একজীবনের যত ঝগড়া ছিল, যত রকমের বোঝাপড়া ছিল তোমার সাথে, তার সবই করে নিয়েছি আমি। এখন আর কিছুই বাকি নেই। না অভিমান, না প্রত্যাশা, না কোনও আশা। জোর করে কিংবা অন্য কোনওভাবে বাধ্য করে যে কারও কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করা যায় না, সে তো আমিও জানতামই! হয়তো মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল শুধু, কেননা আমি ভাবতাম, আমি যেহেতু ভালোবাসি, সেহেতু সেই ভালোবাসার উপর একটা অধিকার আমার অবশ্যই আছে, সেই অধিকারকে পুঁজি করেই হয়তো বারে বারে তোমাকে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে যতটা যন্ত্রণা দিয়েছি, তার শতগুণ আঘাত প্রতি মুহূর্তে আমার নিজেকে ভোগ করতে হয়েছে, যা তুমি জানো না। এখন আমি নিজেরই চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না, যখন তোমার সাথে করা আচরণগুলোর কথা মনে পড়ে। যে আমি আমি নই, সেই আমি’কেই তোমার সামনে হাজির করেছিলাম হয়তো। আমি ছুটে চলছিলাম খরগোশের মতো দৌড়ে দৌড়ে, আর এতটাই বেহুঁশের মতো ছুটছিলাম যে ছুটতে ছুটতে কোন যে দিকে চলেছি, সেকথাই ভুলে গিয়েছিলাম।
অবশেষে আমি স্থির হলাম। এখন আমি ঠিক আছি, জ্বরটাও কেটে গেছে, মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছে অনেক বড়ো কিছু। আবার মনে হয়, আমি যাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছি কিংবা নিজের অজান্তেই মনে মনে যাকে আমি এতটা গ্রহণ করে ফেলেছি, আসলে কি সে আমাকে নিয়ে অতটা পরিষ্কার করে ভাবে কিছু? ভেতর থেকে তেমন কোনও সাড়া পাইনি, কিন্তু লজ্জা হচ্ছিল তাকে নিয়ে আমার প্রত্যাশাগুলোর দিকে তাকিয়ে। কেন আমি চাইছি তাকে? যে আমাকে চায় না কিংবা হয়তো যে আমাকে সে চোখে দেখে না, আমি তাকেই আমার চিন্তার আলোকে বাঁচতে বাধ্য করছি! আবার বহুবার এই মনে হয়েছে যে, নাহয় আমি তাকে ভালোবেসেই ফেলেছি কিংবা নাহয় তার প্রতি আমার মনোযোগ একটু বেশিই, তাই বলে তাকে অতশত বলতে কেন গেলাম? এই ভালোবাসাটুকু ভেতরে রেখে দিয়েও তো দিব্যি পুরোটা জীবন একরকমের স্বস্তি নিয়ে ঠিক বেঁচে থাকা যেত! যেত না? অন্তত তার সামনে এতটা রুক্ষ, এতটা কপট আর বেপরোয়া তো হতে হতো না! তবুও তো আয়নায় নিজের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতাম! নিজেকে নিজের কাছেই এতটা নিচু আর রুচিহীন মনে হতো না! সে যেমন করেই আমাকে ভাবুক, সে যেমনই হোক, কিংবা যেমনটি না হোক, তবুও দূর থেকে এতটুকু বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত যে সে তো কিছু জানেই না আমার ভেতরের কথা!
কিন্তু এখন? এখন যতটা এলোমেলো হয়ে গেল সবই, হয়তো একজীবনেও তা ফুরোবার নয়। আবার এ-ও মনে হয়, একজন ভালোবাসার মানুষকে তো খুব সহজেই ক্ষমা করে, সব ভুলে গিয়ে আবার বুকে জড়ানো যায়! তাহলে আমি কি তেমন কিছুও ছিলাম না? আমি তার জীবনের কিছুই কি ছিলাম না? কিংবা সে আমাকে নিয়ে যেসব কথা বলত, সেগুলো কি শুধুই কথার কথা? আমি কি ভুলভাল বুঝে সত্যি বলে মেনে নিয়েছিলাম সবই? হয়তো তা-ই, হয়তো নয়। এখন আমি যা-কিছু বুঝতে পারি না, এই পৃথিবীর যা-কিছু অবোধ্য মনে হয়, সেগুলোর আর কোনও উত্তরের খোঁজ করতে যাই না। থাকুক না ওসব অজানাই, হয়তো আমি ওসবের কোনও উত্তর পাবো না। কত কিছুই তো পাওয়া হয় না আমাদের। তার চেয়ে বরং মন থেকে যাকে সারাজীবনের জন্য গ্রহণ করেছি, তাকে রাখার প্রতিজ্ঞায় আমাকে অটল থাকতে হবে। তাকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কেননা বেলাশেষে আমি হয়তো অন্য সবাইকে ধোঁকা দিতে পারি, কিন্তু নিজেকে? যাকে একবার মন গ্রহণ করে ফেলেছে, তার জায়গায় অন্য কাউকে চিন্তা করার রুচি যেমন আমার নেই, ঠিক তেমনি সে গ্রহণ না করলেও তাকে ছেড়ে যাবার কোনও পথ এখন আর আমার নেই।
মিথ্যে করে অনেকেই হয়তো অনেক কিছু করে, করতেও হয় হয়তোবা; অনেকেই সারাজীবন একটি মিথ্যেকে সত্যি হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে কোনও রকমে জোড়াতালি দিয়ে অভিনয় করে, মেনে কিংবা মানিয়ে, নিজের মনের বিরূদ্ধে গিয়ে জীবন পার করতে পারলেও আমি পারি তা কী করে? কিংবা এসব করে নিজের চোখে চোখ রেখে কী করে তাকাই? নিজেকে কী জবাব দেবো আমি? নিজের কাছে নিজেকে কী করে লুকাব আমি? আমি তো সহজ একটা জীবন চেয়েছি সবসময়, এ-ই কি তাহলে সেই সহজ জীবন, নিজেরই কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচা? নিজের সাথে জীবনের সবচাইতে বড়ো লুকোচুরি খেলা? সহজ জীবন কি তবে এমন একটা জীবন, যেখানে নিজেকেই নিজের সব থেকে বড়ো শত্রু ভেবে বাঁচতে হবে? আমার কাছে তো জীবন কখনও এমন হয়ে ধরা দেয়নি, তাহলে এখন কেন দিচ্ছে? আমার কাছে আমি যা, আমি সেটাই; যা নই, তবে সেটি হবার চেষ্টা কেন করছি আমি? কেন নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি? আমি যেমন নিজেকে ঠকাতে পারি না, তেমনি অন্য কাউকেও ঠকাতে পারি না। যা-কিছু সঠিক, তা সবসময় সুখকর হবে, এমন ধারণা কোথা থেকে এল আমার ভেতরে? সত্য কষ্টদায়ক হলেও তো সত্য। আগে হোক, আর পরেই হোক, সত্যকেই মানতে হয় শেষমেশ!
নিজেকে কষ্টকর পথ থেকে মুক্ত করতে, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে অস্বীকার করতে আমি নিজেই কখন নিজের বিরূদ্ধে হাঁটতে শুরু করেছি, তা আমার নিজেরই জানা নেই। নয়তো ভালোবাসার মতো একটা পবিত্র সত্তাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদায় মূল্যায়ন করবার মতো শক্তি আমার ভেতরে নেই। হয়তো এই লড়াইটা আমি লড়তেই চাইছি না। সবচেয়ে বড়ো কথা, নিজের ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করাকেই আমি লড়াই ভাবছি! একজন মানুষ যত চেষ্টাই করুক না কেন, সে নিজের কাছে থেকে নিজের ভেতরের রূপ কখনও লুকাতে পারে না, সত্যিটাকে কখনও নিজের কাছে আড়াল করতে পারে না। বেশিরভাগ মানুষই হয়তো এজন্য প্রতি মুহূর্তে নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়, ছুটে পালায় নিজের প্রকৃত সত্তার ঘর থেকে। এটা কখনও সহজ জীবন হতে পারে না। সহজ যা-কিছু, তা-কিছু নিজের মাঝে ধারণ করেই আমাকে চলতে হবে। হোক সেটি কষ্টকর, হোক সেটি অগ্নিপথ, তবুও বেলাশেষে নিজেকে দেবার মতো নিজের হাজারো প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে থাকবে। আমাকে মিথ্যে করে, লোক দেখিয়ে বলতে হবে না যে আমি খুব সুখী একজন মানুষ। কখনও কাউকে মিথ্যে করে যত্ন নিয়ে বলতে হবে না যে বেশ ভালো আছি, বরং আমাকে দেখেই যেন সকলের মনে এই কথাটি আসতে বাধ্য হয় যে, আমি বেশ ভালো আছি। আমি তো আমার জীবনটাকে একটা খেলা হিসেবেই মেনেছি, তাহলে হঠাৎ একে লড়াই ভাবতে শুরু করলাম কবে!
তোমার জন্মদিনটা খুব মনে ছিল, কিন্তু ইচ্ছে করেই কোনও টেক্সট করিনি। করেই-বা কী হবে? জানি, তুমিও অপেক্ষা করোনি আমার কোনও টেক্সটের। কেনই-বা করবে? যাকে সহ্যই করতে পারো না, তার কাছে তোমার কোনও বিশেষ দিনে আনন্দময় মুহূর্তগুলো নষ্ট করতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছিল না তোমার, এজন্যই করিনি। এছাড়া কখনও তোমার জন্যে করার মতো কিছুই করতে পারিনি, তাই সামান্য একটা টেক্সট করে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো আমাকে ঠিক মানায় না। এখন তোমাকে টেক্সট করা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছি। কষ্ট পেলেও তোমাকে টেক্সট আর করি না। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে তোমাকে বিরক্ত না করার। আমি তোমাকে যতটা অশান্তি দিয়েছি, আশা করি, সেগুলো ভুলে যেতে পেরেছ। আমি জানি, তুমি কখনও মনে রাখবেও না। আমিও হয়তো ভুলে যাবার চেষ্টা রোজই নতুন করে, করে যাব, কিন্তু ভুলে যাওয়া আর হবে না। আমার এই অতিরিক্ত চেষ্টাই আমাকে ভুলতে দেবে না।
আচ্ছা, ভুলে যাবার চেষ্টা করছি বলেই যে ভুলে যেতে চাইছিই, এটা কে বলল? আমি তো চাইছি এই চেষ্টার মাঝেই তোমাকে আমার মাঝে রোজ রোজ নতুন করে গেঁথে দিতে। তোমাকে নিজের থেকে আলাদা করার চাইতে বরং নিজের সাথে বাঁচিয়ে রাখা সহজ। কী করছ এখন? লিখছ রোজ? অনেক কাজের চাপ? নিশ্চয়ই খুব ভালো আছ? ভালো-থাকার জন্যেই যার এত আয়োজন, সে আর যা-ই হোক, ভালো অবশ্যই আছে। আমিও আর মিথ্যে ভালোবাসার দায়ে আটকে নেই। সত্যিটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও, অবিশ্বাস হলেও, মেনেছি যে তুমি ভালোবাসার মানে যা বোঝো, আমি সেরকম করে বুঝি না বা ভাবি না। ফলে আমরা হয়তো কোনও এক জায়গায় দুজনই দুজনকে ভালোবাসি, কিন্তু আমাদের ধারণার কোনও মিল হয় না। ভালোবাসতে গেলে শুধু ভালোবাসলেই চলে না, কিছুটা ভালোবাসা নিজের জন্যেও রেখে দিতে হয়, আর তুমি সেটি জানতে বলেই নিজেরটা গুছিয়ে রেখে যতটা আমার জন্যে বরাদ্দ করেছিলে, সেটুকু দিয়ে হয়তো আমাদের দুজনের একসাথে থাকা চলে না, এমনকি আমার সবটুকু দিয়েও নয়।
যা-ই হোক, তোমাকে রোজ টেক্সট পাঠাই না বলে ভেবে বোসো না যে তোমার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি। তোমার সাথে রোজ কাজের ফাঁকে কিংবা অবসরে আগের চাইতেও আরও অনেক বেশিই কথা হয়। তোমার হৃদয় অবধি সেগুলো হয়তো পৌঁছোয় না, কিন্তু আমি বলি ঠিকই। রোজই বলব কথা! চুপ থাকার অর্থ আসলে কেবলই শব্দকে থামিয়ে রাখা, মন কিংবা মস্তিষ্ককে নয়। তোমাকে আমার মস্তিষ্ক থেকে থামাতে হলে নিজেকে থামাতে হবে আর নিজেকে থামাতে হলে এই বেঁচে থাকাকেই থামিয়ে দিতে হবে, যা আমার সাহসেরও ঊর্ধ্বে। এজন্যই একটা মাধ্যম বেছে নিয়েছি তোমার সাথে কথা বলবার। এই বেশ ভালো, তোমাকে জ্বালানোও হলো না, তুমি জানলেও না, আবার আমিও তোমাকে সব কিছু বলতে পারলাম। সব কিছু আসলে কাউকেই হয়তো বলা যায় না। বলতে চাইলেও শোনার মতো কেউ থাকে না, আর জানোই তো, যাদের কথা শোনার মতো কেউই থাকে না, তাদের কথা বলার সবচেয়ে বড়ো সঙ্গী সে নিজেই। নিজের মনের সাথে অনেক অনেক কথা শেয়ার করে হালকা হওয়া যায়, আর লিখে ফেললে তো আরও ভালো, কী মনে এসেছিল, কী ভেবেছিলাম, সেগুলো আর এই মস্তিষ্কে ভনভন করে ঘুরতে থাকে না।
আচ্ছা, তুমি কী করে সময় পার করছ? অবশ্য তোমার হাতে তো অবসর বলে কিছুই নেই, কিন্তু আমার আছে, আমার কাছে তোমার সাথে কথা বলার অনেক অবসর মুহূর্ত রয়েছে। অবসর পেলেই আমি তোমার সাথে কথা বলি, তোমাকে চিঠি লিখি, তোমার কাছেই তোমাকে নিয়ে অভিযোগ করি। এই সব কিছুই আমার ভালো লাগে, মনে হয়, তুমি আমারই আছ। মাঝে মঝে তোমার পুরনো রেকর্ডিংগুলোও সময় পেলে শুনি, শোনার সময় কোনও কোনওটা শুনতে ভীষণ কষ্ট হয়, মনে মনে ভাবি, কেউ তার ভালোবাসার মানুষের প্রতি এতটা রুক্ষ কী করে হয়? আবার ভাবি, হয়তো তুমি অমনই, কিংবা হয়তো আমার অনেক ভুল ছিল, আমার অনেক কিছুই হয়তো তোমার অপছন্দ ছিল, কিন্তু তুমি কখনও বলোনি।
জানো, আজকাল আমি আবার একা হয়ে গেছি। আমি একা হতে কিংবা একা থাকতে চাই না, কিন্তু হয়তো স্রষ্টা আমাকে এভাবে দেখতে ভালোবাসেন, এজন্য আশেপাশে অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও আমার কারও সাথে কথা বলতে, সময় কাটাতে ভালো লাগে না। আমি একটা করার মতো কাজ খুঁজছি। এখন করার মতো কাজ একটাই: পড়াশোনা, পড়াশোনা আর পড়াশোনা। আর এর বাইরে মাঝে মাঝে সময় পেলে তোমাকে চিঠি লেখা, তোমার সাথে কথা বলা, কিংবা ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখা। এখন খুব ক্লান্ত লাগছে আবার পড়ে কথা বলব, এখন রেস্ট করব, তারপর উঠে পড়তে বসব। ভালো থেকো।
মানুষ যে সত্যি করেই মিথ্যে বলতে পারে, সেটা তোমার কথাগুলো শুনলে বোঝা যায়। গতকাল তোমাকে খুব মনে হচ্ছিল, ইচ্ছে হচ্ছিল, তোমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি, কিছুক্ষণ তোমার কথা শুনি। কিন্তু চাইলেও তো আর সেসব হবে না, তাই আমাদের পুরনো কথাগুলোর রেকর্ডিং শুনছিলাম, আর অবাক হচ্ছিলাম বারে বারে। বারে বারেই মনে হচ্ছিল, একটা মানুষ এতটা সত্যি করে কী করে মিথ্যাগুলো বলতে পারে? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তুমি তা-ই করে গেছ আমার সাথে। বানিয়ে বানিয়ে একটা মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করতে চেয়েছ! তুমি আজও সত্যিটা মুখের উপর বলে ফেলতে শিখলে না, এটাই কষ্ট। সত্যি কথা বলতে যে শক্তির প্রয়োজন, সেই শক্তি তোমার ছিল না, নয়তো সেই সত্যের মুখোমুখি তুমি কখনও হতে চাওনি, আর এ কারণেই দিনের পর দিন আমাকে মিথ্যে করে “ভালোবাসি” বলে গেছ! আমিও ধরেই নিয়েছি, তুমি সত্যি বলছ। কখনও মনে কোনও প্রশ্নও আসেনি তোমার ভালোবাসা নিয়ে, কোনও সন্দেহও নয়। যখন দুজন মানুষ একে অন্যের সাথে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন সব কথা ভাষায় প্রকাশ না করলেও চলে। তখন ওই দুজন মানুষের ভেতরে একটি অভ্যন্তরীণ পথ সৃষ্টি হয়, যে পথ দিয়ে ওই দুজন ব্যক্তির মধ্যে একে অপরের হৃদয়ে অবাধে যাতায়াত চলে, এর ফলে তাদের দুজনের কারও মনের খবরই কারও কাছে অজানা থাকে না।
আমাদের ভেতরে কখনও সেই পথ সৃষ্টিই হয়নি, যার ফলে তুমি কখনও আমার ভেতরটা বোঝোনি, কেবলই আমার মুখের কথার উপর নির্ভর করে থেকেছ, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কেন কখনও জানতে চেষ্টা করোনি তুমি আমার ভেতরে কী আছে? আমি কী চাইছি? কারণ তুমি আমার প্রতি, আমার প্রতিটি বিষয়ে উদাসীন ছিলে। তুমি যা-কিছু বলতে, সবই উপরে উপরে, তোমার গভীরে আমার কোনও অস্তিত্বই ছিল না, আমাদের মধ্যে ভালোবাসা বলে কিছুই ছিল না। একজন ভালোবাসার মানুষ এভাবে এত জলদি সব কিছু মুছে ফেলতে পারে না, কখনওই পারে না। মনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা আমিও কখনও কম করিনি, কিন্তু আমি তো পারিনি এই কয়টা দিন একমুহূর্তও ভুলে থাকতে, তাহলে তুমি কী করে আছ? এক বারের জন্যেও তোমার কখনও মনে হয়নি ‘আমি ফিরে যাই ওর কাছে!’? তুমি ফিরে আসোনি, কারণ তুমি কখনও তোমার উঁচু মাথা নিচে নামাতে চাওনি। আমার কাছে স্বেচ্ছায় ফিরে এলে তোমাকে মাথা নত করতে হতো, তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে মেনে নিতে হতো। যেখানে তুমি আমাকে চাওইনি, সেখানে মাথা নত করার কী প্রশ্ন থাকে আর! মানুষ সেখানেই নত হয়, যেখানে সে থাকতে চায়, যাকে সে ধরে রাখতে চায়। আমি তো চাই তোমাকে ধরে রাখতে, আমি তো নত হয়েওছি কতবার, অথচ তুমি কখনও ফেরোনি, কারণ তুমি ফিরতে চাও না, কারণ তুমি ভালোবাসা চাও না। একটা পাগলের সাথে, একটা উদ্ধত, অগোছালো, এলোমেলো মেয়ের সাথে তুমি জড়িয়ে থাকতে চাও না, এজন্যই তুমি মুক্তি চেয়েছ, এজন্যই তোমার কাছে শান্তি সবার আগে, ভালোবাসা নয়। তোমার কাছে আমার কাজগুলো অশান্তির মনে হয়েছে, যেখানে ভালোবাসার মানুষের সব কিছুই গ্রহণযোগ্য, সব কিছুই ভালো লাগে, সব কিছুকেই মন থেকে মেনে নিতে ইচ্ছে হয়। হয় না, বলো?
আমাদের ভেতরে যা ছিল, সেগুলো কি ভালোবাসা ছিল? আমার কাছে তোমার কোনও দিকই কি অপছন্দের ছিল না? অবশ্যই ছিল। তোমাকে ভালোবাসি, তাই বলে তোমার সব কিছুই ভালো লাগবে, তা তো নয়। তা সত্ত্বেও তোমাকে গ্রহণ করতে, তোমার কাছে নত হতে, কিংবা তোমাকে সহ্য করতে…কই, আমার তো কখনও কষ্ট হয়নি! আমার অভিযোগ ছিল, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে তো যাইনি কখনও, কিছুই না বলে চুপ করে থেকে তোমাকে কষ্টেও রাখিনি কখনও, অথচ তুমি যেখানে সারাজীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, সেখানে তুমিই এত দ্রুতই প্রতিশ্রুতি রাখতে ভুলে গেলে! তোমার সাথে সেই সমস্ত মানুষের কী পার্থক্য, যারা খুব জলদি সব কিছু ভুলে গিয়ে ঠিকই নিজে ভালো থাকে? যাদের ভালোবাসার মানুষ মরে যায়, বরং তারাও ভালো থাকার কারণ খুঁজে পায়, কিন্তু যেসব মানুষের ভালোবাসার মানুষকে এই পৃথিবীতে একই সাথে দুটি ভিন্ন জায়গায় এটা মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় যে ‘আমার ভালোবাসার মানুষটি আর আমার নেই!’ তাদের দিনগুলো কী করে কাটাতে হয়, হয়তো তুমিও তা জানবে কোনও একদিন। অনেক বার ভেঙেচুরে কেবল একটা মানুষকেই ভালোবাসা সম্ভব, অনেক বার অনেকগুলো মানুষকে ভেঙেচুরে ভালোবাসা কখনও সম্ভব নয়, কেননা তোমাকে ভালোবাসা এখনও আমার শেষ হয়নি, আর হবেও না আশা করি।
যতদিন বেঁচে থাকতে হবে, ততদিন এই স্মৃতিগুলোকে তো আর মুছে ফেলতে পারব না, তাই আর কারও হতেও পারব না। অন্য কারও হতে হলে নিজেকে আগের জায়গা থেকে পুরোপুরি গুটিয়ে আনতে জানতে হয়, যে বিদ্যেটা আমার অন্তত জানা নেই। এতে করে হয়তো সবার চোখে আমি একটা আবেগি আর বোকা মেয়ে হিসেবে গণ্য হব, কিন্তু নিজেকে অস্বীকার করে চলতে পারব না কখনওই। এর চেয়ে বরং সবাই আমাকে লুজারই বলুক। আর যা-ই হোক, এমন লুজারেরা কখনও নিজের থেকে নিজেকে আলাদা করে না। কথাগুলো বললাম, কারণ একদিন তুমি বলেছিলে ‘তোমাদের মতো মেয়েদের ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন পড়ে না, তাদের কেবল ভালোবাসার মানুষটির কবর দরকার, যেখানে রোজ তারা তাদের শোক প্রকাশ করতে পারে।’ ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল কথাগুলো গিলতে! আমি তো কিছুই বোঝাতে পারিনি সেদিনও, যার মন তুমি কখনও পড়ে দেখোনি, তার মুখের কথার কোনও মূল্য তোমার কাছে নেই, সে আমিও জানি। কথার তীরে তুমিও আমাকে অজস্রবার বিদ্ধ করেই গেছ, অথচ তবুও আমি তোমারই কথা শোনার অধীর অপেক্ষায় থাকতাম, কিছু শব্দ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই থাকত না কোনওদিন তোমার কথাগুলোর মাঝে, তারপরও কেন যে দিনের পর দিন তোমার কথা শোনার অপেক্ষায় থাকতাম আমি জানি না।
কী শুনতে চাইতাম আমি তোমার কাছ থেকে? মন-ভোলানো কিংবা আবেগমাখা কোনও কথাই তো কখনও বলোনি আমার সাথে, বেশিরভাগ সময়ই তোমার কথায় তুমি আমাদের মাঝের দূরত্বটা বুঝিয়ে দিতে, নয়তো ওসব ভালোবাসাবাসির কথাই এড়িয়ে চলতে! তারপরও আমি সেসব যত্নহীন রুক্ষ কথার ভেতরেই তোমার ভালোবাসার খোঁজ করে গেছি, মিথ্যে মায়ায় নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছি, যেখানে আমার জন্যে কিছু ছিলই না। নিজের ভালোবাসার অপমান করেছি, এর চেয়ে বরং দূর থেকে একতরফা ভালোবেসে যাওয়াও ভালো, ওতে আর যা-ই হোক, সেই ভালোবাসায় কোনও চাহিদা থাকে না, অবহেলাগুলোও সহ্য করতে হয় না, সেই মানুষটার প্রতি কোনও অভিযোগ থাকে না, ভালোবাসার বিনিময়ে কোনও দাবি থাকে না, ভালোবাসা অবহেলিত হবার ভয় থাকে না, সেই মানুষটিকে দোষ দেবারও কোনও কারণ থাকে না। প্রতিদিন চোখ বন্ধ করতেই যে মানুষটা চোখের সামনে এসে আমার প্রতি হাজারো তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, সে মানুষটা আর যা-ই হোক, ভালোবাসা কী, তা জানে না।
চোখ বন্ধ করলেই তো আর যে কেউই চোখের সামনে আসে না। শরীরের টানেই যদি ভালোবাসার জন্ম হতো, তাহলে পৃথিবী থেকে ভালোবাসা শব্দটাই উঠে যেত, এই আত্না যে শরীরের অনেক ঊর্ধ্বে। যে মানুষ একবার তার নিজের আত্মার খোঁজ পায়, তাকে কখনও শরীরের দাসত্বে বন্দি করে রাখা সম্ভব নয়। ভালোবাসা সেটাই, যেটা শরীরের ঊর্ধ্বে গিয়ে আত্নার সম্পর্কে জড়ায়। এমনকি যে মানুষ আত্মা কী, তা জানে না, সে যদি কেবলই তার শরীরের দাস হয়ে থাকে, তা সত্ত্বেও তার পক্ষে শুধু তার ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া আর অন্য কাউকেই এই ক্ষুদ্র শরীরটাও দেওয়া আর কিছুতেই সম্ভব হয় না। কী খুঁজে গেছি এতগুলো বছর আর কী পেলাম কিংবা যা পেলাম, তাকে যখন পাওয়াই বলে না, তাহলে কেন এভাবে পেলাম, এসবের কিছুই জানি না আমি। এখন মনে হয়, যারা তাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে একটা জীবন ঝগড়া করেই কাটিয়ে দিলো, কখনও একটা মুহূর্তের জন্যেও দুজনে শান্তিতে থেকে দেখল না, কিংবা যাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে শান্তির মুহূর্তগুলো ভোরের শিশিরের মতো করে আসে, তারাও বরং অনেকই সুখী, তারাও বরং অনেকই পেয়ে গেছে জীবনের কাছে থেকে। পেলে পুরোটা পাওয়া ভালো, নয়তো পুরোটা হারানো ভালো, পাওয়া না-পাওয়ার মাঝামাঝি একটা প্রশ্নবিদ্ধ ভালোবাসা জীবনের সব অর্থকেই অনর্থক করে তোলে।
ভালোবাসার মানুষের মুখোমুখি বসে তাকে ‘ভালোবাসি।’ কিংবা ‘ঘৃণা করি।’ বলতে পারাটাও অনেক অনেক সুখের। সেখানে না-পাওয়ার মাঝেও এক ধরনের বোঝাপড়া থাকে, সেই বোঝা সঙ্গে নিয়েও সামনে এগোনো যায়, কিন্তু একটা অর্ধমৃত জীবনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার যন্ত্রণা কাউকে দেখানো যায় না। সে জীবনে সময়টা যেন প্রতিটি মুহূর্তেই কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে, এ কাঁটা এমনই যে যাকে চাইলেও গিলে ফেলা যায় না, আবার তুলে ফেলতে গেলে নিজেকে শেষ করে দিতে হয়।
আমাকে নেবে তুমি? একটুখানি জায়গা দেবে তোমার কাছে? আমার তো আর কোনও যাবার জায়গা নেই তুমি ছাড়া! আমি কোথায় যাব? এই পৃথিবীতে তোমার কাছে ছাড়া আমি আর কার কাছে যাব? তোমার কাছেও জায়গা হবে না আমার? তোমাকে তো এখন আমি আর জ্বালাই না, তোমাকে এসব কিছুই বলিও না। জানি, বললেও কোনও কাজ হবে না যদি না তুমি নিজে চাও। আমি এখনও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না, কিন্তু থাকি। থাকছি, কেননা এছাড়া কোনও উপায় নেই। তুমিও রাখবে না, অন্য কোথাও আমার যেতে ইচ্ছে হয় না। ভেতর থেকে বারে বারেই আটকে যাই, কে যেন বলে ওঠে, কার কাছে যাবি তুই? যার কাছে যাবি, সেখানে মন বসবে তো? এসব শোনার পর হঠাৎ আরেক মন বলে ওঠে, যাকে ভালোইবাসি না কিংবা যাকে ভালোবাসতে পারব না কোনওদিনই, তার কাছে থেকে পুরো জীবন মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করার চাইতে এ-ও ভালো…একা থাকা। যাকে মন থেকে গ্রহণ করা যায় না, তার সাথে অভিনয় করে থেকে যাওয়াও যে আমার জন্য ভয়ংকর। তার চেয়ে বরং একাই আছি, এই বেশ ভালো আছি। এখন আর অন্য কারও প্রতিই মন টানে না, চেষ্টাও করি না। মনের উপরে আসলেই কারও কোনও জোর থাকে না, তাই না?
তোমাকে কখন একটু একটু করে এতটা গ্রহণ করেছি, আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি, আমি আর কখনও নিজের সাথে প্রতারণা করতে পারব না, নিজেকে ভুল বোঝাব না। মিথ্যে করে নিজেকে সুখী হবার জন্য জোর করব না। আমার মন যেখানে যেতে চাইবে, আমি ঠিক সেখানেই যাব। সেটিই করব, যা আমার ভেতরটা চায়। নিজের সাথে প্রতারণা করে আসলে বাঁচা যায় না। তুমি আমার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছ, আমি সেটা মেনে নিতে বাধ্য, কেননা তোমার উপরে আমার কোনও জোর চলবে না। আমি নিজেও তো অন্য দিকে যেতে পারব না, আমিও তো বাধ্য নিজের মনের কাছে।
একটা প্রশ্ন অনেক বার আমার মনকে নাড়া দিয়েছে, কিন্তু কখনওই বাস্তবতার সাথে এর কোনও মিল খুঁজে পাইনি। আচ্ছা, তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে? যদি ভালোইবাসতে, তাহলে কখনও আমার জন্য তোমার সময় হতো না কেন? সবসময় কেন অমন ব্যস্ততা দেখাতে? আমার সঙ্গে কীসের ভয় পেতে কথা বলতে? যদি তুমি ভালোইবাসতে, তাহলে আমার প্রশ্নগুলোকে কখনও কি তোমার কাছে জেরা মন হতো? আমি তো তোমার কাছে কোনও কৈফিয়ত চাইনি। আমি জানি, তুমি কাউকে কোনও কিছুর জন্যেই কৈফিয়ত দাও না এবং আমাকেও দেবে না। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম যে তুমি অন্তত আমার মনে কোনও সংশয় আসতে দেবে না। জেরা মনে না করে যদি ভাবতে, আমি জানতে চাইছি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো, তাহলে হয়তো তুমি সহজ হয়ে তোমার মনের কথাটিই আমাকে বলতে পারতে! আমি কোনওদিন তোমাকে সন্দেহ করিনি, আমি শুধু চেয়েছিলাম, তুমি একটু আমার প্রতি যত্নশীল হও! আমার মনে হয়েছিল, আমার কোনও কিছুতেই তোমার কিছুই এসে যায় না। সব বিষয়ে তোমার কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব আমাকে বারে বারে কষ্ট দিচ্ছিল। আমি হয়তো মেনে নিচ্ছিলাম, কিন্তু আমার ভেতরে হাজারো প্রশ্ন জড়ো হয়ে আমাকে আক্রমণ করে যাচ্ছিল।
আমি তোমার কাছে নানান কথা জানতে না চেয়ে থাকতে পারতাম না। আমি জানি, তুমি কারও কথা মতোই চলবে না কোনওদিন। আমি সেটা আশাও করিনি। আমি শুধু আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার প্রকাশটা কীরকম দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি কখনওই বুঝতে পারিনি তোমার ভেতরে আমার প্রতি অনুভূতিগুলো কেমন। তুমি তো কখনও তোমার ব্যবহারে কিংবা কোনও কথায় কিছুই বুঝতে দিতে না। আমি তোমাকে প্রতিদিন হাজারো কথা বলে গেছি, কিন্তু আমাকে তুমি নিজ থেকে কখনও একটা কথাও বলোনি। আমি কোনও হিসেব মেলাত পারি না, জানো! তুমি ভালোওবাসো, আবার আমাকে দেবার মতো সময় তোমার হয়ে ওঠে না, আমাকে নিয়ে তোমার কোনও মনোযোগও নেই। তাহলে এই ভালোবাসাটা কীরকম? আমি তোমার কাছে থাকি না যে তোমার কাছে থেকে তোমাকে বুঝব, আবার তুমিও কিছুই বুঝতে দাও না। আমি তাহলে কী বুঝব? অথচ সব দোষ তুমি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দাও! আমি তা-ও তো মেনে নিই! তবুও তো তুমি থাকো না আমার কাছে! তুমি কী চাও, আমি তা জানিই না। আমি তোমাকে বুঝতে কেন পারি না? তাহলে কি আমিই তোমার হয়ে উঠতে পারিনি কখনও? তাহলে কি আমিই ভালোবাসার মতো করে ভালোবাসতে পারিনি আজও? আমিই কি তোমার মন বুঝতে চাইনি? আমি কীভাবে বুঝব তুমি কী চাও? আমি কি চেষ্টাও করিনি? আমি পারিনি? তবু আমি তো পারতে চেয়েছি!
আমি কথা বললে তুমি বলো আমি বেশি কথা বলি! অথচ এই আমি এই পৃথিবীতে একমাত্র তোমার সাথে ছাড়া আর কারও সাথে আজ পর্যন্ত এত কথা বলিনি। আমার কেউ নেই কথার বলার। ভেবেছিলাম, তুমি আমার, তাই তোমাকে সব কিছু বলা যায়। কিন্তু পরে দেখি, আমি বেশি কথা বললে তুমি আমাকে ভয় পাও, তুমি ভাবো, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে গেছি। কিন্তু তুমি কখনও ভেবেও দেখোনি, আমার মতো একটা মানুষের কথা বলার যোগ্য একটা মানুষও নেই! যে মানুষটা ভেতর থেকে এতটা একা, সে মানুষটা আর কোথায় যাবে একটু কথা বলার জন্য? এখন আমি তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি, তোমাকে অযথা বিরক্তি থেকে মুক্তি দিয়েছি। আমি কথা বললে তুমি সেগুলোর কড়া কড়া উত্তর দিয়ে দিতে, অথচ কখনও আমাকে একটুও বুঝতে চাইতে না। আমি এতশত প্রশ্ন, এতএত ধারণা তোমাকে বলা সত্ত্বেও তোমার কাছে কখনওই কিছুর উত্তর পাইনি। আমি চাইনি যে তুমি আমাকে ভুল বোঝো, আমি তোমার উত্তর আশা করতাম, কিন্তু হয়তো তোমার আমাকে বলার মতো কোনও কথা তখনও ছিল না, আর এখন তো নেই-ই।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যে একা, আমার যে কথা বলারও যোগ্য কেউ নেই, এটা হয়তো আমি মেনে নিতে পারছি না, এজন্যই সবার কাছে ভালোবাসার নামে সময় আশা করি। আসলে সবার কাছে বললে ভুল হবে, শুধু তোমার কাছেই। আমি সবার সাথে কথা বলার কোনও তাড়া অনুভব করি না, কখনও করিওনি। আমার মনে হয়েছে যে আমাকে বোঝে না, তার সাথে যে-কোনও বিষয়ে কথা বলা অর্থহীন। তেমন কোনও মানুষ, যাকে আমার কথা বলা যায়, কিংবা আদৌ কথা বলা যায়, এমন কাউকে পাইনি, তাই চুপ করেই থাকতাম সবসময়, এখন যেমন আছি। তুমি আসার পর, তোমাকে যতটা জেনেছি, ততটাই নিজের বলে গ্রহণ করেছি, এজন্য তোমাকে সারাক্ষণ বিরক্ত করতে কখনও কষ্ট হয়নি কিংবা বিরক্ত করা যায় না, এমন মনে হয়নি। কিন্তু আমার প্রত্যাশা ছিল তোমার কাছে, আমার প্রত্যাশা ছিল যে তুমিও আমার সাথে কথা বলো, তুমিও আমাকে তোমার কথাগুলো জানাও। কিন্তু হয়তো তোমার কোনও কথাই নেই আমার সাথে। আমি এখন সব প্রত্যাশাকে ঝেড়ে ফেলেছি, জেনে খুশিই হবে হয়তো। আমি কারও কাছেই আর কিছুই প্রত্যাশা করি না এক নিজের কাছে ছাড়া। পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে আমার আর কাউকে দরকার নেই, এতটা খুব জোর দিয়ে বলতে পারি। আমি কাউকে বুঝি না বুঝতে চেষ্টা করি যদিও, হয়তো পারি কিছুটা, হয়তো ভুল করি অনেকটাই।
এখন আমি নিজেকেই কথা বলার সঙ্গী করে নিয়েছি। এতে লাভ একটাই, কারও কাছে থেকে কোনও প্রত্যাশা আর থাকল না। কেউ ভালো বললেও কিছু এসে যায় না, খারাপ বললেও না। এখন আর কারও কোনও কথাই আমাকে প্রভাবিত করে না। সব কথাই আমাকে শান্ত করে রাখে। ভেতরটাও তোলপাড় করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমার যতটা মনে হয়, এভাবে বেঁচে থাকতে পারলে জীবনটা অত খারাপ না। কিন্তু আমি যেন আর আমাকেই চিনতে পারি না। আমি ছোটোবেলায় ভীষণ চঞ্চল ছিলাম, জানো? আমাকে কেউ ধরে বেঁধেও ঘরে রাখতে পারত না। সারাক্ষণ হাঁস-মুরগির মতো বাইরে বাইরে ঘুরতাম, এখন আমি তেমন নই। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, আমার গণ্ডি কেমন যেন ছোট্ট হয়ে আসছে, এখন আমার সাথে এক আমি বলতে শুধুই আমি। আমার নিজের বলতে শুধুই আমি। একটা ঘরমুখো, একলা আমি কখনও ছিলাম না, কিন্তু এখন আর কারও সাথেই ইচ্ছে হয় না থাকি। কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেছি, আমি চাইনি এমন হতে, কিন্তু হয়ে গেছি। নিজেকে অচেনা লাগে। চাইলেও কেন যেন কারও সামনেই আর নিজেকে মেলে ধরতে পারি না, এখন আর চাইও না। পরিস্থিতিগুলো কি তবে এভাবেই চুপ করে মানুষকে বদলে দিয়ে যায়?
আমি এতটা আবেগি কেন? নিজের আবেগগুলোকে আমি কেন বশে রাখতে পারি না? আমি এতটা আবেগ দিয়ে কেন ভাবি? আর পাঁচজন সাধারণ মানুষ যেমন করে সব কিছু সহজ, স্বাভাবিক চোখে দেখে, আমিও তো চাই সব কিছু সেভাবেই দেখতে, আমিও তো তেমন সহজ একটা সাধারণ জীবন চাই, তাহলে অমন হতে পারি না কেন? আমি যেমন, আমি তেমন কেন? আমার প্রকৃতি এতটা কঠিন কেন? মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমার মস্তিষ্কটাকে খুলে আলাদা করে রাখতে পারলে হয়তো আমি একটা সহজ জীবনে বাঁচতে পারতাম, কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। অথবা আমি কী করলে আমাকে আমার আশেপাশের মানুষগুলো একটু সহজভাবে নেবে? কিংবা আমাকে দেখলেই কেন তোমরা সকলে আমার কাছে প্রত্যাশা করো যে আমিই সবসময় সব কিছু বুঝে চলার জন্য জন্মেছি? কেন আমার ভুলগুলোকে ভুল বলে মেনে নিতে তোমাদের কষ্ট হয়? আমিও তো মানুষ! আমি কি কোনও ফেরেশতা নাকি? কেন তোমরা আশা করো যে আমি কোনও ভুল করতেই পারি না? কেন তোমরা আশা করো আমিই সব দিকে খেয়াল রাখব? কেন তোমরা চাও যে আমি তোমাদের মনের মতন হয়ে উঠি? আমি আমার মতো, এটাই আমার বড়ো দোষ।
যে ব্যক্তি সব কিছু বুঝে ফেলার দায় নিয়ে জন্মায়, তাকে বোঝে, এমন একটা মানুষও হয়তো এই পৃথিবীতে থাকে না, তাই না? আমার আমাকেও বুঝে চলতে হবে, আমার তোমাদেরকেও বুঝে চলতে হবে। মোটকথা, আমার কোনও ভুল হতে পারবে না, আমি হব নির্ভুল, নিখুঁত একটা মানুষ। একবার ভেবে দেখো তো এমন আমির মাঝে আমাকে তোমরা আদৌ কতটা পাও? আমি পারব না, তোমাদের কাউকে বুঝতে পারব না আমি। আমি আমার আগে, পরে তোমাদের। আমি আগে আমার মনের মতো চলব, সেখানে তোমাদের সাপোর্ট থাকুক আর না থাকুক, আমি সবসময় আমার পাশে থাকব। তুমি অথবা তোমরা কেউ না থাকো আমার সাথে, তবুও আমি এক আমিই হব।
আশা করি, অনেক ভালো আছ। ভালো যে আছ, বোঝাই যাচ্ছে। ভালো না থেকে তুমি পারোই না, আমাকে ছেড়ে আছ যেহেতু; ভালো আছ, তাই মনে পড়ে না, কিংবা আমাকে ছেড়েও দিব্যি সুখে আছ, থাকো ওরকমই। তুমি যা বলো, সেটাই আসলে সত্যি---কেউই কারও জন্য অপরিহার্য নয়। আমি গাধি সেই কথাটা কোনওদিন বুঝতে পারলে তো! আমি তোমাকে আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ধরে নিয়েছি, যার সাথে আমার কোনও সুতোর টানও নেই। যাকে অধিকার করা যায় না। যে শুধুই আছে, কিন্তু বহুদূরের কেউ হয়ে। সবচাইতে দূরের…আজকে অনেক দিন পর তোমার সাথে ঝগড়া করলাম। আজকে আমি ঘুমাব। অনেক অনেক ঘুম। অনেক রাত আমি ঘুমাইনি। হয়তো আজকে চোখ বন্ধ করলে তুমি চোখের সামনে আসবে না। এতক্ষণ আমার কথা শুনে তুমিও হয়তো ক্লান্ত।
তুমি আমার জীবনের সেই শূন্যতাটুকু পূর্ণ করেছ, যা প্রতিটি মানুষ জন্মের পর থেকে উপলব্ধি করে এবং কিছু মানুষ একে মৃত্যুর আগমুহূর্তেও বয়ে বেড়ায়। মানুষ তার জীবনে সত্যিই সেই মানুষটাকেই খোঁজে, যাকে পেয়ে মনে হতে পারে, একটা পুরো জীবনের জন্য এই একটা মানুষই যথেষ্ট। কিন্তু কজন পায়? এমন একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্যই-বা কজনের থাকে? যেদিন প্রথম তুমি আমার জীবনে এসেছিলে, সেই দিন থেকে আজ অবধি তোমার অস্তিত্ব আমাকে চারপাশ থেকে এমনভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে যেন একজীবন কেটে গেলেও এই ঘুম, এই নিদ্রা আমার কাটবার নয়। মুহূর্তে থেকে মুহূর্তে আমি তোমাকে আমার প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করি। এই অনুভূতিগুলো প্রথম থেকেই এমন ছিল কি না আমি বলতে পারি না। কিন্তু তুমি ছিলে। আমি বুঝিনি এটি কী, কেন আমি তোমার প্রতি এতটা মোহাচ্ছন্ন আমি জানতাম না, কিন্তু তুমি সবসময় আমাকে তোমার উপস্থিতি জানিয়েছ। আমি অন্যমনষ্ক ছিলাম, তাই সবসময় তোমার উপস্থিতি টের পাইনি, তুমি যে আমার মাঝে আছ কিংবা থাকো, সেটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগে গেছে, প্রতিদিন আমার সমস্ত মুহূর্তে তুমি আমার অনুভবে বারেবার এসেছ, কিন্তু আমি একে ভেবেছি মরীচিকা। নিজেকে তোমার কাছে নত করতে আজ আর বিন্দুমাত্রও দ্বিধা হয় না। কেন এমন হয় আমি জানি না।
যখন একলা ঘরে থাকি, তখন মনে হয় না যে এই পৃথিবীতে আমি ভীষণ একা, কেননা আমার চিন্তা-চেতনা, আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে তোমাকে আমি ঝেড়ে ফেলতে কিংবা অস্বীকার করতে পারি না। তুমি হয়তো সশরীরে আমার কাছে নেই, কিন্তু আমি তোমার চেতনাকে আমার অস্তিত্বে টের পাই, তোমার স্পর্শ আজও আমার শরীর এবং চেতনা জুড়ে বিশুদ্ধ এক সাদা শুভ্র ফুলের মতো, একজন মানুষের আত্মা আরেকজন মানুষকে এতটা ওলটপালট করে ফেলতে পারে, একজন মানুষের অস্তিত্বকে অন্য কেউ এতটা আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে, এসব মাথায় এলে আমি যতবার নিজের দিতে তাকাই ততই আমাকে অবাক হতে হয়। ভালোবাসা কী আমি জানতাম না কখনও, আমি তোমাকে ভালো যে বাসি, সে-ও অজানা, তোমাকে অনুভব করার পর প্রথম বুঝতে পারি ভালোবাসা কী। এতটা আবেগি আমি কোনওদিনই ছিলাম না, এখন যতই নিজেকে দেখি, নিজের কাছেই নিজেকে ততই ভীষণ অচেনা মনে হয়। আমি এমন কখন হয়েছি, আমার চিন্তাচেতনা এতটা করে বদলে গেল কবে, আমি তা নিজেও জানি না। আমি এমন হবার নই, আমি তো এমন মেয়ে নই, আমি নিজেকে যেমন ভাবতাম, সেই আমি কখনওই এই আমি নই।
আজ কতদিন তোমার সাথে কথা হয় না, তবুও আমার মাঝে তুমি প্রকট এক সত্য, যাকে আমি নিজের থেকে আলাদা করতে পারিনি, গত কয়েক বছর হলো পারিনি, কিন্তু আমি যে তোমার ভেতরে এতটা আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম, এ সবই আমার কাছে অচেনা। ঠিক যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ আমি। এই আমার মতো একটা মানুষ কখনও কারও কাছে ভালোবাসার জন্য হাত পাতবে, মাথা ঠুকবে কোনও একজন পুরুষের জন্য, এটা অবিশ্বাস্য। হয়তো আমি অসুন্দরী, তবু মেয়ে তো! মেয়েদের কখনও প্রেমের জন্য, ভালোবাসার জন্য ভিক্ষার হাত পাততে হয় না, একজন খুব অসুন্দরী মেয়েরও একশো প্রেমিক থাকে। ভালোবাসার বেলায় আমি ভীষণ কেয়ারলেস একটি মেয়ে। বলা বাহুল্য, আমার ভেতরে মেয়েসুলভ আচরণ ততটা চোখে পড়ার মতো ছিলই না কখনও। এই আমিকে আমি এখন আর চিনি না, আমার মাঝে যে আমি এখন রয়েছে, সেই আমিটা কিছুতেই সেই পুরনো আমি নই। এই আমিটার ভীষণ ইচ্ছে হয়, তোমার পায়ে পড়ে হাতজোড় করে বলি, ‘প্লিজ, আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না!’
কখনও গভীর রাতে তোমাকে অনলাইনে দেখলে বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মন বারে বারে অশনি সংকেত শোনাতে থাকে। মনে হয়, কার সাথে কথা বলছে ও, এত রাত অবধি? এরই মাঝে নুতন কেউ এসে গেছে তার জীবনে? সেই নতুন মানুষটার মাঝে কী এমন আছে যা আমার মাঝে নেই? সেই মানুষটা নিশ্চিতভাবেই তোমাকে শান্তিতে রাখতে পারার অসীম শক্তি আর যোগ্যতা নিয়ে এসেছে! সেই মানুষটা আসলেই খুব বিশেষ কোনও মানুষ,…অবশ্যই বিশেষ কেউ। আমি ভালোবাসা দিয়েও যা পারিনি, সে তাই-ই করে দেখাচ্ছে, এর চাইতে বড়ো এবং এর চাইতে বিশেষ কেউ আর কীভাবে হতে পারে?
আমি পারিনি, এতকিছুর পরও তোমাকে ছেড়ে তোমার কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে আমি পারিনি। তুমি আমাকে অবহেলা কর, অবজ্ঞা করো, লাত্থি মারো, ছুড়ে ফেলো, গলা চেপে মেরে ফেলো, তা-ও পারব না। যে জালে আমি আটকে গেছি, তা থেকে মৃত্যু ছাড়া আর কেউই আমাকে আলাদা করতে পারে না, পারবে না। বেঁচে থাকার এই দিনগুলোতে তোমার স্মৃতিগুলোকে নিয়ে, তোমার চিন্তাচেতনা, তোমার অনুভূতিগুলোকে নিজের মাঝে ধারণ করেই বেঁচে থাকতে চাই।