রাগ-নিয়ন্ত্রণ

প্রশ্ন: দাদা, অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কিছু বিষয় জানার ছিল। আমি যদি আদতেই খুব রাগি একটা মানুষ হই, তবে আমি কীভাবে নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করব? অনেকে বলে, আমার প্রচুর রাগ, আমি প্রচুর মোটিভেশনাল ভিডিয়ো হয়তো দেখি, দেখেও আমার রাগ নিয়ন্ত্রণে কিছুই করতে পারি না। আমি ইভেন সাইকিয়াট্রিস্টও দেখিয়েছি, কাউন্সেলিং নিয়েছি, কিন্তু কোনোভাবেই আমার অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে না। মাথা ঠান্ডা করার জন্য আমাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়। আমি খেয়ে দুইদিন ঘুমাই। তার পরের দিন উঠে আমি চলাফেরা করতে পারি না। চতুর্থ দিন থেকে আমার আবার রাগ শুরু হয়। তো আমাকে শুধু ঘুমের মধ্যেই রাখা হয়, এভাবেই আমার রাগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু রাগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আসলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। তো দাদা, লাইফে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা কতটা জরুরি? ‘রাগ’ শব্দটা কতটা নেগেটিভ? রাগ জিনিসটা লাইফে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে, কর্মজীবনে কতটা প্রভাব ফেলে?




উত্তর: রাগ ব্যাপারটা কিন্তু মানুষকে ভালো পথেও নেয়। আমি আমার লাইফে যা-কিছু পেয়েছি, তার অনেক কিছুই রাগ থেকে পেয়েছি। অবশ্য সেটাকে রাগ বলে না, সেটা মূলত জেদ। যে রাগটা তুমি তোমার নিজের সাথে করো, সেটা হচ্ছে জেদ। যে রাগটা তুমি অন্যের সাথে করো, সেই রাগটাকে বলা হয় ক্রোধ। ক্রোধ তোমাকে শেষ করে দেয়, আর জেদ তোমাকে লাইফে অনেকদূর নিয়ে যায়।




ধরো, তোমাকে কেউ বলল, তোমার পক্ষে এই কাজটা করা সম্ভব না! একটা ভালো কাজ, একটা কঠিন কাজ, একটা চ্যালেঞ্জিং কাজ করার জন্য যদি তার কথাটা তোমাকে রাগিয়ে দিয়েও অনুপ্রাণিত করে, তবে সেই রাগটার নাম হচ্ছে জেদ। অর্থাৎ তার কথাটাকে তুমি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছ, একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছ এবং সে চ্যালেঞ্জটা তোমাকে ভেতর থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। এখন যদি ওরকম কোনও জেদ হয়, কেউ তোমাকে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না!’ তুমি তাকে বলল, ‘ভালোবাসিস না মানে! তোর বাপে বাসবে! আমি দেখে নিব, ভালো না বেসে কীভাবে থাকিস!’ এই ধরনের রাগ তোমাকে জীবনে কিছুই দেবে না। এই রাগ তোমাকে ধ্বংস করে দেবে। এই জেদ তোমাকে ধ্বংস করে দেবে। এই ব্যাপারটা অবশ্য আমরা বুঝি। সকলেই কম-বেশি বুঝি, অনেকেই সময়মতো মানতে পারি না যদিও।




তো যে রাগটা একটা মানুষকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলে, ভেতর থেকে উজ্জীবিত করে, ভেতর থেকে জ্বালিয়ে ওঠায়, সে রাগটা ভালো। এখন, অন্যের উপর ক্রোধ বা রাগ থেকে আমরা যে আচরণ করি, যে সিদ্ধান্তগুলো নিই, সেটা প্রায় সময়ই সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়, আমাদের ভুল সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করে, নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন করে তোলে এবং অনেক ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি করে। সে রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ অনেক ভাবেই করা যায়! একেকটা মানুষ একেক ভাবে রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন! দুই-একটা আমি বলতে পারি! যখন তুমি কারও উপর রেগে যাচ্ছ, তখন তুমি, তোমার যা-ই বলতে ইচ্ছে করুক না কেন, তোমার যা-ই রিঅ্যাক্ট করতে ইচ্ছে করুক না কেন, তোমার যত যা-ই কিছু করতে ইচ্ছে করুক না কেন, নিজেকে জোর করে হলেও স্থির রাখবে। তুমি নিজের মুখটা জোর করে বন্ধ রাখবে। যদি এমন হয়, সে তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বা বসে আছে, তোমার সামনেই অবস্থান করছে, তুমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছ না, তবে তুমি অনুগ্রহ করে তোমাকে ওই মানুষটার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। অন্য একটা রুমে নিয়ে যাবে, একটু দূরে নিয়ে যাবে। দরজা খুলে তুমি বেরিয়ে যেতে পারো ঘুরতে, অসুবিধা নেই! কিন্তু ওই রাগের সোর্সটা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনতে হবে যেভাবেই হোক!




খুব রেগে গিয়ে রিঅ্যাক্ট করা যাবে না। মানুষ কিন্তু রেগে গেলে যে কথাগুলো বলে, সে কথাগুলো যে মানুষটাকে বলছে, সে মানুষটা বেশিরভাগ সময়ই ধরে নেয়, এসব বোধ হয় তার মনের কথা, বেশিরভাগ সময়ই সে কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলে এবং সিরিয়াসলি নেবার পর, সে মানুষটাকে ভুল বুঝে বসে থাকে। তুমি রেগে গিয়ে যে কথাগুলো বলছ, আমরা রেগে গিয়ে যে কথাগুলো বলি, সেগুলোর কিন্তু প্রত্যেকটাই আমাদের ইগো বলে। আমি নিজে কথা বলি না, আমার ইগোটা কথা বলে। আমার ভেতরে যে অহম্‌সত্তা, যেটাকে ইংরেজি ভাষায় বলে ইগো, সে অহম্‌সত্তাটা কথা বলে। আমি একটা সিরিজ লিখি, ‘অস্পষ্ট জার্নাল’ নামে; ওটা মূলত মনস্তাত্ত্বিক লেখা, সেখানে এইসব নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। যদি মনস্তত্ত্ব নিয়ে কারও আগ্রহ থাকে, তবে তিনি পড়ে নিতে পারেন ‘অস্পষ্ট জার্নাল’ সিরিজটা; আমার ওয়েবসাইটে গিয়ে ‘মনস্তত্ত্ব ও দর্শন’ সেকশনে পাবেন।




তো যেটা বলছিলাম, এখন একটা মানুষ যখন রেগে গিয়ে কথা বলে, তখন সে তার অহম্‌সত্তা থেকে কথা বলে। সে যে মানুষটাকে কথাগুলো বলছে, সে মানুষটা কিন্তু ওই কথাগুলোকে খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে এবং সেই কথাগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাকে আহত করে। কিন্তু আমি কথাগুলো বলছি, আমি ভাবি যে, কথাগুলো হয়তোবা সে রিসিভ করবে, আমার মনের কষ্টটাকে আমি ঝেড়ে ফেলছি এবং সেই কথাগুলোকে রিসিভ করে সে তার ভুলটা বুঝতে পারবে। কিন্তু মানুষ যখন রেগে যায়, তখন মানুষ সাধারণত নিজের ভুলগুলো বোঝে না, সে চেষ্টা করে তার ইগোটাকে জিতিয়ে দিতে এবং নিজের ইগোটাকে জিতিয়ে দিতে গেলে অন্য একটা মানুষ আমাদের যে কথাগুলো বলছে, সে কথাগুলোকে রিসিভ করা যায় না। সে কথাগুলোকে সহজভাবে রিসিভ করাই যায় না। সে কথাগুলোকে আমরা রিসিভ করি রিঅ্যাক্টিভ প্রসেসে। অর্থাৎ যে প্রসেসটা আমাকে রিঅ্যাক্ট করতে সাহায্য করে। আল্টিমেটলি কোনও সমাধানেই পৌঁছানো যায় না।




আরেকটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার রাগটা দেখাচ্ছি, আমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছি, সেই কথাগুলো হয়তোবা সেই জায়গাতে সঠিক! কিন্তু যে মানুষটার সঙ্গে আমি রাগ করছি; ধরো, আমি আমার বাবার সঙ্গে রাগ করছি; আমার বাবা, তিনিও কিন্তু তাঁর জায়গাতে ঠিক; আমি যদি পুত্র না হয়ে আমি পিতা হতাম, তাহলে হয়তোবা আমার পিতা যেভাবে ভাবছেন, আমি ঠিক সেভাবে করেই ভাবতাম! আমি যদি আমি মানুষটা না হয়ে সেই মানুষটা হতাম, তাহলে তার অবস্থানের পক্ষে সকল ধরনের জাস্টিফিকেশন আমার হাতেও থাকত! আমি ঠিক ওরকম করেই ভাবতাম! এই বিষয়টা আমাকে মাথায় রাখতে হবে। এই বিষয়টা মাথায় যদি রাখি, তাহলে হবে কী, যার সঙ্গে আমি রাগটা করছি, তার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, এই যে পারষ্পারিক সম্পর্ক, সে সম্পর্কটা বেঁচে যাবে। সে সম্পর্কটা বাঁচাতে হলে, আমাকে আমার ভেতরটাকে, আমার ভেতরের মানুষটাকে জিতিয়ে দেবার যে নেশা, জিতিয়ে দেবার যে ইচ্ছা, জিতিয়ে দেবার যে অদম্য আগ্রহ, সেখান থেকে সরে আসতে হবে। সেখান থেকে সরে আসতে পারলে আমরা কিন্তু অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারব।




পৃথিবীর প্রত্যেকটা ঝড় কিন্তু একসময় থামে। ঝড় যত ভয়ংকরই হোক, একসময় থেমে যায়। এই যে রাগের যে কারণগুলো তৈরি হলো, সে কারণগুলোও কিন্তু একসময় থেমে যাবে। তখন, থেমে গেলে, এখন আমি যে কথাগুলো বলছি, হয়তোবা সে কথাগুলো ভেবে পরে আফসোস হবে! সেই কথাগুলো ভেবে পরে দুঃখ পাবো! তাই সেই কথাগুলো না বলে, এই জায়গা থেকে নিজেকে দূরে রাখাটা সমীচীন বলে আমি মনে করি। আর এইক্ষেত্রে, একটু যদি চুপ থাকা যায়, নিজেকে চুপ রাখা যায়, তাহলে বোধ হয় অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়া যায় অনেক সহজেই।