যদি দরকার হয়, তবে মন ও মত বদলে ফেলতে জানতে হয়। আমাদের ভাবনা ও কাজ, দুই-ই সময়ের সাথে সাথে বদলাতেই পারে। আমরা এখন এমন একটা সময়ে বাস করি, যখন নিজের কোনও মতামত না থাকাটাই একধরনের লজ্জার ব্যাপার। তাই আমরা প্রায়ই সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বুঝে না বুঝে কিছু একটা মতামত দিয়েই ফেলি। পরিস্থিতির চাপে কিংবা বুঝতে পারার অক্ষমতায় হয়তো সেই মতামতটি আমাদেরই নয়, তবুও তা দিই। এমনও দেখা যায়, যা নিয়ে আমরা কথা বলি, তা আমরা না বুঝেই অন্য কারও কাছ থেকে অন্ধের মতো ধার করেছি। অথচ পরিস্থিতির ও অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণে একসময় আমাদের বিশ্বাস ও তা প্রকাশের ধরন বদলে যায়। আধুনিক সভ্যতার সবচাইতে বড়ো সীমাবদ্ধতাগুলির একটি হচ্ছে, মানুষ এখন অপারগতা জানাতে ভুলে যাচ্ছে কিংবা ভুলে না গেলেও জানাচ্ছে না। যা-কিছু ঠিক, তা গ্রহণ করার চাইতে অনেক বেশি জরুরি হচ্ছে, যা-কিছু আমি বুঝতে পারি, তা গ্রহণ করা। এই বোঝার ব্যাপারটা সময়ে সময়ে বদলায়, এবং এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে তখনই, যখন আমরা আমাদের বোধের সাথে সাথে পুরনো মতামত ও বিশ্বাসকে বদলে ফেলতে পারি না। কী করলে আমার সম্মান, খ্যাতি, অর্থ বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, তা নিয়ে বেশি ভাবতে ভাবতে আমরা সেই কাজগুলিই করতে আর পারি না, যা যা করতে আমাদের ভালো লাগে। তবে হ্যাঁ, ওসব মাথায় রেখে বাঁচলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, ওসব মানতে গিয়ে মানুষ নিজের মনের মতো করে বাঁচতে আর পারে না। নিজের মনের গভীরে ডুব না দিলে মানুষ নিজেকে চিনতেই ভুলে যায়। নিজেকে নিয়ে না ভেবে সমাজের চোখে ঠিকঠাক হয়ে বেঁচে থাকাটা সহজ যদিও, তবু বড়ো কিছু পেতে চাইলে নিজেকে সামাজিক নিয়মের বাইরে নিয়ে গিয়ে ভেঙেচুরে তৈরি করতেই হয়। এই কাজটা করতে পারে না বলেই সমাজের দশটা মানুষই বড়ো হয় না, সেখান থেকে দু-একজন মাত্র হয়। কারও অর্জন নিয়ে সমালোচনা করার চাইতে সেটি উদ্যাপন করা অনেক কঠিন। আমরা যখন কোনও কিছু নিয়ে বাজেভাবে সমালোচনা করি, তখন সেটি কারও-না-কারও মন খারাপ করে দেয়। যে-কোনও বিষয়ে নিয়ে মন্তব্য করার সময় সেটি ভালো করে বোঝা দরকার, আবার যাকে নিয়ে মন্তব্যটা করছি, তাকেও স্পষ্ট করে বোঝা দরকার। মানুষ কী করল, তা নিয়ে ভাবতে পারার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কখন ও কী পরিস্থিতিতে সে কাজটি করল, তা নিয়ে ভাবতে পারা। এইটুকু উদারতার চর্চা করতে পারলে পৃথিবীর সৌন্দর্য আরও বেড়ে যেত। যখন আমাদের কারও সম্পর্কে ভালো কিছু বলার থাকে না, তখন যদি আমরা চুপ করে থাকতে শিখি, তবে আমরা প্রকৃতপক্ষে সেই মানুষটিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করি। মানুষ হিসেবে এইটুকু করাটা আমাদের কর্তব্য। আমরা সমালোচনা করার ছলে নগ্নভাবে নিজের প্রচারণাই চালাই। সমালোচনার উদ্দেশ্য যদি হয় কারও ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তাকে ছোটো করা, তবে সেটিকে সমালোচনা বলে না, নিন্দা বলে। নিন্দুকের কোনও অভাব নেই, রাস্তাঘাটেই পাওয়া যায়; যথার্থ সমালোচকেরই বড়ো অভাব। কথা বলার চাইতে জীবনে অনেক জরুরি হচ্ছে চুপ হয়ে থাকা। মন বিক্ষিপ্ত হলে ঘরে মধ্যে চুপ করে বসে থাকতে হয়। তা যদি পারা না যায়, তবে বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসা যেতে পারে। কোনও লক্ষ্য মাথায় না রেখে ঘুরতে যাওয়াও এক্ষেত্রে উপকারী। অভিজ্ঞতা বলে, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা ও অবসাদে নুয়ে পড়া, এ দুইটি ব্যাপার থেকেও চমৎকার সৃষ্টিশীলতার উন্মেষ ঘটতে পারে। আমাদের মাথায় সেরা চিন্তাভাবনাগুলি তখনই আসে, যখন আমরা ওরকম সেরা কিছু নিয়ে ভাবিই না! আমাদের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা ও ভাবনা মিলে আমাদের অবচেতন মনকে আলোড়িত করে, এবং তখন হুট করেই ভাবনার এমন কিছু বিন্যাস মাথায় পর পর এসে যায়, যা স্বাভাবিক অবস্থায় আসার কথাই নয়! এমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গেলে সৃষ্টির স্বাভাবিক প্রবাহটাই হারিয়ে যায়। আমরা আরেকটা কারণে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারি না, এবং তা হলো, আমাদের ভালো ঘুম হয় না। আমরা যখন জেগে থাকি, তখন নিজেকে সবার সামনে কতটা মেলে ধরতে পারব কিংবা আমাদের কাজের ছন্দ কেমন হবে, দুই-ই নির্ভর করে আমাদের ঘুমের দৈর্ঘ্য ও মানের উপর। শরীর যদি একবার ভেঙে পড়ে, তখন পুরো পৃথিবীই নিরর্থক ও অসুস্থ মনে হয়। শারীরিক সুস্থতাই পৃথিবীর সবচাইতে জরুরি বিষয়। কেউ যখন আমাকে নিজেই জানায়, সে কে, তখন ভালো হয়, তার কথাটা বিশ্বাস করে ফেললে। তবে যদি কেউ আমাকে বলে, আমি কে, তখন তার সে কথা বিশ্বাস না করাই ভালো। মানুষ যাকে ভালো করে চেনেই না, যখন তার সম্পর্কেও বলে, তখন ধরে নিতে হবে, এখানে অনুমাননির্ভর কথার বুনন চলছে এবং এখান থেকে যে সিদ্ধান্তটা আসবে, সেটা ভুল হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। আমাকে নিয়ে যারা অনুমান করে ভুল কথা বলে ও ছড়ায়, তাদের জন্য করুণা অনুভব করা বাদে করার আর তেমন কিছুই নেই। মানুষ যেখানে নিজেকেই ঠিকমতো চিনতে পারে না, সেখানে অন্য কাউকে চেনার দাবিতে তাকে মন্তব্য করাটা মূর্খতা ছাড়া আর কী! কেউ যদি কিছু বলতে চায়ই, তবে যা নিয়ে সে কিছুটা হলেও দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারে, তা হচ্ছে কেবলই নিজের সম্পর্কে। আমরা কে কত বেশি আয় করতে পারি, কে কত বেশি কাজ করতে পারি, কে কত কম সময়ে বেশি দূর যেতে পারি, এসব দিয়ে আমাদের বিচার করা হয়। তবু দিনশেষে, আমরা কে কতটা নিজের মতো করে দিন কাটাতে পারি বা বাঁচতে পারি, মূলত তা দিয়েই আমাদের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি নির্ধারিত হয়। যে মানুষ সারাজীবনই ছুটে বেড়ায় তার স্বপ্নের পেছনে কিংবা তার নিজের ও চারপাশের লোকজনের সুখের পেছনে, সে একসময় বিষণ্ণ হয়ে পড়ে এবং তার কাছে, এতদিন ধরে যা যা সে করে এসেছে, তার পুরোটাই নিরর্থক মনে হয়। আমরা সবসময় ভাবতে থাকি, কীভাবে একটা সুন্দর জীবন কাটাব। অথচ কীভাবে একটা সুন্দর দিন কাটাব, তা নিয়ে আমরা তেমন ভাবি না। আমরা ধরেই নিই, আমাদের হাতে অনেক আয়ু আছে! প্রতিটি বিষণ্ণ দিনের যাপনে যে মানুষ সুন্দর জীবনের আশায় ছুটে চলে, সে সারাজীবনই এমন অন্ধ হয়ে বাঁচে। যাকে নিয়ে কিংবা যা-কিছু নিয়ে আমরা দীর্ঘসময় কাটাতে চাই, তাকে কিংবা তা-কিছুকে যদি তাড়াহুড়োয় ঠিকভাবে নির্বাচন করতে না পারি, তবে জীবনটা দুঃখ পেয়ে পেয়ে কাটে। সাফল্য ও সম্পর্ক খুব চটজলদি আসে না। আসেও যদি, তা হারিয়েও যায় চটজলদি। পৃথিবীতে রাতারাতি সফল হওয়া বলে কিছু নেই। প্রতিটি রাতারাতি সাফল্যের পেছনেই থাকে অসংখ্য নির্ঘুম রাতের গল্প। অভিজ্ঞতা বলে, দৌড়ের উপর বিয়ে করলে সারাজীবনই কাটে দৌড়ের উপর। তাড়াহুড়োয় মাঝারি মানের কিছু পাওয়ার চাইতে অনেক ভালো, সময় নিয়ে ভালো কিছু অর্জন করা। আমাদের আলাদা করে চেনায় যা, তা যদি হাত বাড়ালেই পাওয়া যেত, তবে তো সবাই-ই তা অনায়াসেই পেয়ে বসে থাকত! যে যা-ই বলুক না কেন, হাতি শুয়ে থাকলেও ছাগল কখনও হাতির সমান উঁচু হতে পারে না। উঁচুতে উঠতে চাইলে ঠিক নিয়মে সময় দিতে হয়। দৌড়ানোর আগে বার বার হোঁচট খেয়ে নিজেকে শক্ত করে নিতে হয়, নতুবা দৌড়ের সময় হোঁচট খেতে খেতে লক্ষ্যে পৌঁছনোই আর যায় না। শুধু তাদের সাথেই মিশুন কিংবা শুধু তাদের কথাই ভাবুন, যারা আপনার আশেপাশে কিংবা আপনার মনের মধ্যে থাকলে নিজেকে ছোটো মনে হয় না। যার সাথে থাকলে কিংবা যে সাথে থাকলে নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস কমে, তার সাহচর্য থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই হবে। যে বই পড়লে বা মুভি দেখলে, যেখানে ঘুরতে গেলে, যা নিয়ে ভাবলে মনের উন্নতি হয়, জোর করে হলেও নিজেকে সেসবের মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখুন। আজ আমরা যেভাবে বেঁচে আছি, সেটিই ঠিক করে দেবে কাল আমরা কীভাবে বাঁচব। নিজের উজ্জ্বলতা বাড়াতে উজ্জ্বল মানুষের কাছাকাছি থাকতে হয় কিংবা ওরকম মানুষের উজ্জ্বল দিকগুলি নিয়ে ভাবতে হয়। গাধার সাথে মিশে সিংহের গর্জন শেখা যায় না। কিছু গাধা সিংহের মতো হাঁটে বিধায় ওদের দেখে বাকিরা ভাবে, ওরা বুঝি উন্নত গাধা! উন্নত গাধা বলে কিছু হয় না, কেননা প্রতিটি উন্নত গাধাও দিনশেষে গাধাই। গাধা হয়ে বাঁচতে না চাইলে গাধা চিনতে হয়। খেয়াল করে দেখেছেন, কেউ আপনাকে বেড়ালের স্টিকার বা জিআইএফ পাঠালে যদি আপনি ওতে খুশি হন, তবে সে আপনাকে খুশি করতে আরও বেশি বেশি ওসবই পাঠায়। ফেইসবুকে, ইউটিউবে আপনি যে ধরনের পোস্ট বা ভিডিয়ো দেখতে পছন্দ করেন, সেগুলিই বেশি বেশি আপনার চোখের সামনে চলে আসে। আপনাকে সন্তুষ্ট রাখতে আপনার পছন্দ বা চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই আপনার সামনে এসে হাজির হয়। মজার ব্যাপার, সাপ্লাই বাড়ার সাথে সাথে আপনার ডিমান্ডও বাড়ে। বাড়তে বাড়তে আপনি এমন একটা পর্যায়ে চলে যান, যা দেখে অন্যরা বুঝে নেয়, হ্যাঁ, আপনি এমন ধরনেরই মানুষ। আপনার নিজের মনেও আপনার নিজের সম্পর্কে ওরকমই একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। অর্থাৎ, আমরা কীরকম মানুষ হয়ে গড়ে উঠি, তা মোটামুটি আমাদের নিজেরই হাতে। আমাদের স্বপ্ন আমাদের যতটা বাঁচিয়ে রাখে, তার চাইতে অনেক বেশি বাঁচিয়ে রাখে আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস ও রুচি। তাই নিজেকে আমরা যে অবস্থানে দেখতে চাই, যদি সে অনুযায়ী আজকের দিনটা না কাটাই, তবে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে আমরা অন্য কোথাও পৌঁছে যাব। আপনি যা পেতে চান, যা পাওয়ার জন্য আপনি ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তা নিয়ে মনের মধ্যে কোনও সন্দেহের উদ্রেক হলে সেটিকে প্রশ্রয় দেবেন না, বরং সেটির বিরুদ্ধে লড়াই করুন সচেতনভাবেই। অবিশ্বাস ভালো, যদি তা ব্যক্তির প্রতি হয়, লক্ষ্যের প্রতি নয়। আপনি যে কাজটি করতে চাইছেন, সে কাজটির পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। যদি আপনি আপনার লক্ষ্যের ইতিবাচক দিকগুলি মাথায় না রেখে নেতিবাচক দিকগুলি নিয়েই ভাবতে থাকেন, তবে আপনার মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হবে, যা আপনার কাজের গতিকে অনেক কমিয়ে দেবে। সন্দেহ সমালোচক তৈরি করে, কর্মী নয়। কর্মীর হওয়ার চাইতে সমালোচক হওয়া সহজ, কেননা সফল হওয়ার চাইতে ব্যর্থ হওয়া সহজ। মনে সন্দেহ পুষে রেখে সৃষ্টিশীল, গঠনমূলক কিছু করা অনেকটাই অসম্ভব। বিশেষ করে নিজের স্বপ্নের ব্যাপারে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলে স্বপ্নপূরণের জন্য কাজ করার উৎসাহ ক্রমেই কমতে থাকে। বিশ্বাস করে নিজেকে কোনও একটা কাজে প্রবৃত্ত রাখতে সাহস ও যোগ্যতা লাগে, অবিশ্বাস করে সে কাজটা হতে নিজেকে নিবৃত্ত করতে আলস্য ও ছিদ্রান্বেষণই যথেষ্ট। আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে আমরা যেভাবে দেখি, সেটাই দেখার একমাত্র রাস্তা নয়। জীবন সম্পর্কে আমরা যেভাবে ভাবি, সেটাই ভাবার একমাত্র রাস্তা নয়। আমাদের বিশ্বাসে ও উপলব্ধিতে যা-কিছু আছে, তা-ই একমাত্র সত্য নয়, এর বাইরেও অনেক সত্য আছে, সেগুলির প্রতিও আমাদের সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পৃথিবীর সবাই আমার মতো করে ভাববে না, আমার মতো করে বাঁচবে না। বৈচিত্র্যই সবচাইতে সুন্দর সত্য। চোখের সামনে যতটা দেখেছি, দেখছি ও দেখব, তার বাইরে অনেক কিছুর অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে ছিল, আছে ও থাকবে। নিজের মতের ও পথের দিকে পৃথিবীর সবাইকে টেনে নিয়ে আসতে চাওয়ার নাম জ্ঞান নয়, নির্বুদ্ধিতা। আমরা যত বেশি নিজের বিশ্বাসকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার চেষ্টা করব, আমাদের বিশ্বাস সম্পর্কে লোকে তত বেশি অশ্রদ্ধা- ও ঘৃণাপোষণ করবে। যা-কিছু আমার কাছে সুন্দর ও অনিবার্য, তার বাইরেও পৃথিবী আছে, তার বাইরেও জীবনযাপন আছে। আমরা যেন মাথায় রাখি, যে বিশ্বাস মানুষকে সহনশীলতা শেখায় না, সে বিশ্বাসের নাম অজ্ঞতা বা মূর্খতা। আমরা যতটুকু দেখেছি, জেনেছি ও বুঝেছি, পৃথিবীতে তার চাইতে অনেক বেশি সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। বেঁচে থাকার অনেক পদ্ধতি আছে। সবচাইতে সহজটি বোধ হয়, ক্ষমা করে বাঁচা। নিজের মানসিক স্বস্তির জন্যই ক্ষমা করে দিতে জানতে হয়। জীবনটা অনেকটা লাইফবোটের মতো। তবে কখনও কখনও তা সাবমেরিনও হয়ে যায়। একেবারে গভীরে ঢুকে দুর্জ্ঞেয় ও দুর্বোধ্য জায়গাগুলিতে ঘুরতে থাকে, আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এমন কিছুর সত্যের মুখোমুখি, যার সামনে দাঁড়ানো দূরে থাক, যা নিয়ে ভাবতে গেলেও আমরা ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমাদের সমস্ত লজ্জা, ব্যর্থতা, ভুল, দুর্বলতা যখনই আমাদের চোখের সামনে এসে যায়, তখন আমাদের নিজেকেই নিজের সমস্ত গ্লানির জন্য ক্ষমা করে দিতে হয়। এই একই কাজটা করতে হয় অন্যদের জীবনের ক্ষেত্রেও। যাকে আমরা ক্ষমা করতে পারি না, তার সকল দোষত্রুটির অবস্থান যতটা তার মধ্যে, ততোধিক আমাদের মাথার মধ্যে। আমাদের চোখে তার যা-কিছু অন্ধকার, তা-কিছু মূলত আমাদেরকেই অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে, এবং আমাদের মনটা তখন উদ্বিগ্ন ও বিষণ্ণ হয়ে থাকে। তাকে নিয়ে আমরা আমাদের ভাবনার গভীরে যেতে যেতে ক্রমেই বিমর্ষ হয়ে পড়ি। এই বিষাদযাপনে এক আমাদের বাদে আর কারুরই কিছু এসে যায় না। ক্ষমা করে দিতে জানে যারা, তাদের ক্ষেত্রে এই সাবমেরিনটা ধীরে ধীরে জলের উপরিভাগে ভেসে ওঠে, ওতে সূর্যের আলো এসে পড়ে, অন্ধকারের সাবমেরিন ক্রমেই আলোর লাইফবোট হয়ে আয়ুক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। দুঃখ যখন গ্রাস করে ফেলে, তখন দুঃখকে মন দিয়ে অনুভব করতে হয়। দুঃখ এড়িয়ে চলা কঠিন, বেশিরভাগ মানুষই দুঃখ এড়িয়ে চলতে গিয়ে দুঃখকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তার চেয়ে দুঃখকে গ্রহণ করা ভালো। মন পুরোপুরি দুঃখে ডুবে গেলে ও দুঃখের যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তখন দুঃখের চেহারা মানুষের চেনা হয়ে যায়। সে সময় দুঃখ থেকে বেরিয়ে আসা সহজ। এই কাজটা করার জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টার সে প্রক্রিয়ায় সুখের নানান উপকরণ জোর করে হলেও নিজের জীবনে টেনে নিয়ে আসতে হয়। যা-কিছু মানুষকে সুখী করে, তা-কিছুকে সকল যুক্তি ও তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে জীবনে স্থান দিতে হয়। হতাশা ও নিরাশাকে দূর করতে চাইলে নিজেকে যে-কোনও মূল্যে খুশি করে তুলতে হয়। যা করলে ভালো অনুভব হয়, তা অন্যের চোখে যতই ভুল ও অহেতুক হোক না, তা-ই করে যেতে হয়। এতে দুঃখের উপকরণ কিংবা মনের দ্বন্দ্বগুলি কমে না হয়তো, তবে সেগুলিকে সহজভাবে গ্রহণ করতে মন শিখে নেয়। এই শিখে নেওয়াটা খুব জরুরি। নিজের আকাশের নীলটা নিজেকেই মাপতে হয়, অন্য কাউকে মাপতে দিলে নীল রংটা বদলে কালচে হয়ে যায়। যে বৃদ্ধ লোকটা আরাম করে রোদ পোহাচ্ছে, তার কাছে বৃষ্টির গল্প করে লাভ নেই। যে ছোট্ট মেয়েটা রংধনুর সাতটা রং তার হাতের চুড়িতেই খুঁজে নিতে পারে, তাকে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। যে শামুকটা ভাঙা দেয়ালের এবড়োখেবড়ো পিঠেই আরাম পায়, তাকে বৃষ্টির দিনের স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে হাঁটার লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। শুকনো পাতার নূপুরের ঝংকারে মুগ্ধ যে মানুষ, তাকে বৃষ্টির জলের সাথে পাতার ঘ্রাণের রসায়ন বোঝানোর পথে হাঁটিয়ে লাভ নেই। এতে কিন্তু বৃষ্টির সৌন্দর্যটা কমে যায় না, কাউকে জোর করে কোনও সৌন্দর্য উপভোগ করানোর চেষ্টা করলেই বরং তার চোখে সেই সৌন্দর্য সমস্ত আবেদন হারায়। বৃষ্টি সুন্দর, তবু সেই সুন্দরের জন্য অপেক্ষা করে থাকার সময়, সুযোগ বা ইচ্ছে সবার থাকে না। সুখের মানে আঁধার সরিয়ে আলোর যাপন নয়, বরং আঁধারের মাঝেও আলোর যাপন।