১০ দিনে বিসিএস প্রিলি-পাস!

(নিচের লেখাটি ৩৬তম বিসিএস-এর পরীক্ষার্থীদের জন্য লিখেছিলাম।)

আজকের দিনটি তো শেষই! সো, এটা বাদ। বাকি থাকল আর কয়দিন? ১০। ওকে ফাইন! ধরেই নিচ্ছি, এতদিন যাকিছু পড়েছেন, সেসবের কিছুই এই মুহূর্তে মাথায় নেই। কিংবা, এতদিন তেমন কিছুই পড়েননি। ও আচ্ছা, মাথায় আছে একটুআধটু? যদি মাথায় থাকেও, একটু কষ্ট করে সবকিছু ভুলে যান। সব সঞ্চিত স্মৃতিকে গুডবাই বলে শুরু করা যাক। পুরোপুরি ফাঁকা একটা মাথা! এই মাথা দিয়েই বিসিএস হয়ে যাবে! ভাবছেন, এই ব্যাটা এ কী উদ্ভট ভিত্তিহীন লেখা লিখতে বসলো? লোকটা বড্ডো বেশিই বকে! পুরাই ফাউল লোক একটা! নিজেকে যে কী ভাবে! মনে যা আসে, তা-ই বকে, যেন আর কেউই কোনওদিন বিসিএস ক্যাডার হয়নি! খালি ফালতু প্যাঁচাল পাড়ে! আজাইরা ভাব নেয়! ইত্যাদি, ইত্যাদি। আচ্ছা, আমি যদি বলি, “আরে ভাই, আপনি তো কিছুই পারেন না, আপনার পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ?” তাহলে কি খুব উপকার হবে? কাউকে কিছু বলতে হলে ভালকিছু বলাই তো ভাল, তাই না? ভালকিছু বলার না থাকলে চুপ করে থাকাটা আরও ভাল।

জীবনে পরীক্ষা আসার ব্যাপারটা অন্যের প্রাক্তন কুদর্শন প্রেমিকের/প্রেমিকার সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসার ঘটনার মতোই সুনিশ্চিত। দুটোই—আসবেই আসবে, ঘটবেই ঘটবে! পরীক্ষার সবচাইতে বাজে দিকটি হল, চাই না চাই, পরীক্ষা দিতে হয়। দিতে হবেই যখন, তখন একটু বুদ্ধি করে এই ১০টা দিনকে কাজে লাগান না! কীভাবে? আমি যা বুঝি, যাকিছু মাথায় আসছে এই মুহূর্তে, তা-ই লিখছি। এই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক টেকনিক আমি কাজে লাগাচ্ছি সেই ক্লাস এইট থেকে। আমি পরীক্ষার ১০ দিন আগে ধরেই নিতাম, আমি কিছুই পারি না, কিছুই বুঝি না, কিংবা আমি যা পড়েছি, তার কিছুই আমার মাথায় নেই। একেবারে শূন্য থেকে ওঠার অনুভূতিটাই অন্যরকম! যা-ই হোক, আপনাদের নতুন যাত্রাটা শুরু হোক তবে! ভয় পাবেন না, আমি পাশে আছি। আমার হাতটা ধরুন! এ যাত্রা কেউ-না থেকে কেউ-একজন হওয়ার দিকে যাত্রা!

এক। যা শিখেছেন, তার কিছুই মনে রাখার চেষ্টা করবেন না। তা-ই বলে কি কিছুই মনে থাকবে না? থাকবে, কিংবা আপনার আগের বেসিক, কিছু জিনিস আপনি চান না চান, মাথায় রেখে দেবে। ওতে আপনার কোনওই হাত নেই। আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি শুরু করছেন একেবারে শূন্য থেকে। শুরু না করার চাইতে শূন্য থেকে শুরু করা অনেক ভাল, যাতে পরবর্তীতে এই আফসোসটা কাজ না করে, “ইসস্! ওইসময়েও শুরু করলে আমিও পারতাম!”

দুই। অন্যজগতে যেতে চাইলে নিজেকে অন্যমানুষ করে ফেলতে জানতে হয়। চাকরি-নেই আর চাকরি-আছে—এই দুটো অনুভূতির মধ্যে যোজন-যোজন দূরত্ব। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আপনার হাতে আছে মাত্র ১০ দিন। জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিন’ পড়েছেন না? অক্টোবর বিপ্লবের সময় মাত্র ১০ দিনেই তৎকালীন রাশিয়ার বাকি ইতিহাস লেখা হয়ে গিয়েছিল। আর আপনি আপনার এই ছোট্ট জীবনের বাকি ইতিহাসটা লিখতে পারবেন না? নিজের সবটুকু দিয়ে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন, সত্যিই পারবেন।

তিন। এই ১০ দিনে অতি প্রয়োজন ছাড়া আপনি যে রুমটাতে পড়াশোনা করেন, সে রুম থেকে বের হবেন না। গোসল/স্নান, খাওয়া, প্রাকৃতিক কাজকর্ম আর প্রার্থনা ছাড়া আর কোনও কাজে রুম থেকে বের হওয়ার কিছু নেই বলেই তো মনে হয়। সারাজীবন সমাজে মাথা উঁচু করে চলার জন্য এই ১০ দিন নাহয় একটু অসামাজিকই হলেন, ক্ষতি কী? এই ১০ দিনের সামাজিকতা আপনাকে সারাজীবনের জন্য অসামাজিক করে দিতে পারে। এই ১০ দিনে পেপারটেপার পড়বেন না। গড়ে প্রতিদিন গুনেগুনে ১৬ ঘণ্টা করে মোট ১৬০ ঘণ্টা পড়াশোনা করবেন। কী? পারবেন না? পারবেন, পারবেন। জীবনের বাকি ৩০ বছর আরামে কাটানোর জন্য এই ১০ দিন এই সামান্য কষ্টটা করতে পারবেন না? পারবেন না, এটা মাথায় এসে যাচ্ছে বারবার? আপনার চাকরিটা আসলেই দরকার তো, নাকি? লাইফটা ফাজলামো নাকি, ভাই?

চার। এই ১০ দিনে বিসিএস নিয়ে কারওর সাথেই কোনও কথা বলবেন না; ফোনেও না, সাক্ষাতেও না। আপনি এই ১০ দিন প্রায়সময়ই আপনার মোবাইল ফোনটা অফ করে রাখলে কি বাংলাদেশের জিডিপি একটুখানি কমে যাবে? নাকি, তৃতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে? পারতপক্ষে আপনার বাসায় কাউকে আসতে দেবেন না, আপনিও কারওর বাসায় যাবেন না। ফেসবুক কিংবা অন্য কোথাও যে যাকিছুই বলুক না কেন, সেগুলির দিকে বিন্দুমাত্রও খেয়াল করার কোনওই দরকার নাই। আপনি যা পারেন, যা পারেন না, সেটা দিয়েই আপনার পরীক্ষা আপনি দেবেন। এই ১০ দিনে এটা বিশ্বাস করতে শিখুন, আপনি যা পারেন না, তা পরীক্ষায় আসবে না। কেউ আপনার চাইতে বেশি জানার মানে এই নয় যে, সে পরীক্ষার হলে আপনার চাইতে বেশি লিখতে পারবে। খেলা হবে খেলার দিন মাঠে, মাঠের বাইরে কোনওকিছুর সাথেই খেলার ফলাফলের কণামাত্রও সম্পর্ক নেই। আমি অনেক ভাল প্রস্তুতি-নেয়া ক্যান্ডিডেটকে ব্যর্থ হতে দেখেছি। ওরা কেন ব্যর্থ হলেন ভাল প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও, তার কারণ আমি আজও বের করতে পারিনি। সৃষ্টিকর্তা কিছু জায়গায় রহস্য রেখে দেন। কেন দেন? সত্যিই এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কিংবা এ ব্যাপারটা নিয়ে আমার মাথায় কিছু ভাবনা এলেও তা এ নোটের পরিসরের বাইরে বলে লিখছি না। তবে, সহজভাবে একটা বুদ্ধি দিতে পারি। জীবনে কখনও কারও ক্ষতি করবেন না, করলে আপনার জীবনের কোনও না কোনও সময়ে তার দ্বিগুণ ফেরত পাবেন। পাবেনই! বিশ্বাস হল নাতো? জীবনের সফর এখনও শেষ হয়নি, বন্ধু! অপেক্ষা করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। প্রকৃতি সবকিছুই ফেরত দিয়ে দেয়!

পাঁচ। সিভিল সার্ভিসে নেই, কিংবা আগের কোনও বিসিএস-এ ব্যর্থ, এমন কারওর সাথে এই ১০ দিনে কোনও বিষয়েই কোনও আলাপ করবেন না। আপনার আচরণে অনেকেই আপনাকে পাগল বলবেন (যদি উনি সুস্থ হন)। কেয়ার করার দরকার নেই। দুনিয়ায় চলার একমাত্র নিয়ম, সবাইকে কেয়ার করা যাবে না। এই পৃথিবীর ইতিহাস যুগে-যুগে পাগলরাই লিখেছে। আপনার স্বপ্ন, আপনার জীবন, আপনার পাগলামি—এই দুনিয়ায় সবচাইতে দামি ৩টি রত্ন! এই ১০ দিন পাগলদের দিন। সুস্থ মানুষের দিন এই ১০ দিন নয়।

ছয়। পরীক্ষা যখন চলবে তখন পরেরদিন পরীক্ষা থাকলে আগের রাতে আপনি নিশ্চয়ই অন্তত ৮-৯ ঘণ্টা ঘুমাবেন। যে করেই হোক, ঘুমাবেনই। এর মানে হল, পরীক্ষা চলার সময়টাতে আপনি শুধু ২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছাড়া আর একদিনও মনের মাধুরী (কিংবা ঐশ্বরিয়া) মিশিয়ে পড়ার সময় পাবেন না। তাই, যা করবার এখনই করতে হবে। এখনই সময়! আজকে বসে ১ ঘণ্টা সময় নিয়ে এই ১০ দিন + ওই ৬ দিনের রুটিনটা করে ফেললে কেমন হয়?

একজন সাধারণ মানের ক্যান্ডিডেট, যে পরীক্ষা দেবে এবং ৩৬তম বিসিএস-য়েই ক্যাডার হয়ে যাবে, বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্ব বিচারে তার জন্য রুটিনটা হতে পারে মোটামুটি এরকমঃ

২২ তারিখ সকালবিকালরাত, ১ তারিখ বিকালঃ মানসিক দক্ষতা।

২৩ তারিখ সকালবিকালরাত, ২৪ তারিখ সকালবিকালরাতঃ বাংলা।

২৫ তারিখ সকালবিকালরাত, ২৬ তারিখ সকালবিকালরাতঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

২৭ তারিখ সকালবিকালরাত, ২৮ তারিখ সকালবিকাল, ১ তারিখ রাতঃ আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি।

২৮ তারিখ রাত, ২৯ তারিখ সকালবিকালঃ বাংলাদেশ বিষয়াবলি।

২৯ তারিখ রাত, ৩০ তারিখ সকালবিকালরাত, ৩১ তারিখ সকালবিকালরাতঃ ইংরেজি।

৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে সঠিক নিয়মে অংক করবেন (আরও ভাল হয়, হাতে না করে বারবার দেখলে)। ৩ তারিখ পরীক্ষা দিয়ে এসে পরেরদিন ৪ তারিখ পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পড়াশোনা করার জন্য যে সময়টা পাবেন, সে সময়টাতে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ১ ঘণ্টার বেশি সময় না পড়লেই ভাল।

সাত। এই সময়টাতে ডাইজেস্ট পড়বেন (অন্তত ২টা পড়তে পারলে ভাল হয়)। রেফারেন্স বই পড়ার কোনও দরকার নেই। প্রত্যেকটা বিষয়ের সিলেবাস ধরে-ধরে সব টপিক খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও একবার ‘টাচ করে’ যাওয়াটা ভাল। এই সময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ার সময় নয়, এই সময় অতি দ্রুত চোখ বুলিয়ে পড়ার সময়। একবার হলেও মোটামুটি প্রত্যেকটা জিনিস দেখে না গেলে পরীক্ষার হলে বানিয়ে-বানিয়ে লেখার সময় আত্মবিশ্বাসটা ঠিকমতো আসে না।

আট। কঠিন এবং মনে-থাকে-না টাইপের জিনিসপত্র এই সময়ে পড়বেন না। একটা প্রশ্নের উত্তর আপনাকে মনে রাখতেই হবে কেন? ওটা পরীক্ষায় আসবেই, এটা কে বলল? আর যদি এসেও যায়, অথবা-টা উত্তর করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?

নয়। সবকিছুই পড়তে ইচ্ছে করছে? কী এমন হবে, পড়ুন না! আপনার জন্য ৪০তম বিসিএস প্রতীক্ষা করছে! (তাও যদি ভাগ্যে থাকে আরকি!) যেকোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভাল করতে হলে অবশ্যই সবকিছু পড়ার সহজাত লোভ সামলাতে হবে। সাজেশনস্ ধরে-ধরে যতটুকু সম্ভব, কম সংখ্যক জরুরি প্রশ্ন বেশিবার পড়ুন।

দশ। পড়তে-পড়তে পাগলপাগল কিংবা আউলাঝাউলা লাগলে একটু ব্রেক নিয়ে হাতপা ছোঁড়াছুড়ি করে নাচতে আর গাইতে পারেন, কিংবা ১০-১৫ মিনিট প্রিয়জনের সাথে গল্প করে নিতে পারেন, কিংবা কোনওভাবেই ঘুমিয়ে পড়বেন না—এই কঠিন শর্তে কিছু সময়ের জন্য বিছানায় শুয়ে পড়তে পারেন। কিংবা ওইসময়ে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে লেখা আমার ফেসবুক নোটগুলি দেখতে পারেন। ৩৫তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা নিয়ে এরকম তিনটি লেখার লিংক নিচে দিয়ে দিলামঃ

(লেখাগুলি আজ আর নেই। কিছু মানুষ সেগুলিকে গায়েব করার সকল পাকা বন্দোবস্ত করেছেন, সফল হয়েছেন, আনন্দ পেয়েছেন।)

অনেক কথা হল। আমি একটু বাচাল প্রকৃতির মানুষ তো, তাই আরও কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। শেষ করিয়াও করিবো না শেষ! অহেতুক আত্মকথন বাদ দিয়ে বলেই ফেলি!

ধরা যাক, ৩৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় ‘সবচাইতে ভাল প্রস্তুতি’ যতটা নেয়া সম্ভব, সেটার তুলনায় আপনার প্রস্তুতি ৪০%, আর আপনার এক বন্ধু, যার প্রস্তুতি আপনার তুলনায় খুবই ভাল, উনার প্রস্তুতি ৬৫%। এই ১০ দিনে আমার এই লেখাটি ফলো করে (কিংবা না করে) খুব বেশি চেষ্টা করেটরে আপনি আপনার প্রস্তুতিকে নিয়ে গেলেন ৬৫%-এ, আর আপনার বন্ধুটি নিয়ে গেলেন ৯০%-এ। কথা সেটা নয়। কথা হল এই, ‘সবচাইতে ভাল প্রস্তুতি’ বলে আসলে কিছু নেই। সবচাইতে ভাল প্রস্তুতির কোনও দামই নেই, যদি পরীক্ষাটা ভাল না হয়। আপনি নিজের প্রবল ইচ্ছেশক্তি আর আত্মবিশ্বাসের জোরে আপনার ৬৫% প্রস্তুতির ১০০%-ই পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দিতে পারেন, যেখানে আপনার বন্ধুটি উনার ৯০% প্রস্তুতির ৫০% পরীক্ষায় কাজে লাগাতে পারার কারণে আপনার চাইতে ২০% মার্কস কম পেয়ে চাকরিটা হারাতে পারেন। এবং, প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষাতেই এটা খুব খুব কমন একটা ঘটনা। আপনি যা পড়েছেন, তার কিছুই মনে না থাকলে, আমি বলবো, আপনি একজন সুস্থ-স্বাভাবিক ক্যান্ডিডেট। আমি প্রায়ই বলি, শতভাগ শিখেছি ভেবে তার ষাটভাগ ভুলে গিয়ে বাকী চল্লিশভাগকে ঠিকমতো কাজে লাগানোই আর্ট৷ কথাটা এমনি-এমনি বলি না। পরীক্ষা দিন, নিজেই বুঝতে পারবেন।

আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই ১০ দিনকে ঠিকমতো কাজে লাগান, আপনি নিশ্চয়ই পারবেন। ভাবছেন, চাপাবাজি করছি? ব্যাপার না, ওরকম ভাবতে থাকুন। পারব না—এটা বিশ্বাস করে কেউ কোনওদিনই ক্যাডার হয়নি, ক্যাডার হয় না, কখনওই ক্যাডার হবেও না। প্লিজ, ওদের দলে যাবেন না, ওদের দলটাই ভারি, কারণ ওই দলে যাওয়াটা পৃথিবীর সবচাইতে সহজ কাজ। আবারও বলছি, আপনি পারবেন, এই ৩৬তম বিসিএস-য়েই আপনার হবেই হবে!

গুড লাক উইথ দ্য থার্টিসিক্সথ!!