সদ্‌গতি (১৯৮১)

 সত্যজিৎ রায়ের ‘সদ্‌গতি (১৯৮১)’: সূর্য ডোবার আগে
................................................................................................


সূর্য ডুবছে। পৃথিবীর ক্লান্ত চোখে ঘুম।


এক লোক সুকৌশলে লাশ স্পর্শ না করে লাশের ডান পা দড়ির ফাঁসে আটকে লাশটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। লাশে পচন ধরেছে, চারিদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। লাশটি একজন চামারের, যে কিনা সারাজীবনই নিষ্ঠার সাথে ধর্মপালন করে এসেছে। বেঁচে থাকতে সে ছিল অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত। যে লোকটি লাশ টানছেন, তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ। তাঁর বিশ্বাসের নির্দয়তার বলি হয়ে শূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত দুখী লাশ হয়ে ভাগাড়ে যাচ্ছে। ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের পুরস্কার দুখী পেয়ে গেছে। জীবিত অবস্থায় সে অস্পৃশ্য জীবনযাপন করেছে, মৃত্যুর পর তার জায়গা হলো শেয়াল, শকুন, কুকুর আর কাকের পেটে। আর সে সৎকারের সুব্যবস্থা করে দেন এক ব্রাহ্মণ নিজহাতেই। লাশটা তাঁর হাতের ছোঁয়া না পেলেও লাশটানার দড়িটা তো পেয়েছে। সে সৌভাগ্যই-বা কয়জন চামারের হয়? তা-ও হতো না। কী করে হলো? লাশের কোনও জাত থাকে না, তবে ছোটোলোকের লাশের জাত থাকে। অস্পৃশ্য যারা, ওদের লাশও অস্পৃশ্য।


বেচারা দুখীর মেয়ের বিয়ে। পাঁজিপুঁথি দেখে দিনক্ষণ ঠিক করতে হবে। সকালে উঠেই কিছু ঘাস নিয়ে ছুটল পণ্ডিতবাড়ি। খালিপেটেই। পণ্ডিতমশাই ব্যস্ত মানুষ, যদি বেরিয়ে যান, গিয়ে পাওয়া না যায়! তাঁকে ঘরে নিয়ে আসতে হবে। তাঁর জন্য শুদ্ধ উপায়ে উপঢৌকন সাজানো হয়েছে, মহুয়াপাতার আসন পাতা হয়েছে। দুখীকে দেখে পণ্ডিতের মনে হলো, কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া যাক। দরোজার আশেপাশে ঝাঁট দিয়ে হবে, খামারঘর থেকে বস্তা কয়েক ভুসি গোয়ালঘরে সরিয়ে রাখতে হবে। একটা আস্ত কাঠ পড়ে রয়েছে, ওটাকেও চিরে দিতে হবে। পণ্ডিতমশাই মেয়ের বিয়ের শুভক্ষণ ঠিক করে দেবেন, দুখী কিছু কাজ করে না দিলে কি চলে?


প্রথম দুটি কাজ সহজ। হয়ে গেল। দিন দুপুরের দিকে গড়াচ্ছে। রোদের রাগ চড়ছে। ওদিকে সকাল থেকে দুখী কিছু খায়নি। বাড়িতে খেতে গেলে যদি পণ্ডিতমশাই আবার রাগ করেন! উনি ভগবানের কাছের মানুষ, তাঁর কথাতেই তো ভগবান দুখীর মতো মানুষদের দয়া করে বাঁচিয়ে রেখেছেন। থাক! আগে কাজ সেরে নেওয়া যাক। খাওয়ার কথা পরে ভাবা যাবে। বেচারা দুখী ঘাস কাটতে পারে। জীবনে কোনওদিন কাঠ-চেরার কাজ করেনি। ওদিকে কাঠটাও বেশ বেয়াড়া ধরনের শক্ত। চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে না। একটু তামাক ফুঁকে নিলে শরীরে একটু দম যদি পাওয়া যেত! তামাক জোগাড় হলো, পণ্ডিতের বাড়িতে গিয়ে দুখী কল্কে-তামাকের আগুন চেয়ে নিল। পণ্ডিতগিন্নি জ্বলন্ত কয়লাটা দুখীর গায়ে খুব বিরক্তির সাথে ছুড়ে দিলেন। দেবেন না-ইবা কেন? সুযোগ পেয়ে ছোটোজাতের দুখী ওদের বাড়িতে ঢুকে আগুন চেয়ে বসল! সাহস কত! ভাবা যায়! পণ্ডিতমশাই জানেন, দুখী যে কাজটা করে দিচ্ছে, তা করে দিতে যে কেউই অন্তত একটাকা তো নেবেই!


তামাকে শরীর চাঙা করে দুখী আবারও কাজে লেগে গেল। খটাখট কুড়ুল পড়ছে কাঠের উপর। দুখীর গায়ে আগুন-ছোড়ার অনুতাপ থেকে বামুনগিন্নি ভাবলেন, বেচারা সকাল থেকে না খেয়ে আছে, কিছু খেতে দেওয়া যাক। পরে স্বামীর সাথে আলাপ করলেন, যে খাবার আছে, অত অল্পে তো ওই ছোটোলোকের পেট ভরবে না। খাবার বানিয়ে দেওয়ার ঝামেলা এখন কে করবে? থাক গে! ছোটোলোককে কম খাবার দেওয়ার চাইতে বরং খাবার না দেওয়াই ভালো। পণ্ডিতমশাই খাওয়াশেষে বেশ একটা ভাতঘুম দিয়ে বাইরে এসে দুখীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন, কাজটা ঠিকভাবে শেষ করতে না পারলে কিন্তু মেয়ের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক সময়ে ঠিক হবে না, বিয়ে পিছিয়ে যাবে, তখন দুখী তাঁকে দোষ দিতে পারবে না। দুখী নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল। ঠিকই তো! তার গাফিলতির কারণে মেয়েটার বিয়েই আবার পণ্ড হয়ে না যায়! মুন্সি প্রেমচাঁদের কলমে: পণ্ডিতমশাই শুভ সময়টা ঠিকমতো যদি না-দেখে দেন, তাহলে হয়তো সব্বনাশ হয়ে যাবে! এজন্যেই তো সংসারে তাঁর এত খাতির, এত মান। শুভ মুহূর্তেরই তো সব খেলা! যাকে ইচ্ছে, শেষ করে ফেলতে পারেন ইনি!


দুখী যেন হুঁশ হারায়, ক্লান্তি, অবসাদ, ক্ষুধা সবই যেন উবে যায়। নিজের বাহুবলে নিজেই অবাক সে! কোত্থেকে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে অসুস্থ দুখীর গায়। গাছের উপর এক-একটি আঘাত পড়ছে যেন বজ্রের মতো। উন্মাদের মতো কুড়াল চালাতে থাকে দুখী। দুখীর সে ক্রোধ ছিল কীসের প্রতি? তার নিয়তির প্রতি? ব্রাহ্মণের প্রতি? না কি কলুষিত জাতিভেদ প্রথার প্রতি? একসময় মাথাঘুরে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।


এদিকে দুখীর লাশটা যে রাস্তায় পড়ে আছে, সেটা সবার জল আনতে যাওয়ার রাস্তা। পুলিশি ঝামেলায় পড়ে যাওয়ার ভয়ে চামারবস্তির কেউ লাশ সরায় না। আর ব্রাহ্মণরা তো লাশের গায়ে হাত দেবেই না! পাড়ার কেউ জল আনতে পারছে না, লোকে মড়া ডিঙিয়ে জল আনবে কী করে? একটা হইচই পড়ে গেল। দুখীর বউ পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির বাইরের দরোজায় কপাল চাপড়ে কাঁদতেকাঁদতে ফিরে যায়। ওদিকে বিকেল সন্ধের দিকে পিছলে যায়, বৃষ্টি নামে, লাশে পচন ধরতে শুরু করে। বৃষ্টি থামলে দুখী পণ্ডিতমশাইয়ের পবিত্র হাতের দড়িতে কাদামাটির মধ্য দিয়ে ভাগাড়ের দিকে মহাযাত্রা শুরু করে। দুখীর সৌভাগ্য, ডান পা-টা পচে যায়নি, গেলে তার অশুচি শব ব্রাহ্মণের দড়ির স্পর্শ পেত কী করে?


সূর্য ডুবছে। পৃথিবীর ক্লান্ত চোখে ঘুম।


হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, মানুষের মৃত্যুর পর কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে মৃতদেহের সৎকার করা না হলে মৃতব্যক্তির আত্মা মুক্তিলাভ করতে পারে না, শান্তি পায় না। আত্মার মুক্তির উদ্দেশ্যে করা মৃত্যু-পরবর্তী কাজগুলি আত্মাকে জাগতিক বাসনাশূন্য করে ঈশ্বরের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এরই নাম সদ্‌গতি। সত্যজিৎ রায় মুন্সি প্রেমচাঁদের ‘সদ্‌গতি’ গল্পের সিনেমারূপটি লিখেছিলেন ইংরেজিতে, পরে প্রেমচাঁদের ছেলে অমৃত রাই সংলাপগুলিকে হিন্দিতে রূপান্তরিত করেন। ভারতে প্রচলিত হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা এবং সে গা-সওয়া প্রথাকে ঘিরে কিছু মানুষের মনস্তত্ত্বকে নিয়ে সিনেমাটি তৈরি হয়েছে। গল্পটি লেখা হয়েছে প্রায় ১০০ বছর আগে, আর সিনেমাটি বানানো হয়েছে প্রায় ৪০ বছর আগে, দুঃখের বিষয়, আজকের দিনেও কাহিনির থিম পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, হিন্দুধর্মের এই চার বর্ণের মধ্যে সবচাইতে উঁচু ব্রাহ্মণ বর্ণ ও নিচু শূদ্র বর্ণের দুই পরিবারের মধ্যে ঘটে-যাওয়া একদিনের সামাজিক চালচিত্র এবং সেটিকে ঘিরে চারপাশের মানুষের আচরণ ও একটি মৃত্যু, এইসব নিয়েই এ ৪৫ মিনিটের সিনেমাটি।


ভূত ও ভগবান একমাত্র বিশ্বাসীদেরই কষ্ট দেয়, যারা যত মানে, তারা তত কাঁদে। প্রাচীনকাল থেকে এটাই হয়ে এসেছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পণ্ডিতমশাই ও তাঁর স্ত্রী যা করেছেন, তা আমাদের চোখে ভালো কি খারাপ, যা-ই হোক না কেন, তাঁরা কিন্তু সমাজে প্রচলিত প্রথাই অনুসরণ করেছেন। সে প্রথা অনুযায়ী ধর্মের দোহাই দিয়ে পণ্ডিতরা দুখীদের দিয়ে তাঁদের স্বার্থ হাসিল করে নেবেন, আর দুখীরা এর কোনও প্রতিকার চাইতে পারবে না, শুধুই কাঁদতে পারবে। দুখী এবং তাঁর পরিবার সে সমাজে বাস করে, সে সমাজের সকল সংস্কারের প্রতি ওরা অন্ধভাবে অনুগত ছিল, তবু সে আনুগত্য তাদের বাঁচতে দিল না।


দুখীদের পুরো জীবনটাই একটা ব্যর্থতার দলিল। তারা কখনও কোনও ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারবে না, শুধুই নীরবে মেনে নেবে---এতে যদি মৃত্যু হয় তো হোক! বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা একই দৃশ্য দেখি। শাসকের প্রতি আনুগত্যও দেশের মানুষকে কখনওই সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। যাদের হাতে ক্ষমতা, ভালোভাবে বাঁচার সকল অধিকার একমাত্র তাদেরই।