মেয়ে, তোমায় সেলাম!

একটা মেয়ে একহাতে সংসার, সন্তান লালন-পালন করেও চাকরি করতে পারে এবং করেও থাকে। এক‌ই সময়ে এক‌ই সঙ্গে একাধিক কাজ করার যোগ্যতা মেয়েদের আছে, কিন্তু সেখানে ছেলেদের কেবল চাকরি করলেই চলে, সংসার এবং সন্তান সামলাবার দায়িত্ব তাদের থাকে না। (ব্যতিক্রম আছে, তবে তা কখন‌ও উদাহরণ হয় না।)

আমি এমন পুরুষও দেখেছি, যারা শুধুই পরিবারের আর্থিক যোগান দেয়, এমনকী বাড়ির রোজকার বাজারটাও তারা করে না। সুতরাং একটা মেয়ে কতটা সামর্থ্য রাখে, সেটা প্রমাণ করার কিছুই নেই, কিন্তু যেহেতু আমরা একটা অসুস্থ সমাজব্যবস্থার মানুষ, যেখানে কেবল একটি চাকুরি করতে পারা অথবা পরিবারে অর্থের যোগান দিতে পারাকেই কেবল যোগ্যতা ভাবা হয়, সেখানে মেয়েদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্ন এলে তাদের সে যোগ্যতা প্রমাণ করাই যৌক্তিক।

আমি এমন খুব কম দেখেছি, যেখানে স্ত্রীর অকালমৃত্যুতে স্বামী আর বিয়ে না করেই একহাতে চাকরি, সংসার এবং সন্তান নিজেই লালন-পালন করেছেন, কিন্তু আমাদের আশেপাশে একবার তাকালেই এমন অজস্র মাকে দেখতে পাবো, যাঁরা স্বামীর অকালমৃত্যুতে নিজের সমস্ত সুখ, এমনকী প্রয়োজনটুকুও বিসর্জন দিয়ে একহাতে পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন এবং সন্তানদেরও একহাতে মানুষ করেছেন।

এই সমাজ, এই সমাজের কিছু মানুষ তারপরও মেয়েদের যোগ্যতা নিয়ে বারে বারে আঙুল তোলে, তাদেরকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেখাতে বাধ্য করে তবেই ছাড়ে! এই সমাজের কাছে মেয়েদের কেবল কিছু কাপুরুষের লোভাতুর দৃষ্টি থেকে নিরাপত্তা চাওয়া ছাড়া আসলে তেমন কিছুই চাওয়ার নেই। যদিও বেঁচে থাকার জন্যেই প্রত্যেকটি নারী এবং পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক করেই গড়ে তোলা হয়েছে, কিন্তু আমরা যেন জোর করে সেটি ভুলে গেছি!

আমরা ভুলে গেছি, যখন তুমি আমাকে নিয়ে আমার গণ্ডির সীমানা নির্ধারণ করতে বসবে, তখন অবশ্যই আমিও সমানভাবে সেটি করার অধিকার রাখি, আর সে অধিকার যখন এপাশ থেকেও আসতে শুরু করে, তখন তোমরাই মেয়েদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলো! খুব বেশি নয়, মাত্র একটি মাস নিজের মা, নিজের স্ত্রী, নিজের বোনটিকে তার যাবতীয় সব কাজ থেকে ছুটি দিয়ে নিজেকে সে জায়গাতে সারভাইভ করিয়ে দেখাও যে একটা নারীর সমকক্ষ তুমি পুরুষও হতে পারো, কেননা এই কাজটাই তোমার স্ত্রী তোমার অকালমৃত্যুতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিনা অজুহাতে করে থাকে!

আমরা আসলে প্রত্যেকটা মানুষই শক্তের ভক্ত নরমের যম। যে তোমার দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে পারে, কিংবা যে মানুষটি সকল অমানবিক কষ্টও সহ্য করে নেয়, তখন তোমরা তার কাছ থেকে এটিই আরও বেশি করে আশা করতে থাকো এবং তোমরা তার এই সহ্য করার, মেনে নেবার কাজটিকে সস্তা বানিয়ে ফেলো। তোমরা বারে বারে তার দিকে কষ্টের এক-একটা বড়ো বড়ো দলা ছুড়ে মেরে মেরে তার কাছে আশা করতে থাকো, সে এটা মেনে নিক, সহ্য করে নিক, কেননা সে এটি পারে! একজন নারী যখন তার সকল চাহিদা বিসর্জন দিয়ে হলেও তোমাদেরকে সুখ এনে দেয়, তখন তোমরা সেটিকে স্বাভাবিক মনে করো। এদিকে নারী বেচারি নিজের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকুও ঝেড়ে ফেলে দেয়।
যখন কোন‌ও নারী তোমার দেওয়া কষ্ট সহ্য করেই যায় এবং একটাসময় ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয় নিজের কাছে, তখন হঠাৎ একদিন প্রতিবাদে গর্জে ওঠে, আর তার এই আকস্মিক প্রতিবাদকে তোমরা স্বেচ্ছাচারিতা নাম দিয়ে দাও! একজন নারী চাইলেই জীবনের যে-কোন‌ও সময় স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে, কেননা এটা তার ব্যক্তিঅধিকার। একজন মানুষ হিসেবে কখনও কখনও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার অধিকার, শুধুই নিজের জন্য বাঁচার অধিকার কেবল পুরুষের নয় বরং একজন নারীসহ প্রত্যেকটি মানুষেরই রয়েছে।