সম্পর্ক যেভাবে টিকে থাকে

ভালোবাসা আপেক্ষিক একটা বিষয়। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কেবলই অগাধ ভালোবাসা যথেষ্ট নয়। অগাধ ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও কেবল ভরসার অভাবে অনেক সম্পর্ক ভেঙে যায়। একটা খারাপ মানুষ, যে রোজ চোখের সামনে অপর মানুষটাকে ঠকিয়ে যাচ্ছে, তার সাথেও থেকে যাওয়া যায়, কেননা মানুষটা খারাপ হলেও আদতে সে সৎ। অন্তত নিজের খারাপ অসৎ দিকগুলো আড়াল করে করে রোজ অপর মানুষটার সামনে কিংবা তার কাছের মানুষগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে নিজেকে সৎ, সাধু, শুদ্ধ মানুষ হিসেবে প্রকাশ করছে না সে। মানুষ যখন অন্যদের চোখে ধুলো দেয় এবং নিজেকে একটা পোশাকের আড়ালে, মুখোশ আড়ালে আড়াল করে রাখে, তখন সে আসলে কাকে ধোঁকা দেয়? তার অন্তরাত্মা কখনও কি তার প্রতি ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ করে না আদৌ?

যখনই আমরা কোনও মন্দ কিংবা সামাজিক রীতিনীতিবিরুদ্ধ কোনও কাজ করতে যাই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদেরকে বারে বারে সেই কাজটি না করতে রেড সিগন্যাল দেয়, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, যখন আমরা ভালো কোনও কাজ করি, তখন আমাদের অন্তরাত্মায় একধরনের প্রশান্তি খেলা করে। আমরা নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে পাই। নিজেকে নিজেরই ভালো লাগে। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। সেই কাজ করার পর বহুকাল ধরে আমরা সেই ভালো কাজের প্রশান্তি অনুভব করতেই থাকি। ঠিক একইভাবে, আমাদের খারাপ কাজগুলো ভাইরাসের মতোই সারাজীবন আমাদের পিছু ছুটতে ছুটতে মনে করিয়ে দেয়, আমরা কী কী অনৈতিক, প্রথাবিরুদ্ধ কাজ করেছি, কীভাবে দিনের পর দিন আমরা আমাদের কাছের, আশেপাশের সরল মানুষগুলোকে ঠকিয়ে গেছি। এভাবে একটা সময় নিজের প্রতিই ঘৃণা ধরে যায়। আমরা শুদ্ধতার পথে হাঁটতে চাই, আমরা আমাদের অতীতের মন্দ কাজের জন্য অনুতপ্ত হই, আমরা নিজেদের শুধরে নিতে চাই।

প্রতিনিয়তই নিজের সাথে লড়াই করি নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য। নিজেদের বিন্দুমাত্র ভুলও নিজের গলার কাঁটা হয়ে থাকে। আমরা নিজেরাই নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। পৃথিবীতে ভালো-মন্দ ঠিক-ভুলের হিসেব নিজেদের নিয়মে করতে যাই। যদিও যে-কোনও পরিস্থিতিতে মানুষ যে আচরণগুলো করে, তার অধিকাংশ তার নিজের উপরেই নির্ভরশীল, তা সত্ত্বেও আমরা ভুল করি, করতেই থাকি। একটা সময় পর গিয়ে আমরা আমাদের ভুলগুলো উপলব্ধি করি, নিজেকে শুধরে নিতে চেষ্টা শুরু করি। সেই চেষ্টায় আমরা সফলও হই, কিন্তু পেছনের ভুলগুলো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সেগুলো থেকে পালাতে পালাতে নিজেকে ক্ষমা করতে না পারার দুর্বলতায় আমরা অনেক সময় নিজেকে কষ্ট দিতেও দ্বিধাবোধ করি না। কিন্তু এ কি আদৌ ঠিক? এই সৃষ্টির সব কিছুই আমরা চাই বা না চাই তাদের নিজের নিয়মে চলে এবং চলবে। আমাদের যে কাজের প্রতি আমরা ঘৃণা পোষণ করি, হয়তো এই সৃষ্টিরই তার নিজস্ব নিয়মে চলার জন্য সেটির প্রয়োজন ছিল এবং সে-ই কোনও-না-কোনও উপায়ে আমাদের দিয়ে সেই কাজ হাসিল করিয়ে নিয়েছে। আমরা যেটাকে শয়তান, ইবলিশ কিংবা মস্তিষ্কের ধোঁকা বলি, সেটা কি প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির আরেক রহস্য নয়? বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন আসে, তখন সেগুলোর সব কিছু কি মানুষের কাজের জন্য দায়ী? না কি প্রকৃতি তার নিজের প্রয়োজনে মানুষকে দিয়ে সেগুলো করিয়ে নেয়? মানুষ যখনই নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তখনই সে ভুলগুলো করে…সেটি হোক পৃথিবীর লোভলালসা থেকে কিংবা আত্মিক প্রশান্তির উদ্দেশ্যে। এই নিয়ন্ত্রণহীনতাকে কি মানুষের অভ্যন্তরীণ দুর্যোগ বলা যায় না? কেননা মানুষও তো প্রকৃতির একটি উপাদান, সৃষ্টির উৎস।

একটা সম্পর্ক তাহলে আসলে কী কী উপাদানের সমন্বয়ে টিকে থাকে? আমি জানি, আমার সাথে তোমার কোনও দেনা-পাওনা কিংবা নাম-পরিচয়ের সম্পর্ক নেই। আমাদের মধ্যে অগাধ ভালোবাসা আছে কি না, সেটা আমি নিশ্চিত নই। আমি তোমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি, বিষয়টি তেমন কিছুই নয়। এমনকী দিনশেষে তোমার কাছ থেকে আমার চাওয়া কিংবা পাওয়ার এমন কোনও হিসেবও নেই, যেই হিসেব ধরে চুপচাপ সব কিছু সহ্য করে এমন উদ্ভট একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়। আসলে সম্পর্কটা যে কেউ জোর করে টিকিয়ে রেখেছে, তেমন কিছুও না, কিন্তু দু-জনকেই একটু এফোর্ট দিতেই হচ্ছে---হোক সেটা মানসিক, তা সত্ত্বেও সম্পর্কটা বেঁচে আছে কী নিয়ে? কোন সেই সুতো, যাকে ছেঁড়া যাচ্ছে না কখনও…চেষ্টা করেও?

সম্পর্ক সাধারণত একটা সেতুর বন্ধনে টিকে থাকতে বাধ্য হয়। একটা সেতু এপার থেকে ওপারে মানুষদুটোকে এক করে রাখে ইচ্ছেয় কিংবা অনিচ্ছেয়। কিন্তু আমাদের মাঝে তেমন কোনও সেতু নেই। অথচ কেউ কাউকে পুরোপুরি ইগনোর করতে পারি না। আমি পারি না, কিন্তু হয়তো ওপাশ থেকে দরজা বন্ধ পেলে চলে যেতে বাধ্য হতাম, ভুলে থাকতে বাধ্য হয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতাম। কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না।

দু-জনের জীবনের হিসেব সম্পূর্ণ ভিন্ন, দু-জনের জীবনেই বয়ে বেড়ানোর কিংবা মাথা খাটানোর, ব্যস্ত থাকবার অজস্র কাজও আছে, অথচ কেউ কাউকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। কেন? আমাদের ভেতরে কী এমন আছে, যা এই সম্পর্কটাকে বাইরে থেকে ঠুনকো নাম-পরিচয় গন্তব্যহীন, অথচ ভেতর থেকে এতটা মজবুত করে টিকিয়ে রেখেছে…যেখানে আদৌ কোনও এফর্ট নেই, আবার ছেড়ে যাবার চেষ্টা আছে?! একটা সম্পর্ক ঠিক কতটা এফর্টলেস এবং মূল্যহীন হলে ছেড়ে যাবার কিংবা ভুলে থাকবার চেষ্টা করতে হয়? কী সেই জিনিস, যা এভাবেও এতটা অনড়ভাবে সম্পর্কটিকে টিকিয়ে রেখেছে?

শুধুই কি ভালোবাসা? অগাধ অসীম ভালোবাসা? অসীম ভালোবাসা তো কেবলই স্রষ্টাকেই মানায়। শুনেছি, স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে এতটাই ভালোবাসেন যে তাঁর সৃষ্টিকে কেউ কষ্ট দিলে তিনি নাকি সহ্য করতে পারেন না; এজন্যই বোধ হয় সৃষ্টির কোনও কিছুকেই অসীম ভালোবাসার সুযোগ তিনি রাখেন না। যে ভালোবাসা অগাধ কিংবা যে ভালোবাসায় কষ্ট পাবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিকে তিনি আলাদা করে দেন। তাহলে সে অর্থে আমাদের ভালোবাসা অগাধ নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও এভাবে অবহেলা অযত্ন নিয়েও একটা সম্পর্ক টিকে আছে!!

তাহলে কী সেই জিনিস, যা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে? আমার জানতে ইচ্ছে হয়। এর কারণ আমি জানি না, খুব করে খুঁজেও এর কোনও উত্তর আমি পাইনি।