সূর্যাস্তের বাঁকে

 
তুমি এমন একটা মানুষ, যাকে দেখা যায়, কিন্তু যার সাথে দেখা করা যায় না। আচ্ছা, আমাকে তুমি পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বলবে, প্লিজ? তুমি বলেই দেখো না একবার, আমি সব ছেড়ে দিব। আমি আসলেই অপেক্ষায় আছি, কেউ একজন আমাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিব, কিন্তু কেউ বলে না, ভুলেও বলে না কেউ। এজন্যই বলি, প্রেমটা আর একটু মনোযোগ দিয়ে করো। তুমি তো আমার কোনও কথাই শোন না। মন দিয়ে প্রেম করলে আমার পড়াশোনায় এখন যা-ও মন আছে, তা-ও চলে যেত। আর কাউকে কিছু বলতে হতো না, আমি নিজ থেকে ছেড়ে দিতাম। আর শোনো, তুমি আমাকে ভালো না বাসলে আমি বোধহয় মরেই যাই! তখন দমটা যায় যায় অবস্থা হয়ে ওঠে, আবার এই যে যখন বেশি বেশি ভালোবাস, তখনও মনে হয়, এবার দমটা বোধহয় সত্যিই…আচ্ছা, তুমি আমার সাথে চ্যাটিং করার সময় কেবল হি হি লিখে রিপ্লাই কর কেন? আমি তোমাকে একদিন শেখাব কী করে কুইচ্চামুরগির মতো হি হি করে জোর করে না হেসে হোহ্‌ হোহ্‌ করে হাসতে হয়। তোমাকে এক ভণ্ড প্রতারকের কথা বলেছিলাম না? জানো, অনেক কিছুই শিখেছি তার কাছে। সে খুবই ভদ্র, অমায়িক, ধৈর্যশীল, মিষ্টভাষী। আগে ভাবতাম, আমি ভণ্ড আর ভদ্র, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা ধরতে পারি। এখন জানলাম, আমি ভুল ভাবতাম।


জানো, আমার একটা ডায়রি ছিল, ভূরি ভূরি লেখা ছিল ওতে। প্রেম, বিরহ, বাস্তবতা, জীবনবোধ নিয়ে বড় বড় লেখা ছিল। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ওটা কিনেছিলাম। তোমার সাথে দেখা হওয়ার কিছুদিন পর চুরি হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে বলছিলাম তো, পোস্টও দিয়েছিলাম। সেই চোর ফোন, ল্যাপটপ কিছুই নেয়নি, ওই ডায়রিটাই কেবল নিয়ে গেছে। অনেক কেঁদেছিলাম। ডায়রিটা অনেক পুরনো অনুভূতিতে ভর্তি ছিল। তখন ব্রেইনটা শার্প ছিল, দারুণ সব কথামালায় ভর্তি ছিল। আগের বাসায় থাকাকালীন জানালা দিয়ে কাগজে নাম্বার লিখে পাঠাত একটা ছেলে সব সময়, তোমাকে বলেছিলাম না? ওই ছেলেটাই নিয়েছে। পাশের বিল্ডিংয়ে থাকত, এখন আমেরিকায় চলে গেছে। যাবার আগে আমার সাথে খুব যোগাযোগের চেষ্টা করছিল, শেষমেশ ডায়রিটাই নিল! চোর হলে তো ফোন, ল্যাপটপ, টাকা সবই নিত, সব তো টেবিলে খোলাই ছিল। কিচ্ছুতেই হাত দেয়নি এক ডায়রি ছাড়া। ছেলেটা আমাদের বাসার রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আমি রান্নাঘরে গেলে চুপিচুপি দেখত। পরে যখন বুঝতে পেরেছি, এটা নিয়ে কমপ্লেইন করেছি। কিছু দিনের মধ্যেই শুনলাম, সে চলে গেছে। অনেক বিষয় নিয়ে ওখানে লিখতাম। এই যেমন প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, অপ্রাপ্তি, একাকিত্ব, দূরত্ব, সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি! আমার লেখার রাজ্যে কোনও বন্ধন ছিল না, বাহ্যিক কোনও তাগিদ ছিল না। সৃষ্টির ক্ষেত্রে বন্ধনমুক্তিই সবচেয়ে ভালো। যা লিখতে ইচ্ছে করে, তা-ই লিখতাম। ফরমায়েশে ফুচকা-চটপটি হয়, সাহিত্য হয় না।


জানো, কালকে আমার প্রাক্তনের সাথে কথা হলো অনেকক্ষণ। আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করেছিল, কেমন জানি মায়া করে করে কথা বলছিল। আমার মনটা কেমন জানি করছে। আমাকে দুএকটা গালি দিয়ে দাও। আমার হাত-পা কাঁপছে। আমি ওকে খুব বেশি আঘাত করে করে কথা বলেছি। এখন মন পুড়ছে, কেমন জানি কান্না পাচ্ছে খুব। আজ রাস্তায় নামব। আমি মন খারাপ হলে রাস্তায় নামি। কুকুরদের জন্য খরচ করতে পছন্দ করি। এরা কখনওই অকৃতজ্ঞ হয় না, ধন্যবাদও বলে না, তবুও পরম একটা শান্তি মিলে, সুখ পাই। এদের জন্য প্রতিমাসেই আমার আলাদা একটা বাজেট থাকে। আমার ঘরে আমার জন্য কোনও দামি জুয়েলারি নেই, কসমেটিকস বা সাজগোজের আহামরি কোনও জিনিস নেই। স্রেফ দুটো লিপস্টিক, দুই জোড়া কানের দুল, একটা কাজল, একটা ফাউন্ডেশন দিয়েই একটা বছর কাটিয়ে দিই। শপিংয়ের জন্য আমার কখনও বাজেট লাগে না। পৃথিবীতে বোধহয় আমিই একমাত্র মেয়ে যে কিনা শপিংপ্রিয় না। যে যেখানে সুখ খুঁজে পায় আরকি…এমন একটা কথা আছে না? আমিও রাস্তায় নেমে মাটিতে মিশে যেতে সুখ পাই। এ সুখের ওজন কোনও নিক্তিতেই হয় না।


আজ আমার মনটা ভালো নেই, কিন্তু কেন নেই, তার সঠিক কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, পুরো একটা দুনিয়ায় একমাত্র আমি ছাড়া আর কোনও জনমানব নেই। হঠাৎ এমন অদ্ভুত রকমের একা লাগছে কেন? মনে হচ্ছে যেন আমি কারও না, যেন দুনিয়ার কেউই আমার না, যেন আমি নিজেই নিজের কেউই না! একা লাগছে, ভারি একা। এই একাকিত্বে আমি তলিয়ে যাচ্ছি। তুমি আছ, তবুও মনে হচ্ছে, কোথাও তুমি নেই। আমার একটা পরিবার আছে, অথচ মনে হচ্ছে, আমার কোথাও কোনও পরিবার নেই। সব সময় মনে হয়, আমার মনটা কিছু একটা হাতড়ে বেড়ায়, কাকে জানি খুঁজে বেড়ায়, আমার কে জানি নেই, আমি কী জানি চাই! কী অদ্ভুত এক শূন্যতা, বিশাল এক অপ্রাপ্তি, কী জানি খুব চেয়েও পাই না, কী জানি খুব পেয়েও চাই না। আমার এমন লাগে কেন? আমি আর আমার মন কি তবে আলাদা দুটো সত্তা? আলাদা দুটো মানুষ আমরা? আমি কি আমার ভেতর অন্য এক আমি’তে বসত করি? আমি কি তবে আবার আগের আমি’টায় ফিরে যাচ্ছি? আমি কি আবার অসুখী হয়ে যাচ্ছি, ঠিক জন্মের সময়টার মতো?


আমার এমন কী নেই? রূপ? গুণ? যোগ্যতা? স্বাধীনতা? কী নেই আমার? তবুও কেন মনে হচ্ছে আমার সত্যিই কিছু নেই? আমি খুব অল্পে সুখী হয়ে-যাওয়া মানুষটি কেন এত এত প্রাপ্তির ভিড়েও এত গভীর শূন্যতায় ডুবে গেলাম? আমার মনে হচ্ছে, আমি কেউ নই, আমার কেউ নেই, আমার কিচ্ছুটি নেই। কোথায় জানি দুমড়েমুচড়ে ভেঙেচুরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এপারে আমি ওপারে সুখ, মাঝখানে কাচের দেওয়াল, দেখা যায় তো ছোঁয়া যায় না।


মানুষজনের সাথে কথা বলতে আমার তেমন একটা ভালো লাগে না। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথাও বলি না, কারও সাথে মিশিও না। আমার একা থাকতেই ভালো লাগে। আমার যত কথা, যত গল্প, যত অভিযোগ, যত না-পাওয়া সবই একমাত্র বাবার সাথে বলি। আমার অনেক কথা বলার আছে বাবাকে। সবার চোখে আমার বাবা ওই একটা ফ্রেমেবাঁধা মৃত ছবিমাত্র, আর আমার চোখে বাবাই পুরো একটা পৃথিবী, জীবন্ত একজন মানুষ। সব কথা সবাইকে বলা যায় না, কিন্তু বাবাকে আমি সব কথা বলি। কখনও বাবা হাসে, কথা বলে, কখনওবা আমার চোখে চোখ রেখে হাউমাউ করে কাঁদে। আচ্ছা, বাবা বেঁচে থাকলে বাবাকে কী নামে ডাকতাম? বাবা আমাকে কোন প্রিয় নামে ডাকত? কপালে কি চুমু খেত? চুলে বিলি কেটে দিত? আমার কাছে বাবাকে রূপকথার মতো লাগে। সবার রূপকথার জগত আর আমার রূপকথার জগতের মধ্যে কতই-না পার্থক্য!


আচ্ছা, সবার সন্তানের জন্য সবার যেমন ভীষণ মায়া হয়, যেরকম গভীরতা দিয়ে সবাই সন্তানকে ভালোবাসে, ঠিক ওরকম মায়া, ভালোবাসা বুঝি আমারও প্রাপ্য ছিল? আমিও পেতাম বুঝি? সেদিন আমার এক ভাইয়ার ছেলের খুব অসুখ ছিল। সেদিন সারাক্ষণই দেখলাম ভাইয়ার চোখে ছেলের জন্য কী এক অদ্ভুত মায়া, ছেলের ব্যথায় কী ভীষণ এক যন্ত্রণাবোধ, আমি বারবার ভাইয়ার চোখ পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, বাবা আজ বেঁচে থাকলে এমন মমতা আমার জন্যও থাকত বাবার চোখে। সেদিন বুঝেছি, ভাইয়া একজন আদর্শ সন্তান, স্বামী বা প্রেমিক হতে পারুক বা না পারুক, একজন নিখুঁত বাবা হয়েছে। সেদিন ভাইয়ার চোখে পিতৃত্ব দেখে কেন জানি তীব্র তৃষ্ণায় ভুগেছি। কেঁদেছিলাম সারারাত। আমার ওই জগতটা কেন এমন ঘোর অন্ধকার! আমার কী দোষ ছিল!


জানো, ছোটবেলায় বন্ধু-বান্ধবীরা যখন স্কুলে যেত, তখন ওদের বাবারা ওদের হাতে একটাকার একটা পয়সা ধরিয়ে দিত, মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। আস্তে আস্তে বুঝলাম, আমি জগতের অর্ধেকটার সকল বিষয়ে অপূর্ণতা পেতেই জন্মেছি। খুব ইচ্ছে করত, আমাকে বাবা আমাকে একটা পয়সা দিক, মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খাক। বুকে জড়িয়ে খানিকটা সময় চেপে ধরে রাখুক, বুকের কোনও একটা জায়গাটায় জানি কেবলই ধু ধু মরুভূমির মতো। আমি এমন একটা জন্ম চাই, যে জন্মে বাবাকে এই বুকে সজোরে জড়িয়ে ধরে একশো বছর ধরে হাউমাউ করে কাঁদব। আমার ভেতরটায় জমেথাকা জলের মহাসমুদ্রে ভেসে যাবে গোটা দুনিয়া। সত্যি আমার ভালো লাগছে না কিছুই।


তোমার মন খারাপ করে দিলাম, তাই না? এসব মোটেও বলি না কাউকে, হঠাৎ আজ বলে ফেললাম। তোমাকে তো আমার জীবনের অনেক অলিগলিই দেখানো হয়নি, অনেক কিছুই বলা হয়নি। কেন জানি এসব বলতেও ইচ্ছে করে না। মনে হয়, আমি অন্য কারও মন খারাপ করে দিচ্ছি। এ জীবনে অনেক কথাই কখনওই বলা হবে না। আমি এমন কেন? এসব ভেতরে ভেতরে জমিয়ে রেখে নিজেকে কষ্ট দিতে আমি অদ্ভুত ধরনের শান্তি পাই। আমি পুরোটা নারকেলের মতো, উপরে শক্ত আবরণ, ভেতরে টলটলে পানি। তোমাকে এসব বলে ফেলে একটু হালকা লাগছে। ভুল বললাম, বলে ফেললে না, বরং কেঁদে ফেললে নিজেকে হালকা লাগে। তোমাকে আমার নব্বইভাগ কথাই বলা হয়নি, ষাটভাগ কথা কখনওই বলা হবে না।


আমাকে কখনও ‘কেমন আছি’ জিজ্ঞেস কোরো না। তুমি কি নিজে জানো তুমি কেমন আছ? নিজে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পার না, সে প্রশ্নের উত্তর অন্য কারও কাছ থেকেও জানতে চেয়ো না। এটাকে বলে লিভ অ্যান্ড লেট লিভ। আচ্ছা, একটা কথা জানতে ইচ্ছে হলো আজকে। আমাদের মধ্যে প্রথম কে ‘ভালোবাসি’ বলেছিল? প্রথম কে প্রপোজ করেছিল? সেদিন আমার এক বান্ধবী জিজ্ঞেস করছিল কে প্রথম, আমি টানা তিনঘণ্টা ভেবেও উত্তরটা খুঁজে পাইনি। কখনও মনে হয়েছে তুমি, কখনও মনে হয়েছে আমি। থাক, এটা অমীমাংসিতই থাক। পৃথিবীর কিছু জিনিস অমীমাংসিতই সুন্দর। আগামী দশ বছর পর কেউ এটা জিজ্ঞেস করলে তখন এটা নিয়ে আমরা ঝগড়া করব, কারণ আমাদের আসলে ঝগড়া করার জন্য কোনও ইস্যুই নেই, আমরা কিছু পাইও না। অথবা আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাওয়ার পরও কেউ কাউকে ব্লেইম করার জন্য বলতে পারব না যে…‘ওই কুত্তাটাই আগে প্রপোজ করে আমাকে পটিয়েছে!’ এত নাইস একটা বিষয় কেমনে এড়িয়ে গেলাম এত যুগ! বাই দ্য ওয়ে, তুমি আমাকে অ্যাভয়েড করে যাচ্ছ অনেকদিন ধরে। সেদিন একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, তোমার সাথে আমার এমন কীসের সম্পর্ক, এ সম্পর্কের কোনও ভবিষ্যৎ নাই, কেন আমি এখান থেকে বের হয়ে যাচ্ছি না, ভেঙে কেন দিচ্ছি না সব কিছু…সবশেষে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার কী হও? আমি তেমন কিছু বলিনি, শুধু উত্তর দিয়েছি, ‘সে আমার পুরো একটা সংসার!’


আজ ভালোবাসা-দিবস, আর আমাদের প্রতিদিনই তুমুল ভালোবাসা-দিবস, প্রতিদিনই প্রেমদিবস। আজকের এই দিনটা আমাদের প্রতিদিনের ভালোবাসা-দিবসের কাছে কিছুই না। তবুও ভালোবাসা-দিবসের শুভ্র ভালোবাসা দিলাম একরাশ, মুঠো ভরে নিয়ো।


(চার দিন পর।) আমি ব্যবসা ব্যবসা খেলি না কখনও কারও সাথে, শুধু দেখে যাই, কে কে আমার সাথে ব্যবসা করে কত লাভ করতে পারে! তুমি কোথায় ছিলে এত দিন? এমন কী কাজ ছিল যে আমাকে একটা মেসেজ দেওয়ারও দরকার পড়েনি? তুমি জানো না আমি তোমাকে ছাড়া একঘণ্টাও থাকতে পারি না? তুমি জানো না তুমি জাহান্নামে মরতে গেলেও কেউ একজন তোমার অপেক্ষায় থাকে? তুমি তোমার ভুলের কারণেই একদিন আমাকে হারাবে, দেখো! তুমি আসার পর আমি আরও একা হযে গেছি। তুমি থাকার পরও আমার একা লাগে কেন? আমি থাকার পরও তোমার একা লাগে কেন? তবে কি এর মানে আমরা দুজন দুজনের জন্য সঠিক মানুষটি নই? আমি আজ অনেক বকব তোমাকে। আমাকে বকতে দিয়ো, নইলে রাগ জমে থাকে। রাগগুলো জমতে জমতে বিতৃষ্ণায় পরিবর্তিত হয়, আর আমি বিতৃষ্ণা নিয়ে কারও সাথে একটা ইয়েস-নো পর্যন্ত বলতে পারি না। আমি মুখে এক, মনে আর এক হতে পারি না। এজন্য আমার সাথে বেশি দিন কারও সম্পর্ক টিকে না। আমাকে নিয়ে তোমার যত অভিযোগ সরাসরি বলে দিয়ো, এতে আমি বুঝতে পারব আমার কোথায় ভুল হচ্ছে। আমি আপাতত নতুন কোনও রিলেশনে জড়াতে চাইছি না।


মাঝে মাঝে তোমার ভুল ধরি। এটা ভুলধরা নয়, এটা ভুল ধরিয়ে দেওয়া। আমি তুমি দুজনেই অন্তত ম্যাচুরিটিতে রিলেশনে-থাকা অন্য আট-দশটা কাপল থেকে অনেক এগিয়ে, এজন্য আমাদের তেমন একটা ঝামেলা হয় না, কিন্তু মানুষমাত্রই তো ভুল করে। কিছু ভুল ধরিয়ে দিতে হয়, কিছু ভুল ছেড়ে দিতে হয়। এতে সম্পর্কের সজীবতা থাকে। তোমার লাইফে অন্য কেউ চলে এলেও আমাকে বলে দিয়ো, আমি সময়মতো সরে আসব, কিন্তু প্লিজ হেঁয়ালি কোরো না। আমি যে কী পরিমাণ তুমিনির্ভর সেটা ভাবতেই পারবে না তুমি। মাঝেমাঝে তোমার হেঁয়ালিতে জীবনে অন্য কেউ আসার আশংকা তৈরি হয়ে যায়, এটা আমার জন্য সত্যিই ভীতিকর। তোমার আর আমার চিন্তাধারায় প্রায়ই মিল আছে। এটা শুরু থেকেই বুঝেছিলাম, এজন্য তোমার জন্য একধরনের ভালোলাগা কাজ করত। আমিও তোমার মতো চিন্তাধারার কারণেই মানুষের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হই। সমচিন্তার মানুষ পাওয়া অনেক বেশি টাফ একটা ব্যাপার। আমার জীবনে যেসব মানুষ এসেছে, তাদের বেশিরভাগই হাই-প্রোফাইলের, বাহ্যিক সৌন্দর্যে-ঠাসা, কিন্তু একেবারে অকাটমূর্খ! তোমার সাথে এ কারণে থেকে যেতে চাওয়া, আমার লাইফে তৃতীয় কোনও ব্যাক্তির আগমন না ঘটলে তোমার সাথে আমি বাকি জীবনটা অনায়াসে পার করে দিতে পারব। আমার লাইফে তৃতীয় কেউ আসবে কি না, সেটা অনেকটা নির্ভর করে তোমার উপর। আমার কাছে তোমার কোনও দ্বিধা রেখো না, কারও সাথে তুমি শুয়ে এলেও আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে। আমি দিলখোলা মানুষ, দিলটা আমার মহাকাশের চেয়েও ঢের বিশাল।


সকাল থেকেই কেমন জানি আমার বুকের ভেতর কে একজন হাউমাউ করে খুব কাঁদছে। ইদানীং খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে। একসময় তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে, তাই না? একসময় আমাদের আর কোনও কথা হবে না, তাই না? পৃথিবীর ওই ‘একসময়’টা কত বিচিত্র! গতবছর এই দিনে, এই সময়টায় যে ছিল আমার সবটা জুড়ে, এই বছর তার জায়গাটা অন্য কেউ দখলে নিয়েছে। আগামীবছর, এই দিনে, এই সময়টায় অন্য কেউ হয়তো তোমার জায়গাটা দখলে নিয়ে নিবে, তাই না? আমি আমাকে আর বিশ্বাস করি না। আমি আমার নিজেকে বাদে আর কাউকে ভয় পাই না। প্রতিটা বছরই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে, একজন পেলাম তো আর একজন হারালাম। মাঝেমাঝে এসব ভেবে আমি খুব ক্লান্তবোধ করি। তোমাকে যেরকম ‘আমাকে ছেড়ে যেয়ো না’ বলে বলে জাপটে ধরি, ওরকম গতবছর অন্য একজনকেও বলতাম। একদম মন থেকেই বলতাম। তুমি যে উত্তর দাও, ঠিক একই উত্তরই সেও দিত। আমিও কেমন জানি সবটা দিয়ে আটকে রাখতে চাইতাম ওকে, পরে আমি নিজেই ওকে দূরে ঠেলে দিতাম। আমার নিজের প্রতি নিজেরই বিতৃষ্ণা জন্মেছে। আমি কাউকেই কেন ধরে রাখি না? কেউই কেন ধরে রাখার মতো হয় না? আমি বোধহয় নিজেই জানি না আমি কী চাই!


আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা, বলুন তো, আগামীবছর ঠিক এই সময়টায় আমি কার সাথে? কী করছি? কাকে ভালোবাসছি? তোমার মতোই সে-ও উত্তর দিত, আমি আছি, আমিই থাকব। আজ, কাল এবং আজীবন! এসব ভেবে আমার কান্না পাচ্ছে। আমার কাছে অদ্ভুত লাগে, আমি যা ভাবি, বেশিরভাগ সময়ই তা-ই ঘটে। আমি কখনও কখনও ভবিষ্যৎ দেখতে পাই, হুবহু একই রকম, যেরকম সত্যি সত্যি ভবিষ্যতে ঘটবে, আমি তা-ই দেখে ফেলি। বিশ্বাস না হলে তোমাকে একটা প্রমাণ দিব। মিলিয়ে দেখো, আমি যা-ই বলব, হুবহু তা-ই ঘটবে। এটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়। কখনও কখনও আমি ভবিষ্যতের কতগুলো ঘটনা স্পষ্টই দেখে ফেলি। এটা ছোটবেলা থেকেই ঘটত আমার সাথে। আমি তোমাকে এরকম কিছু একটা বলব যা হুবহু ঘটবে তোমার জীবনে। সময় হোক, বলব। চাইলেই বলা যায় না অবশ্য, আগে দেখতে হয় সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে। যেমন ধরো, আমার ম্যাট্রিকের রেজাল্টটা আমি স্পষ্টই দেখতে পেয়েছিলাম। ৪.৩১। আমি অনার্সের হুবহু রেজাল্ট দেখেছিলাম, মাস্টার্সে সেকেন্ড ক্লাস পাব তাও দেখেছি, তবে পয়েন্ট দেখিনি। আজাদের সাথে লাস্ট যেদিন রাতে আমার কথা হচ্ছিল, সেদিন, স্পষ্টই মনে আছে যে কথা শেষে আমি খুব কাঁদছিলাম। সেই রাতে আর ঘুমাতে পারছিলাম না একদমই, ঘুমাইওনি সারারাত। কারণ আগামীকাল থেকেই ওর সাথে আমার আর কথা হবে না, এটা আমি হলফ করে জেনে গেছি। অথচ ও বলেছে, কাল সকালে কথা হবে। বিশ্বাস করো, সত্যি সত্যি তার পরদিন থেকে ওর সাথে আমার কথা হয়নি আর। আরও অনেকগুলো বিষয় আছে। আমি এই ভবিষ্যৎ দেখে ফেলাটাকে খুব ভয়ংকর রকমের ভয় পাই। তোমাকে ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে বলিনি এটা। এটা এক ধরনের ক্ষমতা। খুবই দুর্লভ ক্ষমতা।


কলেজে থাকতে একজনকে খুব পছন্দ করতাম, ওর সাথে জড়াতে চাইতাম সম্পর্কে, কিন্তু আমি স্পষ্টই দেখতে পেয়েছিলাম যে শহরে যাওয়ার পর একজনের সাথে আমার প্রেম হবে, তার গোলগাল চেহারা, গালভর্তি দাড়ি, মায়ায় ভরা চেহারা, মাথাভর্তি চুল। বিশ্বাস করো, আমি ওই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে শহরে এসেছি, সত্যিসত্যি যেরকম চেহারা দেখেছিলাম, ওরকমই চেহারার আজাদের সাথে পরিচয়, তার সব কিছুই স্পষ্ট দেখে ফেলেছিলাম আগেই। আমার একজন শিক্ষকের সাথে প্রেম হবে, সেটা আমি ইন্টারে থাকতেই বুঝতে পেরেছিলাম এবং সেটা সেকেন্ড ইয়ারেই হবে সেটাও জানতাম, সত্যি সত্যি তা-ই ঘটেছে। কোনও ঘটনার মধ্য দিয়ে না গেলেও আমি স্পষ্টই ঘটনার তিক্ততা সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারণা দিতে পারি, যেরকমটা একজন ভুক্তভোগী ভোগে, তার অনেকটাই আমি বলে দিতে পারি। আমি কখনও বিয়ে করিনি, কিন্তু দাম্পত্য অশান্তি বা সুখ সম্পর্কে তোমাকে হুবহু বলে দিতে পারব। এরকম প্রায় ঘটনাই মিলে যায়।


আমি তোমাকে তোমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলে দিতে পারব, তবে আমি কখনও কোনও রকম চ্যালেঞ্জ নিয়ে পরীক্ষা করিনি, তাই তোমাকে আমি তোমার সম্পর্কে বললে আমি যা বলছি, তা ঠিক কি ভুল, সেটা সততার সাথে বলতে হবে। তোমাকে তোমার স্ত্রীর সাথে একসাথে কখনও দেখিনি, দেখলে আমি অনেক কিছুই বলতে পারতাম। এখন যা বলব, তা অনেকটা তোমার উপর ভিত্তি করে, অপর পক্ষকে না দেখে বললে কিছুটা ভুলও হতে পারে। তবে ভুল না হবার সম্ভাবনাও আছে। এই ঘটনাগুলো মাকে একবার হালকা করে বলেছিলাম, মা চুপচাপ ছিল। জানো, তার পর অনেকদিন আমার সাথে ওই ঘটনাগুলো ঘটেনি। পরে আস্তে আস্তে আবার শুরু হয়েছে। আমি তোমার সম্পর্কে কিছু কথা বলব...তুমি নিজেই তো নিজেকে চিনতে পার না। তবে আমি যা যা বলব, তা তা ঠিক কি ভুল আমাকে বলতে হবে। এখন তোমাকে এই ব্যাপারটা বলে দিয়েছি, তাই, বিশ্বাস করো, ওই ঘটনাগুলো অনেকদিন আর ঘটবে না, মানে ভবিষ্যৎ-দেখাটা অনেকদিনই আর ঘটবে না। তবে আগের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে আমি তোমার সম্পর্কে বলব।


তোমার স্ত্রী তো বাপের বাড়িতে গেছে, তাই না? তোমার মনে হচ্ছে, তুমি অনেক কোটি বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেয়েছ, কেমন একটা অদ্ভুত শান্তি, সুখ সুখ ভাব, এমনকি মেয়ের জন্যও তোমার একটুও মন পুড়ছে না, মাঝেমাঝে একটু একটু মনে পড়ে, তবে আহামরি কিছু না, যেরকমটা একজন বাবার মনে পড়া উচিত, ওরকম করে না। তুমি এই মুহূর্তে তোমার পা ছড়িয়ে বসে আছ। তোমার শরীর হেলিয়ে-দুলিয়ে অদ্ভুত এক ধরনের শান্তিবোধ হচ্ছে। তুমি ভাবছ, এরকমই ভালো! আরও ভালো হবে আজীবনই এরকম থাকলে, তোমার বাসার পাশের রুমগুলোতে অন্যরা না থাকলে আরও খুশি লাগত, এমনকি মা-বাবাও যদি না থাকত, খারাপ লাগত না। আপাতত এইটুকু মিলিয়ে দেখো মিলে কি না। তোমার বই পড়তে ইচ্ছে করে, কিন্তু তুমি পড় না। নাড়াচাড়া করে, উল্টেপাল্টে আবার রেখে দাও। কেমন জানি পড়তে যাচ্ছ, কিন্তু কিছু পড়তে গেলে ওটা পড়ার চেয়ে না পড়েই বরং বেশি স্বস্তিবোধ করছ। এটা তোমাকে কীরকম জানি একটা অনুভূতি দিচ্ছে, তবু তোমার খুশি খুশি মন, হাসি হাসি চোখ। আমি আবার কেমন জানি দেখতে পাচ্ছি, একটা চেয়ারে বসে আছ তুমি, তোমার ঠিক কী করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তুমি নিজেই বুঝে উঠতে পারছ না। চেয়ারে হয়তো এর মধ্যে কখনও বসেছিলে, তবে এই মুহূর্তে নাও থাকতে পার। চেয়ারে বসে ঠিক কী করবে ভাবছিলে, কিন্তু কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারছিলে না। তোমার অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু তেমন কিছুই তুমি করছ না। তাতে তোমার ভেতরে তেমন কোনও অপরাধবোধ বা বিতৃষ্ণাবোধও হচ্ছে না।


তুমি একটু আগে চেয়ারে বসে লিখছিলে...আমার কথা ভেবেছ একটু, তোমার বারবারই মনে হচ্ছিল, আমাকে যতটা ভালোবাসা দরকার, ততটা এখনও বাসতে পারোনি। নিজের প্রতি কেমন একটা নিঃস্পৃহতার জন্ম নিচ্ছিল তখন...আজ অফিসে যাবার সময় বউয়ের সামনে বাসায় এমন ভান করে বের হয়েছ যেন বউ-বাচ্চা ছেড়ে থাকতে তোমার খুবই কষ্ট হবে, খুব দায়িত্বশীলতা দেখিয়েছ। অফিসে যাবার পথে মনে মনে খুশিতে হেসেছ, অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময়ও মনটা প্রফুল্ল ছিল।


আমি কখনও আমার প্রাপ্য ভালোবাসা কারও কাছ থেকেই পাব না, শুধু তুমি না, তোমার পর কেউ এলে তার কাছ থেকেও না। আমি আজীবনই এক ধরনের অপূর্ণতায় থেকে যাব, এটা আমি দেখেছি। এমনকি আমার জীবনের আশিভাগই অজানা থেকে যাবে এই দুনিয়ায়, সবার কাছে এই আশিভাগ অজানা নিয়েই আমি মরে যাব। দুইটা অনুমান করছি। এক, আমার অ্যাবনরমাল ডেথ হবে। দুই, মরার সময় খুব বেশি বয়স হবে না আমার। আমি আমার বাবার বয়সের কাছাকাছি বয়সে মারা যাব। আমি তোমার আগেই মরব, মিলিয়ে নিয়ো। আর একটা কথা। আমি কিন্তু অ্যাবনরমাল ডেথ বলতে সুইসাইড বুঝাইনি। রোগভোগে বা বার্ধক্যে নয়, আমি মরে যাব অন্য কোনও কারণে, হতে পারে সেটা অ্যাক্সিডেন্ট, মার্ডার। তবে আমি এমন একটা সময়ে মরব, ঠিক যে সময়টায় আমি খুব করে বাঁচতে চাইব, মানে খুব সুখের সময়ে। আমি কিন্তু এসব নিয়ে ভাবছি না, এসব আমার ভবিষ্যৎ, যা আমি দেখতে পাচ্ছি।


আমার ঘুমের প্রচুর সমস্যা, চাইলেই আমার ঘুম আসে না। এই বাবুই, তুমি আমাকে ভালোবাস না কেন? মাইনষের প্রেমিকরা ওদের প্রেমিকাদের ওগো, জান, কলিজা, পাখি, আরও কত কিছু বলে ডাকে, আর আমারটা আমাকে ‘কুত্তার বাচ্চা’ ‘শুয়োরের বাচ্চা’ ডাকে! এই দুঃখ কই রাখি! শোনো, আমার ভেতর অদ্ভুত কিছু অভ্যাস আছে। এরকম সাধারণত মানুষের থাকে না। কিছু কাজ আমার অবচেতন মনে হয়ে যায়। আমি তোমাকে একবার বলেছিলাম যে আমি নরমাল না। ওই যে মেন্টালি-সিকদের যেরকম থাকে, ওইসবই আমার আছে। আমি নিজেকে ভালো রাখতে লিখি। Writing is the most wonderful antidepressant drug I've ever known. It's the only excuse why I'm still alive. I've no other excuses for living. Yes, often I feel acute love and affection for you. And most of the time I've many guilty feelings. I don't deserve you. You deserve a better person for your life.


কাল ভার্সিটি গিয়েছি। ক্যাম্পাসে পৌঁছে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কয়েকজন স্যার-ম্যামের সাথে কুশলবিনিময় সেরে নিচে নেমে ঝুপড়িতে গেলাম, সাথে কিছু জুনিয়র। আড্ডা, হাসাহাসি, মজা করলাম। দুপুরের খাবার সেরে বন্ধুরাসহ মিলে জিরোপয়েন্টে রংচা খেলাম, সাথে তুমুল আড্ডা। তার পর সাড়ে পাঁচটার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন এল ছয়টায়। সবাই একটু ইমোশনাল হয়ে গেলাম। সবার থেকে বিদায় নিয়ে ষোলশহরে নামলাম। ওখানে আবার নতুন কিছু ফ্রেন্ডের সাথে দেখা, আবারও আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। তার পর শেষবেলায় বিদায় সেরে সোজা বাসায় ঢুকলাম। জামাকাপড় চেঞ্জ করে ড্রয়ার খুললাম, সাথে সাথে মনে পড়ল, আমি সার্টিফিকেটের কাজে ক্যাম্পাস গিয়েছি, অথচ সার্টিফিকেটের কাজ ছাড়া বাকি সব করে এসেছি। বিশ্বাস করো, আমি কাগজপত্র জমা দিতেই বেমালুম ভুলে গেছি। এটাকে তুমি কী বলবে? পাগলামি? উদাসীনতা? গাধামি? কিন্তু কী করব, বলো! আমি যে এরকমই!


এটা সত্য যে তুমি আসার পর আমার একাকিত্ব বেড়েছে, ডিপ্রেশন লেভেল বেড়েছে, সাথে ফ্রাস্ট্রেশনও। মাঝেমাঝে আমার এটাই মনে হয় যে You are the person I love, I want, but you are not the person I need. Then should I leave you to let you live? চাইলে কি আর ছাড়া যায়? তুমিও পারবে না। ছেড়ে দিয়ে দেখো পার কি না। এই পক্ষ থেকে কোনও প্রকার ‘থাকো’ কথাটা উচ্চারিত হবে না। চাইলেই ছাড়া গেলে সবার আগে, অনেক আগেই তোমাকে আমিই ছেড়ে দিতাম। একটাসময় সব বদলে যাবে। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। Who knows! I want your happiness. I need your happiness. And you are my happiness! তোমার প্রতি এত তৃষ্ণা আমার আর থাকবে না। অনেক অনেক অনেকবার আমি তোমাকে ছাড়তে চেয়েছি, অগনিতবার চেয়েছি। শুরু থেকেই চেয়েছি, কিন্তু পেরে উঠিনি। বেশ কিছুদিন ধরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা সেপারেশনে যাব। এটা দুজনের জন্যই মঙ্গল। তোমাকে অনেকদিন ধরে বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠেনি। অথবা ভুলে যাই। আবার ইচ্ছে করেও ভুলে যাই। আমি জানি, We are not made for each other, we don’t deserve each other. আমাদের দুজনের সম্পর্কের ব্যাপারটায় জোরাজোরির কিছু নেই। এর নাম সম্পর্ক? সত্যিই?


আমাকে তুমি আর ‘ভালোবাসি’ বলবে না। কাউকে ছাড়ার সময় ভালোবাসি বলতে নেই, তা হলে আর ছাড়া হয়েই ওঠে না। ভালোবাসার চেয়ে মায়ার শক্তি ঢের বেশি। বেশিরভাগ সম্পর্কেই অনেকসময় ভালোবাসা থাকে না, মায়াই থাকে কেবল, মায়ার কারণেই টিকে-থাকা। আমি চাই, আমাদের মধ্যে সম্পর্কের কোনও অস্বচ্ছতা না থাকুক, শুধু মায়ায় না টিকুক, ভালোবাসা থাকলেই কেবল ভালোবাসায় টিকুক। নয়তো ভেঙে যাক সব কিছু! ভেবে দেখো, সিদ্ধান্ত নাও।


‘চূড়ান্ত হিসাব’ হিসাববিজ্ঞানের ভাষায় একধরনের অংক। যারা কমার্সের স্টুডেন্ট, ওদের একটা তিন পার্টের অঙ্ক করতে হয়। প্রথম পার্টের যোগফল দ্বিতীয় পার্টে নিয়ে বসাতে হয়, আবার দ্বিতীয় পার্টের যোগফল তৃতীয় পার্টে বসাতে হয়। তৃতীয় পার্টে ডানপাশ বামপাশ দুটো হিসাবের ঘর থাকে। দ্বিতীয় পার্টের যোগফল তৃতীয় পার্টের ডানপাশে বসিয়ে দিয়ে ডান বাম যোগ করে একটা উত্তর আসে। উত্তরটা ডানপাশ বামপাশ সমপরিমাণ সংখ্যা আসে। মানে ডানে দশহাজার হলে বামেও যোগবিয়োগ করে দশহাজার আসবে, এরকম। যদি দুপক্ষের একই উত্তর না আসে, তা হলে বুঝতে হবে অঙ্কে ভুল হয়েছে কোথাও না কোথাও। কখনও কখনও দুপক্ষ না মিললে একটা সংখ্যা নিয়ে দুপক্ষের উত্তর মিলিয়ে দেওয়াকে ‘অনিশ্চিত হিসাব’ বলে। আসলেই আমাদের এই জীবন একটা অনিশ্চিত চূড়ান্ত হিসাব!


আমার অনেকগুলো কাজ বাকি আছে। আমি জন্ম থেকে জ্বলছি। আমাদের এই গল্পেরও সুরাহা হবে একদিন। আমার বাপের খুনের সুবিচারও হবে একদিন। আমাকে যারা জন্মের আগে থেকেই অপূর্ণ করে রেখেছে, ওদের শেষটা আমি দেখব। আমার হাত দিয়েই হবে অনেক কিছু। নিজের সন্তানদের নিয়ে দেখা আমার বাপের স্বপ্নগুলো আমাকে দিয়ে পূর্ণ হবে একদিন, অন্য সন্তানেরা পেরে উঠতে পারেনি, আমাদের সব ভেঙেচুরে দিয়েছে ওরা, কিন্তু আমাকে ভাঙা সহজ নয়। একদিন অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই তৈরি করব। আমরা অনেককিছুই ডিজার্ভ করতাম, অনেককিছুই হতে পারত আমার পরিবার। আমার বাপ মেধাবী, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও একজন সৎবিচারক ছিলেন। সেই হিসেবে তার সন্তানদের অনেক অনেককিছুই হতে পারার কথা ছিল। কেউই কিছুই হতে পারেনি। আমাদের সাথে খুব অন্যায় করেছে ওরা। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। ভালো লাগছে না, লিখতে ইচ্ছা করছে না, অসহায় লাগছে খুব। সব সময়ই আমার মনটা কেন জানি খুব কাঁদে।


আমার কাছে খুব অর্থহীন অর্থহীন লাগে দুনিয়াটা, জীবনটা। আমার কাছে মনে হয়, মানুষ অকারণেই এত আয়োজন করে। হঠাৎ কখন জীবন থেমে যায়, তার কোনও ইয়াত্তা নাই। আমি আসলে জীবনটাকে এখন অবধি সিরিয়াসলি নিতে পারিনি, পারিনি বলেই আমার কোনও উন্নতি বা গতি হচ্ছে না। কোনও কিছু নিয়ে সিরিয়াস হতে গেলেই মনে হয়, আরে আরে…এত প্ল্যানিংয়ের কী আছে! কিছু দিন বাদেই তো মরে যাব! মরে গেলে এত কিছুর কী মানে! আমি এরকম করেই ভাবি। পেপারে দেখলাম, বাগানের গাছকাটাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যকার সংঘর্ষে গাছের মালিক মারা গেছে। মানলাম, এই সংঘর্ষটা অমূলক বা অহেতুক নয়। কিন্তু এখন এই গাছের সুখ কে ভোগ করবে? কী লাভ হলো তাঁর? নিজে বেঁচে না থাকলে পুরো একপৃথিবী সম্পদেরও কী অর্থ? তবে আমি একসময় খুব সিরিয়াস ছিলাম। একমাত্র ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়। এ জীবনে আর কোনও দিন কোনও কিছু নিয়েই সিরিয়াস হতে পারি না। জীবনে সিরিয়াস হতে না-পারাকে কি ব্যর্থতা বলে? আহা, ব্যর্থতাকে মানুষ কত রকম চোখেই-না দেখে! জানো, কাল রাতে ভাত খেতে ভুলে গেছি। না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছি, তরকারিও গরম করতে দেওয়া হয়নি। সকালে ভাত খেতে গিয়ে মনে পড়ল, গতরাতে তো আমি ভাত রান্নাই করিনি! দেখি, তরকারিও নষ্ট হয়ে গেছে! এখন চা দিয়ে বিস্কিট খাই, থুক্কু, বিস্কিট দিয়ে চা খাই। আমার পেটে এসব বিস্কিট-ফিস্কিট হজম হয় না। বিস্কিট অতিফালতু একটা জিনিস!


আমার আগের ডায়রিটাতে ভরাআবেগের সব লেখা ছিল। অনেক অনেক ঘটনা খুব গুছিয়ে, আবেগ-ভালোবাসা মিশিয়ে লিখতাম। আমার বোন ওখান থেকে চুরি করে করে কথা নিয়ে ওর বয়ফ্রেন্ডের কাছে চিঠি লিখত। হা হা হা। একদিন সে ধরা খাবার পর ডায়রিটা লুকিয়ে ফেলেছিলাম। তখন আবেগের স্বচ্ছতা অনেক বেশি ছিল। এখন আবেগে কিছু ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, ভালোবাসাহীনতা মিশে গেছে। আগের মতো করে আর আসে না কথাগুলি। কোনও কিছুই গুছাতে পারছি না। চাকরি-বাকরি হয়ে গেলে সারাদিন বসে বসে শুধু লিখতাম। এখন লিখতে গেলে ডিপ্রেশন কাজ করে, হাত কাঁপে। অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি, এবং অপেক্ষা করি। একটা সুন্দর সময়ের জন্য অপেক্ষা করি। কোনও মানে হয় এমন অপেক্ষার? হয় হয়, মানে হয়। খুব কাছে থেকেও যখন ছোঁয়া যায় না, তখন সেই ছুঁতে না-পারা জিনিসের প্রতি অনুভূতি তীব্র হয়। কী সব বলছি! আমার কাছে এমন কী আছে যার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি?


এখন সমস্যা হচ্ছে, আমাকে নিয়েই আমার এক্সপেকটেশন বেড়ে গেছে। আমি সব সময়ই ভাবি, আমার সব লেখাই বুঝি অনেক সুন্দর হবে। এই এক্সপেকটেশনটা আমাকে বিব্রত করছে। আমি যে সব সময়ই খুব ভালো লিখতে পারব তা কিন্তু না। এবং অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই না!! লেখালেখি নিয়ে যার ন্যূনতমও ধারণা আছে, সে এটা কখনওই ভাববে না। আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আমি আমার মতো করে লিখি, এমনকি না লিখলেও সমস্যা নেই। মন থেকে এলে লিখব, ভাবার অভ্যাস করব---মনে আসবেই লেখা...সবারই তো এমন হয়। সব লেখাই ভালো হয় না পৃথিবীর কারওই। এটাই জগতের নিয়ম। মনে দ্বিধা রেখে প্রেম হয় না, লেখা হয় না। দুইই সমগোত্রীয়, পবিত্র, শুদ্ধ---কোনও ব্যবসায়িক লাভ নেই, আছে কেবলই স্বস্তি ও শান্তি।


আপুর সাথে ঝগড়া করেছি। ট্যাটু করিয়েছি আমি, আর জাত যায় ওদের! আমার শাড়ির ব্লাউজের গলা বড় ছিল। ট্যাটুটা দেখা যাচ্ছিল। শালার কারও চোখ নিজের বউয়ের দিকে নাই, সবার চোখ আমার পিঠে ট্যাটুর উপর। নানুরবাড়ির সবাই আমার আপুকে এসে এসে অভিযোগ দিচ্ছে। এগুলি শুনতে শুনতে তার মাথা আমার উপর চড়ে গেছে। বিয়ের ক্লাবে চুপচাপ ছিল। বাসায় এসে ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানঘ্যান করছে। আমি নাকি দোজখে যাব, পরিবারে যত অমঙ্গল ঘটে, সব নাকি আমার জন্য ঘটে, মায়ের অসুখ কমছে না, এটাও নাকি আমার দোষ, সব কিছুতেই আমার দোষ খুঁজে খুঁজে বের করছে সবাই মিলে। আমি হেন, আমি তেন। জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একদম ওই অবস্থাতেই ওর বাসা থেকে বের হয়ে গেছি। আমি বিয়ে কেন করছি না, এটাও দোষ, আমি নাকি গুনাহ করে বেড়াচ্ছি, আমার গুনাহর ভারে নাকি মায়ের অসুখ বাড়ছে। কাল থেকে খুব মন খারাপ আমার। ভালো লাগছে না কিছুই। দূরে কোথাও, কোনও মরুভূমিতে, নির্জন কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার ডিপ্রেশনের বড় কারণ আমার পরিবার। ওদের জন্য এত করি, তবুও যেন কিছুই হয় না। আমি সবার ছোট হলেও বড়দের মতোই ওদের সব কিছুতে সাহায্য করি, আর দিনশেষে আমিই দোষী। অথচ বড়ভাই ছাড়া কারও কাছ থেকে আমি কখনও দুটাকা হেল্প নিইনি পর্যন্ত কখনও। ওদের যদি আমাকে দেখাশুনা করা লাগত, তখন কী করত, কে জানে! আমার আপন বড় বোনের কাছ থেকেও কখনও কোনও দিন একটা জামাও নিয়েছি, এরকম ইতিহাস নাই। ওর যে সামর্থ্য নেই, তা না। ও প্রচুর খোঁটা দিয়ে কথা বলে। তাই নিই না, উল্টো আমিই করেছি সব ওর জন্য। আমি যখন ইনকাম করতাম, তখন ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন যাতে ওকে কিছু বলতে না পারে, তার জন্য আমি ভাইয়ার হয়ে সব পাঠাতাম। এখনও এই কাজে সেই কাজে সব কাজেই আমাকেই লাগায়। অথচ দিনশেষে আমিই ওদের অমঙ্গলের কারণ। আমার মা-টা বেঁচে আছে বলে পরিবারের সাথে আমার এখনও যোগাযোগ আছে। মা মরে যাক, তার পর আর কারও সাথেই কোনও যোগাযোগ রাখব না। দূরে কোথাও চলে যাব।


বাবুই, আমি মারাত্মক একটা সমস্যায় আছি। আমি ভয়ংকর অস্থিরতায় ভুগি। ঘুমাতে গেলেও থেকে থেকে ঘুম ভেঙে যায় ভয়ে ভয়ে। ঘুমাতে গেলেই বুক কেঁপে কেঁপে অস্থিরতায় ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না, ভেঙে যাচ্ছে। ডিপ্রেশনের ওষুধেও কোনও কাজ হচ্ছে না। আমার সব সময় মনে হয়, খুব লেট করে ফেলেছি, অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি, কী জানি ভুল করছি। পড়ালেখা এক্কেবারেই হচ্ছে না। আমার মধ্যে সারাক্ষণই অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করে। আমার সার্টিফিকেটে আমার ব্যাচের অন্য সবার সার্টিফিকেটে-দেখানো বয়সের চেয়ে কমপক্ষে দুই-তিন বছর করে বাড়ানো। সার্টিফিকেটে সবার বয়স কমানো আছে কমপক্ষে দুই-তিন বছর করে, আর এদিকে আমারটাতে একদিনও কমানো নেই। এদিকেও আমি পিছিয়ে। আমার প্রথমবারে চাকরি হবে, এরকম কোনও গ্যারান্টি তো নেই। ম্যাথ করতে গেলেই আমার মাথাব্যথা উঠে। আর আমি কিনা অন্যদের তুলনায় অলরেডি বয়স বাড়িয়ে পরীক্ষা দিচ্ছি। তার উপর পারিবারিক অশান্তির কারণে ভয়ংকর ট্রমাতে থাকি। আমি ক্যারিয়ার করার মতো এখনও রেডি না, আবার আমার ক্যারিয়ার হতে হতে আসলেই মা ততদিন বাঁচবে না। আবার মা দেখে যেতে পারে মতো ক্যারিয়ার করতে পারার প্রস্তুতিও আমার নেই।


দেশের বাইরে মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য যেতে হলে দেখা যাবে, আমি মাকে শেষদেখাটাও দেখতে পারব না। আবার দেশে থেকে গিয়েও আমি কেমন জানি শান্তি পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে আমি ভয়ংকর রকমের দ্বিধাধন্দে পড়ে গেছি আর আমার ডিপ্রেশন লেভেল ক্রমেই বাড়ছে। জানি না কী হবে। আমার সব কিছুই অগোছালো হয়ে আছে। আমার কেন জানি কিছুই ভালো লাগে না। কিছু করতেও ইচ্ছে করে না। বেসরকারি সেক্টরে আমি ঢুকলে বিশ্বাস করো, ওখানে আমাকে চুষে চুষে খাবে বসরা। সরকারি সেক্টরে লম্বা প্রসেসিংয়ে বছরের পর বছরে চলে যায়, এত বছর তো বেকার থাকা যায় না। আমি সত্যিই পড়ি না, বইপত্র দেখলে আমার ভয়টা আরও বেড়ে যায়। পড়তে গেলেই মনে হয়, আমি অনেক অনেক পিছিয়ে গেছি! চোখ বুলাই, কিন্তু আসলে পড়ি না। আমাকে ঘণ্টা ঘণ্টা ধরে সারাদিনরাত পড়তে হয় না। মন দিয়ে পড়লে একবারই যথেষ্ট। ছোটবেলা থেকেই আমার ব্রেইনটা যথেষ্ট শার্প ছিল। যে পড়া মানুষ দিনরাত পড়ে পড়ে শেষ করত, ওই পড়া আমি কয়েক ঘণ্টা পড়লেই ব্রেইনে থেকে যেত। আমি কখনওই দিনরাত চব্বিশঘণ্টা করে পড়িনি, আমাকে পড়তে হয়নি। আর এখন কেমন জানি ব্রেইনে পড়া ঢুকতেই চায় না। বই দেখলে ভয় বাড়ে, বই দেখলে অস্থিরতা বাড়ে।


এতকিছুর পরও আমার নিজেকে নিয়ে তেমন কোনও ভাবনা নেই। আমি কেবলই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছি। এই অপেক্ষায় যা যা ঘটে যাচ্ছে আমার সাথে, তা নিয়ে আমার সম্মতি বা আপত্তি, কোনওটাই নেই।