আত্মার শক্তি

ঈশ্বরসেবার সংকল্পকে মনের মধ্যে গেঁথে রাখার আর সঠিক পথে অনুতপ্ত হবার জন্য ঈশ্বরের সামনে নিজেকে নিঃশর্ত চিত্তে নিবেদন ও সমর্পণ করতে হয়।




আমার প্রতি তাঁর পরম মঙ্গলময়তার অসীম করুণার কথা স্মরণ করে ঘোষণা করছি: সবচেয়ে হতভাগ্য আর অযোগ্য জীব আমি, যাকে তিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করে রক্ষা আর পালন করেছিলেন, অত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে দানে-দানে ভরিয়ে দিয়েছিলেন যাকে; আর সবার উপরে, যে অনির্বচনীয় মাধুর্য আর অনুকম্পা দিয়ে এই পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর অনুগ্রহের সঙ্গে আমার পাপকে সহ্য করেছেন, এতবার আর এত স্নেহভরে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, পথ পরিবর্তন করার জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন আমাকে---আমার সমস্ত অকৃতজ্ঞতা, বেইমানি আর বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও---যেগুলির ফলে, আমার মনপরিবর্তনকে স্থগিত রেখে এবং তাঁর অনুগ্রহগুলিকে অমান্য করে আমি এত নির্বোধের মতো তাঁর ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠেছি, তা দেখেও আমাকে অনুতাপ করার সুযোগ দেবার জন্যে যিনি এত ধৈর্যের সঙ্গে আমার এই বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন, সে-কথা স্মরণ করে, আর সেইসঙ্গে এ-কথাও মনে রেখে যে, আমার এই পবিত্র যাত্রাপথে চলা শুরু হবার দিনে ঈশ্বরের কাছে তাঁর স্নেহধন্য হিসেবে স্থান লাভ করার জন্য যে আনন্দ আর পবিত্রতার সঙ্গে তাঁর কাছে আমি নিবেদিত ও অর্পিত হয়েছিলাম, আর সেই সময় আমার হয়ে আমার আত্মা কর্তৃক যে-সংকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল, তা পালন না করে, আমার মন আর শক্তিকে তাঁর স্বর্গীয় মহিমার বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে তাঁকে জঘন্য আর ঘৃণিতভাবে এতবার যে আমি অবহেলা করেছি—সেই আমিই এখন অবশেষে যথাস্থানে ফিরে এসেছি।




ন্যায়পরায়ণতার সিংহাসনের সামনে মনে-প্রাণে এখন আমি লুটিয়ে পড়েছি --- এইসব কথা স্মরণ করে, শাশ্বত ঈশ্বর আর স্বর্গের সভামণ্ডলীর সামনে আমি এই পাপস্বীকার প্রকাশ্যে আর অকপটে ঘোষণা করছি, আর সেই সঙ্গে মেনে নিচ্ছি যে, ঈশ্বরের প্রতি অনানুগত্য আর বিশ্বাসঘাতকতার গুরু অপরাধে দণ্ডিত হবার আমি যোগ্য, আর তাঁর সকল মনোবেদনার ও ক্রোধের জন্যে আমি নিজেই দায়ী; আমার করা সেইসব পাপের জন্যে আমি অপরাধী, এইগুলির জন্যেই তিনি আমার প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন, আমি যন্ত্রণা ভোগ করেছিলাম প্রাপ্যস্বরূপ‌ই, আর এইসব পাপের কারণে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবার আর নরকে ডুবে যাবার যোগ্য আমি।




এখন, সমস্ত মনপ্রাণ আর শক্তি দিয়ে আমার অতীত জীবনের পাপাচারগুলিকে ঘৃণা করার পরে, এই একই শাশ্বত ঈশ্বরের অসীম করুণার সিংহাসনের দিকে মুখ ফিরিয়ে, যিনি আমার প্রভু, আর সেই সঙ্গে পরম বন্ধু, তাঁর নির্দেশনা ও আদেশের শরণাপন্ন হয়ে বিনীতভাবে আমি তাঁর ক্ষমা, করুণা আর অনুগ্রহ ভিক্ষা করছি, সেই সঙ্গে আমি চাই আমার পাপগুলি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তিস্নান, আর আমার অন্তরস্থিত ঈশ্বরের উদ্‌বোধন আর তা থেকে পথ খুঁজে নেবার ইচ্ছে ও কর্মের উপর নির্ভর করে আমি যে স্তরে পৌঁছে যাই, সেটিই যেন আমার আশার একমাত্র ভিত্তিপ্রস্তর হয়, নিজেকে জাগানোর মুহূর্তে আমার ঈশ্বরের কাছে আমার হয়ে আমার আত্মা যে আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা করেছিল, তা-ই আবার নতুন করে আমি গ্রহণ করছি, বর্জন করছি শয়তান, পার্থিব আসক্তি আর রক্তমাংসের মোহকে। ঘৃণা করছি নিজের বিপথগামিতাকে, ভুল উপদেশে পথচলাকে, অসার দম্ভ আর ভোগলিপ্সাকে — এই জীবনের বাকি দিনগুলি আর অনন্তকালের জন্যেই আমি এসব করছি।




দয়াময় ঈশ্বরের দিকে মুখ ফিরিয়ে, আমি এই ইচ্ছা প্রকাশ করছি, প্রস্তাব করছি আর সংকল্প করছি যে, আমি তাঁর সেবাযত্ন করব, তাঁকে ভালোবাসব—এখন, চিরদিন। নিজের অন্তরে ঈশ্বরকে সদাই জাগ্রত রাখব। এর আর কোনো নড়চড় হবে না। এই উদ্দেশ্যে সমস্ত মননক্রিয়ার সঙ্গে আমার আত্মা, সমস্ত শক্তির সঙ্গে আমার মনপ্রাণ, সমস্ত স্নেহভালোবাসার সঙ্গে আমার হৃদয়, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আমার দেহ, সবই তাঁর কাছে আমি দান, উৎসর্গ আর নিবেদন করছি। আমার প্রতিজ্ঞা, যাতে আমি তাঁর কাছে আরও বেশি বিশ্বস্ত, অনুগত আর ভক্তিপরায়ণ হতে পারি, যাতে এই দৃঢ়সংকল্প থেকে পিছু হটে আসার বা মতপরিবর্তন করার কোনো বাসনা কোনোদিনই আমার মনে না জাগে, সেইজন্যে, যাঁর কাছে নিজেকে আমি উৎসর্গ করেছি আর বলি দিয়েছি, সেই স্বর্গীয় ইচ্ছা আর মহারাজাধিরাজের বিরুদ্ধে কোনোদিন আমার সত্তার কোনো অংশের অপব্যয় আমি করব না।




কিন্তু হায়! শয়তানের কুমন্ত্রণায় বা কোনো মানবিক দুর্বলতায় কোনোভাবে এই সংকল্প আর ব্রত যদি লঙ্ঘন করি, তাহলে নিজের বিবেকের সামনে এই বলে আমি ঘোষণা আর প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার পতন হচ্ছে, তা দেখার সঙ্গে সঙ্গে, নিজের পবিত্র ও শক্তিধর আত্মার সাহায্যে আবার আমি দাঁড়িয়ে উঠব, এবং স্বর্গীয় করুণার দিকে ঘুরে দাঁড়াব। তাতে কোনোরকম বিলম্ব আর ঘটবে না। সঠিক পথ থেকে মন আমাকে কখনো সরিয়ে ফেললেও আত্মার নির্দেশে আবার সেই পথে নিজেকে ফিরিয়ে আনব।




এইটিই আমার অলঙ্ঘ্য আর অপরিবর্তনীয় বাসনা ও সংকল্প। সেই একই পবিত্র আত্মাস্থিত ঈশ্বরের কাছে, বিজয়ী মানুষের দৃষ্টিতে এবং আমার দুঃখগুলিকে সামনে রেখে আমি দ্বিধাহীন আর শর্তহীনভাবে এই শপথ গ্রহণ করে চৈতন্যের জাগরণকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করছি। হে ঈশ্বর! হে আত্মা! হে কৈবল্য! হে ব্রহ্ম! হে পরা-বিদ্যাপ্রসূত সত্তা! আমার মধ্যে উদ্‌ভূত আত্মজ্ঞানের সংকল্পকে কৃপা করে তোমরা অনুমোদন করো, সুমিষ্ট নির্যাসে আমার এই অকপট আর আন্তরিক আত্মদানকে গ্রহণ করো; এবং তা করার জন্যে, হে পরমেশ্বর, যেমন অনুগ্রহ করে আমার উৎসাহ আর ইচ্ছা জুগিয়েছ, তেমনি এই দুইকে সার্থক করার জন্যে আমাকে দাও যথোচিত শক্তি, প্রত্যয় আর উদ্যম। হে ঈশ্বর, আমি যেন তোমাকে ভুলে না যাই, তোমাকে নিজের হৃদয়ে ধারণ করে চিরকাল তোমার বন্দনা করে বাঁচতে পারি। আমার মনের শক্তিকে আত্মার শক্তিতে পরিণত করার জন্য আমি তোমার আশ্রয় চাই।




আমাদের চৈতন্যের জয় হোক৷