যখন ছোটো ছিলাম

ছোটোবেলায়, আমি যখন খুব ছোটো, অতোটাই ছোটো, যখন ছোটো-ছোটো সবকিছুকেই বড়ো বেশি আমার-আমার মনে হয়, মনে পড়ে, তখন আমার ছোট্টো-ছোট্টো দুই আঙুলের ফাঁকে অচেনা পৃথিবীটাকে চেনা করে নেয়ার চেষ্টা করতাম। বাম চোখটা কায়দা করে বন্ধ করে ডান চোখটা কেমন যেনো দুই আঙুলের ফাঁকের দূরত্বে সেট করে, ছোট্টো মানুষের চোখে দুনিয়াটাকে দেখা। এই খেলাটা হতো নিজের সাথে। এটা প্রায়প্রায়ই করতাম। দুই আঙুলের ফাঁকে চলে আসতো দূরের বিল্ডিংগুলো, হুট করেই থ মেরে যাওয়া বয়েসি গাছ, আকাশে উড়ে যাওয়া ভালো-লাগা দুএকটি ছোটোবেলার পাখি। কখনও-কখনও সাঁই করে ছুট দিয়ে টুক করে হারিয়ে যাওয়া জেটের পেছনে রেখে যাওয়া একরাশ ধোঁয়ার ঘন মেঘরেখা পর্যন্ত ছোটোদের কাছে ধরা দেয়; ওই দুই ছোট্টো-ছোট্টো আঙুলের ফাঁকেই। মা দেখতো, হাসতো। মাকে বলতাম, “মা, দ্যাখো, দ্যাখো! ওই আকাশটা এখানে!” মাকে টেনে নিয়ে খোলা জানালার পাশে গ্রিলের ফাঁকে-ফাঁকে আমার দুই আঙুলের ফাঁকে আটকে-পড়া ছোটোবেলার দুনিয়াটা দেখাতাম। ছোটোবেলার সবচেয়ে সুন্দর দিকটা হলো, ছোটোবেলায় ছোটো থাকা যায়, কেউ কিছু বলে না, বড়োকিছু চাপিয়ে দেয় না, ছোটো-ছোটো সুখ নিয়েও দারুণ সুখী থাকা যায়। কীরকম ছোটো-ছোটো সুখ? এই যেমন, একদিন শরীর খারাপ লাগায় মা পড়া ধরলো না। তখন মনে হতো, লাইফ ইজ বিউটিফুল।

ছোটোবেলাটা হচ্ছে সেই ছোট্টোবেলায় ফেলে আসা এক ইচ্ছের রাজ্য। ওই রাজ্যের আকাশে একটাই ঘুড়ি ওড়ে—ইচ্ছেঘুড়ি। এই ঘুড়িটা অন্য ঘুড়িগুলোকে ভোকাট্টা করে দেয়। আরেকটা খেলা ছিল, মনে-মনে ইচ্ছেমতো ভেবে নিয়ে খুশি হয়ে ওঠার খেলা। একদৃষ্টিতে শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের সামনের দিকটায় জেলির মতো কী যেন ওপর থেকে খুব ধীরে-ধীরে পড়তে থাকে। ওটা সরু-সরু আঁকাবাঁকা রেখায় ক্রমেই নিচের দিকে নামতে-নামতে মিলিয়ে যায়। মনে হতো, যেটার দিকে তাকিয়ে আছি, সেটাকে ঘিরে কোত্থেকে যেনো একটা রংধনু এলো, যেটা আস্তে-আস্তে আমাকে আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে, ছুঁয়ে যাচ্ছে। এটা সহজ নয়, চোখজোড়াকে কোনও অবজেক্টের দিকে স্থির করতে হয় এমনভাবে যাতে মন সেই অবজেক্টে না থাকে। রাঙিয়ে নেয়া মাত্রই কঠিন, নিজেকে হোক, কিংবা অন্য কাউকে; এর জন্যে অসীম ধৈর্য্যে অভ্যস্ত হতে হয়। এভাবে একটা সময়ে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। চোখের পাতাগুলো চট্ করে এক করে, খেলাটা আবার প্রথম থেকে শুরু করা যায়, কল্পনার রঙের রঙধনুতে আমার নিজেকে আমার যেমন করে ইচ্ছে, যতোটুকু ইচ্ছে, রাঙিয়ে নেয়া। হায়! রঙগুলো আজ হারিয়ে গেছে! ওরা এখন আর ধরা দেয় না। বড়ো হয়ে গেছি তো! বড়ো হয়ে যাওয়াটা দারুণ বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার!

সকালে বাবা কোর্টে যেতো। দরোজার কাছে আগে-আগে গিয়ে বাবার ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার ছোটো ভাইয়ের সাথে ব্রিফকেসটা কে বাবার হাতে তুলে দেবে, সেটা নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া হতো। বাবা আমাদের দুজনকেই কোলে নিয়ে চুমু খেতো, কিছু খুচরো পয়সাও দিতো। তখন চারআনা দিয়ে ঝাল-ঝাল একটা চকোলেট কিনতে পাওয়া যেতো, আটআনায় শিঙ্গারা বিক্রি হতো, এক টাকায় এক প্যাকেট সুইটবল (পাখির ডিম) পাওয়া যেতো। এরপর আমরা দুই ভাই দৌড়ে এসে বিছানায় বসতাম। আমাদের বিল্ডিংটা ছিল মেইন রোডের কাছেই। যে জানালাটা খুললেই রাস্তা চোখে পড়তো, সেটার পাশেই একটা খাট ছিল। আমরা দুই ভাইই চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলতাম, বাবা! বাবা!! আর যতোটুকু সম্ভব ততোটুকু ছোট্টো-ছোট্টো হাত দুটো জানালার আড়াআড়ি গ্রিল দিয়ে বাইরের দিকে ছুঁড়েছুঁড়ে বলতাম, বাবা, টা টা, টা টা!! বাবা রিক্সা থেকে হেসে হাত নাড়াতো, রিক্সা দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে গেলেও বাবা পেছন ফিরে হাত নাড়াতে থাকতো। এইসব কাণ্ড দেখে মা খিলখিল করে হাসতো। সে হাসি আমাদের দুষ্টুমি দেখে, নাকি বাবার হাসিমাখা চোখের দিকে তাকিয়ে, নাকি দুটোই, তা অবশ্য বলা শক্ত। আমরা খুচরো পয়সা মাটির ব্যাংকে ফেলতাম। দিনগুলো মাটির ব্যাংকে পয়সা জমানোর দিন ছিল। মনে আছে, আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম, কখন ব্যাংকটা ভাঙতে পারবো। মা বলতো, দেখি, তোদের মধ্যে কার ব্যাংকটা আগে ভরে। পয়সা জমানোর কম্পিটিশন চলতো; বড়োরা যেমন অন্য কারওর পয়সা মেরে দিয়ে ওর সাথেই কম্পিটিশনে নামে, ছোটোদেরটা ওরকম নয়। বড়োদের তুলনায় ছোটদের আত্মসম্মানবোধ বেশি হয়। ব্যাংকটা ভাঙা ছিল রীতিমতো রোমাঞ্চকর। ছোটো বয়সের ছোটো সুখের রোমাঞ্চ। ব্যাংক ভাঙ্গার ঝনঝন শব্দ এখনও কানে বাজে। তীব্র উত্তেজনায় খুচরো পয়সাগুলো গুনতাম, এরপর একসাথে জড়ো করে একটা থলেতে নিয়ে নিচের মুদি দোকানে দিয়ে বড়ো কাগুজে নোট নিয়ে আসতাম। কতোই বা হতো! এই ১৫০ টাকা, ২০০ টাকা! তখন নিজেকে অনেক বড়োলোক, বড়োলোক মনে হতো। সেইসময়টা ছিল অল্পে বড়োলোক হওয়ার সময়। বড়ই মধুর সেইসময়। বাবা ওই টাকাটার সাথে আরওকিছু টাকা যোগ করে পোস্ট অফিসের সঞ্চয়ী হিসাবে জমা দিয়ে দিতো।

সারাটাদিন অপেক্ষায় থাকতাম, বাবা কখন ফিরবে। কখনও-কখনও মায়ের সাথে আমরা দুই ভাই বসে লুডু, কল ব্রিজ আর ক্যারম খেলতাম। বারান্দায় মিষ্টি রোদ আসতো; ওখানে শীতলপাটি বিছিয়ে বিকেলের শেষ আলোটা ফুরিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত খেলতাম। ঠিকমতো ছক্কা না পড়লে মা লুডুর বোর্ড উল্টে দিতো। মাঝেমাঝে কীভাবে যেনো লুডুর গুটিটা ছোঁড়ার সময় কৌশল করে ধরে রেখে ছক্কা ফেলতো। এই চোরাবুদ্ধি পরে আমরাও শিখে যাই। কলাগাছ খেলায় বেশি গুটি ‘খেতে’ না পারলে ক্যারমের গুটিগুলোও এলোমেলো করে দিতো। ইসস! মা কত্তো ছেলেমানুষ ছিল! (ভাগ্যিস, মা ফেসবুকে নেই!) বাবা সন্ধ্যার আগেআগে ফিরতো। কোনওদিন খালি হাতে ফিরতো না। আসার সময় মজার-মজার টিফিন নিয়ে আসতো। একেকদিন একেক রকমের। আমাদের বাসায় ব্রেকফাস্ট, সন্ধ্যার টিফিন, ডিনার সবাই একসাথে বসে করতাম। কেউ কাউকে ফেলে খেতো না। এখনও খায় না। সন্ধ্যায় যখন আযান দেয়, বাবা তখন আমাদের নীরব থাকতে বলতো। মা টিভিটা মিউট করে দিতো। বাবা বলতো, “এই মুহূর্তটা পবিত্র মুহূর্ত। নামাজ হয়, সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে। প্রার্থনার সময় হয় প্রার্থনা করবে, অথবা নীরব থাকবে।” রোজার সময় বাবা প্রতিদিন ইফতার আনে, এবং কখনওই আযান দেয়ার আগে খায় না; টেবিলে ইফতার সাজিয়ে আযানের জন্যে অপেক্ষা করে। সন্ধ্যার টিফিনের পর বাবা যখন বিশ্রাম নিতো, তখন বাবার কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যান করতাম, বাবা, ঘোড়ায় চড়বো, ঘোড়ায় চড়াও। সারাদিন খাটুনির পরও বাবা হেসে ঘোড়া হয়ে আমাদের দুই ভাইকে চড়াতো। এখন ভাবি, কীভাবে সম্ভব! একেবারে ছন্নছাড়া অধৈর্য ছেলেটিও যখন বাবা হয়, তখন বোধহয় ভূতে এসে অসীম ধৈর্য দিয়ে যায়! বাবাকে বলতাম, স্কুলে কে কী বলেছে, কোন-কোন হোমওয়ার্ক করে খাতায় ‘গুড’ পেয়েছি (কোনও ক্লাসে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলে বলতাম না, ওটা মা বলে দিতো), এরকম আরও কতো কী! মা মিটিমিটি হাসতো। হাসলে মাকে এখনও অনেক সুন্দর দেখায়।

বাবা প্রতিদিন ভোরে হাঁটতে যেত। আমরা দুই ভাই সাথে যেতাম। আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রামের আইস ফ্যাক্টরি রোডে। রাস্তার দু’পাশে, কলেজিয়েট স্কুলের মাঠের ওদিকটায় অনেকগুলো ফুলের গাছ ছিল। আমরা ঠাকুরপুজোর জন্যে ফুল তুলেতুলে একটা ফুলের সাজিতে রাখতাম। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুলের জন্যে রেডি হয়ে যেতাম। আমাদের বোন ছিল না। তাই, মাকে বাসার টুকিটাকি কাজে হেল্প করতে হতো। এখনও করি, অবশ্য আমার ছোটো ভাই-ই বেশি করে। ওই সময়ে আমাদের ঠাকুরপুজোও দিতে হতো। মা হাতে ধরেধরে শিখিয়ে দিতেন। বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মী পুজো দেয়া ছিল সবচেয়ে ঝক্কিঝামেলার কাজ। কতো যত্নআত্তি করে ধনের দেবীকে তুষ্ট রাখতে হতো। লক্ষ্মীর পাঁচালি সুর করে পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। এখনও মনে আছে। …… দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ। মৃদুমন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।। …… সন্ধ্যায় মায়ের পাশে আমরা দুই ভাই বসে সন্ধ্যারতি করতাম। মা অপূর্ব মিষ্টি কণ্ঠে সুর করে গাইতেন, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। মায়ের চোখ বেয়ে অশ্রু নামতো। নিবেদনের অশ্রু। মা সন্ধ্যাসংগীতও গাইতেন। তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে॥ তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে। …… আবার বাজাও তোমার পাঞ্চজন্য সুদর্শনধারী। প্রভু, এসো, এসো, ঋষিকেশ, ধরার ভারহারী।। ……কেমন আবেগে গাইতেন, হে পার্থসারথি, বাজাও, বাজাও, পাঞ্চজন্য শঙ্খ……….. সেই সুর, সেই আবেগ, সেই আকুলতা আমি আজো খুব গভীরভাবে অনুভব করি।

দুষ্টুমিও কম করতাম না। বারান্দার গ্রিলের জানালার বাইরে মুখ বের করে পথচারীদের গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিতাম। দিয়েই খুব দ্রুত মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে সরে যেতাম, যাতে উপরের দিকে তাকালে আমাকে দেখা না যায়। এটা করলে মা ঠোঁটের উপর খুব জোরে-জোরে টোকা মারতেন। কাঁচি দিয়ে কাগজ কুচিকুচি করে কেটে ঘরময় ছড়িয়ে দিতাম। ফালিফালি করে কাটা কাগজ জানালার বাইরে বের করে নিয়ে ঘ্যাচঘ্যাচ করে সমান্তরালে কেটে দিতাম আর হাজার-হাজার কাগজের কুচি বিল্ডিংয়ের নিচে চারিদিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তো। স্কুলের হাই বেঞ্চে ঘুণে-ধরা কোনও অংশ পেলে সেটাকে বলপেনের নিব দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে আরও ঘুণ বের করতাম, আর ফুঁ দিয়ে সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করতাম। মাঝেমাঝে কিছু ঘুণগুঁড়ো বন্ধুদের কালো প্যান্টে মেখে দিতাম। আমাদের বাসায় ডিশের লাইন ছিল না। জানালার বাইরে ডিশের লাইন গেলে, সেদিকে টিভির এন্টেনা ঘুরিয়ে দিয়ে কোনও চ্যানেল আসে কি না দেখতাম। না আসলে, টিভিতে জোরেজোরে বাড়ি মারতাম। এখন যারা ছোটো, ওরা ক্যাসেট দেখেনি। আমাদের ছোটোবেলায় ক্যাসেটের চল ছিল। ওইসময়ে ওটাকে অদ্ভুত কিছু একটা মনে হতো। ভাবতাম, এই পাতলা ফিতেয় গান কোথায় কীভাবে আটকে থাকে! ফিতেটা ঘসেঘসে বোঝার চেষ্টা করতাম। নষ্ট ক্যাসেটের মাঝের খাঁজকাটা ফাঁক দুটোতে পেন্সিল ঢুকিয়ে ক্যাসেটটা ঘোরাতে অনেক মজা! এরপর ক্যাসেটের ওপর থেকে ফিতা একটুখানি বের করে পুরো ফিতাটা টেনেটেনে বের করে নিতাম। এটা করতে যে কী পরিমাণ শান্তি, তা বলে বোঝানো যাবে না। এই শান্তির কাজটা করে মা’র হাতে অশান্তিপূর্ণ মার খেতাম। স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে খেলনাগুলোর পার্টস খুলে নিয়ে দেখতাম, ভেতরে কী আছে। আমার মূল আকর্ষণই ছিল চুম্বক আর মোটরের দিকে। মোটর নিয়ে শক্ত কাগজ কেটে পাখার মতো করে বানিয়ে মোটরের মাথায় লাগিয়ে দিতাম আর ব্যাটারির কানেকশন দিয়ে হাওয়া খেতাম। বাবাকে বলতাম, “বাবা, বাবা, দ্যাখো, এই ফ্যানটা আমি বানিয়েছি। বাতাসটা ঠাণ্ডা না?” তখন চুম্বকের সমমেরু বিপরীত মেরু বোঝার বয়স হয়নি। আমাদের বারান্দায় মায়ের ছোট্টো বাগানটা ছিল। কিছু গাছ টবে, কিছু টিনে। গুঁড়ো দুধের টিনে যে গাছগুলো লাগানো হয়েছিল, জংধরা সেই টিনগুলোর নিচের দিকে মাটির কাছাকাছি চুম্বক রাখলে অনেকঅনেক লোহার গুঁড়ো চুম্বকের গায়ে লেগে যেতো। পরে সেগুলো একটা সাদা কাগজের উপর রেখে কাগজের উল্টো পিঠে চুম্বক রেখে লোহার গুঁড়োগুলোকে নাচাতাম। ২টা বৃত্তাকার চুম্বকের বিপরীত মেরু পাশাপাশি রেখে একটার কাছে অন্যটা নেয়ার চেষ্টা করলে সেটা দৌড়ে পালাতো। এভাবে গাড়িগাড়ি খেলতাম। খেলা দুটো মা শিখিয়ে দিয়েছিল। আমাদের ছোটোবেলা ছিল নিজেকে ম্যাকগাইভার ভাববার ছোটোবেলা। ম্যাকগাইভারের থিম সংটা এখনও মাথায় বাজে। ওইসময়ে থিম সংটা ভাবলেও নিজেকে সেয়ানাসেয়ানা মনে হতো। স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে খুলতে না পারলে খেলনা ভেঙে ফেলতাম। পৃথিবীর সমস্ত সুখ খেলনা ভাঙার মধ্যে। যে কোনওদিন খেলনা ভাঙেনি, তার কখনওই শৈশব ছিল না। খেলনা ভাঙলে মা বকতো। বাবা বলতো, “বকছো কেনো? খেলনা তো ভাঙার জন্যই!” তার-টার পেঁচিয়ে খেলনাগাড়ির মোটর, আইসি, পেন্সিল ব্যাটারি আর রাজ্যের আরও হাবিজাবি খুঁটিনাটি ইলেকট্রনিক জিনিস একসাথে বিশেষ কায়দায় বেঁধে ‘ছোটোবেলার বোমা’ বানিয়েছিলাম। প্ল্যান ছিল, মা বকা দিলে, মারলে, এখানে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বোমা মারে বাসাটাসা উড়িয়ে দেবো। পরে মায়ের মারের চোটে, আমার ভাবিকালে দক্ষ বোমাবাজ হওয়ার সকল সুপ্ত সম্ভাবনা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রতিভার কী শোচনীয় মৃত্যু!

ছুটির দিনগুলোতে বাবার সাথে সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হতাম; হাঁটার জন্যে নয়, বাবার সাথে বের হলেই বাবা অনেককিছু খাওয়াতো, সেটার লোভে। বাবা হাঁটতে-হাঁটতে অনেক কথা বলতো। বলতো, বাঘ শিয়ালের মেলা’টা শেষ করেছিস? দেখি, আবোলতাবোল থেকে কী কী ছড়া পারিস? ‘রুশ দেশের উপকথা’ থেকে ছড়া আওড়ে বলতো, দেখি বলতো, ‘সিভকা বুরকা, জাদুকা লেড়কা, চেকনাই ঘোড়া, সামনে এসে দাঁড়া’ এটা কোন গল্পে পড়েছিস? সত্যজিতের বাপঠাকুর্দার সাথে আমার পারিবারিক রিলেশন গড়ে উঠেছিল সেই ছোটোবেলাতেই। আমাদের শৈশব ছিল চাচা চৌধুরী, হাঁদাভোঁদা, নন্টেফন্টে, বাঁটুল দ্য গ্রেট, টিনটিন, বিল্লু, পিঙ্কি, রমন, শ্রীমতীজি, ফ্যান্টম, হিম্যান পড়ে বেড়ে ওঠার শৈশব। আরও পরে তিন গোয়েন্দা। টিফিনের টাকা জমিয়ে-জমিয়ে ওরকম একটা বই কেনার উত্তেজনা এখন পুরো একটা বইয়ের দোকান কিনে ফেললেও হবে না বোধহয়। বাবা আমাদের বড়দিনে গির্জায়, বুদ্ধপূর্ণিমায় প্যাগোডায় নিয়ে যেতো। ওরা কীভাবে প্রার্থনা করে দেখতে বলতো। নানা ধর্মের উপকথা নিয়ে লেখা রঙিন ছবির বই কিনে দিতো। সন্ধ্যায় যখন বাবা কাজের ফাঁকে পড়াতে বসাতো, তখন পড়তে-পড়তে অপেক্ষায় থাকতাম, কখন ম্যাকগাইভার শুরু হবে। আরও কতো কী ছিল! দ্য ফলগাই, দ্য ইউজার্ড, দ্য র্যাভেন, দ্য এ-টিম, মিস্টিরিয়াস আইল্যন্ড, দ্য পাথফাইন্ডার, টারজান, থান্ডারকেডস, পপাই, টম অ্যান্ড জেরি, ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট, দ্য থ্রি স্টুজেস, নতুন কুঁড়ি, অ্যারাবিয়ান নাইটস্, আকবর দ্য গ্রেট, দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান, দ্য রবিনহুড এরকম আরও অনেক। এখনও মনে আছে, হারকিউলিস সিরিজটার স্বল্পবসনা মেয়েদের দেখে কী এক গোপন উত্তেজনাবোধ করতাম, তাই ওটা দেখার সময় খুব করে মনেমনে চাইতাম, পাশে কেউ না থাকুক। বেশিরভাগ টিভি সিরিয়ালগুলো শুরু হতো রাত ৯টায়। আমি ঠিক পৌনে ৯টা থেকে ইচ্ছে করে ঝিমোতে শুরু করতাম, ফাঁকিবাজির সময় মেইনটেইন করার ব্যাপারে শিশুরা খুব পানচুয়াল হয়। বাবা ঠিকই বুঝতো; তবুও বলতো, “ঘুমাস না, ভাত খেয়ে ঘুমা।” মাকে ডেকে বলতো, “এই শোনো, বাপ্পি ঘুমাচ্ছে। ওকে ভাত খাইয়ে দাও।” আমার এই শয়তানিটা মা বুঝতো। মা বলতো, “আচ্ছা, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।” এরপর আমি কাঁদোকাঁদো হয়ে বাবাকে বলতাম, “বাবা, আমি একটু আলিফ লায়লা দেখবো, আজকে দৈত্যটাকে মেরে ফেলবে। আর কোনওদিন দেখবো না। আমি রাতে পড়বো। মাকে একটু বলে দাও না।” আমি জানতাম, মার কাছে কান্নাকাটি করে কোনও কাজ হবে না। তাই, বাবাকে দিয়ে বলাতাম। বাবাকে মনে হতো দুনিয়ার সবচাইতে ভালো মানুষ, আর মাকে মনে হতো শত্রু। আমার এখনও মনে আছে, যখন শাহরুখের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত মুভি ‘দিওয়ানা’ রিলিজ পায়, আমি তখন ক্লাস টু’তে পড়ি। আমাদের বাসায় একটা ভিসিআর ছিল। তখন সিডি’র চল হয়নি, আমরা ভিডিও ক্যাসেটে মুভি দেখতাম। গলিতে-গলিতে ভিডিও ক্যাসেটের দোকান ছিল, ওখান থেকে পপুলার বাংলা-হিন্দি-ইংলিশ মুভিগুলোর ক্যাসেট দু’তিনদিনের জন্যে ১০ টাকায় ভাড়া নেয়া যেতো। আমি আমার লাইফের প্রথম ক্রাশ খাই সেই ছোটোবেলাতেই; দিওয়ানা’তে দিব্যা ভারতিকে দেখে। আমার মনে হয়েছিল, ইসসস! যদি এরকম একটা মেয়ের সাথে প্রেম করা যেতো! এমনকি, আমি প্রার্থনা করার সময়ও ঠাকুরের কাছে ওটা বলতাম! ওইসময়ে কিন্তু আমার ঈশ্বরভক্তি ছিল ঐকান্তিক, কোনও ফাঁকি ছিল না। এখন বুঝি, জ্ঞানীরা কেনো বলে গেছেন, God helps those who help themselves. রীতিমতো ঐশ্বরিক ফাঁকিবাজি!

ছোটোবেলায় আরেকটা উইশ ছিল, ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া। খুব ইচ্ছে হতো, ইসস! যদি মিস্টার ইন্ডিয়া’র মতো যখনতখন ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারতাম! চকোলেটের দোকানে, খেলনার দোকানে গেলে এই ইচ্ছেটা আরও জেঁকেচেপে বসতো। আরেকটা প্রিয় কাজ ছিল শিসের মাধ্যমে পরিচিত গানগুলো তোলা। এই বুদ্ধি বাবার কাছ থেকে শেখা। এই কাজটা তো এখনও করি। বেশ মজার কাজ! এই ধরুন, উইন্ড অব চেঞ্জ’য়েই তো শিস আছে। ওটা শিসে করলে দারুণ শোনায় না! আরেকটা বলি। পাশাপাশি অনেকগুলি ম্যাচের বাক্স লম্বা করে বসিয়ে দিয়ে দুর্গ গড়ে যেকোনও প্রান্তের একটাতে একটু টোকা দিলে কী সুন্দরভাবে একটার পর একটা ধাক্কা খেয়ে-খেয়ে পড়তে থাকে! এই খেলাটাতে বিনে পয়সায় যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেটার আমার কয়েক মাসের চাকরির বেতন দিয়েও আমি কিনতে পারবো না। আমার ছোটো ভাইয়ের সাথে, স্কুলের বন্ধুদের সাথে পেন-ফাইট খেলতাম। সবক’টা কলম টেবিল থেকে ফেলে দিতে পারার আনন্দ অসীম! আরেকটা মনে পড়ছে। বলপেনের নিবের দিকের অংশটা পুড়িয়ে গলিয়ে সেটা ধরে টানতে-টানতে অন্য প্রান্তে ফুঁ দিলে ছোটোবড়ো অনেকগুলো বেলুন ফুলে যায়। এই খেলাটা ছিল খুব কমন একটা খেলা। এটা করতে গিয়ে অনেকবার হাত পুড়ে ফেলেছি এবং যথারীতি মায়ের হাতে ধোলাইও খেয়েছি। বাঙালি মায়েরা তাদের শাখামৃগটাইপ সন্তানরা প্রতিভাপ্রদর্শন করতে গিয়ে কোনওভাবে আহত হলে, প্রথমে আরও আহত করেন, এরপর সেবা দেন। বড়ই বিচিত্র বাঙালি নারীর মন! আমরা লাটিম ঘোরাতাম, মার্বেল খেলতাম, হাতে ইয়োইয়ো নিয়ে নানান কায়দায় বাহাদুরি দেখাতাম। আমি খুব ভালো মার্বেল খেলতে পারতাম, বাসায় আমার খেলায় জিতে-নেয়া মার্বেলের স্তূপ জমে যেতো। ওই সময়ে ওগুলোকে মনে হতো মহামূল্যবান সম্পত্তি। আমার মা অতি যত্ন সহকারে আমার ক্রীড়ানৈপুণ্যে অতি কষ্টে ‘লাভ-করা’ মার্বেলগুলো জানালা দিয়ে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলে দিতো। আহা! আমার সকল অর্জন বিষ্ঠায় মিলায়! রাগে, কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে থাকতাম, তবু মার খাওয়ার ভয়ে কাঁদতেও পারতাম না। আমার এতো কষ্ট হতো! ইচ্ছে হতো, মা’কেও ওরকম করে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই।

আমার কাছে নানান দেশের অসংখ্য ডাকটিকেট আর কয়েন ছিল। আমাদের ছোটোদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো, কে কত বেশি জমাতে পারে। ওগুলো জমাতে গিয়ে চুরিবিদ্যা রপ্ত করেছি। বন্ধুদের কাছ থেকে সিলমারা হয়নি এমন ডাকটিকেট চুরি করতাম। সিলছাড়া টিকেটের আলাদা কদর ছিল। এমনও হয়েছে, ডাকটিকেট এঁকে তার চারদিকে খাঁজখাঁজ করে কেটে আসল ডাকটিকেটের আদল দিতাম, আবার কোনও ম্যাগাজিন থেকে ডাকটিকেটের ছবি কেটে নিয়ে অ্যালবামে আসল টিকেটের পাশে আঠা দিয়ে সেঁটে রাখতাম। মনে হতো, ডাকটিকেট কেউ দেখে আসলনকল বুঝছে না, আমার কালেকশন আর প্রেস্টিজ, দুইই বাড়ছে। অন্যের কালেকশন দেখার সময় কতোকতো টিকেট আর কয়েন যে পকেটে পুরেছি, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। বাসায় কেউ এলেই তাকে ধরেধরে আমার সংগ্রহ দেখিয়ে-দেখিয়ে বিরক্ত করে ছাড়তাম। বইও চুরি করতাম কোনও বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা ছাড়াই। দুনিয়ার তাবৎ বইকেই আমার নিজের বলে মনে হতো। পরহস্তের বই আপন হস্তগত করার মধ্যে যে অনির্বচনীয় সুখ, সেটা এখন আর পাই না। এখন তো পুরোদস্তুর জেন্টেলম্যান হয়ে গেছি। এই জেন্টেলম্যান হয়ে-যাওয়াতে কোনও সুখ নেই, শুধুই অ-সুখ। যতো ইচ্ছে ততো বই কিনতে না পারার সুখটাকে ইদানীং খুব মিস করি। না-পাওয়ার যন্ত্রণার চাইতেও না-পাওয়ার সুখের অভাব বেশি যন্ত্রণা দেয়। এখন আর আমি বই ধার নেই না, দেই না। মানুষ বই ধার নেয় দুটো কারণে। এক। পড়ার জন্যে। দুই। ফেরত না দেয়ার জন্যে। আমি এখন দুটোকেই খুউব মিস করি।

ছোটোবেলায় আমি বিশ্রীরকমের হাড়কিপটে স্বভাবের ছিলাম। ফাউনটেন পেনের কালির দোয়াতে পানি মিশিয়ে দিতাম, যাতে বেশিদিন চলে। এর জন্যে বকাও খেতাম। ফ্যান স্লো করে চালালে ইলেক্ট্রিসিটি বিল কম ওঠে, এই ধারণা থেকে রুমের ফ্যান স্লো করে দিতাম। আমাদের বাসায় একটা টুইনওয়ান ছিল। ওটাতে চ্যানেল চেঞ্জ করে করে বিভিন্ন ভাষার অদ্ভুতঅদ্ভুত সব গান শোনা ছিল আমার শখ। টিভি থেকে টুইনওয়ান দিয়ে ক্যাসেটে পছন্দের গান রেকর্ড করতাম। এরপর রাতজেগে ম্যাথ করার সময় সেগুলো শুনতাম। আমার বাবা-মা আগাগোড়া সংস্কৃতিমনা রুচিশীল মানুষ। যখন কথা বলতেও শিখিনি, তখন থেকেই আমরা বাসায় রবীন্দ্র-নজরুল-অতুল-রজনী লতা-কিশোর ঘরানার মডার্ন আর ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনেছি; শুনেশুনে বড় হয়েছি। ভাবি, শুধু এই ছোটোবেলার গানগুলো শুনতেও বেঁচে থাকা যায়।

বছরের শুরুতে বাবা সবসময়ই স্কুলের বইয়ের সাথে আরও বেশকিছু বই কিনে দিতো৷ কিনে-দেয়া পড়ার বইয়ের বাইরের বইয়ের সংখ্যা আমার আগের ক্লাসের শেষ টার্মের রেজাল্টের সমানুপাতিক৷ বইয়ের লোভ বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া৷ আমি অনেকদিন পর্যন্ত ছোটো ছিলাম৷ ছোটো মানে, যাদের হাতে বড়ো টাকা থাকে না৷ বই-কেনার জন্য টাকা চাইলেই মায়ের কাছে পাওয়া যেতো৷ মেয়েদের টাকা আর টুথপেস্টের টিউবের পেস্ট একইরকমের৷ সব শেষ হয়ে গেলেও কিছু না কিছু থাকেই৷ কীভাবে যেনো মেয়েদের কাছে চাইলেই পয়সা পাওয়া যায়৷ মা বই-কেনার টাকা চাইলে কখনওই ‘না’ বলেনি৷ আসলে, পরেপরে বাবার কাছে চাইতে কেমন যেনো লজ্জালজ্জা লাগতো৷ মায়ের কাছেই বেশি চাইতাম৷ আমাকে কখনও গল্পের বই কষ্ট করে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়নি। বাবা-মা সবসময়ই উৎসাহ দিয়েছে। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে বই-পড়ার কম্পিটিশন হতো৷ মা আমাকে প্রায়ই জিতিয়ে দিতো৷ বাবা হাসতো শুধু৷ সেই হাসির মানে যে কতো মধুর, এখন বুঝি; আমিও হাসি৷ বাবা-মারা যে কতো অবলীলায় বাবা-মা হয়ে ওঠে! ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে!