মায়ের প্রতি দাবি

তুমি আমার মা। তোমার ভেতরে আমি রয়েছি। আমার জ্ঞান, প্রেম, শক্তি সবই তোমার। তোমাতে থেকেই আমি অদ্ভুত, অনির্বচনীয়রূপে তোমা থেকে ভিন্ন হয়ে নিজের সসীমত্ব অনুভব করছি। আমি কতক জানি, অনেকই জানি না। সেই অনেক তোমাতেই রয়েছে। প্রতিক্ষণে তুমি আমার সসীম জীবন হয়ে ব্যক্ত হচ্ছ, আবার আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অব্যক্ত হয়ে যাচ্ছ। তুমি জ্ঞানময়, সৰ্ব্বজ্ঞ, স্বতন্ত্র। তুমি যে বিনা কারণে, বিনা প্রয়োজনে, এই সৃষ্টিকাৰ্য করছ, তা হতে পারে না। এই সৃষ্টিতে নিশ্চয়ই তোমার অভিপ্রায় আছে। সেই অভিপ্রায় যে আমি একেবারে বুঝতে পারছি না, তা নয়।




এই যে তোমার মধ্য থেকে অনির্বচনীয়রূপে ভিন্ন সন্তানকে সৃষ্টি করে তাকে পালন করছ, পোষণ করছ, জ্ঞান, প্রেম, শক্তি, এ সকল শ্রেয় রূপ দিয়ে, মঙ্গল দিয়ে শ্রীমণ্ডিত করছ, এতেই তো তুমি মহিমাময়, মঙ্গলময়। এই শ্রেয় নিজেই নিজের উদ্দেশ্য, এর আর কি অন্য প্রয়োজন থাকতে পারে? তুমি প্রেমময়, প্রেমের আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? প্রেম স্বয়ংই উদ্দেশ্য। তোমার সন্তানকে তুমি ভালোবাসো, তাকে ব্যক্ত না করে, তাকে আপেক্ষিকভাবে স্বতন্ত্র জীবন না দিয়ে, সেই জীবনকে পোষণ-বর্ধন না করে তুমি থাকতে পারো না। তোমার নিজ প্রেম-স্বরূপই তোমাকে এই কাজ করাচ্ছে, অন্য কোনও শক্তি তোমাকে বাধ্য করে এই কাজ করাচ্ছে না।




তুমি যে এই কাজ সর্বদা চালাবে, তা-ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমার স্বরূপের অন্তর্গত, তোমার নিত্যত্বের ভাগী। আমার মরণ অসম্ভব। আমার নিদ্রা-জাগরণ, স্মৃতি-বিস্মৃতি আমার সসীম জীবনের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী; কিন্তু আমার চির-নিদ্রা, চির-বিস্মৃতি তোমার অভিপ্রেত হতে পারে না। তাতে আমার অর্জিত সম্পত্তি ব্যর্থ হয়ে যায়, আমার উন্নতি অসম্ভব হয়ে যায়। তুমি মা হয়ে এই ব্যর্থতা, এই অসম্ভাবনা ঘটাতে পার না। আমি যে মুহূর্তে তোমার সন্তানত্ব অনুভব করি, সেই মুহূর্তেই এই ভয় চলে যায়।




তোমার মাতৃত্বের সঙ্গে কোনও মানুষ-মায়ের মাতৃত্বের তুলনা হয় না। মানুষ-মা এমন করে অনিমেষ নয়নে সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। কেবল নিদ্রায় নয়, জাগরণেও সে যখন-তখনই সন্তানকে চক্ষুর আড়াল করে, তাকে ভুলে যায়। কোনও মানুষ-মা সন্তানকে অনবরত এমন গাঢ় আলিঙ্গনে বদ্ধ করে রাখে না। সন্তান মাকে ছেড়ে, মাকে ভুলে, অনেক সময় কাটায়। সে বড়ো হয়ে মায়ের যত্ন-নিরপেক্ষ হয়। তুমি আমাকে কখনও তোমার কোল থেকে নামাও না, কখনও তোমার যত্ন-নিরপেক্ষ করো না।




মানুষ-মায়ের প্রেমের দাবিও খুব অল্প। তিনি জানেন, তাঁর সন্তান তাঁকে ছাড়াও অন্যকে ভালোবাসবে, হয়তো বেশিই ভালোবাসবে। তাতে তিনি ক্ষুণ্ণ হন না। তোমার দাবি অনন্ত, তুমি আমার সমগ্র হৃদয় চাও, অন্য সকল প্রেমপাত্রকে তোমার অন্তর্ভূত করে ভালোবাসতে বলো। আমি এই দাবি জেনেও তোমাকে সমগ্র হৃদয় কেন, হৃদয়ের একটুকরোও দিতে পেরেছি কি না সন্দেহ।




আমি তোমাকে ভালোবাসতে শিখিনি। ভালোবাসতে শিখিনি, তাই আমার সুখ নেই, শান্তি নেই। তাই আমি সর্বদা ভীত, উদ্‌বিগ্ন। আমার দুর্দশা তুমি দেখছ। আমি নিজের চেষ্টায় প্রেমিক হতে পারছিনে। আমার যে নিজের কোনও শক্তি আছে, এই ভুল ধারণাই বুঝি আমাকে দরিদ্র দুর্দশাগ্রস্ত করে রেখেছে। আমি সমুদয় অহংকার ত্যাগ করে তোমার অহেতুকী কৃপার শরণাপন্ন হই। তুমি আমাকে প্রেমধনে ধনী করে সমুদয় অশান্তি, সমুদয় দুঃখ, সমুদয় ভয় থেকে মুক্ত করো।