একটা বাংলা সিনেমার নাম: মন বসে না পড়ার টেবিলে (২০০৯)। এই কথাটি সব স্টুডেন্টেরই একেবারে মনের কথা! কিন্তু যে করেই হোক, পড়ার টেবিলে মনকে যে বসাতেই হবে! পাশ করতে হবে না? কোনো চিন্তা নেই, আমাদের গুরুর আসনে আছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। গীতার ২/৪০ নং শ্লোকে ভগবান বলছেন:
নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।।
নেহাভিক্রমনাশোহস্তি—”যোগবুদ্ধির এই মহান পথে অসম্পূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টা নষ্ট হবার কোনো ভয় নেই।” আপনি কিছু কাজ আরম্ভ করলেন; কোনো-একটা পরিস্থিতিতে সে কাজ স্থগিত রাখতে হলো। আবার যখন সে কাজে ফিরে আসবেন, তখন আপনাকে গোড়া থেকে আরম্ভ করতে হবে না—যদিও জীবনের বহুক্ষেত্রে গোড়া থেকেই আরম্ভ করতে হয়, যেমন সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বেলায়।
সাধারণত কোনো ধর্মানুষ্ঠান আরম্ভ করে অর্ধসমাপ্ত রাখলে, ফিরে এসে বাকি অর্ধেকটা সম্পন্ন করা যায় না; আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। তবে কর্মযোগের পথে সব কাজের ফল জমা হতে থাকে। যা যতটা শেষ হয়, ততটা থেকে যায়। তাই যতটা পারা যায় শেষ করুন, তারপর ফেলে রাখুন; আবার কিছুকাল পরে ফিরে এসে, কাজ যেখানে ফেলে রেখেছিলেন, তার পর থেকে করে যেতে পারেন, তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। তবে শুরুটা কিন্তু করতেই হবে, শুরু না করলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কাজ করে যান, আরও করে যান, পথে ক্লান্তি বা অন্য ব্যস্ততা এলে থেমে যাবেন (একটু ব্রেক নেবেন), তাহলেই হবে। নিজেকে এভাবে একটু একটু করে গড়তে গড়তে মানুষ একসময় মানুষ হয়ে ওঠে। মানুষের মনের শক্তি ঠিক এই প্রক্রিয়ায় ক্রমেই পোক্ত হয়। আপনি কিছুটা করলেন, আপনার চরিত্রের কিছুটা গঠিত হলো; তারপর আপনাকে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে হলো, কিছু সময়ের জন্য আগের কাজের তাড়না ভুলে গেলেন; ফিরে এসে আবার আরম্ভ করলেন। এ নিয়ে ভগবান অভয়বাণী দিচ্ছেন: কোনো অসুবিধে নেই, ওতেই কাজ হবে। (তবে কাজে ফিরতে হবে, না ফিরলে কিন্তু সব শেষ।)
এই শ্লোক আরও শেখাচ্ছেন: এ পথে আরব্ধ কর্ম নিষ্ফল হয় না এবং কাজের ভুলের জন্য কোনো মন্দ ফলও হয় না। শ্লোকের শেষে রয়েছে এক অসাধারণ প্রতিশ্রুতি: এই ধর্মের (যার যা কাজ, তা-ই তার ধর্ম) এতটুকু পালন করলেও এই জীবনদর্শন আমাদের মহাভয় থেকে রক্ষা করে।
চরিত্র বা মনের শক্তি গঠন এক দিনের কাজ নয়। লেগে থাকতে হয়, ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়—এভাবেই একদিন উদিত হয় এক মহান চরিত্রসূর্য, এক দৃঢ় চরিত্র; এ সবই হবে, তবে একটু সময় লাগবে। এর জন্য যে-কোনো মূল্যে ধৈর্য ধরে রাখতে হবে, পরিস্থিতি যেমনই হোক।
শ্রীকৃষ্ণ আশ্বস্ত করছেন: অসমাপ্ত চেষ্টা বিফলে যায় না; ইহলোক ত্যাগ করার আগে যা করেছ (অর্থাৎ সংস্কার), তা তোমারই (চিত্তে) থাকে। ফিরে এসে, যেখানে ছেড়ে গিয়েছিলে, সেখান থেকে আরম্ভ করো—হোক তা পরবর্তী সময়ে, হোক তা পরবর্তী জন্মে।
বাস্তবে, এই অল্পের জন্যও অধিকাংশ মানুষই চেষ্টা করেন না। ভগবান বলছেন, “তোমার সামর্থ্য ও শক্তি অনুসারে সামান্য কিছু করার জন্য প্রযত্ন করলেও, শেষমেশ তোমার মঙ্গল ও কল্যাণ হবে।” মানুষ বড়ো কিছু করতে চায়, অথচ শুরুটাই (সামান্য কিছু করার মধ্য দিয়ে) করতে পারে না। শুরু করার সাহস ও তাগিদ জরুরি, এমনকী জ্ঞানের চেয়েও জরুরি।
বুদ্ধির সাহায্যে মানুষ তার সমগ্র জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে থাকে। ভগবান তাই সেই বুদ্ধির প্রকারভেদ সম্পর্কে একটা পরিচয় দিচ্ছেন। ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি—দৃঢ়সঙ্কল্পযুক্ত বুদ্ধি। সাধারণ মানুষ একটু সমালোচনায়, একটু প্রতিকূল বা বিরুদ্ধ পরিবেশে—কাজে নেমেও পিছিয়ে যায়। লেগে থাকা, অর্থাৎ যত বাধাই আসুক না কেন, কাজ থেকে না পালানোই হচ্ছে ‘ব্যবসায়াত্মিক বুদ্ধি’। এর জন্য গীতার ৬/৩৫-৩৬ নং শ্লোক দুটির মর্মার্থ অনুসারে কাজ করতে পারেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কী শেখাচ্ছেন এখানে? দেখা যাক।
মনের কথা না শুনে ইন্দ্রিয়-সংঘাতকে (বাহ্যিক কর্মপ্রচেষ্টাকে) অবলম্বন করে—ইচ্ছে করুক না করুক, জোর করে হলেও কাজটা করে যেতে হবে। মনকে বিক্ষিপ্ত করে দেয় যা-কিছু (মোবাইল, ল্যাপটপ, প্যাড-সহ সকল ধরনের ডিভাইস, এমনকী অপ্রয়োজনীয় বস্তুগত স্মৃতি বা কারও সাহচর্য)—কাজ করার সময় সেগুলিকে চোখের সামনে থেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন। এমনি করে দুই সপ্তাহ প্রয়োজনীয় কাজটিতে নিজেকে (জোর করে) দীর্ঘসময় ধরে বেঁধে রাখুন, ডুবিয়ে রাখুন—মরতে মরতেও হাল ছাড়বেন না। (কর্মহীনতা আর মৃত্যুর মধ্যে তফাত আর অমন কী!) এই চর্চাটি মাত্র পনেরো দিন করে যদি কিছু না হয়, তবে আমার অফিসে এসে আমাকে আপনার সময় নষ্ট করার দায়ে জুতোপেটা করে যাবেন।
স্টুডেন্টদের উদ্দেশে বলছি। জীবনে ভালো কিছু করার জন্য ২/৪০, ৬/৩৫, ৬/৩৬ শ্লোকগুলো খুব বেশিই সাহায্য করে। পড়াশোনা নিয়ে (মন না চাইলেও, জোর করে হলেও) নিত্য-অভ্যাসের মাধ্যমে কয়েক গুণ বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ো। স্থির থেকো না, উঁচুতে ওঠো। মনকে বেশি পাত্তা দিলে মন রীতিমতো ঘাড়ে চেপে বসে! মন তো তোমাদের পাড়ার সবচাইতে ফাজিল ছেলেটার চাইতেও ফাজিল! মনকে পাত্তা না দিয়ে অপ্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে নির্বিকার ও নির্লিপ্ত থেকে নিজকাজে (অর্থাৎ ধর্মে) প্রবৃত্ত হয়ে থাকার নামই বৈরাগ্য।
পড়তে ইচ্ছে করে না? করবে কেন? ইচ্ছে করেই-বা কার কবে? ইচ্ছে করার দরকার নেই; মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে পনেরো দিন কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা টেবিলে আটকে রাখো। ওই সময়ে চোখের সামনে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস রাখা যাবে না। ঘরে দড়ি নেই? না, না, ওটা গলায় দিতে বলছি না; বরং বলছি, দরকার হলে নিজেকে দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখো। যে যা বলে বলুক। (তুমি খেতে না পেলে কে খাওয়াবে? কতদিন খাওয়াবে? এ জগতে বিনা কারণে কে কাকে খাওয়ায়, বলো!) চেয়ার ছেড়ে ওঠা যাবে না, কেবল বাথরুম পেলে তবেই উঠবে। পড়াশোনা কোনো ফাজলামো করার জিনিস নয়।
এ ব্যাপারটি আরও একটু বুঝিয়ে বলার জন্য ‘কথামৃত’ থেকে উদ্ধৃত করছি।
“তীব্র বৈরাগ্য কাকে বলে, একটি গল্প শোনো। এক দেশে অনাবৃষ্টি হয়েছে। চাষীরা সব খাল কেটে দূর থেকে জল আনছে। একজন চাষার খুব রোখ আছে; সে একদিন প্রতিজ্ঞা করল, যতক্ষণ না জল আসে, খানার সঙ্গে নদী এক হয়, ততক্ষণ খানা খুঁড়ে যাবে। এদিকে স্নান করার বেলা হলো। গৃহিণী তখন মেয়ের হাতে তেল পাঠিয়ে দিল। মেয়ে বলল, “বাবা! বেলা হয়েছে, তেল মেখে নেয়ে ফেলো।” সে বললে, “তুই যা, আমার এখন কাজ আছে।” বেলা দুই প্রহর একটা হল, তখনও চাষা মাঠে কাজ করছে। স্নান করার নামটি নাই। তার স্ত্রী তখন মাঠে এসে বললে, “এখনও নাও নাই কেন? ভাত জুড়িয়ে গেল, তোমার যে সবই বাড়াবাড়ি! নাহয় কাল করবে, কি খেয়ে-দেয়েই করবে।” গালাগালি দিয়ে চাষা কোদাল হাতে করে তাড়া করলে; আর বললে, “তোর আক্কেল নেই? বৃষ্টি হয় নাই। চাষবাস কিছুই হলো না, এবার ছেলেপুলে কী খাবে? না খেয়ে সব মারা যাবি! আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, মাঠে আজ জল আনব, তবে আজ নাওয়া-খাওয়ার কথা কবো।” স্ত্রী গতিক দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেল। চাষা সমস্ত দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, সন্ধ্যার সময় খানার সঙ্গে নদীর যোগ করে দিলে। তখন একধারে বসে দেখতে লাগল যে, নদীর জল মাঠে কুলকুল করে আসছে। তার মন তখন শান্ত আর আনন্দে পূর্ণ হল। বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললে, “নে, এখন তেল দে আর একটু তামাক সাজ।” তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে নেয়ে খেয়ে সুখে ভোঁসভোঁস করে নিদ্রা যেতে লাগল! এই রোখ তীব্র বৈরাগ্যের উপমা।”
“আর-একজন চাষা—সে-ও মাঠে জল আনছিল। তার স্ত্রী যখন গেল আর বললে, “অনেক বেলা হয়েছে, এখন এসো, এত বাড়াবাড়িতে কাজ নাই।” তখন সে বেশি উচ্চবাচ্য না করে কোদাল রেখে স্ত্রীকে বললে, “তুই যখন বলছিস তো চল!” (সকলের হাস্য) সে চাষার আর মাঠে জল আনা হলো না। এটি মন্দ বৈরাগ্যের উপমা।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ১৪ ডিসেম্বর ১৮৮২)
…থাকতে হয়, মানুষ হতে চাইলে প্রথম চাষীটির মতন অমন তীব্র রোখ বা জেদ থাকতে হয়। ফালতু জেদে জেদি হয়ে, আর যা-ই হোক, মানুষ কিছুতেই হওয়া যায় না। কাজ থেকে আমাদেরকে সরিয়ে নেবার লোকের তো অভাব নেই, বরং আশেপাশে এমন লোকই ভূরি ভূরি। এখানে আমাদের ভূমিকা কী? স্বভাবকবি ও পাঁচালিকার দাশরথি রায়ের লেখা শ্যামাসংগীতে এর উত্তর পাই: “দোষ কারও নয় গো মা, আমি স্বখাতসলিলে ডুবে মরি, শ্যামা।” হ্যাঁ, সব দোষ আমাদেরই। (সচেতনভাবে বা বাহ্যিকভাবে—মনে মনে নয়) আমরা যা শেষ করার চেষ্টা করি না, তা শেষ হবে কি হাওয়া থেকে? মন তো চাইবেই পালাতে, মনের কাজই যে পালানো! মন পালাতে চাইল, আর অমনিই আমি লেজ তুলে পালালাম! মনকে নিজের চৈতন্যের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না যে, সে আবার কীসের মানুষ?
ফাঁকিবাজের দল যেন অপেক্ষাই করে থাকে, কেউ এসে একটু বলুক, “এখন থামো তো! অনেক খেটেছ, এবার একটু জিরোও!” মন তো ফাঁকিবাজির দিকে, তাই কাজ ছেড়ে পালানোর অজুহাত খোঁজে। ফাঁকিবাজের মন গদগদ হয়ে তাকে বলে, “আহা, তুমি তো পালাতে চাওনি! ও এসে বলল বলেই তো পালালে! এখানে তোমার কী দোষ? আর শরীরেরও তো একটু বিশ্রামের প্রয়োজন, তাই না?” মনের অজুহাত শুনে তার খুশি যেন আর ধরে না! শরীরের আগেই মনকে সে বিছানায় (ঘুমোতে) পাঠিয়ে দেয়। নিজের অজান্তেই তার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে…আহা, এক্কেবারে মনের মতো মন!
নিষ্ঠার সঙ্গে, নিজের ব্যক্তিগত ও দৈহিক সুখকে প্রাধান্য না দিয়ে, কাজে লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই আসবে। আর এই বুদ্ধিটা—যে-কাজ কর্তব্য বলে একবার গ্রহণ করা হয়েছে, শত বাধাবিপত্তি এলেও প্রথম কৃষকটির মতো নিরলসভাবে সেই কাজ করে যাবার বুদ্ধিকেই বলা হয় ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি। বাস্তবিক পক্ষে, এটাই কাজের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। গীতা আমাদেরকে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিই গ্রহণ করতে বলেছেন।
এমন ইতিবাচক ভাবের অপর নাম আত্মশ্রদ্ধা। নিজের উপর বিশ্বাস রাখা—আমি পারব, পারবই পারব—শত বাধা এলেও এই ভাবটা ধরে রাখা। যে নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাস করে না, তার ভগবানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছুই এসে যায় না। নিজের শক্তিতে ভর করতে জানতে হয় সবার আগে—ওটা হয়ে গেলে, বাকি সব আপনাআপনিই হয়ে যায়। কাজ করতে জানা বড়ো কথা নয়, সকল আলস্য ও বাধা ঠেলে নিজেকে কাজে নামানো ও খাটানোই সব কিছু। জানার লোকের চাইতে তাই কাজের লোকের কদর সবসময়ই বেশি।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আত্মশ্রদ্ধা যেন যৌক্তিক হয়। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোয়, এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে সময় কাটায়, ব্রেইনের গ্রে-ম্যাটারকে সিন্দুকের ভেতরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে—এমন লোকের আত্মশ্রদ্ধা, নির্বুদ্ধিতারই নামান্তর। মানুষ আজ বই দেখে না, অন্য মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না, কাছের মানুষদের সময় দেয় না—এমনকী নিজেকেও সময় দেয় না, সারাক্ষণই মোবাইলের দিকে সমস্ত ধ্যানজ্ঞান সমর্পণ করে রাখে। আবার এদের মাঝে এমন অনেককেই পাবেন, যাদের আত্মশ্রদ্ধা দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই রীতিমতো এপিক লেভেলের! নির্বোধের আত্মশ্রদ্ধার চেয়ে বরং জ্ঞানীর আত্মনিগ্রহই উত্তম।
গীতায় এই পার্থিব মনুষ্যজীবনকে খুব বড়ো করে দেখানো হয়েছে। এ কারণেই গীতার সকল উপদেশ সবকালে, সবধর্মে (সম্প্রদায়ে) ও সবদেশে সবসময়ই প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে (এবং যাবে)। আমাদের এই মূল্যবান আয়ুটি ক্ষয় করতে হবে সুষ্ঠুভাবে কর্ম করে, আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন হয়ে। যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ও ধনুর্ধর অর্থাৎ কর্মযোগী অর্জুন, সেখানে শ্রী ও জয় উভয়ই সুনিশ্চিত। গীতাকে গুরু মেনে, আপেক্ষিক বিচারে অর্থাৎ—ইন্দ্রিয় থেকে অন্তঃকরণ, অন্তঃকরণ থেকে জীবাত্মা ক্রমে—নিজের জীবাত্মাকে গীতার শিষ্য হবার উপযুক্ত করে তুলতে পারলে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো দর্শনের দ্বারস্থ হতে হয় না।
(জীবাত্মা পরম দ্রষ্টা বিধায় জীবাত্মাকে প্রকৃতপক্ষে শিষ্য করা যায় না, যেমনি ‘সূর্য আলো দেয়’ কথাটি সত্য হয় না। সূর্য সচেতনভাবে আলো দেয় না, সূর্য আলোর (পরম বা চূড়ান্ত) উৎস (সূর্যের বৈশিষ্ট্যই ওটি; সূর্যের আলোতে যা যা প্রকটিত হয়, সেগুলিকে দেখলে মনে হয়, সূর্য আলো দিল বলেই তো ওসব দেখতে পাচ্ছি। ‘সূর্য আলো দেয়’ বললে তার বিপরীত সিদ্ধান্ত ‘সূর্য আলো দেয় না’ নিয়েও ভাবতে হয়, যা বাস্তবিক বিচারে অসম্ভব—যেহেতু, যার পক্ষে করা সম্ভব, তার পক্ষে না করাও নিশ্চয়ই সম্ভব—তাহলে সূর্য আলো দেয় কী করে? চাঁদ আলো দেয়—এটা বলা যায়, কেননা চাঁদ আলোর আপেক্ষিক উৎস (পরম বা চূড়ান্ত উৎস নয়); চাঁদের আলোর উৎস সূর্য। সূর্য থেকে আলো না এলে চাঁদ আলো দিতে পারে না।)—বোঝার সুবিধার্থে সূর্যের উপর আপাতকর্তৃত্ব আরোপ করা হয়—যেমনি ব্রহ্মের উপর আপাতসাক্ষিতা আরোপিত হয়।)
২/৪০, ৬/৩৫, ৬/৩৬—গীতার এই শ্লোকগুলো মুখস্থ নয়, বরং আত্মস্থ করে অর্থাৎ তাৎপর্য খুব ভালো করে বুঝে নিজের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে হবে ঠিক সেভাবে, যেভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (২/৩ নং শ্লোকে) সখা পার্থকে আত্মশ্রদ্ধায় উদ্দীপিত করেছিলেন: “এমন নিষ্ক্রিয় (দুর্বল) আচরণ (মনোভাব) তোমাকে মানায় না।” এই শক্তিদায়ী ভাবটিই গীতার প্রাণ। এই ভাবের জাগরণই চৈতন্যের জাগরণ।
শেষকথা। এই লেখায় গীতার চারটি শ্লোকের দর্শন সম্পর্কে বলার চেষ্টা করেছি। শ্লোক চারটি তাৎপর্য-সহ ভালোভাবে বুঝে বার বার অধ্যয়ন করলে এবং সে অনুযায়ী কাজ করলে নিজেকে ইতিবাচকভাবে বদলে ফেলা সম্ভব।