স্টিল ওয়াকিং (২০০৮)

‘স্টিল ওয়াকিং (২০০৮)’ মুভির নামটা নেয়া হয়েছে ১৯৭০ সালের একটা গান থেকে:

এই শহরের আলোগুলি কী দারুণ জ্বলে, তাই না, বলো?

ইয়োকোহামা………..

নীল আলোর ইয়োকোহামা………..

তোমার সাথে একাকী সময় কাটছে দেখো আহা কী সুখে!

………………………………………………………..

………………………………………………………..

হাঁটছি এখনো, চলেছি হেঁটেই……..

যেমনি দোলে ছোট্ট নৌকো, দুলেছি তেমনিই

মৃদু হাওয়ায়

তোমার ওই বাহুর ডোরে,

আমাদের পেছনপেছন আসে কেবলই পায়ের চিহ্ন,

ইয়োকোহামা………..

নীল আলোর ইয়োকোহামা…………

তোমার ওই আলতো-মধুর চুম্বনে………….

হাঁটছি এখনো। স্টিল ওয়াকিং। জন্ম কি মৃত্যু, এ হেঁটেচলা থামায় না কখনো। থমকে যায়, তবু থামে না। জাপানের ইয়োকোহামা শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প ‘স্টিল ওয়াকিং’। আমার দেখা অপূর্ব ফ্যামিলি ড্রামাগুলির একটি। ওজুর সময় থেকে আজকের দিন পর্যন্ত পারিবারিক গল্প জাপানি ফিল্মমেকারদের চাইতে সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে আর কেউ বলতে পারেন না। সেখানে রয়েছে চরিত্রগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও তাদের মধ্যকার মানবিক সম্পর্ক, এই দুইয়ের বাস্তবানুগ চিত্রণ, একইসাথে ঘরের ও বাইরের নিপুণ আমেজ-সৃষ্টি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জেনারেশন গ্যাপ, চিন্তাভাবনার দূরত্ব, ভালোবাসা ও স্নেহের বিনিময়, কিছু মানবিক সংঘাত ও সমন্বয়, এইসব আবহে পুরাতন ও নতুনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মিল, এমন আশ্চর্য মিথস্ক্রিয়া জাপানি ফিল্মে সবচাইতে প্রকটভাবে লক্ষণীয়। পরিবারের ঐতিহ্য ও প্রথাকে ক্যামেরার লেন্সে তুলে আনার সময় জীবনযাপনের নৈমিত্তিক সংকট ও সৌন্দর্যকে ফিল্মের প্রধান উপাদান হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ওজুর পর কোরে-ইদাই সবচাইতে সফল। সে নিরিখে, কোরে-ইদাই ওজুর সবচাইতে সার্থক উত্তরসূরি। তাঁর সিনেমাগুলি যতটা না সিনেমা, তার চাইতে অধিক চিত্রকর্ম, মনে হয় যেন পাশাপাশি সাজানো কিছু ছবিকে আমরা পরপর দেখছি। প্রতিটি ছবিই এর আগের ছবিটার গল্প টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সিনেমার গল্পটা যেন আমাদেরই পরিবারের গল্প, সেখানে আবেগ ও অনুভূতির যে সিনেমাটিক খেলা, নিজের অজান্তেই আমরা সে খেলার একটা অংশ হয়ে যাই যেন। কোরে-ইদার এই ২৪ ঘণ্টার গল্পটি ৬৬ বছর আগে নির্মিত ওজুর টোকিও স্টোরি দেখার অনুভূতি দেয়।

সিনেমায় দেখি, বৃদ্ধা মা ঘরের সব কাজ দারুণভাবে সামলে রাখেন। রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, ঘরের সবাইকে ঠিক সময়ে খাওয়ানো, আড্ডা দেয়া, সর্বোপরি, তাঁর অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক স্বামীর দেখাশোনা করা, সবকিছুই হাসিমুখে করে চলেছেন। সিনেমায় তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী তাঁর মেয়ে চিনামি। মেয়ে তার স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। ছোট ছেলেকেও দেখি তার নতুন পরিবারসহ। গল্পের বৃদ্ধা মা-টি সাধুও নন, সন্তও নন। তাঁর মধ্যে কিছু সংস্কার কাজ করে, আবার কিছু ক্ষেত্রে তিনি মুক্ত মনের। তিনি কখনো উদার, কখনোবা সংকীর্ণ মনের। একেবারেই গড়পড়তা মায়েরা যেমন হয়, তিনি তেমনই। সিনেমায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আবেগ-অনুভূতির দিকগুলিকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে, সেখানে সম্পর্কের জটিলতা আছে, তবে তার উপস্থাপন মৃদু, সরল, সহজ। হালকা মেজাজে এ মুভি দেখে ফেলা যায়, মুভির মেসেজটা বাড়তি কোনো চেষ্টা করে মাথায় নিতে হয় না। সিনেমাটি পারিবারিক বন্ধন, ভালোবাসা, কর্তব্যবোধের গল্প বলে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারার আফসোস ও কষ্টের কথা বলে।

১৫ বছর আগে এই পরিবারের বড় ছেলে জুনপেই তার বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। সে ছিল বাবা-মায়ের একান্ত অনুগত, দুই ছোট ভাইবোনের প্রিয় ভাই। তার মৃত্যুদিবসকে সামনে রেখে পরিবারের সদস্যরা একসাথে মিলিত হয়। সেদিন তার সমাধিতে ফুল দেয়া হয়, প্রার্থনা করা হয়। সাথে থাকে কিছু খাওয়াদাওয়ার ঘরোয়া আয়োজন। পরিবারের ছোট ছেলে রিয়োতা। জীবনে তেমন কিছু করতে পারেনি। নিজের পছন্দে বিয়ে করছে এক বিধবা মেয়েকে, সে মেয়ের আগের ঘরের এক ছেলেও আছে। রিয়োতা নিজের খেয়ালখুশিতে চলে। বাবা-মায়ের কোনো স্বপ্নই সে কখনো পূরণ করতে পারেনি। বাবা প্রায়ই বলেন, আমার জুনপেই না ডুবে তুই ডুবলি না কেন? বাবার উপর তার অনেক রাগ। সাথে জুনপেইয়ের উপরও। দাদা অতোটা চমৎকার ছিল বলেই তো তাকে সবসময়ই অপদস্থ হতে হয়! কিন্তু জীবনটা তো তার নিজের, সেটাকে কীভাবে কাটাবে, সে সিদ্ধান্তও তো তার ব্যক্তিগত। সেখানে বাবা-মা নাক গলাতে আসে কেন? সবাইকেই বড় কিছু করতেই হবে, এরই বা কী মানে? ছোটোখাটো কিছু একটা করে সাদামাটা জীবন তো কাটিয়েই দিচ্ছে। এতে যদি তার নিজের এবং তার পরিবারের কোনো আপত্তি না থাকে, তবে তাকে নিয়ে কেন সবার এত মাথাব্যথা? সে কারো সাহায্য নিয়ে চলে না, নিজের মতো করে নিজের সীমিত সামর্থ্যে চলে। এইসব মাথায় এলে তার বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। বড় ছেলের মৃত্যুর শোক বাবা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তাঁর বারবারই মনে হয়, জুনপেই কেন মরল? রিয়োতা কেন নয়? তিনি প্রায়ই খিটখিটে ও নিঃসঙ্গ সময় কাটান।

দিনটি এল। সে দিনে যাকে বাঁচাতে গিয়ে জুনপেই মারা যায়, তাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। প্রতিবছরই। তার নামটা সিনেমায় বলা হয়নি। সে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ একজন মানুষ, শারীরিক গঠনে বেশ স্থূলকায়। জুনপেইয়ের মৃত্যুর জন্য সে বারবারই সবার কাছে ক্ষমা চাইতেই থাকে। তার মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করে, এবং তার কাছে মনে হয়, সে মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী। প্রতি বছর সেইদিন প্রচণ্ড গ্লানি ও বেদনা নিয়ে তাকে জুনপেইয়ের পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটাতে হয়। তাকে দেখে বাবার বারবার মনে হতে থাকে, এরকম একটা অথর্বকে বাঁচাতে জুনপেই নিজের জীবন বিলিয়ে দিল! তবে তার প্রতি রিয়োতার এক ধরনের সহানুভূতি কাজ করে। তার বিব্রত অবস্থা রিয়োতাকেও স্পর্শ করে। দুজনই জীবনে ব্যর্থ মানুষ, ফলে বাবার অপছন্দের মানুষ, সে কারণে এই টান, নাকি সে আছে বলেই জুনপেই নেই, সে কারণে এ টান, তা অবশ্য বলা শক্ত। রিয়োতা মাকে অনুরোধ করে যেন দাদার মৃত্যুর দিনে সে লোকটিকে নিমন্ত্রণ না করা হয়, কী দরকার বেচারার কষ্ট বাড়িয়ে? কিন্তু মা বলেন, অবশ্যই তাকে নিমন্ত্রণ করা হবে, এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে, সে-ই জুনপেইয়ের মৃত্যুর কারণ। সে কষ্ট পায় বলেই, তাকে খুবই আন্তরিকভাবে নিমন্ত্রণ করা হয়। প্রতিবছরই! মা চান, তাঁর ছেলে যাকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেল, বেঁচেথাকার অপরাধবোধ তাকে যেন সবসময়ই তাড়িয়ে বেড়ায়। ছেলেটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। জুনপেই নিজে মরে তাকে বাঁচিয়ে দেয়। যার মৃত্যুর কারণেই সে বেঁচে আছে, তার মৃত্যুদিবসে তার পরিবারের সাথে সময় কাটানো যে কতটা কঠিন ও যন্ত্রণার, তা তীব্রভাবে অনুভব করাতেই তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। সিনেমায় মায়ের এই সূক্ষ্ম ও ‘সঙ্গত’ প্রতিহিংসাবোধ আমাদের ভাবায়, নাড়া দেয়।

আজ থেকে ৫০ বছর পরও যেসব সিনেমা টিকে থাকবে, ‘স্টিল ওয়াকিং’ সে তালিকায় থাকবে বলে মনে হয়। চাপা ক্ষোভ, সংবেদনশীলতা, নস্টালজিয়া, অপরাধবোধ, আকাঙ্ক্ষা, আফসোস, ভালোবাসা—এইসব মানবীয় উপাদান আধুনিক মানুষমাত্রই ভদ্রতার মুখোশে যথাসম্ভব আড়াল করে রাখে। এ সিনেমায় পারিবারিক বলয়ের মধ্যে এইসব উপাদানের নীরব উপস্থিতি আমাদের এমন একটা মনস্তাত্ত্বিক আবেশে নিয়ে যায়, যা টিকে থাকে সিনেমা শেষ হবার বহুক্ষণ পর অবধিও। কিছু সিনেমা নিয়ে আমাদের গল্প করতে ইচ্ছে করে, খাবারের টেবিলে কিছু সিনেমার আলোচনা উঠে আসে। এ সিনেমা তেমনই একটি সিনেমা। একই পরিচালকের ‘নোবডি নৌজ’ মনে গভীর দাগ রেখে গিয়েছিল, ‘স্টিল ওয়াকিং’ দেখেও শ্রদ্ধায় টুপিটা খুলে রাখতেই হল।