ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম ভেঙে যাবার পর আধো জাগরণ আধো ঘুমে কাটল আরও দেড় ঘণ্টা। ভোরের আলো মুখের উপর এসে পড়াতে উঠে পড়ল মৌরি। এরপর সে বুঝতে পারছিল না, আগে ফ্রেশ হবে, না কি আগে দুধ জ্বাল করে নাশতাটা রেডি করবে। অনেকক্ষণ ভাবার পর সে সিদ্ধান্ত নিল, আগে ফ্রেশ হবে, মাথা ঠাণ্ডা হবে, তারপর চুলোর ধারে যাবে।
নাশতা বানানো শেষ হলো, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না যদিও; এত ভোরে নাশতা খেতে তার ভালো লাগে না, তবুও জোর করে ২-৩ চামচ নুডলস গেলার পর ১ গ্লাস দুধ ঢকঢক করে খেয়ে মেডিসিন নিল মৌরি।
মা চা করে সকাল সকালই। চা-টা'ও আজ অখাদ্য হয়েছে। মৌরি বরাবরই অখাদ্য টাইপের চা বানায়, কিন্তু মায়ের হাতের চা খেতে সবসময়ই হয় অমৃত। মা আজ একটু তাড়ার মধ্যে চা করেছেন। সকালে বাসার গেস্ট চলে যাবেন বলে তাড়াহুড়োয় করা চা এর চেয়ে ভালো হলে বরং সেটাই আশ্চর্য হতো।
যা-ই হোক, ঝটপট রেডি হয়ে বের হবার সময় ঘুমন্ত ছেলের কপালে চুমু খেতে মৌরি কখনোই ভুলে যায় না। বেরিয়ে যাবার সময় মা'কে বলতেও কখনও ভুল হয় না মৌরির।
এরই মধ্যে পেখম ফোন দিয়েছে বেশ কয়েক বার। মৌরি এক বারও কল ধরতে পারেনি, কারণ ফোনটা সাইলেন্ট ছিল, কল যে এসেছিল, দেখার আগ পর্যন্ত তা বুঝতে পারেনি। বাসায় থাকাবস্থায় কলটা সে ব্যাক করেনি। এটা মৌরির অভ্যেস। কোথাও বেরুনোর আগে কেউ কল করলে বাসায় কথা বলতে মৌরি পছন্দ করে না। এতে বাসার লোকজনের কৌতূহল এবং সন্দেহ দুই-ই বাড়ে, যেটা মৌরির অসহ্য রকমের বিরক্তিকর লাগে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের ভালো একটা বাস পেয়ে গেল সে। এত ভালো বাস পেয়ে যাবে ভাবেনি মৌরি। বাসে বসতেই পেখমের ফোন এল। বাসে তখন যাত্রীরা উঠছিল, বসছিল, তাই পেখমের কলটা এবারও রিসিভ করতে পারল না মৌরি। সে বুঝতে পারছিল, পেখম দুঃশ্চিন্তা করছে। পেখম স্বভাবতই অস্থির প্রকৃতির। বাস চলতে আরম্ভ করলে মৌরি কলব্যাক করল।
খপ করে কিছু ছিনিয়ে নেবার মতো করে পেখম এক রিং পড়তে না পড়তেই কল রিসিভ করল।
হ্যালো... কোথায় তুমি? আমি মাত্র বাসে উঠলাম। আচ্ছা। কতক্ষণ লাগতে পারে? জানি না তো, কেবল তো উঠলাম। রাস্তা ফাঁকা থাকলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব হয়তো। আচ্ছা, তুমি আমাকে তোমার কারেন্ট লোকেশনটা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাও। তাহলে আমি সময়টা বুঝতে পারব। ঠিক আছে।
প্রায় দু-মাস পর ওদের দেখা হচ্ছে। দু-জনই এই দু-মাস ছটফট করে মরেছে। এর মধ্যে অনেক বার দেখা হবে হবে করেও হয়নি। এক বার পেখমের সমস্যা হাজির হয় তো অন্য বার মৌরির!
অর্ধেক রাস্তা না পেরোতেই পেখম না হলেও অন্তত পাঁচ-ছয় বার ফোন করে জানতে চেয়েছে মৌরি কতদূর পৌঁছল। পেখমের এই অস্থিরতা মৌরির ভীষণ ভালো লাগে, তবে সেটা ফোনের চেয়ে বাস্তবে বেশি। চোখের সামনে যখন পেখম এটা-ওটা নিয়ে অস্থিরতা করে, তখন ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভীষণ জোরে ঠোঁটে চুমু খেতে ইচ্ছে করে মৌরির, যদিও এখন পর্যন্ত সেটা করেনি সে।
আজ সরকারি ছুটির দিন। রাস্তাঘাট একদমই ফাঁকা। মাত্র পৌনে এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেল মৌরি। এরপর কিছুটা ভেঙে যেতে হয়। বাস থেকে নেমে বিশ মিনিটের মধ্যে মৌরি পেখমের নতুন ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল। বেল দিতেই পেখম এত দ্রুত দরজা খুলে দিল যেন দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে ছিল সে। পেখমের এইসব অস্থিরতা খুব মজার।
মৌরি ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকে অবাক না হয়ে পারল না সে! একা একটা ছেলেমানুষ এত বড়ো একটা ফ্ল্যাট এত সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছে যে মৌরির বিশ্বাসই হচ্ছিল না! অবশ্য মৌরি বহু বছর আগে থেকেই পেখমকে সবসময়ই সুন্দর চোখে দেখে। মৌরি ভেবেই রাখত, পেখম মৌরিকে তার সবচেয়ে সুন্দর রূপটাই সবসময় দেখাবে। এটা মৌরি একরকম অন্তর থেকে বিশ্বাস করত। কে জানে সেই বিশ্বাসের জোরেই কিনা পেখমের সাথে মৌরির বিশ্রী একটাও ব্যাপার কখনোই ঘটেনি।
কেন জানি ওরা পরস্পরের কাছাকাছি এলে অদ্ভুত রকমের ধীরস্থির হয়ে যায়। জগতের কোনো কিছুই আর ওদের স্পর্শ করে না। ওরা শুধু ওদের নিয়েই থাকতে চায়।
মৌরি আর পেখম মিলে সকালের নাশতা সবজি-নুডলস তৈরি করল, তার সাথে চিকেন স্টু। সমস্ত সবজি ধুয়ে কেটে তৈরি করে দিল পেখম, আর রান্না করল মৌরি। যদিও পেখম নিজেই রান্না করতে চেয়েছিল, মৌরি দেয়নি করতে। টেবিলটাও সাজিয়ে ফেলল পেখম।
একমুহূর্তের জন্যে নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হলো মৌরির। ভালোবাসা ব্যাপারটা তার কাছে একদমই মেকি লাগে, তবুও পেখমের সমস্ত কিছু সত্যি ভাবতে কেন যেন খু-উ-ব ইচ্ছে করে তার।
সাত বছর আগেও যেমন করে সে চাইত, পেখম এক বার, শুধু এক বার বলুক, "মৌরি, তুমি থেকে থাও আমার হয়ে আজীবনের জন্যে।", আজ এত বছর পরেও মৌরির সেই চাওয়ার একটুও পরিবর্তন হয়নি।
ভালোবাসার উপর চরম অবিশ্বাস জন্মে যাবার পরও কেন সে পেখমকে নিয়ে এসব ভাবতে চায়, মৌরি সত্যিই তা জানে না।
এসব ভাবতে ভাবতে পেখমের দিকে তাকিয়ে থেকে পেখম-সহ মৌরি নাশতা করেছে। ওদিকে পেখম সমানে বকবক করে যাচ্ছে, আর মৌরি ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পেখম প্রায় সবসময়ই কথা বলে, মৌরি প্রায় সবসময়ই শোনে। এই ব্যাপারটাই ওদের দু-জনের কেমিস্ট্রিকে অনবদ্য করে তোলে।
কথার মাঝে মৌরি যখন মাঝে মাঝে কথা বলে কিংবা উত্তর দেয়, তখন পেখম পারলে বাতাসের শব্দকেও বন্ধ করে দেয়। আমরা সকলেই শুধু বলতে চাই, ভালো শ্রোতা আমরা কেউই নই। ভালো শ্রোতা হতে পারলেই একটা সম্পর্ক মধুর চেয়েও মিষ্টি হয়ে যায়!
সেই মিষ্টতা চিরকালই পেখম-মৌরির সম্পর্কে বহমান।
তবে পৃথিবীতে সবই অনিশ্চিত। হতে পারে দীর্ঘকাল দূরত্বের কারণে ক্ষণকালের সেই মিষ্টতা নষ্ট হয়নি আজও।
মৌরি কিছুটা খেয়ে আর খেতে পারল না। অবশ্য মৌরির খাওয়াই অতটুকু। তা ছাড়া পেখম তাকে অনেকটা তুলে দিয়েছে, পেখম নিজে বাকিটুকু খেয়েছে। বার বার পেখম বলছিল, দারুণ হয়েছে, অনেক ভালো হয়েছে নুডলসটা। স্টুটাও একদম ফাটাফাটি!
মৌরি নিজেকে অতটা এক্সপার্ট রাঁধুনি ভাবে না কখনোই, তবে যখন রান্না করে, নিজের বেস্ট এফোর্ট দিয়েই করে। মৌরি যে-কোনো কাজেই অনেক প্যাশনেট, হোক তা রান্না কিংবা চুমু।
পেখমের খাওয়া দেখতে ভালো লাগছে মৌরির। খাওয়াশেষে পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখাল মৌরিকে। কোথা থেকে কতকিছু কিনেছে সব দেখাল। মৌরি খুবই অবাক হলো এটা দেখে যে, একা একটা ছেলেমানুষ আস্ত একটা বাসা গুছিয়ে ফেলেছে এত সুন্দর করে! সব ধরনের খাবার থেকে শুরু করে ছোট্ট একটা দরকারি জিনিসও কিনতে ভোলেনি সে। মৌরি কেনাকাটার যে লিস্ট দিয়েছিল, তার অন্তত চারগুণ কেনাকাটা করেছে পেখম। সত্যিই এতটা আশাই করেনি মৌরি। সে ভাবে, পেখম বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তার কাছে তাই পেখম সবসময়ই ভীষণ আদরের, একদম তার টবের গাছটার মতো।
মুভি দেখার জন্যেও আলাদা রুম সাজিয়েছে। টিভি, খাট আর হোম থিয়েটার রয়েছে সেখানে। কিছুটা দূরত্বে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পেখম বকবক করে যাচ্ছিল। কী কী সে করবে, তার নিজের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা, এটা, ওটা।
মৌরি স্বভাবতই চঞ্চল ও দুষ্টু প্রকৃতির। অপ্রত্যাশিত ঝড় জীবনকে কিছুটা মন্থর করলেও ভেতরের সেই ছটফটে ফড়িংসত্তাটা বেঁচে আছে। মানুষ বুঝে সেসব সময়ে সময়ে বেরিয়ে আসে।
পেখমের কর্মপরিকল্পনা শুনতে শুনতে মৌরি দুষ্টু দুষ্টু এক্সপ্রেশন দিচ্ছিল উত্তরে। আচমকা পেখম ছুটে এসে মৌরিকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে গভীরভাবে চুমু খেতে লাগল। মৌরির ভেতরটা শিহরনে কেঁপে উঠল। নিজের শরীরটা পেখমের মধ্যে ভাসিয়ে দিয়ে হালকা হয়ে গেল, তার মনে হতে লাগল, সে এই পুরো পৃথিবী পেয়ে গেছে, জীবনের কাছে চাওয়ার আর তেমন কিছুই মৌরির নেই।
মৌরি ঠিক জানে না, পেখম এখন যতটা পাগলের মতো মৌরিকে চায় কাছে পেতে, সেই দিনগুলিতেও চাইত কি না! তবে মৌরি চেয়েছিল, খু-উ-ব করে চেয়েছিল, তবে মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু বলেনি। শুধু পেখম যেন তার সেই ভালোবাসার গভীরতাটা উপলদ্ধি করতে পারে, সেভাবেই সে ছিল। তবু পেখম একটা বারের জন্যেও সমাজকে উপেক্ষা করে আজও বলতে পারল না, "মৌরি, দ্বিতীয় বার জীবন আমাকে সুযোগ দিয়েছে। এবার আর তোমাকে হারাতে দেবো না। থেকে যাও আমার সঙ্গী হয়ে বাকিটা জীবনে। সমাজ তো দেখলাম অনেক। দিনশেষে আমার ভালো কিংবা খারাপ থাকা আসলে ম্যাটার করে না কোথাও। এসো, এই বস্তাপচা সমাজটাকে পেছনে রেখে এবার আমরা পরস্পরের জন্য একসাথে বাঁচি।"
শুধু এক বার বলুক পেখম কথাগুলি। মৌরি এরপর ফিরে যাবে না আর কোথাও। ঠিক সেই মুহূর্তেই থেকে যাবে পেখমের হাতটা ধরে আমৃত্যু!এখন আর কোনো কিছুই টানে না মৌরিকে। জীবনযুদ্ধ করতে করতে সে আজ ভীষণ ক্লান্ত, অবসাদে অবসাদে পরিশ্রান্ত। পেখমের কাছে আবার ফিরে আসার কোনো পরিকল্পনাই মৌরির ছিল না। কেন, কীভাবে এসেছে মৌরি নিজেও বুঝতে পারে না। মৌরি-পেখমের ব্যাপারটা আগেও এরকম ছিল। ওরা কেউই কাউকে অ্যাভয়েড করতে পারত না, এখনও পারে না। কাছে এলেই আজও ওরা কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়।
পেখমের বিয়ের পর মৌরি তাই কখনোই যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। সে চেয়েছিল, থাক, বিয়ে করেছে, তাকে নিয়েই পেখম সুখী হোক। এই সুখের মাঝে মৌরি নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে আর ছোটো হতে চায়নি। কিন্তু পেখম শেষ অবধি সুখী হতে পারেনি। আহা, মানুষ যে কীসে সুখী হয়!
পেখম প্রায়ই বলে, এতগুলি বছরে সে অসংখ্য বার মৌরিকে চেয়েছে। ফেলে-আসা দিনগুলির সেই নিবিড় ভালোবাসার শক্ত শেকড় সে কখনোই উপড়ে ফেলতে পারেনি। এর কারণ শারীরিক নয়, ভীষণ রকমের মানসিক এবং আত্মিক।
মৌরি জানে, এসব পেখম মনের কথা। পেখমের মুখপরিচিতির কারণে আগেও বহু মেয়ে তার প্রেমে হাবুডুবু খেত, তাই মৌরির ভালোবাসা পেখম আদৌ অনুভব করত কি না, করলেও সেই অনুভূতি তাকেও একইভাবে নাড়া দিত কি না, তা নিয়ে মৌরি সন্দিহান ও দ্বিধান্বিত থাকত। তাই মুখে তার অনুভূতির কথা পেখমকে সে কোনোদিনই তেমন একটা বলত না। কাজেকর্মে, আচরণে সেই তীব্রতা পেখম হয়তো বুঝত।
আজও সেই দ্বিধা মৌরির কাটেনি, সেই দ্বিধা আজও মৌরিকে একইভাবে হতাশায় ডুবিয়ে রাখে। এর কারণ, পেখম আগের মতোই এখনও বলে না, মৌরি, আমার সাথে থাকো, আমার সাথেই বাকিটা জীবন বাঁচো।
আজ দুপুরের রান্না মৌরি করবে, আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সেই অনুযায়ী পেখম মুরগি কিনেছে। কিছু টুকটাক কাঁচা বাজারও করেছে। পেখম স্নানে গেলে মৌরি মুরগিটা ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করছিল।
স্নানশেষে বেরিয়েই পেখম এসে বলল, কী করছ তুমি? এই তো মুরগিটা পরিষ্কার করছি। রান্না করতে হবে তো। আজ আমি রান্না করব। তুমি খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে। তাই নাকি? তুমি রাঁধতে পারো? চেষ্টা করি আজ। না করলে তো কখনও শিখব না। হঠাৎ এটা শিখতে হবে কেন? এমনিই, আমি আজ রান্না করব। তোমার কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু দেখো। একটু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখি কী হয়। কিছু-একটা তো হবে, তাই না?
মৌরি হাসে, কিছু বলে না। এরপর পেখম কী কী মশলা দেবে মুরগিতে, তা বলতে শুরু করল। বলল, সবশেষে একটু দারুচিনি-গুঁড়ো দেবে। এবারে হা হা করে হেসে উঠল মৌরি।
আচ্ছা? জিরা-গুঁড়ো না দিয়ে দারুচিনি-গুঁড়ো কেন? দারুচিনি-গুঁড়ো দিলে অনেক মজা হবে। দেইখো তুমি! হা হা হা, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। না… বলো! ... হয় না? এভাবে হয় না? অবশ্যই হয়! কেন হবে না? না না, সত্যি সত্যি বলো। বললাম তো, অবশ্যই হয়। হা হা হা...
মৌরির হঠাৎ মনে হতে লাগল, জীবন বড়ো সুন্দর।
পেঁয়াজ, রসুন পেস্ট করার জন্য ছিলতে লাগল মৌরি। পেখম আদা নিয়ে এল, এবার সে সব মশলা ব্লেন্ড করবে একসাথে। আদা না ছিলে শুধু ধুয়েই দিয়ে দেবে ব্লেন্ডারে। রসুনও ছিলতে হবে না কষ্ট করে, আর পেঁয়াজও কাটতে হবে না; সবকিছু ব্লেন্ডারে দিয়ে খুব জোরে ব্লেন্ড করবে, তাহলেই হয়ে যাবে।
পেখমের এসব প্ল্যান শুনে মৌরি হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। অনেকটা জোর করেই পেখমের হাত থেকে আদার টুকরোটা নিয়ে ছিলে ধুয়ে কুঁচিয়ে দিল, তার সাথে পেঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ সব। এবার পেখমের জোরে ব্লেন্ড করার পালা।
মশলা তৈরি হয়ে গেলে অর্ধেকটা মশলা মুরগিতে নিজ হাতে মেখে চুলোয় বসিয়ে দিল পেখম। এরপর নিজ হাতেই বেগুন কেটে হলুদ, মরিচগুঁড়ো আর লবণ দিয়ে মেখে ভাজা করল।
রাইসকুকারে ভাত করল সে। মৌরি সালাদ কাটল। খোসা-সহ শশার বড়ো বড়ো টুকরো, টমেটো আর লেবু! বেশ আয়োজন করে রান্না শেষ হলো। পেখম নিজেই সার্ভিং-ডিশ এনে ডিশ আর চামচ ধুয়ে ওতে মুরগিটা তুলল। মৌরি ভাত আর সালাদ বাড়ল, ততক্ষণে বেগুনটা ভাজা হয়ে এল। টেবিলে সব যত্ন করে সাজাল পেখম।
খেতে বসল ওরা দু-জন।
গরম ভাতে ঘি দিল মৌরি। পেখম মৌরিকে খাবার তুলে দিল, মৌরিও তুলে দিল ওকে। খাওয়া শুরুর আগে পেখম বলল, এই প্রথম আমরা একসাথে লাইক অ্যা ফ্যামিলি খাবার খাচ্ছি।
মৌরি স্মিত হাসল শুধু। এই কথাগুলো শুনে তার আনন্দ হবার কথা ছিল, কিন্তু ভীষণ কষ্টে নুয়ে পড়ল মৌরি। চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায় না এতটা নীল কষ্ট নিয়ে।
পেখম নানানভাবে মৌরিকে বোঝাচ্ছে, তার একটা বিয়ে করে ফেলা দরকার, এত বড়ো ডাইনিং টেবিল, ছয়টা চেয়ার। একটা বিয়ে করে চারটা ছেলে-মেয়ে নিয়ে নেওয়া দরকার। তাহলেই ভর্তি চেয়ার-টেবিল দেখতে ভালো লাগবে।
মৌরিও সায় দিল। পেখম তাকে পাত্রী খুঁজতে বলল। মৌরি রিকয়ারমেন্ট জানতে চাইল। পেখম ইঙ্গিতে মৌরির মতো পাত্রী চায় বলল, মৌরি হাসল। এসব শুনে মৌরি ভেতর থেকে আনন্দে মেতে উঠতে পারে না। পেখমের কাছে এসব নিতান্তই কৌতুক, আর মৌরির কাছে একেকটা শব্দ একেকটা বম্বশেলের মতো বিঁধে থাকে বুকে।
মৌরি তবু ভেতর থেকে কেন জানি খুব অনুভব করে, পেখমে যখন পঞ্চাশ পড়বে, মৌরির সাথেই ভীষণ করে থাকতে চাইবে। খুব চাইবে, খুউব। মৌরি জানে না, কেন এরকমটা মনে হয় তার।
গল্প-কৌতুক করতে করতে খাওয়া শেষ করল ওরা। নিজের হাতে তেমন খেতে হয়নি মৌরির, পেখমই তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে। পেখম বলল, তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না, আমি সব ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখছি। কিছুতেই পেখম মৌরিকে বাসনগুলো ওয়াশ করতে দিল না। অগত্যা কী আর করা! ধোয়ার পর সেগুলো শুধু ডাইনিং-ওয়াগনে গুছিয়ে রাখছিল মৌরি।
পেখমের সাথে দেখা হবার দিনটা মৌরির কাছে যেন এক লহমায় শেষ হয়ে যায়। মৌরি জানে না, পেখমেরও ঠিক একইরকম ফিল হয় কি না। মৌরি যখন ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ায়, তখন পেখমেরও মনে হয় কি না আরেক বার জড়িয়ে ধরে রাখতে, ঠিক মৌরির যেমন ইচ্ছে করে।
বিকেলে গড়িয়ে এল প্রায়। চা বানানোর কথা থাকলেও বানানো হল না। দুপুরের খাওয়াশেষে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল দু-জনই। ওরা ঘুমিয়ে গেল গান শুনতে শুনতে। সন্ধ্যা নাগাদ মৌরি জেগে উঠল, পেখম ঘুমুচ্ছে তখনও। ঘুমন্ত পেখমকে দেখতে মৌরির খুব ভালো লাগে।
মৌরি আর পেখম একসাথে পাশাপাশি একই বিছানায় ঘুমোবে প্রতিদিন, এটাই তো চাওয়া ছিল মৌরির। ক্ষণিকের অতিথি হতে মৌরি কখনোই চায়নি। আজও চায় না। তবু এই অতিথি হয়েই রয়ে গেল সে।
সন্ধ্যে নেমে এল। মসজিদে আযান হচ্ছে। মৌরি উঠে পড়ল, এবার তাকে ফেরার সাজ নিতে হবে। পেখমকে আলতোহাতে ছুঁয়ে বলল, সে তৈরি হচ্ছে। আধো ঘুম-জাগরণে পেখম সায় দিল।
তৈরি হয়ে মৌরি পেখমকে আরেক বার ছুঁয়ে দিল। এবার পেখম উঠে পড়ল। উঠেই মৌরিকে জড়িয়ে ধরল বুকের মধ্যে। পুরো মুখে চুমু খেল; বলল, সাবধানে যেয়ো, পৌঁছে ফোন দিয়ো। আংটির বক্সটা নিয়েছে কি না জানতে চাইল।
দুষ্টু মৌরি দুষ্টুমি করার লোভ কখনোই সামলাতে পারে না। দু-হাত দিয়ে পেছন থেকে পেখমের কোমর জড়িয়ে চেপে ধরে বলল, বক্স দিয়ে কী করব? জিনিস তো আমার হাতে, খালি বক্স।
পেখমের কী হলো হঠাৎ কে জানে! মৌরিকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করতে লাগল। মৌরি না পারল পেখমকে আটকাতে, না পারল নিজেকে।
আরও ঘণ্টাখানেক দেরি করে বের হলো মৌরি। ঘোরের মধ্যে পুরো দিনটা কেটে গেল ওদের। কিছুতেই মৌরির ইচ্ছে করছে না যেতে, ইচ্ছে করছে পেখমকে জড়িয়ে ধরে রাখতে বুকের মধ্যে অনন্তকাল।
পেখমের বাসার গেইট পেরোবার পর পরই মৌরির মনে হলো, স্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়ে হিংস্র পৃথিবীতে নেমে এসেছে সে, যেখানে মৌরি প্রতিটাদিনই নিজের সাথেই লড়াই করে বাঁচে!
আকাশের চাঁদটা আজ ভিজে গিয়েছে। কালো মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে-আসা ভেজা চাঁদের একটা ছবি তুলে পেখম মৌরিকে পাঠাল। মৌরি তখন ছুটে চলেছে তার চিরাচরিত একঘেয়ে জীবনের পথে…