মায়ের জন্য

আমি তোমায় ভালোবাসি।

এর মানে কী? এর মানে হল, আমি তোমার ভালতে বাস করি। ভালোবাসায় মন্দবাসাও থাকে। একটা মানুষের সবকিছু ভাল হওয়া সম্ভব নয়। ভালোবাসায় ভাল দিকগুলোকে পছন্দ করার ব্যাপার থাকে। আমাদের প্রায়ই এরকম মনে হয় না, এত সুন্দর একটা মেয়ে এরকম খ্যাত্টাইপের একটা ছেলের সাথে ঘুরে কেন? হয়, হয়, সবারই হয়। সুন্দরী নারীর অন্য প্রেমিকমাত্রই তো খ্যাত্! পরস্ত্রীমাত্রই তো অপরূপা! খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওই ছেলেটির এমনকিছু ব্যাপার আছে যা মেয়েটি মনেমনে খুঁজছিল। হায়! অবশ্য এমনও হয়, ৭ বছরের ভাললাগার করুণ সমাপ্তি ঘটে ৩ মাসেই; বিয়ের পর। কাছে এলেই দূরের মোহটা কেটে যায়। সেটার কথা না ধরলে, ভালোবাসার সমীকরণ সাধারণত অসংজ্ঞায়িত। সাধারণত ছেলেরা রূপের পূজারি, মেয়েরা গুণের। একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে ভালোবাসে, তখন শুধু মেয়েটার ভালগুলোকেই ভালোবাসে। আর একটা মেয়ে যখন একটা ছেলেকে ভালোবাসে, তখন ছেলেটার ভালমন্দ সবকিছু মিলিয়েই ভালোবাসে। এখানেই মেয়ের ভালোবাসা আর ছেলের ভালোবাসার পার্থক্য।

হ্যাঁ, যে কথায় ছিলাম। ধরুন, এই ছোট্টো একটা টোনাটুনির সংসার। ভালোবাসা যদি থাকেই, তবে ছোটখাট না-পাওয়াগুলোকে ভুলে গেলে কিংবা ভুলে থাকলেই ভাল। এই যেমন, রুটিটা একটু গোলাকৃতি না হলই বা! কী এসে যায় ওতে? গোলরুটি আর এবড়োথেবড়ো রুটি, দুটোর যেকোনওটিই খেলে তো পেট ভরে। এটা কেন বলতেই হবে, অমুক ভাবির বানানো রুটিটা খুব চমত্কার হয়? আপনি কি জানেন, আপনার স্ত্রীর এমনকিছু গুণ আছে যা নিয়ে অমুক ভাবিই প্রচণ্ড ঈর্ষান্বিত? নিজের স্ত্রীর ভাল দিকগুলোর প্রশংসা আপনি নিজে না করলে কেউ না কেউ করবেই, আর সেটা যদি একবার আপনার স্ত্রীর মনে ধরে যায়, তখন কী হবে, ভাবতে পারেন? এভাবেই তো সবকিছু ভেঙে পড়ে। মেয়েরা খুব ছোটছোট সুখ পেয়েও অনেক সুখী হয়। একটা বুদ্ধি দিই, কেমন? বুদ্ধিটা কাজে লাগাতে খরচ হবে মাত্র ২৫-৩০ টাকার মত। আজকেই অফিস থেকে ফেরার পথে পাঁচটি কদম ফুল হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখুন তো কী হয়? বৃষ্টি হচ্ছে তো! প্রকৃতির সব সৃষ্টিতেই কিছু না কিছু ম্যাজিক লুকিয়ে থাকে। হোক রোদ্দুর কিংবা বৃষ্টি! ম্যাজিকটা খুঁজে নিতে জানতে হয়।

অফিস থেকে বের হওয়ার পর থেকে আপনার স্ত্রীকে কতকিছু সামলে রাখতে হয়! কাজের ফাঁকে একটু করে ওই একটু জিবাংলা-স্টারপ্লাস দেখে, রান্নার বইটই নাড়াচাড়া করে, শুধু এটাই মাথায় রাখেন কেন? একটা মেয়ে কি সবসময়ই কাজ করবে নাকি? সবাই যে আবার বইও পড়তে ভালোবাসে না। তো? কী করতে বলেন বেচারিকে? আপনার সাথেও তো ফোনে প্রেম করা যাবে না, আপনি অফিসে ব্যস্ত। অন্যকারওর সাথে প্রেম করলে সেটা কি ভাল হবে? আপনি নিজে যতক্ষণ অফিসে থাকেন, ততক্ষণই কি কাজ করেন? আক্ষরিক অর্থেই? যদি করেন, তবে আপনি একটা বলদ। আপনি বলদ, তাই বলে আরেকজনকেও বলদ হতে হবে কেন?

ছোটবেলা থেকেই আমার মাকে দেখেছি। সত্যি বলছি, মহিলাদের ঘরেবাইরে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, সেটার জন্য পারিশ্রমিক দিতে হলে আপনার স্ত্রীর বেতন হত আপনার বেতনের কমপক্ষে দ্বিগুণ। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে ব্রেকফাস্টটা আর বাসায় ফিরেই কফির মগটা ঠিকমতো পান তো, তাই গায়ে লাগে না আরকি! ধরুন, একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলেন, ঘরময় ধুলো, কিচ্ছু ঝাড়মোছ করা হয়নি, বিছানার চাদরটি এলোমেলো হয়ে আছে, রান্না হয়নি, নাস্তাটাও বানিয়ে খেতে হচ্ছে, আপনার ছোট্টো পুতুলের মতন আদরের মেয়েটির রেশমি চুলগুলো আঁচড়ানো হয়নি, ও ময়লা ড্রেস পরে ঘরময় টুকটুক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেমন লাগবে বলুন তো? এই অস্বস্তি আর বিরক্তির দাম কি আপনার বেতনের চাইতে অনেকগুণ বেশি নয়? এসব ঠিকঠাক করে রাখা কি সহজ কথা? ঘর টিকে থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসায়। আমার নিজের বাসার গল্পই বলি। বাবাকে কোনওদিনও মায়ের রান্নাকে বাজে বলতে শুনিনি। বাবা বলতেন, তোর মা সারাদিন ঘর সামলে রাখে বলেই তো আমি বাইরে কাজ করতে পারি। বাবা মা’কে বলতেন (এবং এখনও বলেন) হোম মিনিস্টার। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। বাসায় শুধু ডাল-আলুভর্তা রান্না করলে যে খাবারের টেবিলে বসে মা’কে জিজ্ঞেস করতে হয়, “আর কিছু নেই?” এটা ছোটোবেলা থেকে কখনওই শিখিনি। বরং মা যে সারাদিন আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এই অসুস্থ শরীরেও ব্যস্ত সময় কাটান, বাবা সেটা অ্যাকনলেজ করতেন বারবার। মায়ের সব কাজের প্রশংসা করতেন। মা ছোটো বাচ্চাদের মতো খুব খুশি হয়ে উঠতেন আর সমস্ত কষ্ট ভুলে বাবার কাছে গল্প করতে বসে যেতেন সারাদিনে কী কী হল। বাবা বলেন, “মেয়েরা বড্ডো ছেলেমানুষ হয়। ওদের মনে কষ্ট দিলে সেটা বহুগুণে ফেরত আসে।” আমার মা একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতেন। এটা করতেন স্রেফ শখে। আমাদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা, বাসার সব কাজ সামলে রাখা, সামাজিকতা ঠিক রাখা, এইসবও মা’কেই করতে হত। আমার মনে হয়, যদি আপনি আপনার স্ত্রীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেন, তবে এর ফল আপনি না পেলেও আপনার ছেলেমেয়ে পাবে। ফ্যামিলিতে যিনি পয়সা আয় করেন না, তিনিও কিন্তু আপনার মতোই টায়ার্ড ফিল করেন। পয়সা আয় করা বা না-করার সাথে ক্লান্তিবোধ করা না-করার কোনও সম্পর্ক নেই। জীবনের ছোটো ছোটো সুখগুলোকে যদি ভালোবাসা দিয়ে উপভোগ করা যায়, তবে জীবনের সব হিসেব তো মিলেই, সাথে বোনাসও মেলে। আমি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। খাবার খেতে ভাল লাগে স্বাদে নয়, ভালোবাসায়। তাই বুঝি সবার মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সবচে’ সুস্বাদু রান্না। যারা অনেকদিনের জন্য ঘরের বাইরে আছেন, তারা তো জানেন মায়ের হাতের মসুরের ডাল আর বেগুন ভাজি খাওয়ার লোভে পৃথিবীর সব ঐশ্বর্যকেও কতো সহজেই গুডবাই বলে দিতে ইচ্ছে হয়!

তো, যেখানে ছিলাম! ভালোবাসায় ছিলাম। মানে ভালতে বাস করায় ছিলাম। জীবনে আমরা যাদেরকে নিয়ে বাঁচি, যা কিছু নিয়ে চলি, এর কিছুই পারফেক্ট না। তবুও এসব নিয়েও খুব সুন্দরভাবে বাঁচা যায়। জীবনটা ছোটো তো! আমরা বাঁচবোই বা আর ক’দিন! আফসোস নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কোথায়? আপনার স্ত্রী যদি চাকরি করেন, তাহলে একটু হিসেব করে মিলিয়ে নিন, উনাকে আপনার তুলনায় অন্তত ৩ গুণ বেশি কাজ করতে হয়। আপনার স্ত্রী সবচাইতে বড় যে কাজটি করেন, সেটি হল উনি আপনাদের সন্তানদের মানুষ করেন। সুসন্তান গড়ে তোলা একজন মানুষের সারাজীবনের সবচাইতে বড় অর্জন। এই মহান কাজটিই করে দেন আপনার স্ত্রী। আপনার ছোট্টো খোকনটি স্কুলে পড়া ঠিকমতো পারে কিনা সে খোঁজ কি কখনও রেখেছেন? ঘরে ভাল রান্না না হলে মাঝেমাঝে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসলে কী হয়? আপনি একটুআধটু ঘরের কাজগুলো গুছিয়ে রাখলে তো গিন্নী ঠিকই থাইস্যুপ রান্না করে দিতে পারে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমার ফিমেল কলিগরা কী যে টেনশনে থাকেন বাচ্চাকে নিয়ে! চাকরির পাশাপাশি সন্তানকে মানুষ করা বড্ডো ঝক্কিঝামেলার কাজ। শিশুর প্রাথমিক জীবনদর্শনের সিংহভাগই গড়ে ওঠে মায়ের জীবনদর্শন থেকে। পৃথিবীর পথে হাঁটতে গিয়ে যে জীবনদীক্ষার প্রয়োজন হয় সেটার গোড়াপত্তন হয় সেই ছোটবেলাতেই, মায়ের কাছে। মায়েরা আমাদের ভাবনার কারিগর। আমি দেখেছি, আমার যদি শরীর খারাপ থাকে, সেটা বাবার আগেই মা কেমন করে জানি টের পেয়ে যায়। আমার ফোন করতে মনে থাক না থাক, মা ঠিকই ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, “বাবা, দুপুরে খেয়েছিস?” আমি অনেকবার দেখেছি, না খেয়ে ‘খেয়েছি’ বললে মা কীভাবে যেন ঠিকই বুঝে ফেলেন। সৃষ্টির সময় স্রষ্টা পুরুষদের এসব ইনট্যুইশন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাননি। ছেলেরা জন্মে মাত্র ২বার: জন্মানোর পর আর বাবা হওয়ার পর। আর মেয়েরা জন্মে ৩বার: জন্মানোর পর, বিয়ের পর আর মা হওয়ার পর। জন্মের দায় আর যন্ত্রণা যে কী তীব্র, সেটা মেয়েদেরকে খুব স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করতে হয়। প্রত্যেকটা মেয়েই ঘর বাঁধার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। এই যে ঘরে-ফেরা’র কথাই ধরুন না কেন! ঘরে মা না থাকলে ঘরে ফেরার আকুতিটা কি থাকত অতো? এই এক নারীই কখনও হরিণীচঞ্চলা প্রেমিকা, কখনও দক্ষ কর্মী, কখনও নিপুণ রাঁধুনি, কখনও স্নিগ্ধ ঘরণী, কখনও ঈশ্বরের প্রতিভূ মা। এ বড় কঠিন কাজ!

গতকাল থেকে আজকে পর্যন্ত অসংখ্য অনুরোধ পেয়েছি, যেন মা দিবসে মা’কে নিয়ে কিছু না কিছু লিখি। বন্ধুদের এই চাওয়াটুকু ফেলা যায় না। আমার লেখার জন্য কেউ প্রতীক্ষা করে আছে, এই তাড়নাটি তীব্র। কালকে ব্যস্ত ছিলাম, তাই আজকে লিখলাম।

পৃথিবীর সকল মা’কে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। মায়েরা খুব ভাল থাকুক।

মা দিবসে আমার একটাই চাওয়া—হে ঈশ্বর! আমার আয়ু থেকে কিছুটা আয়ু আমার মা’কে দিয়ে দিয়ো।

(কোনও এক মা দিবসের পরেরদিন লেখা)