যুদ্ধে জয়ী হবার পথে

গাছে ফল ধরে পেকে গেলে তা পাড়তে হয়। না পাড়লে তা আপনিই পড়ে যায় বা পাখিতে-পশুতে খেয়ে ফেলে। ঠিক তেমনি মনেও ফল ধরে। কথা হচ্ছে, আমাদের মনের ফল কী? মনের ফল হচ্ছে সৎকাজ করার ইচ্ছে। মনে সুমিষ্ট ফল আসামাত্রই মনের কাঁচিটাকে শক্ত করে ধরে যা-কিছু মরা আর বাড়তি, তার সবই আমাদের বিবেক থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। কোনো কোনো সম্প্রদায়ে বিয়ে করার আগে কেবল পোশাক পালটালেই চলে না, তার সঙ্গে নখ কাটতে আর মাথা কামাতে হয়। আত্মা চায় সুমিষ্ট ফলের সন্ধান পেতে; তাই ফলের ধারেকাছে যা-কিছু বাড়তি ও ফল আস্বাদনের জন্য অপ্রয়োজনীয়, তা বর্জন করে কেবল ফলরূপী নির্যাসটুকু রাখতে হবে আত্মার জন্য। কাজটা করার সময়ে, ভগবানের ভালোবাসা থেকে যা-কিছু আত্মাকে বঞ্চিত করতে চায়, সে-সব বাধাবিপত্তিকে কাটছাঁট করতে হবে। শরীরের মধ্য থেকে বাজে বৈশিষ্ট্য আর সমজাতীয় উপাদানগুলিকে বের করে দিতে পারলেই আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, ফলে আত্মিক স্বাস্থ্য গড়ে উঠতে শুরু করবে।




মানুষের পাপক্ষালন হয় ধীরে ধীরে, রাতারাতি নয় — তা দেহেরই হোক বা আত্মারই হোক; একটু একটু উন্নতির ভেতর দিয়ে, চেষ্টার মাধ্যমে — তা-ও খুব আস্তে আস্তে। বাইবেলে দেখি, যে-সব দেবদূত জ্যাকবের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করেন, তাঁদের সবারই ডানা আছে; তবু তাঁরা ওড়েন না, তাঁরা একটা-একটা ধাপ করে ওঠা-নামা করেন। এ থেকে শেখার আছে। উড়তে জানলেও অনেকসময় পথ চেনার প্রয়োজনে পথের নানান বাধা চিনে চিনে ধীরে চলা ভালো। এতে করে চলার ক্ষমতা বাড়ে। আত্মা যখন পাপ থেকে ভক্তির সিঁড়িতে ওঠে, তখন তাকে আলোর মতন দেখায়। এর আবির্ভাবে অন্ধকার একমুহূর্তেই মিলিয়ে যায় না, যায় ধীরে ধীরে। অভিজ্ঞতা বলে, যে-অসুখ ধীরে ধীরে সারে, তা বেশ ভালোভাবেই সারে; দেহ আর মনের রোগ ঘোড়ার বেগে আসে, একবারে হইহই করে; কিন্তু ফিরে যায় ওরা পায়ে হেঁটে, রীতিমতো গদাইলশকরি চালে।




তাই নিজের আত্মাকে জাগাতে চাই সাহস আর ধৈর্য। নিজেদের মধ্যে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি দেখে যারা কিছুদিন ভক্তিমার্গের পথ অনুসরণ করে এবং ভাবে, তাদের দিয়ে কিছুই হচ্ছে না, এক পা-ও এগোতে পারছে না, আর তা ভেবে ভেবে উদ্‌বিগ্ন আর হতাশ হয়ে সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে পিছু হটে আসার জন্য প্রলুব্ধ হয়, তাদের পক্ষে আত্মজ্ঞান বা ভগবৎজ্ঞান বা ব্রহ্মত্বের খোঁজ পাওয়া সম্ভব নয়। আবার অন্য দিকে, যারা পাপক্ষালন অনুশীলন শুরু করার প্রথম দিনেই মনে করে, তারা সমস্ত রকমের ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে মুক্ত হয়ে একেবারে খাঁটি সাধকে পরিণত হয়েছে — মানে, তাদের মন ভালোভাবে তৈরি হবার আগেই, আর তা-ই ভেবে ডানা গজাবার আগেই উড়তে চেষ্টা করে, তারাও চরম বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়ে না। অসুখে সারার আগেই ডাক্তারের তত্ত্বাবধান থেকে যাদের সরিয়ে আনা হয়, তাদের মূলত অনেক বড়ো বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। আলো আসার আগেই কখনও পথে নেমে ছুটতে নেই।




মনকে পরিষ্কার করার কাজে এই অনুশীলন আমাদের মৃত্যুর আগে শেষ হতে পারে না; আর তা হওয়াও উচিত নয়। তাই নিজেদের ছোটোখাটো ভুলত্রুটির জন্যে দুঃখ না করে সেগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্যেই আমাদের সম্পূর্ণতা; আর ওদের দেখতে না পেলে তো ওদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করতে পারব না; আর লড়াই করতে না পারলে ওদের আমরা জয় করতে পারব না। এদের উপস্থিতির অনুভূতি না থাকাটা আমাদের কৃতিত্বের পরিচয় দেয় না; আমাদের কৃতিত্ব বরং ওদের পোষণ না করা। আর এ কথাটাও মনে রাখতে হয় যে, ওরা আমাদের নাজেহাল করলেই যে ওদের সঙ্গে হাত মেলানো হলো, তা কিন্তু নয়। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা যাতে নম্র হতে পারি, নিজেদের অবস্থানটা টের পাই, সেজন্যে মাঝে মাঝে আমাদের এই আধ্যাত্মিক যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হবার প্রয়োজন রয়েছে, তবে জীবন অথবা সাহস হারানো ছাড়া আমরা আর কখনও প্রকৃতপক্ষে পরাজিত হই না।




এখন সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি আর লঘু পাপের ফলে অনুগ্রহের জীবন থেকে আমরা বঞ্চিত হতে পারি না; কারণ সে-জীবন মানুষ হারায় একমাত্র মারাত্মক পাপ করলে। শোধরানোর সুযোগ প্রায় সময় থাকেই, লোকে তা গ্রহণ করতে জানে না বলেই ঠকে। তাহলে শেষপর্যন্ত কথাটা এই দাঁড়াল যে, ত্রুটিবিচ্যুতির জন্যে আমরা যেন সাহস না হারাই। কাপুরুষতা আর নৈরাশ্য যাকে গ্রাস করতে পারে না, সে কখনও হারে না। জীবনের যুদ্ধে আমাদের পক্ষে সুখের কথা এ-ই যে, জয়ী আমরা হবই হব, অবশ্য যুদ্ধে মনোবল ধরে রাখার ইচ্ছে যদি আমাদের থাকে।