সব কিছু ভাঙছিল যখন

 তোমার ধারণা, তোমার জীবন থেকে ভালোবাসার মানুষটা চলে গেলে তুমি মরেই যাবে? বাঁচতেই পারবে না?
  
 জীবন থেকে কাউকে তুমি হারিয়ে ফেলতেই পারো। এটা খুবই সহজ ও স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তবে হারিয়ে ফেলার পর যা যা ঘটে, সেগুলি মেনে নেওয়াটাই ভীষণ কঠিন। তখন নিজেকে সামলে রাখা সহজ নয়।
  
 আমি ঠিক এরকম একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। দিনের পর দিন চরম নিরাশা ও হতাশার ভেতর দিয়ে গেছি, কিন্তু কখনও কাউকে কিছু বুঝতে দিইনি। আমি জানি, নিজের বোঝা কক্ষনো কারও ঘাড়ে চাপাতে নেই। চাপাই যদি, বোঝা আরও উলটো বাড়বে। এ পৃথিবীতে কেউ কারও দুঃখ নিতে পারে না। তাই সেই চেষ্টা করাও নিছক বোকামি।
  
 তখন আমি ক্রমেই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম। তবে এটা কাউকেই বুঝতে দিচ্ছিলাম না, বরং সবাইকে বোঝাচ্ছিলাম, আমি ভালো আছি। মনে রাখবেন, কেউই আপনার যন্ত্রণা শুনতে চায় না, শোনালে লোকে বরং বিরক্ত হয়, মুখে কিছু না বললেও। তাই আমি তখন সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলতাম। ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছি, কিন্তু বাইরে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি!
  
 সেই যন্ত্রণার সঙ্গে বসবাস করার সময় যন্ত্রণাটা একটু হলেও এড়ানোর জন্য যা যা বুদ্ধি মাথায় আসত, তা-ই তা-ই করার চেষ্টা করতাম। আমি নিজেকে বার বার বোঝাতাম, আমি ভালো আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি জোর করে হলেও বিশ্বাস করেছি, এই কষ্টটা থাকবে না, খুব শিগ্‌গিরই এটা চলে যাবে।
  
 হ্যাঁ, ধীরে ধীরে আমি সেই কষ্টটা দূরে সরিয়ে কিংবা পুরনো স্মৃতিকে পাত্তা না দিয়ে বাঁচতে শিখে যাচ্ছিলাম। এটা অভ্যাস করার একটা ব্যাপার। জোর করে হলেও অভ্যাসটা করতে হয়। অভ্যাসটা শুরুতে হয় না, তখন ক্রমাগত অভিনয় করে যেতে হয় নিজেরই সঙ্গে। নিজেকেই খুব শক্ত করে বলতে হয়, হ্যাঁ, যন্ত্রণাটা এড়িয়ে বাঁচতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিজের অপ্রয়োজনীয় আবেগকে যতই পাত্তা দেবেন, ততই তা আপনাকে পেয়ে বসবে। জোর করে হলেও নিজেকে তখন শাসন করতেই হয়।
  
 আমি জানি, আমাকে কীসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অতটা কষ্ট সহ্য করা সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু বেঁচে থাকতে চাইলে সহ্য তো করতেই হবে। সেদিন নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়েছিলাম বলেই আজ আমি নিজের মনের মতো বাঁচতে সক্ষম হয়েছি।
  
 এখন আমি বেশ ভালো আছি। এখন আমার মন সত্যি সত্যি ভালো, সেই পুরনো দিনের মতো অভিনয় করে করে বাঁচতে আমাকে আর হয় না। বাঁচতে এখন আর আমার কষ্ট হয় না। আমার মধ্যে এখন আর হতাশা কিংবা নিরাশা কোনোটাই নেই। এমনকী তখন আমি যেরকম মানুষ ছিলাম, এখন আর সেরকম নেই, আজ আমি পুরোপুরিই ভিন্ন একটা মানুষ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে এখন আমার আর অস্বস্তি হয় না।

 সেই তীব্র কষ্টের অভিজ্ঞতা চমৎকারভাবে বাঁচতে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে, আজকের এই দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে এসেছে। অমন যন্ত্রণা পেয়েছিলাম বলেই আজ আমি নিজের মধ্যে এতটা শক্তি ধারণ করি। আমি আর আগের আমিটা নই। চাইলেই কেউ আমাকে আজ আর ভেঙে ফেলতে পারবে না। আজ আমাকে কেউ আর চিনতেই পারে না। আমার সাহস দেখলে সবাই আজ অবাক হয়।
  
 সময়ের দাবি অনুযায়ী নিজেকে ও নিজের মনকে বদলে ফেলতে হয়। যারা পারে না বদলাতে, তাদের বাঁচতেই খুব কষ্ট হয়ে যায়। আমি নিজেকে বার বারই বোঝাতাম, এরকম কষ্টে কষ্টে জীবন কাটানোর জন্য আমার জন্ম হয়নি। আমি পৃথিবীতে এসেছি জয় করতে, যুদ্ধে নামার আগেই এমন হেরে যেতে নয়।
  
 নিজের জীবন থেকেই বলি। ভুল করা অপরাধ নয়, ভুল থেকে না শেখাই অপরাধ। তোমার ভুলগুলি নিয়েই কাজ করো, সেগুলিকে দূর করার চেষ্টা করো, নিজেকে বাঁচার ও বেড়ে ওঠার সুযোগ দাও। তোমার জন্য ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে।
  
 মাথায় রেখো, কাউকে তুমি জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছ, এর মানেই হলো, নিজেকে খুঁজে পাবার সবচাইতে বড়ো সুযোগটা তুমি পেয়ে গেছ। এখন সেই সুযোগ তুমি কাজে লাগাবে, না কি নিজের চোখে নিজেকে একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখবে, তা সম্পূর্ণই তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।