যেভাবে বই কিনি, বই পড়ি

২৬/০৯/২০১৫ তারিখ আমার আগের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটা অ্যালবাম আপলোড করেছিলাম; আমার সংগ্রহের বইগুলির ছবি দিয়ে। সেদিন নিচের পোস্টটা দিয়েছি:

অনুগ্রহ করিয়া বই চাহিয়া লজ্জা পাইবেন না।

হৃদয় চাইলেও দিয়ে দেবো! কিন্তু বই? নৈব নৈব চ!

বই ধার দিয়ে ফেরত চাইলে যে ব্যবহারটা পাওয়া যায়, এতে বরং নিজেকেই চোর-চোর লাগে। এর চাইতে এ-ই তো ভাল: ধার চাইবও না, দেবও না।

এত বইয়ের নাম মাথায় রাখাটা খুব একটা সহজ নয়। মাঝেমাঝেই দুএকটা বই একাধিক কিনে ফেলেছি। এরকম কোনও বইয়ের নাম বলতে পারলে সেটি দিতে পারি।

ভাল কথা, আমার সংগ্রহের প্রায় কিছুই পড়া হয়নি এখনও। বিভিন্ন স্মৃতিকথা পড়ে যত দূর জেনেছি, বাঙালি লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বই পড়েছেন নীরদ সি চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। নীরদ সি চৌধুরীর লেখায় দেখি, তিনি পড়েছিলেন ১০,০০০ বই। বিস্ময়ে ভাবি, কীভাবে সম্ভব!! অবশ্য বাকিদের হিসেবটা জানি না।

২৭/০৯/২০১৫ তারিখে নিচের পোস্টটা দিয়েছি :

গতকালকে আমার বইয়ের সংগ্রহের ছবি পোস্ট করার পর বেশ কিছু প্রশ্ন/ মতামত পেয়েছি। সেগুলির কয়েকটিকে জড়ো করে FAQ জাতীয় কিছু একটা তৈরি করলাম।

বইগুলি বিষয়ভিত্তিক/ লেখক অনুযায়ী সাজিয়ে রাখলে ভাল হত।

………… খুবই সত্যি কথা! কিন্তু অত সময় দিতে গেলে সেটা একদিনে সম্ভব নয়। আর বদলির চাকরি করি বলে বাসায়ও থাকতে পারি না। হবে হয়তো কখনও, কেউ করে দেবে। কে করে দেবে? বুঝে নিন!

বইগুলি কোথা থেকে কিনেছেন?

……………. বাংলাদেশ থেকেই। কিছু বই কলকাতা আর সিঙ্গাপুর থেকে কিনেছি।

কতদিন ধরে কিনেছেন? কীভাবে?

…………… অনেকদিন ধরেই! ঘুরে ঘুরে! অনেক অনেক অনেক বেশি কষ্ট করে! আমার সংগ্রহের কয়েকটি বই আছে, যেগুলি বাংলাদেশে বেশি লোকের কাছে আছে বলে আমার জানা নেই। ভাল বইয়ের বড় ব্যবসায়ী, কিন্তু আমার চেহারা দেখেননি, বাংলাদেশে এমন কেউ আছেন বলে আমি জানি না।

বই চুরি হয় না?

…………… চুরি অত হয় না, তবে অনেকেই বই ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। ভেবেছে, পরহস্তে ধনের কী-ই বা মহিমা! এর চাইতে বরং হস্তগত করি! এতেই সর্বসুখ নিহিত। বই ধার দিলে পুরোপুরি ভিখিরি সাজতে হয় সেটা ফেরত পেতে। অসহ্য!

রক্ষণাবেক্ষণ করেন কীভাবে?

……………. শেলফে সাজিয়ে রাখি, টেবিলে, এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি, এই তো! পরিবারের সদস্যরা ঝাড়মোছ করে, ন্যাপথেলিন দিয়ে দেয় মাঝেমাঝে।

সবগুলি পড়েছেন?

………….. নাহ্‌! পনেরো ভাগের এক ভাগও পড়িনি। প্রায়ই মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা করে পাঠকজীবন খুব খুব খুব প্রয়োজন।

বই কি পুরোটা পড়েন?

…………….. না, সেটাও পড়ি না। কিছু-কিছু বই উল্টেপাল্টে দেখি। কিছু-কিছু বই পড়তে-পড়তে মনে হয়, আর পড়তে হবে না, এরপর রেখে দিই। মাত্র কয়েকটা বই পুরোপুরি পড়ে শেষ করেছি। পড়া-বইয়ের চাইতে না-পড়া আর আধ-পড়া বইয়ের সংখ্যা অনেক বেশি।

বড় লেখকদের বই বেশি পড়েন?

…………….. ঠিক ওরকম নয়। রবীন্দ্রনাথ পড়তেই হবে, কারণ উনি রবীন্দ্রনাথ —– এরকম কোনও ব্যাপার আমার মধ্যে নেই। আমার সংগ্রহে বড়-বড় লেখকদের রচনাবলী আছে। এর মানে এ নয় যে, উনাদের সবকিছুই পড়ে ফেলতে হবে। যেমন ধরুন, আমি জেমস জয়েস পড়ে অত বুঝিনি। উনার লেখা কম পড়েছি। এর মানে তো এ নয় যে, উনার লেখা ভাল না। এর মানে, হয় উনার লেখা আমার জন্য না, কিংবা আমি উনার এমন একটা লেখা নিয়ে বসেছি, যেটা আমার পাঠকমনের উপযোগী নয়। আমার কাছে মানিকের উপন্যাস বঙ্কিমের উপন্যাসের চাইতে বহু গুণে ভাল, জীবনানন্দের কবিতা রবীন্দ্রনাথের কবিতার চাইতে ভাল, রবীন্দ্রনাথের গান অন্য যেকোনো গীতিকারের গানের চাইতে ভাল, গল্পগুচ্ছ অন্য যেকোনো গল্প সংগ্রহের চাইতে ভাল। এতে কেউ কিন্তু বড় কিংবা ছোট হয়ে যান না। আমার ব্যক্তিগত অভিরুচির উপর আমার পড়ার অভ্যাস নির্ভর করে। কিছু-কিছু বিদেশি ভাষার লেখক আছেন, যাঁদের কথা কেউ হয়তো অতটা জানে না, মানে উনারা লাইমলাইটে নেই, কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক। ওঁদের লেখাও সংগ্রহ করি; বাংলা কিংবা ইংরেজি অনুবাদে।

আপনি টোটাল কতটা বই পড়েছেন?

……………… কেউ এ ধরনের প্রশ্ন করতে পারে, এটা আগে জানলে তো গুনে-গুনে বই পড়তাম। সরি বস্‌, ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না। হাহাহা…….

বইয়ের কভার দেখে বই নির্বাচন করেন?

………………. হ্যাঁ, করি। বই কেনার আগে দেখে নিই, বইটি কেনা আদৌ দরকার কিনা। জীবন ছোট তো! অনেক ভাল বই আছে পড়ার জন্য, কেনার জন্য, সংগ্রহে রাখার জন্য। বাজে লেখকদের জাতে তুলে কী লাভ? যে কেউই লিখতে পারে, এর মানে এ নয় যে, সবারই লেখা উচিত। বাজে বই লিখে মানুষকে বিরক্ত করাটা এক ধরনের ক্রাইম। একটা বই পড়তে যে কী পরিমাণ কষ্ট হয়, সেটা যদি বাজে লেখকরা বুঝত! বুঝবে কী করে! ওরা তো পড়ে না, শুধু লেখে।

নোবেল প্রাইজ যারা পায়, ওঁদের বই বেশি কেনা হয়?

……………… তা নয়। ওগুলোও কিনি, এর বাইরেও বিভিন্ন পুরস্কার-জেতা বইও কিনি। এই যেমন, পুলিৎজার পুরস্কার, আকাদেমি পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, এরকম আরও অনেক! ইন্টারনেটে বিদেশি বইয়ের রিভিউ পাওয়া যায়। সেগুলি পড়ি, বই কিনি। প্যারিস রিভিউতে ঢুঁ মারি, রাইটারদের ভাল-ভাল পরামর্শ গ্রহণ করি। আচ্ছা, সব ভাল লেখকই কি নোবেল পেয়েছেন? টলস্টয় নোবেল পাননি। আমার তো মনে হয়, উনাকে ধারণ করার ক্ষমতাই নোবেল পুরস্কারের নেই। আমাদের ‘কবি’ কিংবা ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’কে অনুবাদ করে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করলে নোবেল কমিটি মেনে নিতেন, তারাশঙ্কর-মানিক কয়েকবার নোবেল পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

এই যে বই কেনেন এত-এত, অথচ পড়েন না, কষ্ট হয় না? কিনে কী লাভ?

………………… হ্যাঁ, তা তো হয়ই! ঈশ্বরকে বলতে ইচ্ছে করে, ছোট্ট করে আরেকটা জীবন দিলে কিছু ভাল বই পড়ে ফেলতে পারতাম! মাঝেমাঝে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ পড়ার জন্য হলেও চাকরিটাকে গুডবাই বলে দিই। আর কিনে কী লাভ? তার আগে বলুন, না কিনে কী লাভ? বই কিনলে সুখ বাড়ে। মানুষ একটু সুখের খোঁজে কতই না ছুটে মরে, তাই না? একটু সুখের আশায় জীবনটাও দিয়ে দেয় যেন! আমি নাহয় একটু পয়সা দিয়ে সুখের বিকিকিনি করি। আমার কাছে, Money is the cheapest bargain! একটা বই ভাল লাগল, আর না কিনেই বইয়ের দোকান থেকে বাসায় ফিরে এলাম। এটার কষ্ট অনেক! রাতে ঘুম হয় না, ছটফট লাগে। এর চাইতে তো এ-ই ভাল: বই কিনে আনলাম, পড়ি কিংবা না-ই পড়ি, মানসিকভাবে শান্তিতে থাকলাম। কাজকর্মও ভালভাবে হল। কাউকে বলে দেখুন, আপনি উনাকে শান্তি এনে দেবেন, এর জন্য অমুক পরিমাণ পয়সা খরচ করতে হবে। দেখবেন, সে কী অবলীলায় রাজি হয়ে যায়। বাজি ধরে বলতে পারি, কয়েকটা ভাল বইয়ের দাম এর দশভাগের একভাগের চাইতেও কম।

এমন কোনো বই কি আছে, যেটা হাতে পাওয়ার পর খুব খুশি হয়ে উঠেছিলেন?

……………… অনেক আছে! একটার নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে: ইতালো ক্যালভিনোর Invisible Cities. বইটি দোকানে দেখার পর মনে হয়েছিল, কাউন্টারে চুপি-চুপি গিয়ে বইয়ের দামটা দিয়ে বইটি খুব দ্রুত আমার করে ফেলি; এই ভয়ে যে, কেউ যদি আমার আগেই বইটি দেখে ফেলে আর কিনে নিয়ে চলে যায়! ও আচ্ছা, এরকম আরেকটা বই রোন্ডা বায়ার্নের The Secret. এই বইটা আমার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে!

বইয়ের দোকান দিতে ইচ্ছে করে?

…………… নাহ্‌! বইয়ের দোকান দিলে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা চলে যাবে।

বই লিখছেন না কেন?

……………. বই লিখতে হলে অনেক যোগ্যতা লাগে, অনেক পড়াশোনা আর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। আমি এখনও বই লেখার জন্য আত্মপ্রস্তুত নই। তাছাড়া লেখালেখিতে যে পরিমাণ সময় দিতে হয়, সেটাও পাই না। সবচাইতে বেশি যা লাগে, তা হল ধৈর্য। আমার এটাতে যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

একটা বই এক বসায় শেষ করে ফেলেন?

…………….. ডিপেন্ডস ……. যদি বই আমাকে আটকে রাখতে না পারে, তবে আমি বইকে আটকে রাখি না। আমি কয়েকটা বই একসাথে নিয়ে বসি। একটা বইয়ের কিছু দূর গিয়ে হয়তো আরেকটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আগেরটা ছেড়ে, এটা প্রায়ই হয়। সব বই তো আর পড়ার জন্য নয়। কিছু বই সাজিয়ে রাখার জন্য। ভাল বই; অতএব, ওটার এক কপি আমার কাছেও থাকা চাই। আমি এজন্যই বই কিনি।

বই কেনার সময় গ্রেটদের বই বেশি কিনেন?

…………… হ্যাঁ, তা তো কিনিই। যাকে ভাল লাগে, কিংবা যিনি বড়, তাঁকে নিয়ে যা-ই লেখা হোক না কেন, কিংবা তিনি যা-ই লিখুন না কেন, অবশ্যই কিনে ফেলি। গ্রেটদের প্রতি আমার সবসময়ই এক ধরনের অন্ধ শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। এই যেমন ধরুন, সুচিত্রা সেনকে নিয়ে এমন কোনও ভাল বই বাজারে নেই, যেটা আমার কাছে নেই। সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ দেখার পর মাধবী মুখোপাধ্যায়ের উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম। সেদিনের পরে উনার সব মুভি দেখে ফেলেছিলাম এবং উনাকে নিয়ে লেখা সব বই কিনে ফেলেছিলাম। এরকম আরও অনেকেই আছেন। এইতো সেদিন একটা বইয়ের পেছনের ফ্ল্যাপে দেখলাম, বইয়ের লেখক প্রথমে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস পরীক্ষা এবং পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস পরীক্ষা, দুটোতেই প্রথম হয়েছেন। কম কথা নয় কিন্তু! অনেক কঠিন পরীক্ষা তো! উনার নাম টি এন শেষন। এমন একজন মানুষের লেখা তো অবশ্যই পড়তে হবে। এটা আমার কাছে নিয়মের মতন। কেউ-কেউ বলতে পারেন, কী দরকার! আমি কেয়ার করি না। পড়াশোনার ব্যাপারে আমি আমার নিয়মেই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বইয়ের রিকমেন্ডেশন কোথা থেকে পান?

…………… বিভিন্ন বড় বড় লেখকদের রিডিং হ্যাবিট সম্পর্কে স্টাডি করে। উনাদের স্মৃতিকথামূলক লেখা পড়ি, সাক্ষাৎকার পড়ি, অনলাইনেও দেখি, এই যেমন, প্যারিস রিভিউ থেকে অনেক বইয়ের নাম সংগ্রহ করেছি। গুডরিডস, অ্যামাজন, টাইমস, গার্ডিয়ান, টেলিগ্রাফ সহ বিভিন্ন সোর্স থেকে বই সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। অনেকের কাছ থেকেও নিই। তবে অত পড়াশোনা করে না, এমন কারও কাছ থেকে বইয়ের রিকমেন্ডেশন নিই না। যে নিজে ভাল জানে না, সে অন্যকে ভাল জানাতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক।

আপনার কালেকশনে অ্যাকাডেমিক বই অত নেই কেন?

…………… আমার প্রশ্ন হল, অ্যাকাডেমিক বই কালেকশন করতে হবে কেন? ওটা তো পড়ারই কিছু নেই। পরীক্ষায় পাস করতে না হলে ওটা পড়ত কয় জন? যে বই স্রেফ অন্নসংস্থানের জন্য, সে বই কখনওই সংগ্রহে রাখার মতো বই হতে পারে না।

বই পড়তে না পারলে সাজিয়ে রেখে কী লাভ?

…………… এটা বুঝতে হলে আপনাকে প্রথমেই বইয়ের সংগ্রাহক হতে হবে। বইকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। বইয়ের ঘ্রাণ নেয়ার অপার্থিব সুখটুকু অনুভব করার মতো পরিপক্ব হতে হবে। স্রেফ বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে নিজের মনেই হেসে ওঠার ম্যাজিকটা রপ্ত করতে হবে। আমার কাছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও একটা বই না কেনার কষ্ট কয়েকটা মৃত্যুর সমান।

এতগুলি বইয়ের ছবি তুলেছেন কীভাবে?

……………… যেগুলি শেলফে ছিল, সেগুলির ছবি নিতে প্রত্যেকটা তাকের ছবি তুলেছি। যেগুলি শেলফে রাখার জায়গা হয়নি, সেগুলির কিছু-কিছু নিয়ে একসাথে জড়ো করে-করে বারবার ছবি তুলেছি। সবগুলি স্ন্যাপ নিতে ধৈর্য ধরে প্রায় ৩ ঘণ্টা ক্যামরা নিয়ে শরীর বাঁকিয়েটাকিয়ে ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ চালাতে হয়েছে। খুবই কষ্টের কাজ!

বই ধার দেন না কেন?

…………… দিতাম একটা সময়ে। এখন দেয়া ছেড়ে দিয়েছি। বই ধার দিলে লোকে ফেরত দিতে ইচ্ছে করে ভুলে যায়, ফেরত চাইলে মনখারাপ করে ফেলে, এমনভাবে পাওনাদারের মত ঘোরায় যে নিজেকেই চোর-চোর লাগে। এর চাইতে বরং আমি বই কিনে দিই, আমারও ওটার উপর দাবি থাকে না, উনাকেও বিব্রত হতে হয় না। কাউকে বই উপহার দিলে একটা অসম্ভব রকমের ভাললাগাও কাজ করে। এর দাম লক্ষ টাকা। আর ধার দিলে টেনশন কাজ করে। কী দরকার!

আপনি নিজে কখনওই বই চুরি করেননি?

……………… করেছি দুএকবার। করেছি বলেই তো জানি, কী করে সুদক্ষ বইচোরদের কাছ থেকে সাবধান থাকতে হয়।

আরে ভাই, টাকা থাকলে ওরকম বই দিয়ে বাসা সাজিয়ে ফেলা যায়।

…………… টাকা থাকলে বাসা কিন্তু দামি-দামি শোপিস দিয়েও সাজিয়ে ফেলা যায়। ওতে খরচও ঢের ঢের বেশি! ওটাও খারাপ না। রুচিবোধ আর মানসিকতার ব্যাপার। আমি চাই, আমার ড্রইংরুমে এক সেট রবীন্দ্রনাথ মনকে শান্ত করুক; কেউ হয়তো চান, উনার ড্রইংরুমে একটা হরিণের কাটামুণ্ডু শিং উঁচিয়ে ভয় দেখাক। যার যেটাতে চোখের স্বস্তি, মনের শান্তি। এই আরকি! ঘর সাজানোর ধরন দেখে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব বোঝা যায়।

আপনি ছবিগুলি পোস্ট করে জাস্ট শোঅফ করেছেন।

…………… ঠিকই ধরেছেন। আপনার শোঅফ করার জন্য যেমন বার্গারে কামড় বসানোর সেলফি ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই, তেমনি আমার শোঅফ করার জন্য ওটার সাথে বইগুলিও আছে। আমি নেক্সট শোঅফটা মুভি আর মিউজিক দিয়ে করব ভাবছি। ঈর্ষা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। পারলে নিজে করে দেখান, না পারলে ঈর্ষা করুন। দুটো পথই খোলা আপনার সামনে।

আপনার বই আছে, এটা দিয়ে আমার কী? এটা পোস্ট করে জানাতে হবে কেন?

……………… আপনার হয়তো কিছুই না। কিন্তু অনেকেরই যে অনেককিছু! আমিও খুশি হই এরকম কেউ বইয়ের ছবি পোস্ট করলে, কিছু বুক-রিকমেন্ডেশন পাওয়া যায়, কিনতে সুবিধে হয়। আপনার ভাল না লাগলে, জাস্ট এড়িয়ে যান। আমি তো আর আপনাকে ট্যাগ করে বিরক্ত করছি না।

বই কেনার সময় কী কী বিষয় মাথায় রাখা উচিত?

………….. ‘রাখা উচিত’ বলে কিছু নেই। বই কেনাটাও একটা আর্ট। এটা একদিনে রপ্ত হয় না। অনেক দিন ধরে সময় দিতে হয়। আমি আমার জীবনে ঘরের বাইরে যতটা সময় কাটিয়েছি, এর বেশিরভাগ সময় কেটেছে বইয়ের দোকানে-দোকানে। অনেকদিনই এমন গেছে, সকাল থেকে রাত, মানে সারাদিনই বইয়ের দোকানে-দোকানে কেটেছে। আমার বন্ধুটি যে সময়ে আড্ডা দিয়েছে, ডেটিংয়ে গেছে, আমি সে সময়টাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই নাড়াচাড়া করেছি, হাত-চোখ-মুখ ধুলোয় ভরে গেছে, কষ্ট করে-করে বইয়ের বোঝা বহন করে বাসায় নিয়ে এসেছি। ভাল বই কিনলে ভাল লেখকদেরকে উৎসাহিত করা হয়। কেনার সময় এটা মাথায় রাখি, প্রতি ৭টা বইয়ের মধ্যে হয়তো ১টা ভাল লেগে যাবে। কিন্তু কোনটা লাগবে, সেটা তো আর জানি না। তাই, ভাল লাগতে পারে, এরকম কয়েকটা বইই কিনে ফেলি। এমনকি কখনও-কখনও স্রেফ বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়েও বই কেনার পয়সা উশুল হয়ে যায়।

আপনি খুব সূক্ষ্ম একটা পাবলিসিটি করছেন, নিজের জন্য বউ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আপনাকে বিয়ে করলে আপনার বইগুলি পাওয়া যাবে, এটা বোঝাচ্ছেন।

………… স্বাভাবিক। আমার বই আমার বউ পাবে না তো কি আপনার বউ পাবে? নাকি, ওরকম পেলে আপনি খুশি হবেন? আর, আমাকে বিয়ে করলে এরকম কিছু বই-মুভি-মিউজিক-লেখালেখি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হবে। হ্যাঁ, অন্য সবকিছুও পাবে, কিন্তু ওসবের সাথে এটাও মেনে নিতে হবে। সবকিছু জেনেশুনেই আমার জীবনে এলে কি ভাল নয়? নাহলে তো পরে আমাকে ছেড়ে পালাবে। তখন আমি বউ পাব কোথায়? আর বারবার বিয়ে করাটাও তো একটা ঝামেলার ব্যাপার!

সব বইই কি অরিজিনাল কপি?

…………. হ্যাঁ। আমি বই সংগ্রহ করি, তাই অরিজিনালই কিনি। আমার সংগ্রহে হাতেগোনা ১০-১২টি ফটোকপি থাকতে পারে যেগুলির অরজিনাল কপি পাইনি।

আপনি তো চাকরিসূত্রে বাসার বাইরেই থাকেন। কীভাবে করে বই সাথে-সাথে রাখেন?

………… বই বহন করার কষ্টটা বহন করি। আর পরের বার বাসায় আসার আগ পর্যন্ত যে কয়টি বই পড়ে ফেলতে পারব বলে মনে হয়, সে কয়টিই সাথে রাখি। যখন যেখানেই থাকি না কেন, বই কেনা সবসময়ই চলতে থাকে। এভাবেই আরকি!

বই পড়তে পারেন না, কিন্তু কেনেন, এটা কি অর্থের অপচয় নয়?

…………. ভাই, একটা মাঝারি সাইজের ক্যাডবেরি কিনতে যে টাকা লাগে, সে টাকায় একটা ভাল বই কেনা যায়। অবশ্য বই খাওয়া যায় না, এটা ঠিক। প্রেমিকাকে মাঝেমধ্যে বইটই কিনে দিয়ে দেখুন না! ও ঠিকই খুশি হবে। ওর পড়ার অভ্যেস না থাকলে, অভ্যেসটা না হয় আপনিই তৈরি করে দিলেন! একেবারেই বই না-পড়া প্রেমিকারা প্রায়ই স্টুপিড হয়। একটা স্টুপিডের সাথে জীবন কাটাতে অস্বস্তি লাগবে না?

আজকাল তো ই-বুক পাওয়া যায়। তবে এই লাইব্রেরি কেন?

…………… সঙ্গম ছাড়াও তো সঙ্গমের ‘সফটকপি সুখ’ মানে, ই-রতিসুখ পাওয়া যায়। তবে সঙ্গম কেন? বই ছুঁয়ে দাগিয়ে-দাগিয়ে বই পড়ায় যে আনন্দ, সেটা ই-বুকে কীভাবে পাওয়া সম্ভব? একটা বই আমার চোখের সামনে আছে, ইচ্ছে হলেই আমি সেটা উল্টেপাল্টে দেখতে পারি, এই অনুভূতি তো স্বপ্নের মতন। তাছাড়া, মনিটর / মোবাইলস্ক্রিন কিংবা রিডারের ডিসপ্লেতে চোখ রেখে পড়তে কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। ফোনে চুমু খাওয়া আর সামনাসামনি চুমু খাওয়ার ফারাক যারা একবার বুঝতে পারে, তাদের পক্ষে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ফোনে চুমু খাওয়ার অসহায়ত্ব মেনে নেয়াটা কঠিন। তবে এটা ঠিক, অনেকগুলি বইয়ের সফটকপি সাথে থাকলে বিভিন্ন সময়ে মুড-সুইংয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্বাদের বই পড়ার সুযোগ থাকে। তাই কিছু ভাল বইয়ের সফটকপি হ্যান্ডসেটে রেখে দেয়া ভাল।

আপনার বইগুলি কোনো লাইব্রেরিতে দান করে দিতে পারেন। অনেক লোক পড়ার সুযোগ পাবে।

……………. আমি মৃত্যুর সময় আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে বইগুলিও দান করে যাব। বেঁচে থাকতে যেমনি আমি আমার চোখ, কিডনি এসব দান করতে পারি না, তেমনি বইও দান করতে পারি না। জীবিত অবস্থায় অন্তত এ ব্যাপারে স্বার্থপর থাকতে আপাতত ভাল লাগছে। আর আমার মতো স্বার্থপর কেউ-কেউ দান না করলেও অনেকেই কিন্তু করছেন। যাঁরা করছেন, তাঁদের বেশিরভাগ অবশ্য বইপড়ুয়া কিংবা লেখক নন; শিক্ষানুরাগী ধনাঢ্য ব্যাক্তি। সহৃদয় ধনাঢ্য ব্যক্তি হওয়া খুবই ভাল একটা ব্যাপার।

আপনি আপনার লাইব্রেরির জন্যই তো বিসিএস-এ ফার্স্ট, তাই না?

…………… কোন দিন না কোন দিন বলে বসবেন, “আপনি অমুক সময় ধরে বড় টয়লেট করেন বলেই তো বিসিএস-এ ফার্স্ট!” সবকিছুতেই বিসিএস’কে টেনে আনতে হবে? মাথায় বুদ্ধি এত কম কেন? যাক গে সে কথা। শুধু সমৃদ্ধ লাইব্রেরি দিয়েই যদি বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া যেত, তবে বাংলাদেশের কোটিপতির ছেলেমেয়েরা একবার-একবার করে বিসিএসয়ে ফার্স্ট হত।

একটা প্রশ্ন কয়েকবার পেয়েছি—আপনার সংগ্রহে মোট বই কত?

আরেকটা রিকোয়েস্ট এসেছে, আপনার বইগুলির তালিকা করা নেই? থাকলে যদি একটু দিতেন…………

প্রথমটার উত্তর: গুনিনি।

দ্বিতীয়টির প্রসঙ্গে বলছি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তালিকা করা আমার পক্ষে এখনও সম্ভব হয়নি। যদি আমার বইয়ের সংগ্রহের ছবিগুলি দেখে-দেখে কেউ তালিকা ইতোমধ্যেই করে থাকেন, তাহলে দয়া করে সেটি আমাকে দিন। কিংবা কেউ যদি তালিকা করার মহাপরিকল্পনা করে থাকেন, দয়া করে সেটি করুন। তালিকাটি আমার এবং অনেকেরই কাজে লাগবে। ওরকম একটা তালিকা পেলে সেটিকে একটু সাজিয়েটাজিয়ে নোট তৈরি করে ফেসবুকে রেখে দেবো। কেউ অনুগ্রহ করে এ কাজটি করে দিলে সত্যিই কৃতজ্ঞ থাকব। সাথে উপহার হিসেবে আপনার পছন্দমত আমার সংগ্রহের যেকোনো তিনটি বই (কিছু বই বাদে) আপনাকে কিনে দেবো। আপনার পছন্দের বই তিনটির কোনোটি যদি আমার পড়ার বাকি থাকে, তবে আমার সংগ্রহ থেকে সেটিই আপনাকে দিয়ে দেবো। পড়া-বই দেবো না, কারণ আমি দাগিয়ে-দাগিয়ে বই পড়ি; যে বইটি আমি দাগিয়ে পড়েছি, সেটি হাতছাড়া করতে চাই না।

হ্যাপি রিডিং!!

আমার বইয়ের সংগ্রহের অ্যালবামটির লিংক নিচে দিয়ে দিচ্ছি :

(আগের আইডি’টা এখন আর নেই, ওটার সাথে আমার অনেক সম্পদ হারিয়ে গেছে।)