মায়াটান

আমাদের এই জীবনটা আগাগোড়াই একটা গোলকধাঁধা। এখানে অনেক শুদ্ধ অঙ্কেও জের মেলে না, আবার অনেক ভুল জেরেও অঙ্ক মিলে যায়।

পৃথিবীতে যত হিসেবনিকেশ আছে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হিসেব কোনটা জানেন? . . . মায়া।

অর্ধযুগের‌ও বেশি সময় ধরে যে মানুষটি আপনাকে তীব্রভাবে ভালোবেসে বেসে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তাকে কেন কখনও একটুও ভালোবাসতে পারেননি, তার যেমন কোনো হিসেব খুঁজে পান না, ঠিক একইভাবে অর্ধযুগের‌ও বেশি সময় ধরে কেউ একজনকে সবটা উজাড় করে ভালোবেসে শূন্য হয়ে যাবার পর‌ও কেন সে আপনাকে একটুও ভালোবাসতে পারেনি, তার সমীকরণও আপনি কখনোই মেলাতে পারবেন না। 

ভালোবাসা কোনো টু-ওয়ে ট্রাফিকের রাস্তা নয়।

সব কিছুতেই মায়া যেন মাকড়শার জালের মতন আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে; ছিঁড়তে চাইবেন, কিন্তু কী এক অজানা কারণে ছিঁড়বেন না। বন্ধন থেকে বের হতে চেয়ে তড়পড় তড়পড় করবেন, কিন্তু সব কষ্ট সহ্য করেও বের হবেন না। কুয়ায় থেকে যাওয়া ব্যাঙ কিংবা মায়াজালে আটকে পড়া ফড়িঙের মতন একটা বৃত্তের ভেতর পড়ে যাবেন---ওঠার জন্য না পাবেন সিঁড়ি, ওড়ার জন্য না ঝাপটাবেন পাখা। সব বুঝেও অবুঝের মতো ঠায় আটকে থাকবেন।

প্রিয় মানুষটির সব কিছুতেই কী যেন একটা নেশায় বাঁধা পড়ে যাবে জীবন। এই যেমন, তার আধখাওয়া সিগারেটটা কেন আগ্নেয়গিরির মতন ঠেকে, আনমনে ছুঁয়ে দেওয়া হাতের আঙুলের ছোঁয়াটাকে কেন আফিমের মতন নেশা নেশা ঠেকে, আপনি এসবের কোনো সমীকরণ খুঁজে পাবেন না। ভালোবাসা এক চিরঅমীমাংসিত মীমাংসা।

তার দুয়ারে রোজ দাঁড়িয়ে থাকা পোষা কুকুরটাকে কেন এত স্নেহ স্নেহ লাগে, বারান্দায় ঝুলতে থাকা তার ছেঁড়া তোয়ালেটাকে কেন নকশিকাঁথার মাঠ মাঠ লাগে, চায়ের কাপে তার রেখে যাওয়া শেষ চুমুকটিকে কেন পৃথিবীর সুন্দরতম শিশিরবিন্দু শিশিরবিন্দু লাগে, এসবের হিসেব দুনিয়ার কোথাও তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাবেন না। যেখানে সব হিসেব মিলে যায়, সেখানে ভালোবাসা নেই।

মায়া একটা নেশা। ভালোবাসা একটা আসক্তি। দুটোই যখন একইসাথে হয়ে যায়, তখন সেটা হয়ে ওঠে আফিম। একবার এই আফিমের ঘ্রাণ নাকে ঢুকে গেলে পুরো পৃথিবীটাকেই আপনার কাছে পানশালা মনে হবে। সেই পানশালায় শরাবের নয়, রাতদিন জীবনের নেশা চলতে থাকে।

আচ্ছা, মায়া জিনিসটা নেশা, না কি নেশা জিনিসটা মায়া? ভালোবাসলে মানুষ পাগল হয়ে যায়, না কি পাগল হয়ে গেলে পরে মানুষ ভালোবেসে ফেলে?

মানুষ শেষমেশ মায়ায় মরে।