(ছয় বছর আগে রথযাত্রার দিনে লেখা)
আজ রথযাত্রা। এর উৎপত্তি নিয়ে অনেক মত প্রচলিত। কয়েকটা বলছি।
কৃষ্ণের মামা কংস কৃষ্ণ ও বলরামকে হত্যার উদ্দেশ্যে মথুরায় নিমন্ত্রণ করেন। তাঁদেরকে নিয়ে আসার জন্য অকুরকে গোকুলে পাঠান। গোপীদের বিদায় দিয়ে কৃষ্ণ বলরামকে সঙ্গে নিয়ে মথুরার উদ্দেশে রথে যাত্রা করেন। কংসের সাথে লড়াইয়ে জিতে রথে চড়ে ফেরার পথে কৃষ্ণ মথুরায় ভক্তদের দর্শন দেন। সেই ফিরতিযাত্রাই আজকের রথযাত্রা।
একবার শ্রীকৃষ্ণ বড়োভাই বলরাম ও ছোটোবোন সুভদ্রাকে নিয়ে দ্বারিকা নগরীর শোভা দেখতে রথে বের হন। সেই দিনটিকে উদ্যাপন করতেই রথযাত্রা।
মহাভারতের আঠারো দিনের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি বা পাণ্ডবদের সর্বময় চালিকাশক্তি হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। ভক্তরা রথযাত্রার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণকে তাদের সংসার-রথের সকল দায়িত্ব সমর্পণ করেন।
বলরামের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মৃত্যুবাসনায় মহাযোগ অবলম্বন করে মাটিতে শুয়ে রইলেন। তখন জরা নামে এক ব্যাধ কৃষ্ণের পদযুগলকে ভুল করে হরিণ ভেবে তীরবিদ্ধ করলেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে শঙ্কিতমনে শরাহত কৃষ্ণের পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, এই ঘটনা পূর্বনির্ধারিত। তাঁদের উভয়ের পূর্বের এক জন্মের কর্মফলের কারণেই জরাব্যাধের হাতে তিনি দেহত্যাগ করছেন। তথাপি, জরাব্যাধ বারবার অনুশোচনাপূর্বক কৃষ্ণভজনের অনুমতি প্রার্থনা করলে শ্রীকৃষ্ণ জরাব্যাধকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন প্রথমে দক্ষিণে গিয়ে পরে পূর্বদিকে সমুদ্র উপকুলে ধরে হেঁটে যান; এভাবে গিয়ে যেখানে সমুদ্রের জলে তিনি কৃষ্ণের চিতার কাঠ ভেসে যেতে দেখবেন, সেখানে সেই কাঠ সংগ্রহ ও প্রতিষ্ঠাপূর্বক তিনি যেন আরাধনার ব্যবস্থা করেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লৌকিক দেহ ত্যাগ করেন। অতঃপর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের মরদেহ সৎকারের জন্য দ্বারকায় না পাঠিয়ে সমুদ্র উপকূলে দাহ করার মানসে চিতায় উঠিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করেন। জরাব্যাধ শ্রীকৃষ্ণের আদেশ অনুসারে সমুদ্র উপকূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরীতে এসে পৌঁছেন। এদিকে জ্বলন্ত চিতায় মরদেহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হওয়ার পূর্বেই সমুদ্রের এক প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে চিতার আগুন নিভে যায়। কিছু দেহাবশেষ-সহ চিতার কাঠ সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে থাকে। জরাব্যাধ পুরীর কাছে সমুদ্রের জল থেকে শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষ-সহ সেই কাঠ সংগ্রহ করে গভীর অরণ্যে সেইগুলো স্থাপনপূর্বক দারুব্রহ্ম বা জগন্নাথরূপে আরাধনা করতে থাকেন। এই জরাব্যাধই ছিলেন অরণ্যচারী শবরদের রাজা বিশ্ববসু। ওই সময় ভারতের পুরী শহরের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে কৃষ্ণ পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। দেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের অনুরোধে বিশ্ববসু তদকর্তৃক সংগৃহীত চিতার কাঠ (শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ) রাজাকে দান করেন। মূর্তি নির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী রাজার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েক দিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন, মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি-সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন, মূর্তি তখনো অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ। পরবর্তীকালে ব্রহ্মার আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই অর্ধনির্মিত মূর্তির মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের অস্থি স্থাপন করে মূর্তিতে চক্ষু, দৃষ্টি এবং প্রাণের সংস্থানপূর্বক তা আরাধনার ব্যবস্থা করেন। মূর্তিগুলো হলো জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা।
রথযাত্রা উৎসবের সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে কাঠের তৈরি তিনটি বিরাট রথে করে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভক্তরাই এই রথগুলো টেনে নিয়ে যান। যেখানেই জগন্নাথ মন্দির আছে, সেখানেই এই ধরনের রথযাত্রা আয়োজিত হয়।
এখন দেখা যাক, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে রথ নিয়ে কী লেখা আছে।
কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, যম তাঁর পুত্র নচিকেতাকে বলছেন, যে ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তাকে তাঁর জীবনরথের সারথি করেন, যাঁর মন তাঁর পঞ্চইন্দ্রিয়কে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে, তিনি ওইভাবে এ সংসারে বিচরণ করে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারেন।
রামায়ণে রামচন্দ্র বিভীষণকে বলছেন, আমাদের সংসারযাত্রার রথটির চাকা হল সাহস আর জেদ, অপরিবর্তনীয় সত্য আর চরিত্র হচ্ছে এর পতাকা, এর চারটি ঘোড়া শক্তি, বিবেচনা, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ আর বদান্যতা, এবং ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই হল এর সারথি। এমন রথে লোকে সকল সংসারবাধা অতিক্রম করতে পারে।
মহাভারতে কৃষ্ণ অর্জুনের রথের সারথি হয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে জয়ের দিকে পরিচালিত করেছেন। জীবনযাত্রার রথে সংসার পাড়ি দেবার সময় কেউ যদি তাঁর সমস্ত নিয়তি যথার্থ সারথির উপর সমর্পণ করেন, তবে তিনি পূর্ণতার পথে চলতে পারবেন।
রথযাত্রা হচ্ছে মূলত আমাদের হৃত আত্মার পুনরুদ্ধার কৌশল। আমাদের হৃদয়ে কৃষ্ণ, অর্থাৎ ঈশ্বরকে স্থান দেয়ার ধ্যানই রথযাত্রা। এই ধ্যানের প্রথম ধাপ হচ্ছে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করা। কাম, ঈর্ষা, ঔদ্ধত্য, লোভ, ক্রোধ আর মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করার মাধ্যমে পরিশুদ্ধির কাজটি করা যায়। শুধু নিজেকে নয়, অন্যকেও সুন্দর হৃদয় ধারণ করতে সাহায্য করা রথযাত্রার দর্শন।
রথে জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা থাকেন।
জগত মানে পৃথিবী আর নাথ মানে পতি। জগন্নাথ অর্থ জগতের পতি, অর্থাৎ জগতের সকল কর্মকাণ্ডের প্রভু।
বল মানে শক্তি আর রাম মানে আনন্দ। বলরাম হচ্ছেন, যিনি আমাদের আত্মিক শক্তি দান করেন যাতে আমরা ঈশ্বরের আশীর্বাদগুলি উপভোগ করতে পারি।
সু মানে ভাল আর ভদ্রা মানে কল্যাণ।
ফলে যখন জগন্নাথ বলরাম আর সুভদ্রা একসাথে থাকেন, তখন এ ত্রিশক্তি মানুষের জীবনকে মঙ্গলময় করেন, মানুষ তার সৌভাগ্যকে পুনরুদ্ধার করতে পারে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “আমি সকলের হৃদয়ে আছি।” হৃদয়ে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান থাকলে আমাদের দেহ একটা রথ ছাড়া আর কিছু নয়। সে রথের সারথি আমাদের হৃদয়। রথের সুন্দর যাত্রাই আমাদের জীবনের সুন্দর যাত্রা।
রথযাত্রা মূলত আমাদের জীবনকে সত্য ও সুন্দর পথে পরিচালিত করার দার্শনিক প্রয়াস মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কণিকা’য় লিখেছেন--- রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম, ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম। পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’, মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’—হাসে অন্তর্যামী।
আমরা যে ঈশ্বরের আরাধনায় নিজেদের নিয়োজিত করি, সে ঈশ্বর পথে থাকেন না, দেবালয়ে থাকেন না, কোনও বিগ্রহে অধিষ্ঠিত থাকেন না। ঈশ্বরের অধিষ্ঠান সাধকের নিজের হৃদয়ে। যদি সে হৃদয় না জাগে, তবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে আমরা চিরকালই বঞ্চিত থেকে যাব। নিজের অন্তর্শক্তির উদ্বোধনই সর্বোচ্চ স্তরের প্রার্থনা। যে নিজের আত্মশক্তিকে চিনতে পারে না, স্রেফ বাহ্যিক ধর্মনিষ্ঠা ও অগাধ বিশ্বাসের উপর ভর করে বেশিদূর যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
ধর্ম মূলত বোধের বিষয়, বিশ্বাসের নয়। জ্ঞান ও চেতনাশূন্য ধর্মীয় বাহ্যিকতার অনুকরণ অসহায় অন্ধত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান আমরা যতটা পালন করি, যদি তার সামান্যতমও বুঝতাম, তবে ধর্মের সৌন্দর্য আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলত। ঈশ্বর আমাদের সৌভাগ্য দান করেন কর্মের মধ্য দিয়ে, ধর্মের মধ্য দিয়ে নয়। বিশ্বাস ও অনুকরণ ধর্ম নয়, বোধ ও কর্মই ধর্ম।