সমাজকে বদলাতে চাইলে

 আমরা চারপাশের সমাজটাকে বদলে ফেলতে চাই, অথচ নিজেরাই থেকে যেতে চাই এখন যেমন আছি ঠিক তেমনই। সমাজ তো আমাদের নিয়েই, তো আমরা যদি একই থেকে যাই, সমাজটা অন্যরকম হবে কী করে?
  
 কারও ছোটো ছোটো ভুল দেখলেও যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি তার উপর, নিজের বড়ো বড়ো ভুলগুলিকে কৌশলে লুকিয়ে না রেখে কিংবা সেগুলির জন্য নিজেকে ক্ষমা করে না দিয়ে ঠিক সেভাবে নিজের উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লে আত্মশুদ্ধির পথটা আরও মসৃণ হতো। এগোতে চাইলে কেবল নিজের পেছনেই লাগতে হবে, অন্যের পেছনে নয়।
  
 এ পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা নিজেরা সুযোগ পেলেই মদ্যপান করে, অথচ অন্যকে গালি দেয় মাতাল-মদখোর বলে। মদের বারে মদভর্তি গ্লাস হাতে ধরেই পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে সমানে মদ্যপ ভাবতে ও বলতে আমি কাউকে কাউকে দেখেছি। সারারাত জুয়া খেলে সকালে বাড়ি ফিরে যদি কেউ পাশের বাড়ির লোকটিকে ‘শালা জুয়াড়ি!’ বলে গালাগালি করে, তবে তার মুখে থুতু ছিটাতেও রুচিতে বাধে। এই বঙ্গদেশে দুই ধরনের ভদ্রলোককে শালা বলতে ইচ্ছে করে: সুযোগের অভাবে ভদ্রলোক, সুযোগের অনুপস্থিতিতে ভদ্রলোক।
  
 গরিবদের হক সুকৌশলে হরদম চুরি করে যে শুয়োরের বাচ্চারা, ওদেরকেই দেখবেন, সামান্য দশ-বিশ টাকা, হাঁড়ির দু-মুঠো ভাত কিংবা পুরনো স্যান্ডেল চুরি করে কেউ ধরা পড়লে ‘শালা, চোরের বাচ্চা চোর!’-সহ নানান অশ্রাব্য গালি ছুড়তে ছুড়তে তাকে অবিরাম পেটাতে থাকে। ভাবুন তো, ওই বেধড়ক পিটুনিটাই অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ওই শুয়োরদের উপর প্রয়োগ করা হতো যদি, তবে তো শালাদের হাড়গোড়ও খুঁজে পাওয়া যেত না!
  
 উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চপ্রতিষ্ঠিত এমন নারীবাদী পুরুষও আছে, যারা ঘরের বাইরে নারীস্বাধীনতার বুলি ছোটাতে ছোটাতে মুখ দিয়ে ফেনা বের করে ফেলে, আর ঘরের ভেতরে উঠতে-বসতে বউ পেটায়। নারীর সমঅধিকার নিয়ে সোচ্চার এসব কুকুরের দল ঘরের বউয়ের উপর কীরকম খ্যাঁকখ্যাঁক করে, তা আপনি ওদের বাইরের রূপ দেখে কল্পনাতেও আনতে পারবেন না!
  
 কাজের মেয়েটিকে কথায় কথায় পিটিয়ে জখম-করা, খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা-দেওয়া শ্রদ্ধেয় ম্যাডামটি যখন নারী দিবসে নারীর অধিকার নিয়ে গলা ফাটাতে থাকে মাঠে-ঘাটে, তখন সত্যিই ঘেন্নায় তার মুখ বরাবর ছেঁড়া স্যান্ডেল ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করে! মুখোশহীন শয়তানের সঙ্গও সহ্য করা যায়, কিন্তু ফেরেশতারূপী শয়তানের ছায়াও সহ্য করা কঠিন!
  
 বিয়ের পর বউকে জোর করে চাকরি করতে দেয় না যে পুরুষ, তাকেও দেখা যায়, প্রতিটি মুহূর্তেই রীতিমতো নিয়ম করে বউকে খাওয়া-পরার খোঁটা দেয় এবং মানসিক, কখনওবা, শারীরিকভাবে নির্যাতন করে; আর ঘরের বাইরে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার পক্ষে সাফাই গেয়ে গেয়ে হাততালি কুড়োয়। চাকরি পাবার আগে বিয়ে করলে মেয়েদের আত্মসম্মান প্রায়ই চরম হুমকির মুখে পড়ে। বেকার গৃহিণীকে উপযুক্ত পারিবারিক স্বীকৃতিপ্রদান এদেশে খুবই বিরল একটা ঘটনা।
 ওয়েস্টার্ন ড্রেস-পরা মেয়েটিকে নিয়ে ফেইসবুকে ও নানান জায়গায় তামাশা-করা ভণ্ড লোকটাও সুযোগ বুঝে পর্নোগ্রাফিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকে, চোখ দিয়ে মেয়েদের ধর্ষণ করে চলে প্রতিনিয়ত। তথ্যপ্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষের যুগে নারী নির্যাতন ও নারীর পোশাক, এই দুইয়ের মধ্যে কোনও দূরতম সম্পর্কও নেই। কে কী পোশাক পরবে বা পরবে না, তা একান্তই তার নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছে ও রুচির উপর নির্ভর করে। হায়েনা কখনও পোশাকের রং কিংবা ঢং দেখে মানুষের উপর ঝাঁপায় না; প্রদর্শনের ন্যূনতমও সুযোগ পেলে হায়েনা তার হিংস্রতা দেখাবেই!
  
 ছেলের বিয়েতে ‘মেয়েকে আপনাদের খুশিমতো দেবেন’ বলে-টলে যৌতুক-নেওয়া যে বাবা-মা ছেলেবউয়ের সামনেই তার বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো উপহারসামগ্রীর বিশ্রী রকমের ব্যবচ্ছেদ করে সুযোগ পেলেই, নিজের মেয়ের বিয়ের সময় কোনও দাবিদাওয়ার কথা উঠলে তারাই পাত্রপক্ষকে ভিখারি-ছোটোলোক ডাকতে ছাড়ে না। এইসব ভণ্ডামি দেখলে ঘেন্না লাগে, বমি চলে আসে! যৌতুক গ্রহণ বা প্রত্যাশা করে বিয়ে করার বা করানোর চাইতে ভিক্ষার ঝুলিহাতে রাস্তায় নামা অনেক অনেক বেশি সম্মানের।
  
 সমাজের এমন সাপগুলি সুযোগ বুঝে যেখানে-সেখানে খোলস ধরে, খোলস ছাড়ে। সমাজসিদ্ধ নানান রীতিনীতির মুখোশ পরে ঘুরে-বেড়ানো এইসব মহাত্মাদের পাল্লায় না পড়লে বোঝার কোনও সাধ্য নেই, শয়তানের যে কত রূপ! লোকের কষ্টের টাকা মেরে দিয়ে নানান জায়গায় সততা ও ধর্মের বুলি কপচায়, এরকম পাপীদের দেখি যখন, তখন খুব ইচ্ছে করে, সবার সামনে ওদের আসল চেহারাটি নগ্ন করে দেখাই!
  
 নিজের চরিত্র যেমনই হোক, অন্যের খুঁত খুঁজে খুঁজে জীবন কাটায় যারা, ওসব অমানুষেরাই সবার চোখে আজ সাধু-সন্ত! ভণ্ডামির চাইতে নিরাপদ আশ্রয় আজকালকার যুগে আর একটিও নেই। সমাজ বদলের ধুয়া তুলে তুলে নিজেদের আখের গোছানোই আধুনিকতার মূল ফ্যাশন। হুজুগে মানুষের দেশে ধরা না খেলে কিংবা সুযোগ না পেলে সব শালাই একেক পিস জলজ্যান্ত মহাপুরুষ!
 আগে নিজে ঠিক হোন, তারপর অন্যকে ঠিক হতে বলুন। চরিত্রের যে দিকটায় আপনার নিজেরই কোনও সতীত্ব নেই, সেই নির্দিষ্ট দিকে অন্যের সতীত্বের সার্টিফিকেট বিতরণ করে বেড়াবেন না। নিজেকে পালটাতে না পারলে সমাজ পালটানোর পতাকা-হাতে ছাগলের মতন ঘুরবেন না। দেখতে সত্যিই খুব বাজে লাগে!
  
 অন্যের কমোডের দাগ নিয়ে লেকচার দেবার আগে নিজের কমোডটি পরিষ্কার করুন। অন্যের চরিত্রের যে যে দিক নিয়ে রাস্তাঘাটে মাইকিং করার জন্য ওরকম করে কোমর বাঁধছেন, নিজের চরিত্রের সে সে দিক সম্পর্কে শতভাগ সৎসাহস নিয়ে এখনই প্রকাশ্যে কয়েক লাইন বলুন দেখি? আঙুরফলটা টক কি মিষ্টি, তা যদি নির্ভর করে সেই ফল পাওয়া না-পাওয়ার কূটহিসেবের উপর, তাহলে বরং নিজের উচ্চতা বাড়ানো কিংবা ফলের উচ্চতায় লাফানো শিখে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
  
 ইদানীং মানুষের ক্রোধ দেখলে বোঝার চেষ্টা করি, সেই ক্রোধের উৎসটা ঠিক কোথায়। সক্ষমের সততায়? না কি অক্ষমের ঈর্ষায়?