শেকল ভাঙতে গিয়ে

 মনে পড়ে, তখন আমি অখণ্ডযৌবনা.........
শুভ্র তুষারের মত নির্মল চিত্তে প্রথম জীবনের অব্যক্ত যত ব্যথা নীরবে বয়েবেড়ানো প্রচ্ছন্ন অশ্রুপ্লাবিত উচ্ছ্বসিত এক দুঃখী নদী।
শরীর বেড়েছে, সাথে উষ্ণতা।
তবু মন তখনও বালিকাগণ্ডিতে, পেরোয়নি তা!
দিনগুলি ছিল মৃত্যুর মত বীভৎস, আর বিষণ্ণ কুয়াশায় ঢাকা ধূসর।
 
সে এল আমার উনবিংশ চূর্ণ অধীর জীবনে।
সে এল এক অভ্যুত্থানের হয়ে, সে এল যেন পরশুরামের মত!
গভীরে আমায় ছুঁয়ে দিল সে.........এক পশলা বৃষ্টি সহসা ছোঁয় যেমনি মরুর হৃদয়!
সে আমার সঙ্গী হল---আমার যত কান্নাহাসি, জোছনাঅমা---সবকিছুতেই পেলাম তাকে।
ঘুরল বছর এমনি করেই।
দূরেই থেকে নিবিড় করে টানল সে আমায় আপন করে।
কখনও তাকে পাইনি কাছে---সে সুখ আমার দূরেই ছিল, দূরই তবু টানত কাছে কোন যাদুতে, আমি বুঝিনি!
দেখা হয়েছিল কয়েকবারই---সেও দূরেই!
ভালোবাসা ওর টানত ভীষণ আমায় কেমন.........আমি জানি না!
ছুটে যেত মন দিনরাত্রি, তবু ভাবিনি আমি, স্বপ্নের মতন আসবে সে কখনও জীবনে আমার সত্যি হয়ে!
সে প্রেম আমার প্রথম ছিল না, তবু কাকে বলে প্রেম, সে প্রেমই প্রথম বুঝিয়েছিল!
 
একদিন সে কাছে এল, দেখা হল এক বিজন ঘরে।
স্পর্শও থাকুক দূরে, কখনও সে আমি দেখিনি পুরুষ নিজের মতন, হয়নি কথা তেমন করে সঙ্গে কারও,
ভয়ের বাধাটা পারিনি পেরোতে কোনওমতে,
বেঁধেছি সে কী লজ্জা আর সংকোচ ঘিরে সেই নিজেকে বড় দূর হতে!
বদ্ধ কামরা, একাকি আমরা---বসে মুখোমুখি।
একটু দূরে, নিশ্চুপ সুরে, কাটছে সময় দ্বিধাকুণ্ঠার ডানায় উড়ে।
ওর সে দুচোখে তাকাতে পারিনি, কী ছিল সে চোখে, জানি না যে আজও!
কাছে টেনে নিক, হাতটা ধরুক, আমায় বাঁধুক বড় আদরে!
সেদিন মনেতে ঝড় উঠেছিল এক---কীসের সে ঝড়, ভয়েই বুঝিনি।
কখনও জানিনি, পুরুষমানুষ কীভাবে যে ছোঁয়, কতটা আবেগে, কোন ইশারায়!
 
নৈঃশব্দ্যের ভাঙল দেয়াল আচমকাতেই!
“এই যে মেয়ে! ভয় করে বুঝি?”
কিছুতেই মুখে সরলো না কথা, নাড়লাম মাথা, বোঝালাম---না।
কাছে এল সে! বুকের ভেতরে ঢংঢং যেন ঘণ্টা বাজল!
হাতের মুঠোয় জড়িয়ে এ দুটি হাত মৃদু হেসে নিল আর বলল, এ আঙুল আমার কেটেছে কেমন, একটু দেখো তো!
আমি ওর আঙুলটাতে আলতো ছোঁয়ার অভিনয়ে যেন প্রবোধ নিলাম, ফেললাম দম!
আমার চশমা খুলে নিজ চোখে দিল, খুলল আবারও, রাখল পাশেই।
হাতের আঙুলের উল্টো পিঠে এ গালটা ছুঁয়ে আলতো চুমুতে শরীর কাঁপাল!
এ কোন রহস্য! কোন মায়া গো! কী হয়ে গেল! বুঝিনি তো কিছুই!
 
চোখ মেলতেও সে কী কষ্ট! নিঃশ্বাসটুকুই বা পালাল কোথায়?
“এই বোকা মেয়ে! ঠোঁটটা কেমন ওয়াইন কালার! এ গালে মোছো তো আচ্ছা করে!”
এ চুম্বন পারবো না আমি কখনও কিছুতে!---জানত বলেই চেয়েছে অমন!
“ক্ষমা করো, প্রিয়, আমি পারবো না!”
“চুমু খাও, প্রিয়, সরাও দ্বন্দ্ব, এ দুচোখ দেখো, করছি বন্ধ!”
দেখলাম আমি, থরোথরো হাত খেলল ও চুলে!
ম্যাট লিপস্টিক, মুছতে চায় না, তবু ঠোঁট ছুঁয়ে গালে শুধালাম চমকে, “মুছে গেছে তো?”
“নাগো, বোকা মেয়ে! ওই শুকনো মোছেনি এখনও!”
মাথা নিচু, দাঁতে নখ কেটে চলি, যেন কত মধু আছে নখের শরীরে!
 
কানের পেছনে ঠোঁট দুটো এনে নিঃশ্বাসের তাপে আমায় গলিয়ে হেসে বলল, “লজ্জা কীসের, এই সোনাবাবু?”
“যাও তুমি, পচা! জানি না কিছুই!”
“এখানে কী তবে? চলো এখুনিই, ঘুরি বাইরে।”
“যাবো না কোথাও। এখানেই থাকো!.........উমমমম্‌ কোলে তুলে নাও!”
“বলে কী, বোকাটা? কোলে চড়বে? বলো বাবাকে।”
“বাবা নেয় নাতো! তুমি নাও নাগো!”
“চুপ করো এবার! তুলে কিন্তু মারবো আছাড়!”
হাতড়ে পকেট বেরোল স্নিকার্স! “নাও ধরো, খাও!”
“কিচ্ছু খাবো না! কোলে উঠবো! নাও না কোলে!”
 
ও বিছানা ছেড়ে আঁটল দরোজা।
আর অমনিই সামনে এসে হাত বাড়িয়ে বলল হেসে, “দেখি, আসুন ম্যাডাম! কোলেই আসুন!”
আমি ছিলাম বসে খাটের চাদরে।
দাঁড়িয়ে খাটে, ছোট্ট লাফে, ওই গলাতে জড়িয়ে নিজেকে সে পরশে মাতাল হলাম মুহূর্ততেই!
জানি না, সময় পেরুল কতটা ঠিক ওইভাবে!
এ পাঁজরের খাঁচা শরীরের ঘ্রাণে কেমন দারুণ উষ্ণ হলো!
এত কেন সুখ! এত কেন সুখ! মরে যাইও যদি, কষ্ট পাবো না।
“ফেলে দেবো?”
“দাও নাগো, হুঁ!”
ওই মায়াবী দুহাতে জড়িয়ে আমায় ছড়িয়ে নেশা শুধাল আবারও, “একটু মারি?”
বড় সাবধানে নামিয়ে খাটে প্রিয় আমার বসল পাশে।
“তুমি এত পচা কেন, বলো নাগো, হুঁ? শুধু মার, বক! আদর কর না একটুখানিও!”
আমায় তখন বসিয়ে কোলে কী এক মায়ায় জড়িয়ে বুকে শক্ত করে আমার দুগালে ছোঁয়াল ওষ্ঠ পাগলের মত!
 
আমি যেন মহুয়ার নেশায় কাঁপছি মাতাল! খেয়াল নেইকো কোথাও যে কোনও!
চোখ দুটো ওর লাল হয়ে গেল, ঘন হল শ্বাস, সাথে কাঁপল শরীর.........আমিও চলেছি অন্য জগতে!
আমি বন্য হয়ে চাইছি যে কী, বলতে পারি না।
চেয়েও ফেললাম কিছু না ভেবেই! চাইলাম কী, বলতে পারি না!
ও আমায় জাপটে ধরে মাতাল সুরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল হেসে, “এ আমি পারবো নাগো! ভালোবাসি যে! এ ক্ষতি তোমার.........পারবো নাগো! ভালোবাসি যে!”
কেটে গেল ক্ষণ! কাটল কীভাবে, বলতে পারি না!
বুকে রেখে মাথা হৃদপিণ্ডের শব্দ গুনেছি! সেই ধকধক.........কানে বাজে আজও! ভুলতে পারি না!
 
ওরই কেবল ধর্ম ছিল---ওর ভালোবাসার, চোখের জলের, কিংবা প্রেমের---ধর্ম ছিল না!
হয় না দেখা, কিংবা কথা।
স্মৃতি যতটুক---অশ্রু, যাতনা, বিরহ কেবলই!
শুধু মনে পড়ে, শুধু মন পোড়ে!
ঠুনকো কেমন এ দেহমন---ভাঙলে হৃদয়, কষ্ট হয়---ভাঙলে ধর্ম, নষ্ট হয়!
যত ধর্ম শিকল, তত হৃদয় বিকল! ওরা বলে একে ধর্মের জয়!
প্রেমের ক্ষততে মরে যায় যে, সে-ই তো বোঝে বাঁচতে কেমন কষ্ট হয়!
একটু নষ্ট হলে এমন কী হত! বাঁচাতে হৃদয় আমি নাহয় নষ্ট হতেম!