মতো বলবে—ডোন্ট লিভ মি! অনেক দামি কথা কিন্তু! অনেক! দুঃসাহস লাগে বলতে! আচ্ছা, মায়ের আশ্রয়ে সন্তান তো তাকে এমনি করেই বলে, তাই না? ……ছেড়ে যেয়ো না।……আমার যে মা থেকেও নেই! আমি কাকে বলব ওরকম করে?

জানেন, কাল সারাদিন আপনাদের পরিবারের ছবিগুলি দেখলাম আর ভাবলাম, সৃষ্টিকর্তা কোনও কার্পণ্যই করেনি আমার ভাগ্য লিখতে! রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র বিনোদিনীর মত। তাই না? আপনাকে বলব, সন্তানের জন্য তো বাঁচতে হবে ঠিকমতো, তাই না? কাজের ফাঁকে ঠিকমত রেস্ট নেবেন। আপনার রেস্টও দরকার। অনধিকার চর্চা করলাম। আপনাকে আমি আর কখনও বিরক্ত করব না।

আমিও জানতাম, মেসেজটা সিন হবে না। ওতে আমার কিছু এসে যায় না। কারণ আমি সহজাত নির্লজ্জ। যে মানুষটিকে আমি ভালোবেসেছিলাম, একদিন পার্কে শ’খানেক লোকের মধ্যেই তার পা ধরে কাঁদছিলাম, যেন সেআমাকে ছেড়ে না যায়। অবশ্যই সে কান্নার ফলও পেয়েছিলাম। সেই রকমের ধুমধাম করে মানুষটা বিয়ে করেছে! কত বাজনা, কত রং, কত স্বপ্ন! তারপর থেকে আমি নিজের কান্নার শব্দ নিজেই শুনি। কাউকে কান্নার আওয়াজ শুনিয়ে আসলে লাভ নেই। কান্নার শব্দকে ভেঙে দেখলে এর কত অর্থ হয়! আর সেখানে কিনা লোকে কেবল অনর্থই দেখে! সবাই তো কেবল কান্নার শব্দটাই শুনতে পায়, কাঁদছে যে, তার দুঃখ বোঝেটা কে? কোনও মানে আছে শব্দ করে কাঁদার? আমি নাকি বেহায়াপনার জন্য নোবেল প্রাইজ পাবারও যোগ্য, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা এমন করে বলে! যার জীবনটাই………যাকগে! আমাকে আপনার কল দিতে হবে না কখনওই কষ্ট করে। ওই যে বললাম, বিনোদিনীর গল্প কেবল মেসেঞ্জারেই মানায়, আর আশালতাদের নিয়ে সংসার হয়। রবীন্দ্রনাথের মতো বিনোদিনীকে নিয়ে ভাববার সময় লোকের কই! আরেকটা কথা, ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমাটা দেখছেন না? ওই যে গানটা……তবু এক মুঠো সুখ ছুঁয়ে গেলে ভাবি, এ যেন হঠাৎ বৃষ্টি! তো এই দুইচার দিন আপনার দুইচার লাইনের টেক্সটের কারণে আমি চোখের জল মুছে বই হাতে নিয়ে বসেছিলাম। (চাকরির টিপস চাইনি কিন্তু!) ভেবেছিলাম, এই অসুস্থ পরিবেশ থেকে আমি বের হব, যাতে আপনার ওই কথাটা সত্য হয়—পিপল থিংক, দেয়ারফোর আই অ্যাম।

যা-ই হোক, তা আর সম্ভব নয় হয়তো কোনওদিনই। আপনার জন্য সমবেদনা রইল………ওই কবিতার মতো………কাছের সৌন্দর্যকে একপাশে সরিয়ে রেখে দূরের সৌন্দর্য অবলোকন। মানে, জীবনযুদ্ধে হারতে হারতে কোনওমতে বেঁচেযাওয়া মানুষটার গল্প না শুনে কাল্পনিক কিছু গল্পকে বিশ্লেষণ করার মধ্যেই আছেন তো? ভাল কথা, আপনি আমাকে অপমান করে কিছু বললে আমি কাঁদি, তাই শেষ মেসেজে অপমান করবেন না, প্লিজ। আমি এজন্যই আপনার পাবলিক পোস্টে কমেন্ট করি না, কারণ আপনার অপমান সহ্য করার মতো অনুগত ফলোয়ার আমি হতে পারিনি। আপনার তুচ্ছতম কথাটিকেও আমি অনেক গুরুত্ব দিয়ে ভাবি। আমি আপনার প্রতি এক ধরনের স্বর্গীয় টান অনুভব করি। এক চোখের জলফেলা নগণ্য ফলোয়ার আমি আপনার। আশা করি, সৃষ্টিকর্তা আমাদের জোর করে করা দুইদিনের ভার্চুয়াল কনভারসেশনের এখানেই ইতি টানবে। তবে, নীরবে, নিভৃতে রয়ে যাবেন আপনি আমার মননে, বোধে। মাঝেমধ্যে দেখব, নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলছে কি না, মানে আপনি অ্যাকটিভ কি না। আর হ্যাঁ, পাঞ্জাবিতে আপনাকে দারুণ লাগে! চাকরির টিপস পাবার জন্য বলছি না কিন্তু! আমার তো কোনও জীবনই নাই, চাকরি দিয়ে কী হবে! আমি চাই, আমি যাঁদের ভালোবাসি, তাঁরা ভাল থাকুক, তাঁদের দেখতে সুন্দর লাগুক, তাঁদের জীবনটা চমৎকার হোক। আমার কেন যেন মনে হয়, আপনি আমার এত্ত বড়ো মেসেজ সম্পূর্ণটা পড়েনই না! অনুরোধ, আজকেরটা পড়বেন। আপনার সন্তান আপনার মতোই একজন মানুষ হয়ে উঠুক।

আমি বেদবাক্যের মতো একটা কথা মানি,সেটা হল, পৃথিবীতে কেউই ব্যস্ত না, সবকিছুই নির্ভর করে গুরুত্বের উপর। আমি আমার গুরুত্বটা বুঝে গেছি! আপনি আমার কষ্টটা একটুও অনুভব করতে পারছেন না। খুবই স্বাভাবিক! যার যায়, সে-ই শুধু বোঝে। বাই দ্য ওয়ে, আপনার জন্য সারাদিন আজ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার ব্যাপারে আপনার স্মৃতিশক্তি খুব কম। আপনি খালি আমাকেইভুলে যান। আচ্ছা, আপনাকে আমিই একদিন কল দিই! টাকাটা আমিই খরচ করি। কেমন হবে? আপনি এই জনমে আমাকে কল দিবেন না, সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত আমি।

আপনার কথাই আপনাকে বলি, একটু সংশোধন করে—আমি আর কখনওই নিজের কষ্টের কথা কারও সাথেই শেয়ার করব না। আপনাকে আরও বলি, লাইনগুলি খুব ভালভাবে পড়ে নিন………আপনি আমার খুব আবেগের জায়গা ছিলেন। খুউব………রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকবার যাবার পরও আপনাকে আমি দেখতে পারিনি। তাই ইউটিউবে সার্চ করেকরে আপনার কথা শুনতাম। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো এ পৃথিবীর কেউ না কেউ আমাকে সাহায্য করবে, দুটো ভাল কথা বলবে, একটু পাশে দাঁড়াবে,আমাকে একটা সুস্থ জীবন পেতে সাহায্য করবে। আর এজন্যই আমি নিজের অব্যক্ত লজ্জার কথা, কষ্টের কথা বলার জন্য আপনাকে খুঁজে বের করেছিলাম। আপনাকে এই সাতআট দিন বিরক্ত করার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি অদ্ভুত, আমি বেয়াদব, আমি বেহায়া, এরকম সব বিশেষণেই আমাকে ফেলে দেয়া যায়। মাই ডে’তে নিশ্চয়ই আমার ছবিটা দেখেছেন, তাই না? আজকের দিনে আমার মতো এমন একটা নিষ্পাপ মুখেরও তো একটা সংসার থাকতে পারত, তাই না? আমি কি একটা সংসার ডিজার্ভ করতাম না? কেউ তো পারত আমাকে ভালোবাসতে? বাসেনি তো! আমাকে নিয়ে ফেসবুকে মিথ্যে প্রেমের নাটক তৈরি করা যায়, আর যাদের মা-বাবা আছে, তাদের নিয়ে সংসার করা যায়। বাব্বাহ্‌! আমার মা নেই, বাবা নেই, ভাই নেই, বোন নেই, তাই আমার বেঁচেথাকার কোনও অধিকারও নেই! কেউ তো কোনওদিন আমার চোখগুলির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেনি, এই দুচোখের আর কিছু নয়, একটু ভালোবাসা লাগবে! ভাবছেন, এমন কাঙালের মতো ভিক্ষা চাইছি কেন? কী করব, বলুন, আমি যে কখনও ভালোবাসা পাইনি! মরে যাওয়ার আগে একবার অন্তত দেখতে ইচ্ছে করছে, এই অভাগীকেও কেউ ভালোবেসেছে!

কেউ তো বুঝেনি, কতটা অবহেলায় আমি বড় হয়েছি!আমার বয়সি একজন, আমার চেয়ে রূপেগুণে ঢের কম হয়েও সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে দিব্যি সংসার করে, আর তখন আমি রাত ৯টার সময় টিউশনি করে ফিরি! জানেন, আমি ইদানীং ওই সৃষ্টিকর্তাকে অভিযোগেরও অযোগ্য মনে করি। আসলে মানিকের কথাই ঠিক। ঈশ্বর সত্যিই কেবল ভদ্রপল্লীতে থাকেন, আর কোথাও না! আমার কষ্ট কখনওই আপনি অনুভব করতে পারবেন না, কারণ আমার যা হারিয়েছে, তা আপনার হারায়নি। আমার অপূরণীয় ক্ষতির কোনও কম্পেন্সেশন হয় না। আপনার কাছে ২১ বছর মাত্র দুটো ডিজিট,আর আমার কাছে তা আমার বিধ্বস্ত জীবনের জেরক্সকপি। ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে আজ ছয় মাস কখন সকাল হয়, কখন রাত হয়, আমি জানি না। আমার পরিবার নেই, তাই আমার কখনও সংসারও হবে না। আমি অগাস্টাস সিজারের মতো করে বলব, আসলাম, দেখলাম, আর দুনিয়া থেকে চলে গেলাম। আমি তো কখনও কিছুই জয় করতে পারিনি, তাই আমি শুধুই চলে যেতে পারব। আর আপনি আমাকে টেক্সটে শুভসকাল বলবেন না কখনও। আমার জীবনে কোনও সকাল নেই। আর একজনের পা ধরে বলেছিলাম, আমাকে ছেড়ে না যাওয়ার জন্য। তবুও গিয়েছে। আর সেদিন আপনাকে বলেছিলাম, স্যার, সবার মতো চলেযাবেন না। ভুল বলেছিলাম। আমি আমার আকুতি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। আমি যেতে পারেন। চলে যান! আর আপনাকে বলি, শুধু ফেসবুকের মধ্যে আমাকে না রাখলেও পারতেন। ফলোয়ারদের চোখের জলকে আপনি ভাবেন, চাকরির টিপস পাবার জন্য ন্যাকামো। আপনার জন্য আমার চোখ থেকে জল পড়েছে। সেটা আপনি দেখতে পাননি। আমি অঝোরে কেঁদেছিলাম। এই দুইতিন দিন আপনার কোনও পোস্ট পড়িনি। খুঁজেছেন একবারও আমায়? খুঁজেননি। আমি কিন্তু খুঁজেছি আপনি অ্যাকটিভ আছেন কি না। এখানেই আমার আর আপনার মধ্যে পার্থক্য।

আমি সকল পরীক্ষাতেই ফেল করলাম পাস করেও, এ দিয়ে নতুন একইতিহাস লেখা হবে! আমারও অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিল। আমার কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু না! আমাকে নিয়েও একটা বনলতা-কবিতা লেখা যেত নতুন করে। ভালোবাসতে ও শান্তি দিতে আমিও পারি। আমার ভালোবাসা নেয়ার কেউ নেই, আমার কাছে কেউ কোনওদিন শান্তি চাইবে না। আমিও বাবা-মা পেতে পারতাম, তাঁদের সেবা করতে পারতাম, তাঁদের ভালোবাসা অনুভব করতে পারতাম। আমি কিছুই পেলাম না জীবনে! আমি কেবলই একটি জ্যান্তলাশ! আমি ছয় মাস আগে আমার ভালোবাসাকে অন্য একজনকে বিয়ে করতে দেখেছি। সেই মেয়ের সবইআছে। আমার যে এক ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই ছিল না! তাইতো বলি, আশালতাদের নিয়ে সংসার হয়, আর নির্ভয়ার মতো বিনোদিনীকে নিয়ে সূচনা হয় দুর্ভাগ্যের অধ্যায়ের। এটাই নিয়তি। নিয়তির বাইরে কে যেতে পারে, বলুন? আমি আপনাকে নক করে ভুল করেছিলাম, স্যার। দুঃখিত! এই জীবনে আর কখনওই আপনি আমাকে দেখবেন না। আপনার ফলোয়ার হিসেবেও না। আর আপনিসহ পৃথিবীর সব বাবাই বেঁচে থাকুক,ভাল থাকুক। কারও যেন আমার মতো জীবন না হয়।

পুনশ্চ। আপনি টেক্সটে লিখেছেন, আপনি আমাকে ভয় পান, তাই নক করেন না। এর সত্যিই কোনও মানে নেই। তবু এইটুকু নিয়ে আপনি যদি মানসিক তৃপ্তি পান, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আমাকে দেখতে কি ভূতের মতো লাগে যে ভয় পান? আসলে আমার কথা আপনার মাথায় থাকেই না কখনও! আপনি আমায় ভয় পান, আমি ভয়ংকর কিছু, একজন লেখকের মুখে এরকম মন্তব্য শুনলে বুঝতে হবে, তাঁর মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি বলে কিছু নেই। এত সুন্দর যিনি লিখতে পারেন, তাঁর মুখে এগুলি মানায় না। সাধারণের মতো চিন্তা করলে চলবে না। প্রথম দুইতিন দিন আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম, চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়েছে। অবশ্য, আমি এখন আর অপেক্ষায় নেই। আমি এই কয়েক দিনে কিছুটা হলেও আপনাকে পড়তে পেরেছি। আমার সার্থকতা এখানে, আর আমাকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতা আপনার এই ভয় পাওয়ার কথায় প্রমাণিত! আবেগ শুধু লেখার ক্ষেত্রে নয়, অন্য একজন মানুষকে সামান্য বোঝার ক্ষেত্রেও থাকতে হবে। আমার রাগটাই দেখলেন অন্য সবার মত, কষ্টটা দেখলেন না? আমি প্রায়ই অন্যমনস্ক ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকি, তাই কখনও কখনও খুব বেশি বাজে বকে ফেলি! আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আমি সত্যিই আপনাকে মিস করি, আপনার মঙ্গলকামনা করি। মনে করিয়ে দিই, আপনি হয়তো কয়েক লক্ষ ফলোয়ার পাবেন, কিন্তু আমার মতো একজনকেও পাবেন না।