মানুষ জীবনানন্দ

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে?’




কম কথা বলে, কাজে বড়ো হয়ে পৃথিবীতে তাঁর মায়ের কবিতাকে স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন পুত্র জীবনানন্দ। খ্যাতনামা মহিলা কবি কুসুমকুমারী দাশ এবং শিক্ষাব্রতী সত্যানন্দ দাশগুপ্তই হলেন জীবনানন্দর মা-বাবা। বাবার ধ্যানগম্ভীর ভাব ও মায়ের অপার সহনশীলতা, এই দুইয়ের মিশ্রণে গঠিত হয়েছিল কবি জীবনানন্দ দাশের চরিত্র। বোধ হবার আগে থেকেই যে শিশুর ঘুম ভাঙত বাবার কণ্ঠে উপনিষদের আবৃত্তি এবং মায়ের গলায় গান শুনতে শুনতে, সেই শিশু বড়ো হয়ে জীবনানন্দ হবেন, এ আর আশ্চর্য কী!




রবীন্দ্রনাথের পরে প্রধানতম কবি হিসেবে ধরা হয় যে জীবনানন্দকে, সেই জীবনানন্দর ব্যক্তিজীবন যে কতটা নির্মম আর ভাগ্যবিড়ম্বিত ছিল, আমরা আজকের দিনের পাঠকেরা তাঁর ঝাঁ চকচকে বই ওলটাতে গেলে তা বিশ্বাসই করতে পারব না। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে করেও লিখে গেছেন নিজের মতো করে, সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে।




নিজের লেখা প্রচারের পক্ষে তিনি ছিলেন না কখনোই। এমনকী তাঁর নিজের কাছেই নিজের লেখা নিয়ে ছিল প্রচুর সংশয় আর অতৃপ্তি। এ-ও সম্ভব? যে জীবনানন্দর লেখাকে বহু বহু যশস্বী লেখক সাহিত্যচর্চার অভিধান হিসেবে ব্যবহার করেছেন, করছেন, করে যাবেন আজীবনই, সেই জীবনানন্দর ছিল নিজের লেখা নিয়ে সন্দেহ, সংশয়!




এমনকী, লেখা শেষ হবার আগেই বইটা বেরিয়ে যেত যদি, হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যেত---এমন করে ভাবেন যে মহান লেখকগণ, লোকজনকে বিরক্ত করে হলেও নিজের ব‌ইটা হাতে গছিয়ে দিয়ে তা পড়ার ও প্রচার করার জন্য হাতেপায়ে ধরেন যে মহাত্মাগণ, তাঁদের জানাই, জীবনানন্দর বহুল আলোচিত “মাল্যবান” প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর উনিশ বছর পরে। অনেকেই ধারণা করেন, উপন্যাসটি আসলে সূক্ষ্ম ছদ্মবেশে কবির আত্মজীবনীই। এই উপন্যাসটি হয়তো তিনি ছদ্মনামে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। এটি জানা যায় ১৯৫০ সালে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখা তাঁর একটি চিঠি থেকে। তিনি লিখেছিলেন,




‘প্রিয়বরেষু,




আশা করি, ভালো আছেন। বেশি ঠেকে পড়েছি, সেজন্য বিরক্ত করতে হলো আপনাকে। এখুনি চার-পাঁচশো টাকার দরকার, দয়া করে ব্যবস্থা করুন।




এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি। পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাব। আমার একটা উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়, ছদ্মনামে) পূর্বাশায় ছাপতে পারেন; দরকার বোধ করলে পাঠিয়ে দিতে পারি। আমার জীবনস্মৃতি আশ্বিন কিংবা কার্তিক থেকে মাসে মাসে লিখব। সবই ভবিষ্যতে, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই–আমাদের মতো দু-চারজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এরকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার-বিবেচনা অনেক দিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন–সেজন্য গভীর ধন্যবাদ।




লেখা দিয়ে আপনার সব টাকা শোধ করে দেবো–নাহয় ক্যাশে। ক্যাশে শোধ করতে গেলে ছ-সাত মাস (তার বেশি নয়) দেরি হতে পারে…’




ধারণা করা যায়, এটি তিনি “মাল্যবান” প্রসঙ্গেই লিখেছিলেন। কারণ এটির বিষয়বস্তু আত্মজৈবনিক। সেটি পাঠকের কাছে প্রকাশ না করার জন্য তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।




ভাবুন, ভাবতে শিখুন! লেখক হবার স্বপ্নে বিভোর থাকতে থাকতে বেআক্কেল হয়ে বসবেন না যেন!




কবি ছিলেন তাঁর বড়ো মামা প্রিয়নাথ দাশগুপ্তর অতি প্রিয়। তিনিই কবিকে দীঘির জলে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন আকাশের তারার সঙ্গে পরিচিত হতে। তিনি যখনই নৌকো করে কোথাও যেতেন, কবিকেও সঙ্গে নিতেন। তাই ছোটোবেলা থেকেই বরিশালের গ্রাম, প্রকৃতি, নদীর সাথে পরিচিত ছিলেন কবি। কবির কবিত্বের অভিষেক হয়তো সেই তখন থেকেই।




নিজের ছাত্রদের প্রতি জীবনানন্দর ভালোবাসা ছিল আকাশছোঁয়া। প্রতিদিন দলে দলে ছাত্র-ছাত্রী তাঁর কাছে আসত, এবং হাসিমুখে ফিরে যেত। এ নিয়ে কিছু বললেই কবি উত্তর দিতেন, ‘এরাই তো আমাদের ভবিষ্যতের আশাভরসা। এদের ভেতর দিয়েই তো আমি বেঁচে থাকব। এদের কি ফেরাতে পারি?’




ওরা কবিকে বাঁচিয়ে রেখেছে কি না জানি না, তবে কবির দুর্দশার দিনে ওদের মধ্যে তেমন কেউই কবির পাশে দাঁড়িয়ে কবিকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেনি বলেই জানি। বাঙালিঘরের সন্তান বলে কথা!




জীবনানন্দ দাশের শুধু যে প্রতিভার মূল্যায়ন হয়নি, তা নয়, তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়‌ই কাটিয়েছেন প্রবল অর্থকষ্টে। পেয়েছেন স্ত্রীর অবহেলা, তাচ্ছিল্য। জীবনসঙ্গিনীর এত তীব্র অবহেলা সহ্য করেও জীবনানন্দ হয়ে ওঠাটা হয়তো অন্য কারুর পক্ষেই সম্ভব হতো না। সবকিছু অগ্রাহ্য করেও লিখে যেতে পেরেছেন বলেই বোধ হয় মানুষটি জীবনানন্দ।




আমার কাছে মনে হয়, তাঁর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে নিশ্চয়ই হারিয়ে যেতেন। একজন অসীম প্রতিভাবান মানুষ, যিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় বেকার ছিলেন, দেখতে খুব বেশি সুশ্রী ছিলেন না, এমনকী খুব সুন্দর করে কথাও বলতে পারতেন না। আবার সেই দুর্ভাগা মানুষটিই ট্রামের নিচে চাপা পড়ে মারা যান!




অবশ্য সেসময়কার অনেকেরই জোর দাবি যে, জীবনানন্দ আসলে আত্মহত্যাই করেছিলেন।




জীবনানন্দর প্রতি তাঁর স্ত্রী, আত্মীয়স্বজনের অবহেলার কিছু নমুনা দিই।




জীবনানন্দ সবসময়ই তাঁর স্ত্রীকে উপেক্ষা করতেন, এবং তাঁর স্ত্রীও তাঁকে উপেক্ষা করতেন। জীবনানন্দ দাশ উৎকৃষ্ট স্বামী ছিলেন না, উৎকৃষ্ট পিতাও ছিলেন না। তিনি তাঁর স্ত্রীকে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে জীবনানন্দ সংসার চালাতে যে অক্ষম, এটা বোঝাতে তাঁর স্ত্রী ভালোবাসতেন।




প্রতিভার বিচারে আমাদের মতন অপদার্থ স্বামীকে আমাদের স্ত্রীরা যতটা গ্রাহ্য করে, তা যে কতটা বেশি, আসুন, এক বার ভেবে দেখি!




জীবনানন্দর মৃত্যুর পর পরই তাঁর স্ত্রীর সেই সময়কার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভূমেন্দ্র গুহ "বিশ্বভারতী" পত্রিকায় লিখেছেন-




'এক সময়ে জীবনানন্দর স্ত্রী লাবণ্য দাশ আমাকে ঝুলবারান্দার কাছে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, অচিন্ত্যবাবু এসেছেন, বুদ্ধবাবু এসেছেন, সজনীকান্ত এসেছেন, তা হলে তোমার দাদা নিশ্চয়ই বড়ো মাপের সাহিত্যিক ছিলেন; বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেককিছু রেখে গেলেন হয়তো, আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো!'




জীবনানন্দর মৃত্যুর পরে শ্রদ্ধাবাসরে রাখার জন্য তাঁর একখান মানানসই ছবি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিল না কোনও আত্মীয়ের কাছে, এমনকী তাঁর বোনের কাছেও না। (ছবির অথ‌ই সমুদ্রে ভাসতে-থাকা এখনকার কবিরা অবশ্য মৃত্যুপরবর্তী এই ঝামেলা থেকে মুক্তির রাস্তা আগেই করে রেখেছেন সযত্নে।) লাবণ্য দাশের কাছে ছবির কথা জানতে চাইলে তিনি অবজ্ঞার সুরে ভূমেন্দ্র গুহকে বলেন, ‘মনে পড়ছে, আমার কাছে নেই অন্তত, তা ছাড়া ওই ছবি-টবি তোলানো-টোলানো নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা কোনোদিন বিশেষ ছিল না। তোমাদের দাদা দেখতেও তো এমন কিছু রাজপুত্তুর ছিলেন না।’




জীবনানন্দর ব্যক্তিজীবন নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক। জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিজীবনের নানান দিক উঠে এসেছে, এমন একটি বই “মানুষ জীবনানন্দ”; আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।