যখন হৃদয়ে জগন্নাথ

নুয়ে-পড়া দেহ টেনে টেনে নিয়ে বৃদ্ধ অশীতিপর
গেল বছরেও গিয়েছিল রথে লাঠিতে দিয়ে ভর।




বিগ্রহ যখন মন্দির হতে ওঠাল রথের 'পরে,
গেঁথে মালা নানা গন্ধ-কুসুমে পরম ভক্তিভরে,
সাজিয়ে অর্ঘ্য নানা উপচারে পূজে জগন্নাথে,
ভূমিতল হতে পদরজ নিয়ে মাখল আপন মাথে।
তারপর রথ হলে গতিমান রশিটি পরশ করে,
'জয় জগন্নাথ!' কাঁপল কণ্ঠে, প্রাণ উঠল ভরে।




বছর ঘুরে আবার এল রথযাত্রার দিন,
আজ সে বৃদ্ধ লাঠির ভরেও চলৎশক্তিহীন।
চুকে গেছে দূরে মন্দিরে গিয়ে মাল্য-অর্ঘ্যদান,
আর আশা নেই রশি-পরশের রথে যদি পড়ে টান।




বসতি বৃদ্ধের পর্ণকুটিরে, যাতায়াত পথ-পাশে,
সকাল হতেই রথযাত্রীদের কোলাহল কানে ভাসে।
ছেলেকে ডেকে বৃদ্ধ তখন বলল আবেগভরে,
উঠোনটা বাবা পূত করে রাখ গোবর লেপন করে।
আসবেন আমার উঠোনে আজ দয়াল জগন্নাথ,
ফুলে-নৈবেদ্যে করব বরণ বাপ-ব্যাটা একসাথ।




ভাবল ছেলে, এ ইচ্ছে বাবার কেবলই নিরাশাময়;
ব্যথা পেয়ে তাই শান্তস্বরে বাবাকে সে শুধোয়,
বহুদূরে দেখি ঠাকুরের রথ, আসবে কেমনে এখানে?
ভেবো না বাবা, চড়ে এ কাঁধে তুমি যাবেই যাবে সেখানে!




শুনে বলে বাবা, ভুল বুঝিস না রে, কোনো খেদ নেই মনে;
যা বলেছি... ঠিক; রথে চড়ে তিনি, আসবেন এই উঠোনে।
ঘর আমার হবে জলসত্র, ঘড়া ভরে রাখ জল,
ফিরবে যখন নিদাঘ-শ্রান্ত ভক্ত যাত্রীদল,
খুব খুশি হবে জল পেয়ে ওরা, ক্লান্তি হবে দূর,
ঠাকুরের প্রেমে আজ যে ওদের প্রাণ-মন ভরপুর!




পোরাতে বাসনা, সেবা নিতে তিনি ভক্তের হৃদয়রথে,
দয়াল প্রভু আসবেন আজ‌‌ই পেরিয়ে ও-দূর পথে।
যত গোপী তত কৃষ্ণ হলেন দ্বাপরে বৃন্দাবনে,
আজ‌ই হবে আবার সেই অভিনয় এখানে এই উঠোনে।




যত ভক্ত তত হৃদয়মাঝে আছেন জগন্নাথ,
পদধূলি নেব ভক্তিভরে বাড়িয়ে দিয়ে হাত।
ও-বাড়ির নরেশ ফিরলে তাকে ডাকিস একটুখানি,
রথযাত্রার পুণ্য কুড়োব, পাথেয় যে ওটুক‌ই... জানি!




প্রতিটি মানুষের হৃদয়মাঝে যদি তাঁর দেখা পাই, তবে
চলতে পারি না, এ নিয়ে আমার এত দুঃখ কেন হবে?
মানুষের গড়া মন্দিরে আমার প্রয়োজন কীসে আর?
তাঁরই সৃজিত বিশ্ব-দেউলে পেয়েছি যে দেখা তাঁর!
Content Protection by DMCA.com