যা করলে টাকা আসে না, তা কোনও কাজই নয়। ঠিক এরকম করে ভাবে, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। ওদের ধারণা, যতক্ষণ আমরা কাজ করি, তার বাইরে যা-কিছুই করি না কেন, তা হচ্ছে খেলাধুলা। জীবনে এই খেলাধুলার কোনও দরকার নেই।...কী আশ্চর্য রকমের ভুল একটা ধারণা! আমাদের জীবনটা খুব ছোটো এবং দামি। কেবলই কাজ করে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কোনও মানেই হয় না। শুধুই কাজ করে যায় বলেই অনেকেই দিনের পর দিন মানসিকভাবে বেকার হয়ে বসে থাকে। আমাদের প্রধান সীমাবদ্ধতা, আমরা চাইলেই বর্তমান অবস্থা থেকে পালাতে পারি না। আমরা সেই ব্যাঙটার মতো, যে একটা জলভর্তি পাত্রে চুপচাপ বসে থাকে, জলের তাপমাত্রা বাড়ালেও সেখান থেকে পালায় না, তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে একসময় এমন একটা পর্যায়ে চলে যায়, যখন সে চাইলেও সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার শক্তিটুকুও আর পায় না। যখন পালাতে পারত সহজেই, তখন সে পালায় না। যখন পালাতে চায় জীবন বাঁচাতে, তখন পালাতে সে আর পারে না। আমরাও ওরকম। আমাদের শুধুই দেরি হয়ে যায়। আমরা বুঝি সবই, তবে দেরিতে, যখন আর কিছুই করার থাকে না। ধরুন, কেউ এমন একটা চাকরি পেল, যে কাজটা করতে সে পছন্দ করে না। অন্য চাকরি না পেয়ে বাধ্য হয়ে কাজটা সে করেই যায়। মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই একঘেয়ে কাজটা করতে করতে একসময় সে নিজের বোধবুদ্ধি ক্রমেই হারাতে থাকে। এরকম অবস্থাতেও চাকরি করে যেতে হয় যাদের, তাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, ওদের চোখে কোনও উচ্ছ্বাস নেই, মুখে কোনও হাসি নেই, ওদের চলাফেরা ও কথাবার্তাও অনেকটা রোবটের মতন। কাজটা করতে হয় বলেই করে, এর বাইরে আর কোনও মোটিভেশন ওদের নেই। ওদের মনের শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই, জীবনীশক্তিও ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। ওরা তবু চাকরি করে যাচ্ছে। ওদের বেঁচে থাকতে হয়, পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। চাকরি চলে গেলে ওরা না খেতে পেয়েই মরে যাবে। ওদের জীবন আছে, সুখ নেই। চাকরিতে কি তবে কেউ সুখী হয় না? হয়, যখন কেউ নিজের পছন্দের চাকরিটা পায় এবং সেখানে নিজের দক্ষতা ও উৎসাহকে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করার পর সেই কাজের সঠিক মূল্যায়ন পায়। তখন কাজের একটা লক্ষ্য সে খুঁজে পায়, বড়ো কিছু অর্জনের প্রতি তার একধরনের ইচ্ছে গড়ে ওঠে। তার মধ্যে তখন এই প্রত্যয় জন্মে যে, সে যা করছে, তা নিছকই বেতন পাওয়ার কাজ নয়, তার মনে আনন্দ আছে, অফিসে তার একটা অবস্থান আছে। এ পৃথিবীতে সবাই যদি তার পছন্দের কাজটা করার জন্য বেতন পেত, কিংবা তার কাজের সঠিক মূল্যায়ন পেত, তবে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতো, মানুষের কর্মদক্ষতাও অনেক বেড়ে যেত। আমরা কী করতে চাই, তার চাইতে অনেক বেশি জোর দিতে বাধ্য হই, আমাদের কী করা উচিত, তার উপর। সবচাইতে বেশি সন্তুষ্টি আসে তখনই, যখন কেউ তার নিজের মতো করে তার পছন্দের কাজটা করতে পারে, এবং তার আশেপাশের মানুষ সে কাজের প্রশংসা করে। সৃষ্টি করে করে বাঁচার আনন্দ অসীম। মানুষ কাজের স্বীকৃতি পেতে ভালোবাসে। বাঁচার জন্য জীবন মাত্র একটাই। যে মানুষ বিখ্যাত একজন সংগীতশিল্পী হতে পারত, সে কিনা ব্যাংকে চাকরি করে জীবন কাটায়! যে মানুষ ভালো একজন চিত্রকর হতে পারত, সে কিনা কেরানির চাকরি করে জীবন কাটায়! সে মানুষ খুব দক্ষ একজন ইংরেজির শিক্ষক হতে পারত, সে কিনা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে জীবন কাটায়! যে মানুষ ভালো একজন লেখক হতে পারত, সে কিনা ব্যবসায়ী হয়ে জীবন কাটায়! যে মানুষ কিংবদন্তীতুল্য ভাস্কর হতে পারত, সে কিনা রাজনীতিবিদ হয়ে জীবন কাটায়! নিজের প্রতিভার প্রতি চরম অবিচার করতে করতে মৃত্যুর দিকে চলে যায় এ পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। প্রত্যেক মানুষই কোনও-না-কোনও ক্ষেত্রে গ্রেট হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। পরিবার ও সমাজের মনের মতো করে বাঁচতে গিয়ে মধ্যমেধার মানুষ হিসেবে জীবন কাটাতে অনেকেই বাধ্য হয়। যারা সবার মতো করে ভাবে না, তাদের সবাই যে ভুল পথে ভাবছে তা কিন্তু নয়, হয়তো তারা এমন কিছু ভাবছে যা ভাবনায় আনার মতো শক্তিই অন্যদের নেই। ধরুন, আপনার টাকাপয়সার কোনও চিন্তা নেই। তখন যদি আপনাকে বলা হয়, আপনি কোন কাজটা করে আপনার জীবন কাটাতে চান? উত্তরে আপনি যা ভাববেন, তা-ই হচ্ছে আপনার পছন্দের জায়গা। যদি সে জায়গায় কাজ করে জীবিকানির্বাহ করতে পারেন, তবে আপনার কখনও কাজে ক্লান্তি আসবে না, অবসাদ ভর করবে না, কাজের মানও বাড়বে। কে কী পারে আর কী পারে না, তা নিয়ে তার নিজের মনের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায় অল্প বয়সেই। জীবনে তেমন কিছু করতে পারুক আর না-ই পারুক, মানুষ ঠিকই বুঝে ফেলে, সে কী করতে জন্মেছে! ধরুন, কারও মধ্যে সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার একটা ধাক্কা সে অনুভব করবেই ভেতর থেকে। সে তার নিজের ক্ষমতার ব্যাপারটা বুঝতে পারবে কিংবা একটা তাগিদ অনুভব করবে। সে দেখবে, সে যা অনায়াসেই করতে পারে কিংবা করতে পারার মতো একধরনের আত্মবিশ্বাস বা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে, অন্যরা তা হয়তো খুব চেষ্টা করেও করতে পারে না। হ্যাঁ, তার মধ্যে একজন আর্টিস্ট বাস করে। ধরা যাক, আপনি কোনও একটা বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করেন, অন্যদের কাজ নিয়ে ভাবতে ও তা ব্যাখ্যা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেন, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে নিজের মতো করে ভাবতে পারেন, বিভিন্ন অপারেশন ও কর্মীদের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, যৌক্তিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা উন্নয়নে কাজ করতে পারেন। এর অর্থ হচ্ছে, একটা প্রতিষ্ঠানের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হওয়ার সমস্ত গুণ আপনার মধ্যে আছে। আপনি যদি খুব ছোটাছুটি করতে পছন্দ করেন, অন্যদের সংগঠিত করে কোনও একটা কাজকে এগিয়ে নিতে পারেন, এবং একটা ব্যবসার নির্দিষ্ট একটা ক্ষেত্রের মোটামুটি পুরো দায়িত্বই নিজের কাঁধে নিয়ে নিতে পারেন, তাহলে সম্ভবত আপনি প্রথম সারির একজন তত্ত্বাবধায়ক হতে পারবেন। আপনি মানুষ নিয়ে কাজ করতে পারেন, মানুষকে অনুপ্রাণিত করে কাজ করিয়ে নিতে পারেন, কে কী করল বা কতটুকু করল বা ঠিকঠাক করল কি না, এসব নিয়ে যদি মন থেকেই আপনার মধ্যে উৎসাহ কাজ করে, তবে আপনি একজন ভালো ব্যবস্থাপক হতে পারবেন। কাজে আনন্দ পেলে কাজকে চাপ মনে না হয়ে দায়িত্ব মনে হয়। কেউ যখন কাজটাকে পছন্দ করে না, নেহায়েত বাধ্য হয়েই করে, তখন তাকে যদি কাজের মান কেন ভালো হচ্ছে না, এমন প্রশ্ন কেউ করে, তাহলে সে এ ধরনের কিছু গৎবাঁধা উত্তর দেয়: কাজটা গুছিয়ে করার সময় পাচ্ছি না। যে টাকা দেয়, তাতে আমার হয় না। কাজের পরিবেশটা আরও ভালো হলে কাজের মান বাড়ত। কলিগদের কেউই তেমন একটা ভালো নয় বলে কাজটা নিজের মতো করে করতে পারি না। আমার পক্ষে এর চাইতে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। আমি চাইলে এর চাইতে অনেক ভালো ভালো চাকরি করতে পারতাম।...এরকম নানান অজুহাত মনের মধ্যে চলে আসে। মানুষ যা করতে পছন্দ করে না, তার বিরুদ্ধে হাজারো অজুহাত দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারে। অপরদিকে, পছন্দের কাজটা মানুষ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অবিচলভাবে করে যেতে পারে। সবার দিনই চব্বিশ ঘণ্টায়। এই সময়টাকে কে কীভাবে ব্যবহার করছে এবং কতটা ব্যবহার করছে, এই দুইয়ের উপরেই নির্ভর করে কে কতদূর কাজ করতে পারবে। সময়ই হচ্ছে এই পৃথিবীর একমাত্র জিনিস যা কখনও কারও সাথে কোনও ব্যাপারেই পক্ষপাতিত্ব করে না। এই সময়টা থেকে যে যতটা বের করে নিতে পারে নিজের জন্য, সে ততটা বেশিদূর যেতে পারে। সবচাইতে ব্যস্ত মানুষটা যতটা সময় চেয়েও পায় না, ঠিক ততটাই সময় কীভাবে যে কাটাবে, তা-ই হয়তো অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না। অবসর ও ব্যস্ততা, দুই-ই হচ্ছে আমরা সময়কে কে কীভাবে ব্যবহার করতে পারছি, তার উপর নির্ভরশীল। একজনের কাছে যা অবসর, আরেকজনের কাছে তা-ই ব্যস্ততা। কারও মনে প্রশ্ন, তার এত ব্যস্ততা কীসের? কারওবা মনে প্রশ্ন, সে এত অবসর পায় কীভাবে? একটা ম্যাজিক শিখিয়ে দিই। যারা একদমই সময় পায় না, তাদের অনেকেই, দেখবেন, এমন অনেক কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখে, যে কাজগুলো তার জীবনে কোনও কাজেই লাগবে না। যদি আমরা জীবনের জন্য অপ্রয়োজনীয় কাজগুলোর পেছনে সময় খরচ করি, তবে দেখা যাবে, যে কাজগুলো প্রয়োজনীয়, সেগুলোর পেছনে খরচ করার সময় আমাদের অনেক কমে আসবে। যারা জীবনের জন্য ফালতু ও অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় খরচ না করে কিংবা কম খরচ করে যা-কিছু করা দরকার, তা-কিছু ঠিকভাবে করে, তারা নিঃসন্দেহে বাকিদের চাইতে অনেক বেশি এগিয়ে যাবে। সময় নষ্ট করার মধ্যে আনন্দ আছে। জীবনে বড়ো হতে হলে যা যা করতে হয়, তা তা না করার মধ্যে অনেক সুখ আছে। পাপ ও আলস্য, এই দুই সুখের সামনে পুরো পৃথিবীটাকেই ম্লান লাগে! ওই সমস্ত আনন্দ ও সুখ যারা পেয়ে গেছে, তারা অবশ্যই তাদের পেছনে থাকবে, যারা সেগুলি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। জীবনের শেষ দুই-তৃতীয়াংশের মজা আগের এক-তৃতীয়াংশে ভোগ করে ফেললে, জীবনের আগের এক-তৃতীয়াংশের কষ্ট শেষ দুই-তৃতীয়াংশে ভোগ করতে হয়। হিসেবটা নিজেই একবার মাথায় আনুন, বাকিটা আপনাআপনিই বুঝে যাবেন। এর নামই সময়ের ন্যায়বিচার। সময়ের বিচারে ভুল হয় না। জীবনে কী কী ধরতে হবে, তা বুঝতে পারার চাইতে অনেক বেশি জরুরি কী কী ছেড়ে দিতে হবে, তা বুঝতে পারা। যে যত বেশি কাজ হাতে নেয়, তার কাজের মান তত বেশি খারাপ হয়। কেউ যে সময়টা পাঁচটা কাজের পেছনে দেয়, আরেকজন হয়তো একই পরিমাণ সময় একটা কাজের পেছনে দেয়। স্বাভাবিকভাবে দ্বিতীয় ব্যক্তির কাজের মান ও পরিমাণ দুই-ই বেশি হবে। সাফল্য ধরা দেয় তাদেরই কাছে, যারা কোনও একটা কাজে লেগে থাকতে পারে, অন্য সবকিছুকে ছেড়ে দিয়ে। কাজটা করতে কেমন লাগছে, তা মাথায় আনার চাইতে জরুরি হচ্ছে, কাজটা করা কতটা জরুরি, তা মাথায় আনতে পারা। যা করা দরকার, তা করতে ভালো না-ও লাগতে পারে; ঠিক একইভাবে, যা করতে ভালো লাগে, তা করার কোনও দরকার না-ও থাকতে পারে। এডিসন কীভাবে ওরকম অমানুষিক পরিশ্রম করতেন? তাঁর ক্লান্তি আসত না? আসতই তো বটেই! তবে তিনি সেই ক্লান্ত হওয়াটাকেও এনজয় করতেন। যা করে করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তা-ই ছিল তাঁর জীবনের সবচাইতে বেশি ভালোবাসার কাজ। নতুন নতুন আবিষ্কার করতে গিয়ে যে অসীম সুখটা তিনি পেতেন, নিজের আবিষ্কারের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনের মধ্যে যে ইউফোরিয়ার জন্ম দিত, তা ছিল জগতের বিশুদ্ধতম যে-কোনও আনন্দের সমতুল্য। যা করতে আমাদের ভালো লাগে, যা আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, তা থেকে যে ক্লান্তিটা আসে, সে-ও পরমসৌভাগ্যের। শারীরিক ক্লান্তি আমাদের যতটা ক্লান্ত করে, তার চাইতে অনেক বেশি ক্লান্ত করে দেয় মানসিক ক্লান্তি। ভালোবাসার কাজে মানসিক ক্লান্তি আসে কম। মানুষ মনের শক্তির জোরেই অন্যদের তুলনায় বেশিদূর হাঁটতে পারে। ভালোবাসার কাজটা দশ ঘণ্টা ধরে করলেও মনে হয়, সময়টা এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল! অথচ একটা দেয়াল ঘড়ি বা বালিঘড়ির দিকে কোনও কাজ না করে অলসভাবে এক ঘণ্টা তাকিয়ে থাকার সময় প্রতি মুহূর্তেই মনে হবে, সময় যেন ফুরোচ্ছেই না! সময়টা উপভোগ করছি কি করছি না, তার উপরেই অবসাদ ব্যাপারটা নির্ভর করে। টানা এক ঘণ্টা স্বর্গীয় রতিক্রিয়ার পরে যে অবসাদ ভর করে শরীরে ও মনে, তা শুধুই শান্তি দেয়, ক্লান্তি দেয় না। সেই অবসাদে চোখে তৃপ্তির হাসি ফোটে, বুকে শ্রান্তির অশ্রু ঝরে না। খুব পরিশ্রান্ত দেহেও মানুষ রতিক্রিয়ায় সাধারণত একটুও অনাগ্রহ দেখায় না। যে মুভি দেখতে ভালোবাসে, সে সারাদিন পরিশ্রম করার পর ঘরে ফিরে ঠিকই ফ্রেশ হয়ে মুভি দেখতে বসে পড়ে। যার বইয়ের নেশা, সে বই পড়তে পড়তেই ক্লান্তি দূর করে। মানুষ তার ভালোবাসার কাজে শরীরের ক্লান্তিকে পাত্তা দেয় কম। সে কাজে মন ক্লান্তি দেখায় না বলে ঠিকই কাজটা করে ফেলতে পারে। টাকার পেছনে ছুটলেই টাকা আসে না, বরং যদি কাজকে ভালোবেসে, সে কাজটা সবচাইতে ভালো যেভাবে করা যায়, সেভাবে করতে পারি, তবে টাকাই আমাদের পেছনে ছুটবে। এর জন্য দরকার কাজের প্রতি আন্তরিকতা, নির্দিষ্ট কৌশল-অবলম্বন, পরিশ্রম করার মানসিক প্রস্তুতি। আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে মানুষ আজ ধনী তো কাল গরিব! কেউ যদি তার কাজটাকে খুব ভালো করে রপ্ত করতে না পারে এবং তার দক্ষতাকে বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে না পারে, তবে তার জীবনটা সবসময়ই ঝুঁকির মুখে থেকে যায়। তাই আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, আমরা যা করতে ভালোবাসি, নিজেকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে সে কাজে আমাদের সমকক্ষ খুব কম মানুষই থাকে। এটা করতে পারলেই আমরা আমাদের দামটা ধরে রাখতে পারব। আমাদের সম্পর্কে অন্যরা যা বলে, তা আমাদের অনেকটাই প্রভাবিত করে। আমরা যতটা ভাবি, প্রভাবিত করার এই ব্যাপারটা তার চাইতে অনেক বেশি ঘটে। আমরা ক্রমেই আমাদের আশেপাশের লোকজনের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেদের তৈরি করতে থাকি নিজেদের অজান্তেই। তাই আমরা কাদের আমাদের আশেপাশে থাকতে দিচ্ছি কিংবা কাদের আশেপাশে নিজেদের রাখছি, সেটা নিয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। ফালতু লোকের সঙ্গে চলাফেরা করলে মানুষ ক্রমেই ফালতু হয়ে ওঠে। বৈদ্যুতিক বাল্বের উপর যে ধুলো-কালির আস্তরণ পড়ে, তা তার আলো ছড়ানোর ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। আমরাও ঠিক ওরকম। যদিও আমাদের মন ও বোধ থেকেই আমাদের মূল চালিকাশক্তি আসে, তবু চারপাশের কে কী বলছে এবং কে কী ভাবছে, তা আমাদের কাজের ধরনকে আমরা না চাইলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। বাকিদের চিন্তা, শক্তি ও লক্ষ্য আমাদের সাথে মিলবে না, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের বন্ধুরা ও পরিবারের সদস্যরা, ওরা যে পরিস্থিতিতে আছে, সেটাকে মাথায় রেখে ওদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও জ্ঞানের ভিত্তিতে পরামর্শ দেয়। যদি আমরা মনের ভুলেও ওদের দর্শনে নিজেদের পরিচালিত করি, তবে আমাদের সমস্ত স্বকীয়তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। ধার-করা ধারণা দিয়ে জীবন চলে না। তাই নিজের পথটা নিজেকেই ঠিক করে নিতে হয়। কে কী ভাববে, তা মাথায় রেখে যদি বাঁচি, তবে আমাদের পুরোটা জীবনই কেটে যাবে অন্যকে খুশি করতে করতেই। আমরা তাদেরই খুশি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, যাদের খুশি অখুশিতে আমাদের কিছুই এসে যায় না, এবং যারা আমাদের জীবনের অনেক ঝামেলা ও কষ্টের মূল কারণ। যার অহেতুক কাজ আপনার জরুরি কাজের জন্য বাধা, সুযোগ থাকলে তার কাছ থেকে দূরে সরে আসাই ভালো। এই পৃথিবীর সবচাইতে ফালতু ভাবনা হচ্ছে, ‘কে কী ভাববে!’ যে যা-ই ভাবুক না কেন, আমরা যদি কারও কোনও ক্ষতি না করে নিজের কাজটা ঠিকভাবে করি, তবে কারও ভাবনা দিয়েই আমাদের কিছুই এসে যায় না। আমাদের কেউ খারাপ ভাবলেও আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না, যদি না আমরা নিজেরা খারাপ হই। জীবন ক্রমেই ফুরোচ্ছে। পুরোপুরি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে জীবনের জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতেই হবে। আমাদের ভাবনাগুলি সবসময়ই অমূল্য! যার চিন্তাভাবনা সুন্দর নয়, সে কখনওই সুন্দর মানুষ হতে পারে না। অন্যদের চাইতে এগিয়ে যেতে চাইলে অন্যদের চাইতে উন্নত ভাবনা আপনার থাকতেই হবে। এগিয়ে যায় যারা, ওদের চিন্তাভাবনাগুলিও অনেক এগিয়ে। বড়ো মানুষ ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে কখনও ভাবে না। কোনও সমস্যা কিংবা সম্ভাবনা চোখের সামনে এলে তখন কে কীভাবে সেটার মুখোমুখি দাঁড়ায়, তা দিয়েই বোঝা যায়, কার দৌড় কতদূর। যে-কোনও প্রতিষ্ঠানেই দেখবেন, দুই ধরনের ব্যক্তি আছে। কেউ সমস্যায় পড়লে সমাধান খুঁজতে বসের কাছে দৌড়ে যায়। কেউবা সমস্যায় পড়লে নিজেই সেটার সমাধান বের করে তারপর বসকে জানায়। স্বাভাবিকভাবেই, দ্বিতীয় ধরনের কর্মীরা প্রথম ধরনের কর্মীদের চেয়ে উঁচু অবস্থানে থাকবে। আপনি যা করছেন, যদি তার প্রতি আপনার ভালোবাসা ও দক্ষতা তৈরি হয়, তবে তা নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করার সময় আপনি আনন্দ পাবেন, ক্লান্ত কম হবেন। তাই জীবনের সাথে কিছু কমপ্রোমাইজ করে হলেও নিজের মন যা চায়, সেই সেক্টরেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা ভালো। এতে দিন দিন কাজের মানও উন্নত হয়, কাজের প্রতি বিরক্তি ও ক্লান্তিও আসে না। কিংবা এলেও সেটা পরবর্তী কাজের মান কমিয়ে দেয় না। যে কাজটা করার সময় বিশ্রাম নেওয়ার সুখ অনুভূত হয়, তা করে জীবিকার্জন করতে পারে যে ব্যক্তি, তার মতো সুখী মানুষ কমই আছে। জীবন থেকে অপ্রয়োজনীয় মানুষ কমিয়ে ফেলুন, তবেই বাড়তি ঝামেলাগুলি জীবন থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।