ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯৪তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো বায়ান্ন

………………………………………………………

(আমার এই ফেসবুক স্ট্যাটাসটিকে নোট করে রেখে দেয়ার আসলে কিছু নেই। তবুও পোস্টটিতে লাইকের সংখ্যা আর কমেন্টের ধরন দেখে মনে হল, লেখাটি বোধ হয় ভালই হয়েছে, এটিও হারিয়ে না যাক। আমি কী লোভী, না? লোভীই তো! কেউ আমার পোস্টে লাইক না দিলে কিংবা লেখা ভাল হয়েছে, এমনটা না বললে, লিখতাম কি কখনওই? বন্ধুরা ভাল বলে, ভালোবেসে হোক কিংবা না বেসে হোক, লাইকটাইক দেয়, শেয়ার করে, আমার লেখা নিয়ে কথা বলে, শুধু সেজন্যেই তো লিখি। যদি কোনদিন এমন হয়, কেউ চাচ্ছে না, আমি লিখি, সেদিন থেকে আর লিখব না। আরও অনেকের মতই, আমিও কমেন্ট, লাইক আর শেয়ারের লোভে লিখি।)

গত দুইদিনে একটা ব্যাপার খুব গভীরভাবে মনে গেঁথে গেছে। আমি খুব সম্ভবত খুব হাসিমুখে মারা যাব। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও যতই যন্ত্রণা হোক না কেন, একটুও কাঁদব না, এমনকি মনখারাপও করব না। আমি এতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি, এটা কবে শেষবার মনে হয়েছিল, তা মনে নেই।

আমি অবশ্য বরাবরই অসুস্থ শরীরে হাসতে অভ্যস্ত। চারপাশের মানুষকে যন্ত্রণায় রাখার ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, আমার সব কষ্টের জন্য একমাত্র আমিই দায়ী। খুব জ্বর, এই যেমন ১০৩, ফেসবুকে হাসিখুশি টাইপ লেখা দিচ্ছি, এরকমটা অনেকবারই হয়েছে। ফেসবুকে, ভাল নেই, বলে কী হয়? কিচ্ছু হয় না। কমেন্টবক্সের দোয়া কমেন্টবক্সেই মিলিয়ে যায়।

বেশিদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা কখনওই আমার মধ্যে ছিল না, এখনও নেই। আসলে বেশিদিন বেঁচে কী হয়? তার চাইতে বরং হাসিমুখে সবার সাথে মিলেমিশে ছোট্ট একটা জীবন কাটিয়ে চলে যাব। বেঁচে থাকার সময়টাতে খুব করে বাঁচব, আফসোসটাফসোস থাকবে না কিংবা কম থাকবে। তবে মরে যাওয়ার সময় কিছু আফসোস থেকেই যাবে। এই যেমন, আরও কিছু বেশি বই না-পড়তে পারার, আরও কিছু ভাল মুভি দেখতে না-পারার, আরও কিছু ভাল সুরে ভাসতে না-পারার, আরও কিছু সুন্দর জায়গায় ঘুরতে না-পারার, কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসা কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিতে না-পারার, আরও একটুখানি নিজের মত করে না-বাঁচার, আরও কিছু কম মানুষের মনে কষ্ট দিতে না-পারার, সত্যিই ভালকিছু লিখে যেতে না-পারার, ভাললাগার মানুষগুলোকে ‘ভাল লাগে’ বলতে না-পারার, চাকরিটা আরও একটু কম করে না-করার, এরকমকিছু। হয়তোবা মৃত্যুর আগের খাবারটা খাওয়ার সময়েও কিছু ঠাট্টা করে যাব। কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না। ঘুমের মধ্যে মরে গেলে বেশ হয়। আমিও কষ্ট পাব না, অন্যরাও পাবে না। সবাই ঘুম ভেঙে দেখবে, আমি নেই। মজার না? আমি বেঁচে থাকার সময়ে আমাকে নিয়ে অন্যদের কষ্ট দেখতে রাজি নই।

গত পরশু মাঝরাতে ঘাড় থেকে পিঠের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথায় ঘুমুতে পারিনি। ব্যাকপেইন যে কী জিনিস, এটা যার ওটা কখনও হয়নি, সে কিছুতেই বুঝবে না। আমার পেইনটা এর আগেও হয়েছে দুএকবার, তবে পরশুরটার মত তীব্র কোনটাই ছিল না। আমি কায়িক শ্রম করি না অত। আমার পেইন হয়েছে স্নায়বিক কারণে। গত বৃহস্পতিবার অনেকবেশি লেখালেখি করতে গিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসেছিলাম অন্তত ১২-১৪ ঘণ্টা। কী কষ্ট কী কষ্ট! চোখের কষ্ট, স্নায়ুর কষ্ট, মনের কষ্ট, শরীরের কষ্ট! তবুও লিখতে শুরু করলে, একবার লেখার ভূত ঘাড়ে চেপে বসলে, উঠে যাওয়াটা লেখালেখির শারীরিক ও মানসিক কষ্টের চাইতেও বেশি কষ্টকর। যারা লিখে না, শুধু পড়ে কিংবা চুরি করে, ওরা এটা কোনভাবেই বুঝবে না। লিখতে যে সে কী ভীষণ কষ্ট, সেটার কিছুমাত্র খোঁজও ওরা জানে না। সেদিন বারবারই মনে হচ্ছিল, পুরো শরীরমন অবশ হয়ে যাচ্ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, এই বুঝি মাথাঘুরে পড়েটড়ে যাব; তবুও লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মনের খেয়ালে শরীরের দাবি মেনে না নিলে শরীর কখনও কখনও এতটা ভীষণভাবে বিদ্রোহ করে বসে, এটা এর আগে এতটা তীব্রভাবে শেষবার কবে বুঝেছি, ঠিক মনে পড়ে না।

মজার ব্যাপার হল, পরশু রাতে ঘাড় আর পিঠের ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছি, চোখের জলে বালিশ ভিজছে, অথচ আমি নিজের মনে হাসছিলাম আর শুধুই হাসছিলাম। মা-বাবা কিংবা আমার ছোটভাই কাউকেই ডাকতে ইচ্ছে করছিল না, অবশ্য আমি ওরকম ডাকিও না; মনে হচ্ছিল, কষ্টটা কেমন, দাঁতে দাঁত চেপে একটু দেখি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। খাট থেকে নেমে অ্যাটাচড বাথরুমে যেতে সময় লেগেছিল অন্তত ১৫ মিনিট। তবুও মনে হচ্ছিল, এটাও তো জীবনের একটা অংশ! জানালাটা খুলে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম, আর ব্যথায় কাঁদছিলাম। আমার হাসিমাখা মুখ দেখে রাগেক্ষোভে কিনা জানি না, শরীরটায় বিদ্রোহ একেবারে জেঁকে বসেছিল সে রাতে। এভাবে করে আর ঘুমাতে পারিনি। সকালে মা রুমে এলে হাসিমুখেই বললাম যন্ত্রণার কথা। ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। কিছু ওষুধ দিলেন, সাথে ঘাড় আর পিঠে গরম রসুন-সরিষার তেল দিয়ে ম্যাসাজ, এবং শুকনো গরম টাওয়েলের সেঁক। আমার ছোটভাইই ম্যাসাজ করে দিচ্ছিল, মায়ের গায়ে এখন আর অত শক্তি নেই। ছোটভাই ম্যাসাজ করে দিচ্ছে, মা পাশে বসে আমার কপালে-চোখেমুখে চুমু খাচ্ছে, আর আমি কী এক সংকোচে অনবরত হাসছিই তো হাসছি, এরকমটা হচ্ছিল। আমার ব্যথার চাইতেও ওদের ব্যথাটাই বেশি কষ্ট দিচ্ছিল আমাকে। বাবা বারবার বলছিলেন, বাবা, তুই খুলনাতে মঙ্গলবারে জয়েন করিস না, দুদিন পর কর। মা বলছিলেন, খবর্দার, ফেসবুকে বসবি না! তোকে আর কখনও কিছু লিখতে হবে না। আমার মহাফাজিল ছোটভাই বলল, আহা মা, ওকে কিছু বলো না। ও না লিখলে লোকে চুরি করবে কীভাবে? আর ও লোকজনকে গালাগালি করে মাথাটা খারাপ করবে কীভাবে? আমি শুধুই হাসছিলাম আর হাসছিলাম; মাঝেমাঝে ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে আমার ছোটভাইকে বলছিলাম, পাপ্পু, পরেরবার টাওয়েলটা ওভেনে ৩০ সেকেন্ড কম রাখবি, কেমন? চামড়া পুড়ে যাচ্ছে তো! ও বলল, চুপ থাক! তোকে এরকম খ্যাঁকখ্যাঁক করে গাধার মত হাসতে কে বলসে?

জীবনটা আসলেই এতটা খারাপ লাগত না যদি পরিবারকে আরও একটু বেশি সময় দেয়া যেত! খুব অসুস্থ হয়ে গেলে আর কে-ই বা পাশে থাকে? জ্বরে প্রলাপ বকতে থাকলে, পরিবার ছাড়া আর কে-ই বা কাঁদে? আর যারা আমার মত আত্মসংবৃত মানুষ, তারা তো কাউকে বলতেই পারবেন না, আপনি অসুস্থবোধ করছেন। একমাত্র আপনার পরিবারই বুঝতে পারবে, আপনি ভাল নেই। বাকিরা জানতে পারলে বরং বিরক্ত হবে, কেউ কেউ সহানুভূতি দেখাবে অবশ্য। কেউ আমার জন্য ঝামেলায় পড়ে গেছে আর মমত্ব দেখাচ্ছে, এটা মেনে নেয়াটাও খুব কঠিন। এই যে দুদিন ফেসবুকে তেমনকিছু লিখিনি, কই তেমন কেউ তো জিজ্ঞেস করল না, আমি কেমন আছি! আসলে জীবনটা এরকমই। সবাই তো ব্যস্ত, কে কার খোঁজ রাখে? আমি নিজেও তো রাখি না অত। তবে কেউ আমার খোঁজ কেনই বা রাখবে? উল্টো সুযোগ পেলেই তো লোকজনের সাথে দুর্ব্যবহার করি। ওরা কষ্ট পায় না? ওদের কিছু কিছু বদদোয়াও তো কবুল হয় কখনও কখনও, নাকি? মানুষের দোয়া কবুল হোক আর না হোক, বদদোয়া প্রায়ই কবুল হয়ে যায়! হায়! অসহায় হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ ভালোবাসতে শেখে না। মানুষ অসহায় হয়ে গেলে বোঝে, কাছের মানুষ কী। ভালোবাসা না পেলে কেমনটা লাগে!

এখন একটু ভাল আছি। ফেসবুকে আসতে না পারার, লিখতে না পারার কষ্ট অনেক। এমনকি বই পড়তেও পারছিলাম না। এমনিতে খুব ভাল আছি। পাপ্পু আমার সব কাজ করে দিচ্ছে, এমনকি আমি বারণ করা সত্ত্বেও জোর করে পরনের কাপড়টাও ধুয়ে দিচ্ছে! মা পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবা বারবার জিজ্ঞেস করছে, এখন তোর কেমন লাগছে? কেউ কেউ জানতে পেরে ফোনে খবর নিচ্ছে। সত্যি বলছি, এসবের কষ্টও কম নয়! কার জন্য আমি কবে কী করেছি? কিছুই না! ভালোবাসা বড় কষ্ট দেয়! ঘৃণাও এর তিল পরিমাণও দিতে পারে না। কষ্টে থেকেও কোন অভিযোগ-অনুযোগ ছাড়া হাসতে কী যে ভাল লাগে! আমি চলে গেলে কারোর কিচ্ছু এসে যাবে না, অসুস্থতার সময় এ ভাবনা বড় আরাম দেয়। আমরা কী অদ্ভুত! যখন সুস্থ থাকি, তখন বিশ্বাস করে নিই, আমি কখনওই অসুস্থ হব না। যখন অসুস্থ থাকি, তখন মনে করতে ভাল লাগে, বুঝি আর সুস্থ হব না। মনে আছে, একবার গলা ভেঙে গিয়েছিল। এমনভাবেই যে, প্রায় দুসপ্তাহ কারোর সাথে কথা বলতে পারিনি। তখন এমবিএ চলছিল, থাকতাম আইবিএ হোস্টেলে। কথা বলতে না-পারার সে কী কষ্ট! খুব বেশি মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি আর কোনদিনও কথা বলতে পারব না। সেসময় শুধু মা ছাড়া আর কেউই আমার কথা বুঝত না। ক্যান্টিনে খেতে গেলে কাগজে লিখে দিতাম, আমি কী কী খাব। যখন কথা বলতে পারতাম, তখন কত আজেবাজে কথা বলে কথা বলতে পারার সুযোগটাকে নষ্ট করেছি, সেকথা ভেবে মনখারাপ হত। কথা বলতে পারাটাকে মনে হত, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর কিছু। অসুস্থ হলে অনুভব করা যায়, এই শরীরটা কতটা দামি!

গতকালকের সমস্ত ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেরে উঠছি আস্তে আস্তে। এর পুরো কৃতিত্ব ডাক্তারের, আমাকে ভালোবাসে এমনকিছু মানুষের শুভকামনার, মায়ের, বাবার আর অবশ্যই পাপ্পুর। অসুস্থ হয়ে গেলে দুটো ভাবনা বড় বেশি পীড়া দেয়। এক। আমার জন্য আমার কাছের মানুষগুলো কষ্ট পাচ্ছে। এর চাইতে দূরের কোন দ্বীপে চুপচাপ মরে যাওয়াও অনেক ভাল। দুই। এমন কেউ নেই, যে ফোন করে বলবে, তোমাকে যদি মেসেঞ্জারে আর একবারও অ্যাক্টিভ দেখি, একেবারে খুন করে ফেলব। কেউ যে একেবারেই বলেনি, এমনও নয়। সেটা কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। যে ভালোবাসাকে আশ্রয় দিতে পারব না, সেটাকে প্রশ্রয় দেয়াটা কি আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? ভালোবাসা বড় বেশি অপরাধী করে দেয়। ভালোবাসা এমনকিছু, যেটা না-পেলেও বিপদ, পেলে তো আরও বড় বিপদ! মানুষ ভালোবাসার খোঁজে কাঙাল হয়ে ঘোরে, আর পেয়ে গেলে পালিয়ে বেড়ায়। যতদিন ভালোবাসা অনুভব করতে না শেখে, ততদিন মানুষ ভালোবাসা নিয়ে স্বস্তিতে থাকে। একবার ভালোবাসা দিতে আর নিতে শিখে গেলে পৃথিবীর সমস্ত অপরাধবোধ এসে সবকিছু একেবারে এলোমেলো করে দেয়!

ভাবনা: ছয়শো তেপান্ন

………………………………………………………

একটাসময়ে হাতে হ্যান্ডচেইন, রিস্টব্যান্ড, ব্রেসলেট পরতাম। খুব বেশিদিন আগের কথা না, তখন মনে হয় অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। এখনো মনে পড়ে, একবার মা আমার দামি ম্যাগনেট ইয়াররিং জোড়া জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার সময় কতোটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, এইসব জিনিস বস্তির মেয়েদের কানে ভালো মানায়; কেউ কুড়িয়ে পেলে খুব খুশি হবে, বাবা। আমার আর রিং পরা হয়নি। ম্যাচিং করে সানগ্লাস, জিন্স, টিশার্ট, স্নিকারস, বেল্ট, আংটি, হ্যান্ডচেইন — এসব পরে যখন আমার নিজের কোচিংয়ে পড়াতে যেতাম, তখন নিশ্চয়ই কোনো কোনো গার্ডিয়ান ভাবতেন, এই অদ্ভুতদর্শন যুবাটি উনার ছেলে/ মেয়েকে কী শিখাইবেন! অনেকে এসে আমাকে বলতেন, আমি পলস্ কোচিং হোমের ডিরেক্টর স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি, উনাকে ডেকে দাও (আমাকে দেখে ‘দিন’ মুখে আসতো না হয়তো)।

যখন কোচিংয়ে স্টুডেন্ট বেড়ে যায়, তখন আমি বেত রাখতে শুরু করি। স্টুডেন্টরা বলতো, স্যার, আপনার অ্যাপিয়ারেন্সের সাথে মাইর-দেয়া যায় না। হিপহপ গেটাপের একটা ছেলে স্কুল মাস্টারের মত পোলাপানদের বেতাচ্ছে, ছেলে-মেয়ে কেউ বাদ নাই। কেমন না, ব্যাপারটা? এমসিকিউ’র জন্যে আক্ষরিক অর্থেই বইয়ের আগাগোড়া মুখস্থ করাতাম। আমাকে সবাই বলত, অবজেক্টিভ গুরু! স্টুডেন্টদের ইংলিশের বিশাল বিশাল ওয়ার্কশিট সলভ করাতাম। প্রায়ই ওদের চোখে নানান স্বপ্ন বুনে দিতাম, বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শেখাতাম, কখনওই কাউকে ভাবতে দিইনি যে, ও পারবে না। নিজের ভেতরের শক্তির জায়গাগুলিকে চিনতে শেখাতাম। ভাবতে খুব ভালো লাগে, ওরা এখন বড় হয়েছে, বড় হচ্ছে। এই ভালো-লাগা’টাই অনেক বেশি দামি। আমার কোচিংয়ে ছিলো ক্লাস নাইন থেকে অনার্স পর্যন্ত। ওইসময়টাতে প্রচুর পড়তাম, স্টুডেন্টদের সামনে পারি না বলতে কেমন যেন লাগে। আমার অনেক ডায়লগ এখনও মাঝে মাঝে স্টুডেন্টদের সাথে দেখা হলে বলে। স্যার, আপনি আমাকে এটা বলতেন, আপনি ওটা বলতেন। দু’একটা শেয়ার করি।
# আমি যেভাবে অংকটা করিয়েছি, ঠিক সেইভাবে করবে; দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন সহ। (প্রয়াস মনে করিয়ে দিলো)
# পড়তে ইচ্ছা না করলে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও। ….. পেমেন্ট নিয়ে আসবে নেক্সট দিন। (সুলতান মনে করিয়ে দিলো)
# এই কী? সমস্যা কী তোমার? ……. মাইর চিনো, মাইর? (রাতুল মনে করিয়ে দিলো)
# কোয়েশ্চেন ইজি-হার্ড কোনটাই না, কোয়েশ্চেন স্ট্যান্ডার্ড হইসে। (প্রান্ত মনে করিয়ে দিলো)
# সবকিছুর মধ্যেই কনসেপ্টের একটা ব্যাপার আছে। (তানভীর মনে করিয়ে দিলো)
# প্রত্যেকটা সাইডনোট দিতে হবে। (সৌম্য মনে করিয়ে দিলো)
# ক্লাসে কথা বললে স্মার্টনেস বাড়ে নাতো! (জেভিন মনে করিয়ে দিলো)
# বাঁশ দেয়ার পর আপনি বলতেন, “ও! লজ্জা পাচ্ছো মনে হয়!?” আমরা যখন বলতাম, “নাহ!” তখন বলতেন, “ছি ছি! তুমি নির্লজ্জ?” (শুভ মনে করিয়ে দিলো)
# দুইজন স্টুডেন্ট দেরি করে এসেছে। ওরা কাজিন, তোরান আর তুরিন; সবসময় একসাথেই আসে। “তুরিন, দেরি হল কেন?” “স্যার, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।” “তোরান, তোমার কেন দেরি হল?” “স্যার, ওকে ডাকতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে।” “ও আচ্ছা, বুঝেছি। ওকে ডাকতে গিয়ে ওর সাথে তুমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তাই না?”
# থাপ্পড় মেরে জানালা দিয়ে ফেলে দিবো। (কে মনে করিয়ে দিলো বলা যাবে না)
# পর্দার লাঠিগুলা খুলে পিটাবো। (কে মনে করিয়ে দিলো বলা যাবে না)
আরো কী কী যেন বলতাম; মনে নেই।
খুব বেশি কড়াকড়ি করতাম কোচিংয়ে, রীতিমতো হিটলারি শাসন। ছেলেদের ‘তুমি’ আর মেয়েদের ‘তুই’ করে ডাকতাম; এর ব্যাখ্যা কোনোদিন কাউকে দিইনি। সেসব কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম ইংরেজি আর বাংলা পড়াতে। একেকটা বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে অসংখ্য রেফারেন্স দিয়ে পড়ানোর সুখ পৃথিবীর আর কোনোকিছুতেই পাওয়া যায় না। ঠিক ওইসময়ে মনে হতো, আমি যেন ওটা আরেকবার সৃষ্টি করছি! অন্যান্য বিষয়গুলোও সমানতালে পড়াতাম। আমি ওইসময়ে ভূতের মতো পরিশ্রম করে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে স্টুডেন্টদের জন্যে বিশাল বিশাল লেকচার শিট রেডি করতাম, কঠিন কঠিন সব সাহিত্যিক স্টাইলের নোট দিতাম। সারাংশ আর সারমর্মের নোটগুলির কথা স্টুডেন্টরা এখনও বলে। জিআরই ওয়ার্ড দিয়ে কঠিন গ্রামাটিক্যাল স্ট্রাকচারে ইংরেজি নোট দিতাম। যেদিন অ্যাকাডেমিক ক্লাস থাকত না, সেদিন ওদেরকে আইবিএ, ভার্সিটি আর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশনের জন্য ফ্রিতে পড়াতাম, ওয়ার্কশিট সলভ করাতাম। আহহ! সেইসব দিনগুলো!! ম্যাট্রিক-ইন্টারের বইগুলো যে কয়শ’ বার পড়েছি পড়িয়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

২০০২ থেকে ২০১১। দীর্ঘ সময়!! সবাই বলতো, লাইফটাকে স্টুডেন্ট পড়িয়ে পড়িয়ে নষ্ট করছি। সবাই ধরেই নিয়েছিলো, আমি মাস্টারি করেই জীবন কাটিয়ে দেবো। অথচ আমার ওই কাজটাই করতে সহজ লাগতো, তাই ভালো লাগতো, পড়াশোনা একটুও ভালো লাগতো না। আমার কী দোষ! পরে দেখলাম, ওই পড়ানোটাই আমার লাইফে সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে। “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা– ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা,” জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, কীভাবে নিয়ে যায়, আমরা কখনো তা ভাবতেই পারি না৷ Life is always stranger than fiction. খুব মিস করি সেইসব দিনগুলো। ক্লাসভর্তি এতগুলো মুগ্ধ চোখের সামনে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পড়ানো, কিছু মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া, এতোগুলো স্টুডেন্টের স্বপ্নযাত্রা শুরু করে দেয়া; এ অনেক বড় প্রাপ্তি! আমি আর কোনোকিছুতেই এতটা শান্তি পাই না। তাইতো এখনো সুযোগ পেলেই মন-খারাপ-করে-থাকা বন্ধুদের স্বপ্নকে স্পর্শকের স্পর্ধায় ছুঁয়ে ফেলার শপথ নিতে শেখাই; যতোটা পারি, যেভাবে পারি; এবং যতদিন পারি, আমি শিখিয়ে যাবো। কেননা আর কেউ জানুক আর না-ই বা জানুক, আমার নিজের জীবন থেকে আমি তো জানি, মন-খারাপ-করে-থাকা’টা কী ভয়াবহ কষ্টের একটা ব্যাপার!

ভাবনা: ছয়শো চুয়ান্ন

………………………………………………………

(যাঁরা ভাবেন, কিছুই পারেন না, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করবেন কী করবেন না, এটা নিয়ে দ্বিধায় আছেন এবং কোচিংকেই সবকিছু ভেবেটেবে বসে আছেন, তাঁদের জন্য ………… লেখাটি গত ৭ মে ২০১৫ তারিখে লিখেছিলাম)

কালকের প্রথম আলো’তে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার বাংলাদেশ বিষয়াবলীর প্রস্তুতিকৌশল নিয়ে আমার একটা লেখা থাকছে। গতসপ্তাহের লেখাটা ছিল আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর উপর। লিখিত পরীক্ষার সব বিষয় নিয়েই লেখা হয়ে গেল। এসব টেকনিকের বাইরে আরোকিছু মাথায় আসলে আমার ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করে দেবো। যাদের কাছে লেখাগুলো সংগ্রহে নেই, তারা আমার ওয়াল থেকে পুরোনো পোস্টেই পেয়ে যাবেন। কিছুদিন পর প্রথম আলো’তে সামগ্রিক প্রস্তুতিকৌশল আর এক্জামফিটনেস নিয়ে কিছু কথা লিখব।
এই আমিও বাংলাদেশ বিষয়াবলী আর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লিখছি! ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে! কেন? বলছি।
আমার পেপারটেপার পড়ার অভ্যেস নেই। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করার আগে বিনোদন পাতা আর সাহিত্য পাতা ছাড়া পেপারের আর কোনো অংশ তেমন একটা পড়তাম না। বাসায় পেপার রাখত ২টা। এর একটাও আমি পড়তাম না। বিসিএস’য়ের প্রস্তুতির জন্য নিতান্ত বাধ্য হয়ে অনলাইনে প্রতিদিন ৫-৬টা পেপার পড়তে শুরু করি এবং চাকরিটা পেয়ে যাওয়ার পর আবারও পেপারপড়া ছেড়ে দিই। দেশের এবং বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, রাজনীতির হাওয়া কোনদিকে, ব্যবসাবাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি, এসব ব্যাপার নিয়ে আমার কোনকালেই কোন মাথাব্যথা ছিল না, আমি এর কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না, এবং এ নিয়ে আমার কোন দুঃখবোধও ছিল না। আমার নীতি হল, আমার যা দরকার নেই কিংবা ভাল লাগে না, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। সবকিছু জানতেই হবে কেন? পৃথিবীর সবকিছু জেনেটেনে ‘সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা।’

বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। দেখলাম, প্রিলি আর রিটেনের জন্য হাতে সময় আছে মাত্র ৪-৫ মাস। (সময় পেয়েছিলাম এরও কম।) প্রস্তুতি শুরু করার পর আমার প্রথম অনুভূতিঃ সবাই সবকিছু পারে, আমি কিছুই পারি না। অনেকেই দেখলাম বিসিএস নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স-পিএইচডি শেষ করে এখন পোস্টডক্টরেটে আছে। কোচিংয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর ক্লাসে এক স্যার আমাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম কী? (পরে জেনেছি, কথাটা হবে, বিদেশমন্ত্রী) যে ছেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম জানে বলে খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে একধরণের আত্মশ্লাঘাবোধ করে, তার পক্ষে এটা জানার কথা না এবং এ না-জানা নিয়ে তার মধ্যে কোন অপরাধবোধ কাজ করার প্রশ্নই আসে না! পারলাম না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি হাহাহিহি শুরু হয়ে গেছে। তখন বুঝলাম, ‘এটা একটা সহজ প্রশ্ন ছিল।’ স্যার বললেন, “দেখি, এটা কেউ বলতে পারবেন?” সবাই হাত তুলল, উত্তরও দিল। সবাই-ই পারে! বুঝলাম, এই মুহূর্তে আমার চেহারাটা একটু লজ্জা-পাওয়া লজ্জা-পাওয়া টাইপ করে ফেলা উচিত। আমার বেহায়া চেহারাটাকে লাজুক লাজুকটাইপ করার চেষ্টা করছি, এমনসময় স্যার বললেন, “আপনার সম্পর্কে তো অনেক প্রশংসা শুনেছি। আপনি নাকি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ভাল স্টুডেন্ট। এটা পারেন না কেন? আপনার এজ কত?” ভাবলাম, কাহিনী কী? উনি কি আমার ঘটকালি করবেন নাকি? কিন্তু আমার মত বেকার ছেলেকে কে মেয়ে দেবে? (আমি আসলে বেকার ছিলাম না, নিজের কোচিং সেন্টার ছিল অন্যান্য ব্যবসাও ছিল; প্রচুর টাকাপয়সা ইনকাম করতাম। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষিত ছেলেরা চাকরি না করলে সবাই ভাবে, বেকার।) এসব ভাবতে ভাবতে আমার এজটা বললাম। রিপ্লাই শুনলাম, “ও আচ্ছা! আপনার তো এখনো এজ আছে। অন্তত ৩-৪ বার বিসিএস দিতে পারবেন। চেষ্টা করে যান। প্রথমবারে হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নাই, ২-৩ বার চেষ্টা করলে হলেও হতে পারে। আপনার বেসিক দুর্বল।” স্যারকে কিছুই বললাম না। কিন্তু মেজাজ খুব খারাপ হল। উনার প্রতি সমস্ত আস্থা আর সম্মানবোধ চলে গিয়েছিল। উনাকে আমার মনে হয়েছিল একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ। যে মানুষ আমাকে না চিনেই প্রথম দেখায় এমন কনফিডেন্টলি ফাউল একটা অ্যাসেসমেন্ট করতে পারে, তার ক্লাস করার তো প্রশ্নই আসে না, সে উনি যত ভাল ক্লাসই নিন না কেন! আমি কিছু পারি না, এটা তো আমি জানিই! এজন্যই তো কোচিংয়ে আসা। পারলে কি আসতাম নাকি? আমি একটা গাধা, এটা শোনার জন্য এত কষ্ট করে, সময় নষ্ট করে, গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাসা থেকে কোচিংয়ে এসেছি নাকি? এটা শুনতে তো আর এতদূর আসতে হয় না। বাসায় বসে থাকলে মা দিনে অন্তত ১০বার একথা বলে! তখনই ঠিক করে ফেললাম, ব্যাটার ক্লাস আর কোনদিনও করব না। করিওনি।
পরে জানলাম, উনি অংক-ইংরেজি-বাংলা-বিজ্ঞানে অতিদুর্বল সাধারণ জ্ঞানে মহাপণ্ডিত ৫বার বিসিএস’য়ে ব্যর্থ একজন বিশিষ্ট বিসিএস বিশেষজ্ঞ। শুধু নিজেরটা ছাড়া পৃথিবীর সকল মানুষের ব্যর্থতার কারণগুলি তিনি খুঁজে দিতে পারেন। উনি জানতেন, সুশান্ত সাধারণ জ্ঞানের কিছুই পারে না। কিন্তু উনি এটা জানতেন না, সুশান্ত বাংলা-ইংরেজি-অংক-বিজ্ঞান ওসব বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স করা যেকোনো স্টুডেন্টের চাইতে ভাল না পারলেও কোন অংশেই কম পারে না। উনি এটাও জানতেন না, শুধু সাধারণ জ্ঞানে তোতাপাখি হয়ে বিভিন্ন খাঁচায় বসে বসে মনভোলানো নানাঢঙে ডাক দেয়া যায়, কিছু হাততালিও জুটে যায়, কিন্তু বিসিএস ক্যাডার হওয়া যায় না। ক্লিনটনের ওয়াইফের বান্ধবীর পোষা কুকুরের নামও আপনার মুখস্থ, কিন্তু আমার নানার একটা কালো কুকুর ছিল’কে ইংলিশে লিখেন, My grandfather was a black dog……… কোনো কাজ হবে না। সত্যি বলছি, কোনো কাজই হবে না।
কোচিংয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর প্রথম মডেল টেস্টে পেলাম ১০০’র মধ্যে ১৭! বলাই বাহুল্য, আমার মার্কসটাই ছিল সর্বনিম্ন। সেকেন্ড লোয়েস্ট মার্কসটা ছিল ৩৮; আমার প্রাপ্ত মার্কসের দ্বিগুণের চেয়েও ৪ বেশি! বুঝুন আমার অবস্থাটা! বাকিরা আমার অনেকআগে শুরু করেছে, আমি তো বিসিএস কথা জীবনেও শুনি নাই, আমি তো মাত্র শুরু করলাম—-নিজেকে খুশি করার জন্য এসব কথা ভাবতেই পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। ভাবলাম, ঠিক আছে, আমি না হয় কিছু পারি না, সেটা তো আর আমার দোষ না। কিন্তু আমি যদি সে দুর্বলতাকে জয় করার জন্য কিছু না করি, হাতপা গুটিয়ে বসে থাকি, সেটা তো নিশ্চয়ই আমার দোষ! প্রচণ্ড পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম একেবারে জিরো থেকে। কে কী পারে সেটা ভেবে মন খারাপ না করে দুটো ব্যাপার মাথায় রেখে কাজ করতে লাগলাম। এক। সবাই যা পারে, সেটা পারাটা আদৌ কতটুকু দরকার। অন্ধের মত না পড়ে একটু বুঝেশুনে পড়তে শুরু করলাম। সবাই যা যা পড়ে, আমাকেও তা-ই তা-ই পড়তে হবে, এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। দুই। সাধারণ জ্ঞানে ভাল কারোর সাথে নিজেকে তুলনা না করে নিজের সাথেই নিজেকে তুলনা করা শুরু করলাম। গতকালকের সুশান্তের চাইতে আজকের সুশান্ত কতটা বেশি কিংবা কম পারে, শুধু সেটা নিয়েই ভাবতাম। আমার কম্পিটিশন হতো আমার নিজের সাথেই। অন্যকাউকে না, ‘আজকের আমি’ ‘আগেরদিনের আমি’কে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কাজটা প্রতিদিনই করতাম। যারা ভাল পারে, তারা তো আর রাতারাতি এত ভাল পারে না। অনেক পরিশ্রম আর সাধনার পর এ দক্ষতা অর্জন করা যায়। যে স্টুডেন্টা অংকে ২০ পায়, সে যদি কখনো অংকে ২৪ পেয়ে যায়, তবে সে কিন্তু সাকসেসফুল। জানি, ৩৩ পেলে পাস, সে ফেল করেছে; তবুও আমি বলব, সে কিন্তু সফল। সে তো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে। এভাবে করে একদিন সে ১০০’তে ১০০-ই পাবে! এরজন্য ওকে বুঝেশুনে প্রচুর প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে এবং এটাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। মজার ব্যাপার হল, জেতাটা একটা অভ্যাস। যে একটা চাকরি পেয়ে যায়, সে চাকরি পেতেই থাকে। এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, হারাটাও কিন্তু একটা অভ্যাস। ভাল কথা, যারা কোচিং করছেন, কোচিংয়ে মার্কস কমটম পেলে মন খারাপ করবেন না। অনেকেই মেয়েদের কাছে হিরো হওয়ার জন্য আগে থেকে প্রশ্ন যোগাড় করে ‘পরীক্ষা’ দেয়। কোচিংয়ের প্রশ্ন যোগাড় করা তো কোন ব্যাপার না। এইরকম অনেক বান্দাকে আমি সেইরকমভাবে ধরা খেতে দেখেছি।
যে ছেলে কোনদিনও ঠিকভাবে বিসিএস’য়ের নামও শোনেনি, যে ছেলে জীবনেও কোন চাকরির পরীক্ষাই দেয়নি, সে ছেলে যদি বিসিএস পরীক্ষায় প্রথমবারেই ফার্স্ট হতে পারে, তবে আপনি কেন পারবেন না? ফার্স্ট হওয়াটা ভাগ্যে জুটুক আর না-ই বা জুটুক, মনপ্রাণ বাজি রেখে চেষ্টা করলে অন্তত চাকরিটা তো জুটবেই। ভাবছেন, খুব হেসেখেলে ফার্স্ট হয়ে গেছি? কিছুতেই না! এর জন্য অনেকরাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে। অনেক ছোট ছোট সুখকে গুডবাই বলে দিতে হয়েছে। মুখ বন্ধ রেখে মানুষের বড় বড় কথা হজম করে পড়াশোনা করতে হয়েছে।
আমি বিশ্বাস করি, আপনারাও পারবেন। যারা চাকরি পায়, ওরা আপনাদের চাইতে কোনোভাবেই বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। নিজের উপর আস্থা রাখুন, নিজেকে সম্মান করুন, আপনার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করুন। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার হাতে!
গুড লাক!

ভাবনা: ছয়শো পঞ্চান্ন

………………………………………………………

২৬ আগস্ট ২০১৫

একটি সত্যি ঘটনা শেয়ার করছি।

একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের একটা মেয়ে। এসএসসি’তে ৩.৮৮, মানে মাঝারি ধরণের রেজাল্ট। বাড়ির কাছাকাছি একটা মোটামুটি মানের থানার কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। কাছাকাছি মানে কিন্তু বাড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে। কোন যানবাহন নেই, হেঁটে যেতে হয়; বৃষ্টির সময় হাঁটুকাদার মধ্য দিয়ে। ওর অনেক ক্লাসমেটই ছোটবেলা থেকে ঠিকমতো টিচার পেয়েছে, কোচিংয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সচেতন বাবা-মা’র সন্তান বলে পড়াশোনা কীভাবে করতে হয় সেটাও জানতে পেরেছে আগে থেকেই। মেয়েটা এতকিছু কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। কখনো কারোর কাছে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য কিংবা সুযোগ কোনটাই তার ছিল না। একদিন কলেজের ইংরেজি শিক্ষক মেয়েটাকে বললেন, “তুমি আমার ব্যাচে আস।” মেয়েটা সাথে সাথেই বলল, “না স্যার! আপনার ব্যাচে যারা পড়ে, ওরা ইংরেজিতে অনেক ভাল। আমি কিছুই পারি না স্যার। আমি যাবো না।” স্যার জোর দিয়ে বললেন, “তুমি আস কালকে সকালে। বাকিটা পরে দেখা যাবে।” মেয়েটা পরেরদিন অনেক সংকোচ নিয়ে কোচিংয়ে গেল। একে তো গ্রাম্য মেয়ে, ঠিকমতো কথাও বলতে জানে না, তার উপর ইংরেজিতে অতি দুর্বল। ও গিয়ে দেখল কোচিংয়ের স্টুডেন্ট প্রায় ৩০ জন; সবাই ওর চাইতে অনেক ভাল ইংরেজি পারে। ও নিয়মিত যেতে থাকল। ও লজ্জায় কথাও বলতো না। যেত, এককোনায় চুপচাপ বসে বসে ক্লাস করত, আর ছুটি হলে কলেজে যেত।

একদিনের ঘটনা। ও ক্লাসে একটা ইংরেজি শব্দ ভুল উচ্চারণ করল। এতে তার এক ক্লাসমেট এত জোরে হাসল যা তার এখনো মাথায় বাজে। সেদিন ও এতই কষ্ট পেয়েছিল যে কোচিং শেষে আর কলেজে যায়নি, বাড়িতে এসে রুমের দরোজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কাঁদল। সেদিনই ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যে করেই হোক, ও ইংরেজি শিখবেই! প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তি আর পরিশ্রম করে সে পড়াশোনা করতে শুরু করল। ওর ইংরেজির শিক্ষক ওকে সবসময়ই উৎসাহ দিতেন, আর সাহায্য করতেন। ওর একটাই ইচ্ছে ছিল, যে করেই হোক, ও ওর ক্লাসমেটদের চাইতে ১ মার্কস হলেও বেশি পাবে! সে জীবন বাজি রেখে চেষ্টা করত। এভাবে করে ক্রমাগত চেষ্টায় ও ওদের কলেজে একটা টার্ম পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে গেল। এবং এরপর থেকে প্রতিবারই ফার্স্ট হতো। যে মেয়ে একটা সময়ে ইংরেজি শব্দ উচ্চারণও করতে পারত না, একেবারে সহজ গ্রামারও বুঝত না, ভোকাবুলারির অবস্থা ছিল শূন্যের কোঠায়, সে মেয়েটিই এইচএসসি’তে ইংরেজিতে এ+ পেল; ওর মার্কস ছিল ওর কলেজে সর্বোচ্চ। ওর জেদ ছিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সেই ইংরেজি’তেই অনার্স-মাস্টার্স করবে। এবং পরবর্তীতে সেটাই করল।

আরেকটা ঘটনা ওর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর রেজাল্ট বের হওয়ার আগে ও একটা অ্যাডমিশন টেস্ট কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিল। ক্লাসে তেমন কোন কথা বলতো না। স্যাররা যা জিজ্ঞেস করতেন, শুধু সেটারই উত্তর দিত। একদিন ক্লাসে এক স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা কী করেন?” ও গর্বের সাথে উত্তর দিল, “কৃষিকাজ করেন।” সেই স্যার তখন তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে কৃষক?” মেয়েটা বলল, “জ্বি স্যার।” “তাহলে উনি তো নিশ্চয়ই পড়াশোনা জানেন না। তা, তোমাকে বাড়িতে কে পড়ায়?” এসব শুনে ওর ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করছিল। অনেক কষ্টে কান্না চেপে “স্যার, আমি নিজেই পড়ি, আমার বড় ভাই সবসময়ই আমাকে উৎসাহ দেন।” এইটুকু বলেই এইটুকুন মেয়েটা বসে পড়ল। অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্টের পর কোচিং থেকে ওকে ফোন করেছিল ছবি তোলার জন্য। ওদের ব্যাচ থেকে একমাত্র ও-ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল। কোচিংয়ের লিফলেটে ওর দরিদ্র নিরক্ষর কৃষক বাবার সাথে ওর ছবি ছাপা হয়েছিল। সেদিন ব্যাচে ওর এক ফ্রেন্ড ওর বাবার পরিচয় দেয়ার জন্য ওকে গাধী বলে বকাঝকা করেছিল, এবং বলেছিল, এই পরিচয়টা ‘ট্যাক্টফুলি’ এড়িয়ে গেলেই ভাল হয়। আর সে মেয়েই এখন ওর কৃষক বাবা আর ওর গ্রাম্য যৌথ পরিবার নিয়ে সবাইকে মাথা উঁচু করে গর্বের সাথে বলতে পারে। সেই ছোট্টো মেয়েটা ওর অসাধারণ সুন্দর গ্রাম্য পরিবার নিয়ে সারাজীবনই গর্ব করে যাবে।

যে দেশে কৃষকের সন্তান প্রাপ্য সম্মান পায় না, যে দেশে বিয়ের সময় উচ্চ বংশজাত নিম্ন অবস্থান আর রুচির পাত্রপাত্রীরাও প্রাধান্য পায়, যে দেশে ‘খারাপ’ স্কুলকলেজ থেকে পাসকরা স্টুডেন্টদেরকে ‘খারাপ’ স্টুডেন্ট বলে ধরে নেয়া হয়, যে দেশে বাইরের চাকচিক্য দিয়ে এখনো মানুষ বিচার করা হয়, যে দেশে ফালতু বাহ্যিক স্মার্টনেস দেখানো ফাউল ছেলেপেলেদের মূল্যায়ন করা হয়, যে দেশে বড়লোকের সন্তানই শুধু বড় চেয়ারটা পায়, যে দেশে মেরুদণ্ডহীন ছেলেরা বসে থাকে বিয়ের পর মেয়ের বাবার টাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশায়, আমি বিশ্বাস করি, সে দেশ আর যা-ই হোক, বেশিদূর যেতে পারে না। এটা সত্যিই খুব লজ্জার। আমাদের দেশের এই করুণ দুর্দশার জন্য আমাদের মানসিকতাই দায়ী।

আমি নিজেও চট্টগ্রামের সবচাইতে ‘বাজে’ স্কুলগুলোর একটি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। স্কুলটাকে সবাই অবজ্ঞা করে ‘বালতি স্কুল’ বলে ডাকে। আমাকে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে। টুডে আই অ্যাম প্রাউড অব মাই ‘বালতি স্কুল’!!

বড় বড় কথাবলা অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা! এই বড় ভাইয়ার কথা বিশ্বাস কর, দিন সারাজীবন এরকম থাকবে না। যেদিন তোমাদের সমাজের কাছে মাথা নিচু করে চলতে হবে, সেদিন তুমি কোথায় পালাবে? সময় থাকতে এখুনি নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য চেষ্টা কর। যারা তোমাকে তোয়াজ করে, তারা কোন স্বার্থে এ কাজটা করে, সেটা একটু ভেবে দেখ। জীবনটা সবসময়ই এভাবে করে যাবে না। তোমার মা-বাবা’কে সমাজের কাছে সম্মানিত করার চেষ্টা কর। পৃথিবীর কাছে নোবডি হয়ে বেঁচে থাকাটা যে কতটা গ্লানির আর কষ্টের, সেটা আমি খুব ভাল করে জানি। মানুষকে সম্মান কর, বিনীত হতে শেখো, আর প্রচুর পরিশ্রম করার অভ্যেস গড়ে তোলো। জীবনটাকে এখন চাবুকপেটা করার সময়, উপভোগ করার নয়। তোমাদের জন্য শুভকামনা রইলো।

লেখাটির অডিও ক্লিপ :

RJ Salman’য়ের কণ্ঠে যে অডিও ক্লিপগুলি আছে, সেগুলির মধ্যে এখনও পর্যন্ত (মানে এই নোটটি সেভ করার সময় পর্যন্ত) সবচাইতে বেশিবার শোনা ক্লিপগুলির মধ্যে এটির অবস্থান ২য়। ………. লেখাটি পড়ার সময় উনি নিজেও কেঁদেছেন, আমাদেরকেও কাঁদিয়েছেন।

শুনুন, সবার সাথে শেয়ার করুন। যাঁরা ভাবেন, আপনি খুব ক্ষুদ্র অবস্থানে আছেন, তাঁরা জীবনে বড় হওয়ার কিছু অনুপ্রেরণা হয়তো পেয়ে যাবেন এ অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়েটির কাছ থেকে।

লিংকটা দিয়ে দিচ্ছি……….

ভাবনা: ছয়শো ছাপান্ন

………………………………………………………

২৫ এপ্রিল ২০১৫

(এটি এখনো পর্যন্ত আমার সবচাইতে জনপ্রিয় লেখা। এটিকে নোট হিসেবে সেভ করার সময় পর্যন্ত এটিতে বিভিন্ন সাইটে, গ্রুপে, পেইজে, ওয়ালে, পোস্টে লেখাটিতে প্রায় ২০০০০০+ লাইক, ৩০০০০+ কমেন্ট আর ২০০০০+ শেয়ার যুক্ত হয়েছে। লেখাটি এ পর্যন্ত পঠিত হয়েছে অন্তত সাড়ে ৩ লক্ষ বার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে লেখাটি ফটোকপি করে বিতরণ করা হয়েছে। আমার যত লেখা চুরি করে লোকে নিজের নামে চালিয়েছে, এ লেখাটি সেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বার চুরি হয়েছে। ওসব চোরছ্যাঁচড়ার দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের ডিরেক্টর থেকে শুরু করে একেবারে সার্টিফিকেটসর্বস্ব গণ্ডমূর্খরাও আছেন। অনেক হারামজাদা নিজের নামে এ লেখাটি বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ এবং জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশ করে দিয়েছিল। আমি আমার ভাষার ব্যবহারের জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি না। কুম্ভিলকদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও সহানুভূতি নেই।

বন্ধুদের অনুরোধে লেখাটিকে নোট আকারে রেখে দিলাম। হয়তো কারোর কারোর কাজে লেগে যাবে। আমার বেশিরভাগ লেখাই তো হারিয়ে গেছে। লেখাটি আমার আনস্মার্ট মোবাইলে টাইপ করে করে অফিসে বসে তাড়াহুড়োয় লেখা। বাসায় বসে সময় নিয়ে ল্যাপটপে লিখতে পারলে হয়তো আরো বড় আর ভাল করতে পারতাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে লেখাটি এতবেশি লোকের কাজে আসবে! বন্ধুদের সাড়া পেয়ে এখন মনে হচ্ছে, লেখাটি অতটা তাড়াহুড়োয় লেখা ঠিক হয়নি, আরেকটু সময় নিয়ে লিখলে ভাল হতো।

আমার মূল পোস্টটির লিংক নিচে দিলাম। পোস্টটিতে গিয়ে ওখানের কমেন্টগুলো থেকেও অনেককিছু শিখতে পারবেন।

https://www.facebook.com/sushanta.iba/posts/10153205370883771 )

২৭ বছর বয়সে যখন হন্যে হয়ে ব্যাংকে চাকরি খুঁজছেন, তখন আপনারই বয়েসি কেউ একজন সেই ব্যাংকেরই ম্যানেজার হয়ে বসে আছেন। আপনার ক্যারিয়ার যখন শুরুই হয়নি, তখন কেউ কেউ নিজের টাকায় কেনা দামি গাড়ি হাঁকিয়ে আপনার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছে। কর্পোরেটে যে সবসময় চেহারা দেখে প্রমোশন দেয়, তা নয়। দিন বদলাচ্ছে, কনসেপ্টগুলো বদলে যাচ্ছে। শুধু বেতন পাওয়ার জন্য কাজ করে গেলে শুধু বেতনই পাবেন। কথা হল, কেন এমন হয়? সবচাইতে ভালটি সবচাইতে ভালভাবে করে কীভাবে? কিছু ব্যাপার এক্ষেত্রে কাজ করে। দুএকটি বলছি।

প্রথমেই আসে পরিশ্রমের ব্যাপারটা। যারা আপনার চাইতে এগিয়ে, তারা আপনার চাইতে বেশি পরিশ্রমী। এটা মেনে নিন। ঘুমানোর আনন্দ আর ভোর দেখার আনন্দ একসাথে পাওয়া যায় না। শুধু পরিশ্রম করলেই সব হয় না। তা-ই যদি হত, তবে গাধা হত বনের রাজা। শুধু পরিশ্রম করা নয়, এর পুরস্কার পাওয়াটাই বড় কথা। অনলি ইওর রেজাল্টস্ আর রিওয়ার্ডেড, নট ইওর এফর্টস্। আপনি এক্সট্রা আওয়ার না খাটলে এক্সট্রা মাইল এগিয়ে থাকবেন কীভাবে? সবার দিনই তো ২৪ ঘণ্টায়। আমার বন্ধুকে দেখেছি, অন্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সে রাত জেগে আউটসোর্সিং করে। ও রাত জাগার সুবিধা তো পাবেই! আপনি বাড়তি কী করলেন, সেটাই ঠিক করে দেবে, আপনি বাড়তি কী পাবেন। আপনি ভিন্নকিছু করতে না পারলে আপনি ভিন্নকিছু পাবেন না। বিল গেটস রাতারাতি বিল গেটস হননি। শুধু ভার্সিটি ড্রপআউট হলেই স্টিভ জবস কিংবা জুকারবার্গ হওয়া যায় না। আমার মত অনার্সে ২.৭৪ সিজিপিএ পেলেই বিসিএস আর আইবিএ ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে যাওয়া যাবে না। আউটলায়ার্স বইটি পড়ে দেখুন। বড় মানুষের বড় প্রস্তুতি থাকে। নজরুলের প্রবন্ধগুলো পড়লে বুঝতে পারবেন, উনি কতটা স্বশিক্ষিত ছিলেন। শুধু রুটির দোকানে চাকরিতেই নজরুল হয় না। কিংবা স্কুলকলেজে না গেলেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাওয়া যাবে না। সবাই তো বই বাঁধাইয়ের দোকানে চাকরি করে মাইকেল ফ্যারাডে হতে পারে না, বেশিরভাগই তো সারাজীবন বই বাঁধাই করেই কাটিয়ে দেয়।

স্টুডেন্টলাইফে কে কী বলল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমাদের ব্যাচে যে ছেলেটা প্রোগ্রামিং করতেই পারত না, সে এখন একটা সফটওয়্যার ফার্মের মালিক। যাকে নিয়ে কেউ কোনদিন স্বপ্ন দেখেনি, সে এখন হাজার হাজার মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। ক্যারিয়ার নিয়ে যার তেমন কোন ভাবনা ছিল না, সে সবার আগে পিএইচডি করতে আমেরিকায় গেছে। সব পরীক্ষায় মহাউত্‍সাহে ফেল করা ছেলেটি এখন একজন সফল ব্যবসায়ী। আপনি কী পারেন, কী পারেন না, এটা অন্যকাউকে ঠিক করে দিতে দেবেন না। পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাননি? প্রাইভেটে পড়ছেন? কিংবা ন্যাশনাল ভার্সিটিতে? সবাই বলছে, আপনার লাইফটা শেষ? আমি বলি, আরে! আপনার লাইফ তো এখনো শুরুই হয়নি। আপনি কতদূর যাবেন, এটা ঠিক করে দেয়ার অন্যরা কে? লাইফটা কি ওদের নাকি? আপনাকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে কেন? কিংবা ডাক্তারি পাস করে কেন ডাক্তারিই করতে হবে? আমার পরিচিত এক ডাক্তার ফটোগ্রাফি করে মাসে আয় করে ৬-৭ লাখ টাকা। যেখানেই পড়াশোনা করেন না কেন, আপনার এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে আপনার নিজের উপর। শুধু ‘ওহ শিট’, ‘সরি বেবি’, ‘চ্যাটিংডেটিং’ দিয়ে জীবন চলবে না। আপনি যার উপর ডিপেনডেন্ট, তাকে বাদ দিয়ে নিজের অবস্থানটা কল্পনা করে দেখুন। যে গাড়িটা করে ভার্সিটিতে আসেন, ঘোরাঘুরি করেন, সেটি কি আপনার নিজের টাকায় কেনা? ওটা নিয়ে ভাব দেখান কোন আক্কেলে? একদিন আপনাকে পৃথিবীর পথে নামতে হবে। তখন আপনাকে যা যা করতে হবে, সেসব কাজ এখনই করা শুরু করুন। জীবনে বড় হতে হলে কিছু ভাল বই পড়তে হয়, কিছু ভাল মুভি দেখতে হয়, কিছু ভাল মিউজিক শুনতে হয়, কিছু ভাল জায়গায় ঘুরতে হয়, কিছু ভাল মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, কিছু ভাল কাজ করতে হয়। জীবনটা শুধু হাহাহিহি করে কাটিয়ে দেয়ার জন্য নয়। একদিন যখন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, তখন দেখবেন, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। স্কিল ডেভেলাপমেন্টের জন্য সময় দিতে হয়। এসব একদিনে কিংবা রাতারাতি হয় না। “আপনার মত করে লিখতে হলে আমাকে কী করতে হবে? আমি আপনার মত রেজাল্ট করতে চাই। আমাকে কী করতে হবে?” এটা আমি প্রায়ই শুনি। আমি বলি, “অসম্ভব পরিশ্রম করতে হবে। নো শর্টকাটস্। সরি!” রিপ্লাই আসে, “কিন্তু পড়তে যে ভাল লাগে না। কী করা যায়?” এর উত্তরটা একটু ভিন্নভাবে দিই। আপনি যখন স্কুলকলেজে পড়তেন, তখন যে সময়ে আপনার ফার্স্ট বয় বন্ধুটি পড়ার টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত, সে সময়ে আপনি গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এখন সময় এসেছে, ও ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আপনি পড়ার টেবিলে বসে থাকবেন। জীবনটাকে যে সময়ে চাবুক মারতে হয়, সে সময়ে জীবনটাকে উপভোগ করলে, যে সময়ে জীবনটাকে উপভোগ করার কথা, সে সময়ে জীবনটাকে উপভোগ করতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এটা মেনে নিন। মেনে নিতে না পারলে ঘুরে দাঁড়ান। এখনই সময়!

বড় হতে হলে বড় মানুষের সাথে মিশতে হয়, চলতে হয়, ওদের কথা শুনতে হয়। এক্ষেত্রে ভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধু নির্বাচনটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সাবকনশাস মাইন্ড আপনাকে আপনার বন্ধুদের কাজ দ্বারা প্রভাবিত করে। আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই আমাদের চাইতে ইনফেরিয়র লোকজনের সাথে ওঠাবসা করি, কারণ তখন আমরা নিজেদেরকে সুপিরিয়র ভাবতে পারি। এ ব্যাপারটা সুইসাইডাল। আশেপাশে কাউকেই বড় হতে না দেখলে বড় হওয়ার ইচ্ছে জাগে না। আরেকটা ভুল অনেকে করেন। সেটি হল, ধনীঘরের সন্তানদের সাথে মিশে নিজেকে ধনী ভাবতে শুরু করা। মানুষ তার বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। উজাড় বনে তো শেয়ালই রাজা হয়। আপনি কী শেয়ালরাজা হতে চান, নাকি সিংহরাজা হতে চান, সেটি আগে ঠিক করুন।

বিনীত হতে জানাটা মস্ত বড় একটা আর্ট। যারা অনার্সে পড়ছেন, তাদের অনেকের মধ্যেই এটার অভাব রয়েছে। এখনো আপনার অহংকার করার মত কিছুই নেই, পৃথিবীর কাছে আপনি একজন নোবডি মাত্র। বিনয় ছাড়া শেখা যায় না। গুরুর কাছ থেকে শিখতে হয় গুরুর পায়ের কাছে বসে। আজকাল শিক্ষকরাও সম্মানিত হওয়ার চেষ্টা করেন না, স্টুডেন্টরাও সম্মান করতে ভুলে যাচ্ছে। আপনি মেনে নিন, আপনি ছোটো। এটাই আপনাকে এগিয়ে রাখবে। বড় মানুষকে অসম্মান করার মধ্যে কোন গৌরব নেই। নিজের প্রয়োজনেই মানুষকে সম্মান করুন।

লেখাটির অডিও ক্লিপ :

RJ Salman’য়ের কণ্ঠে যে অডিও ক্লিপগুলি আছে, এই ক্লিপটি এখনও পর্যন্ত (মানে এই নোটটি সেভ করার সময় পর্যন্ত) সবচাইতে বেশিবার শোনা হয়েছে। ক্লিপটিতে সালমান ভাই আমার লেখাটিকে খুব চমৎকার করে পড়েছেন।

https://static.xx.fbcdn.net/images/emoji.php/v9/t27/1.5/18/1f642.png

শুনুন, সবার সাথে শেয়ার করুন। অনেকেই বলেন, যখন পড়তে ইচ্ছে করে না, ঘুম পায়, থেমে যেতে ইচ্ছে করে, তখন আরজে সালমানের কণ্ঠে এই কথাগুলি শুনলে শরীরমনের সব জড়তা কাটিয়ে উঠে আবারও শুরু করা যায়! এই শুরু করাটাই তো বড় কথা! 🙂

লিংকটা দিয়ে দিচ্ছি……….

ভাবনা: ছয়শো সাতান্ন

………………………………………………………

এক।

২৬ আগস্ট ২০১৫

(এই পোস্টটি গত ৬ মে তারিখে দিয়েছিলাম)

গতকাল অফিস আর সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হল। বিয়ানীবাজারের এক ভদ্রলোক আবদুল আলীম লোদী। (উনি ইব্রাহীম লোদীর কেউ হন নাকি?) গাছ ভালবেসে ভেষজ আর ফলজ উদ্ভিদের বাগান গড়ে তুলেছেন। উনার প্রচণ্ড ইচ্ছে, এ লোদী গার্ডেনের কথা দেশময় ছড়িয়ে যাক। সবাইকে খুব আগ্রহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাগান দেখান। কালকে সন্ধ্যায় অসম্ভব টায়ার্ড ছিলাম। শুধু কাউকেই ‘না’ বলতে পারি না বলে উনার অনুরোধ আর আগ্রহে রাত সাড়ে ৮টার দিকে লোদী গার্ডেনে গেলাম। দেশিবিদেশি অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছে বাগান ভর্তি। উনি টর্চলাইট জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে গাছ চেনাচ্ছিলেন। গাছ আমি নিজেও ভালবাসি, গাছের প্রতি একধরণের মমত্ব অনুভব করি। কিন্তু প্রচণ্ড শারীরিক অবসাদের কারণে অতিবিরক্ত লাগছিল। তবুও কষ্ট করে হাসিমুখে উনার কথা মন দিয়ে শোনার অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। এমনই ঘর্মাক্ত হাসিমুখ, উনার অনুরোধে যে কয়েকটি ছবি তুলেছি তার প্রত্যেকটাতে আমাকে দেখাচ্ছে পকেটমারের মতো, দেখলেই যে কারোরই ধরে গণধোলাই দিতে ইচ্ছে করবে। গাছ নিয়ে উনার প্রচণ্ড আবেগ আর ভালবাসা সত্যিই দেখার মতো। এ পৃথিবীতে শুধু আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে মাস্টারপিস বানানো সম্ভব। সাথে প্রয়োজন অক্লান্ত পরিশ্রম করার মানসিকতা। এর সবই লোদী সাহেবের আছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। কালকে এটা আরো একবার শিখলাম।

রেস্টহাউজে ফিরলাম রাত সাড়ে ১০টার দিকে। শরীর যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। পরদিন, মানে আজকে সকাল ৭টায় আবার ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। এদিকে প্রথম আলো’তে শুক্রবারের চাকরিবাকরি পাতায় বিসিএস লিখিত পরীক্ষার বাংলাদেশ বিষয়াবলীর প্রস্তুতিকৌশল নিয়ে লেখাটা রেডি করে বুধবার বিকেলের মধ্যেই পাঠাতে হবে। মানে, লেখাটা যে করেই হোক, রেডি করতে হবে আজকে রাতের মধ্যেই। কিন্তু এ শরীর নিয়ে সেটি কিছুতেই সম্ভব নয়। গোসলটোসল সেরে সাড়ে ১১টার দিকে প্রথম আলো’তে ফোন দিলাম। ‘অনিবার্য কারণবশত আজকের লেখাটি ছাপানো সম্ভব হল না। লেখাটি আগামী সংখ্যায় ছাপানো হবে।’ আমার পক্ষে এ ক্লান্ত শরীর নিয়ে লেখাটা খুব কঠিন হবে, তাই এরকম কিছু একটা ছেপে দিতে বললাম। কিন্তু উনি জানালেন, এ মুহূর্তে এটা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সবাই লেখাটির জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। একটু কষ্ট হলেও যেন দয়া করে লিখে দিই। . . . . . . সত্যিই অসহায় লাগছিল। যেমনতেমন করে তো আর লেখাও যায় না, এত লোক পড়বে! তার উপর এ ধরণের লেখা লেখার সময় আমার ভেতরে একটা প্রচণ্ড দায়িত্ববোধ কাজ করে। শওকত ওসমানের জননী পড়ছিলাম। ওটা আরো একটু পড়েটড়ে সাড়ে বারটার দিকে লিখতে বসলাম। এ বসা প্রয়োজন থেকে নয়, আবেগ থেকে, ভালবাসা থেকে, অসীম দায়িত্ববোধ থেকে। জানি বেশিক্ষণ ঘুমুতে পারব না, কালকে মোটামুটি ভোর থেকেই সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে হবে, তবুও। ল্যাপটপে স্লো ইনস্ট্রুমেন্টাল ছেড়ে লিখতে লাগলাম। ফেসবুকিং করেটরে লেখাটা শেষ করে যখন শুতে গেলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন আড়াইটা ছুঁইছুঁই। ঘুমুতে যাওয়ার আগে মনে মনে শপথ করলাম, পরের জন্য আর না, এখন থেকে একটু নিজের জন্য বাঁচব। দুচ্ছাই! বলে সব ছেড়েছুঁড়ে দেবো! কী হবে এসব করে? সবাই তো আর ভালবাসে না, কেউ কেউ তো গালাগালিও দেয়। কী দরকার! যথেষ্ট হয়েছে! . . . . . . . নিজের উপর রাগটা একটা ভোর হওয়া পর্যন্তই! জানি, মানুষের অপরিসীম ভালবাসায় এই ভূতের বেগার খাটা কখনোই বন্ধ করে দিতে পারব না। হয়তো থমকে যাবো কখনো কখনো, তবুও থামব না। সবচাইতে বেশি কষ্ট পাই, যখন দেখি আমার কাজগুলো নিয়ে কেউ আজেবাজে মন্তব্য করছে। শারীরিক কষ্টও এতটা কষ্ট দেয় না। এসব লেখালেখি, ক্যারিয়ার আড্ডা, মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং থেকে এ পর্যন্ত এক পয়সাও তো কোনদিনও নিইনি!

তিন ঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছি। ৭টায় ঘুরতে বের হলাম। এখন আছি বিছানাকান্দি আর পাংথুমাইয়ের পথে। এরপর রাতারগুল, জৈয়িন্তাপুরের সাইট্রাসবাগান, রাজবাড়ি, লালাখাল। বিছানাকান্দি যাওয়ার রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিল-হাওড়ের দূশ্যটা দেখার মতো। রাস্তার ধারে সারি সারি জেন্টলম্যান-দেখতে গাছগুলো, এরই মাঝ দিয়ে ছুটে চলা। বস্তুত জীবন তো ছুটে চলাই! হোক সুন্দরের মধ্য দিয়ে কিংবা অসুন্দরের মধ্য দিয়ে। জীবন শুধু সুন্দরই নয়, জীবন অসুন্দরও। আমার প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্টকে মনে পড়ছেঃ জীবন সম্পর্কে আমি যা শিখেছি, সেটিকে আমি তিনটি শব্দে বলে দিতে পারি— জীবন বয়ে চলে। দ্য শশ্যাঙ্ক রিডেম্পশনের অ্যান্ডি ডুফ্রেইনের কথাটি মাথায় রেখেও জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায়ঃ Get busy living, or get busy dying.

দুই।

আমার কাছে প্রায়ই একেবারে পিছিয়ে থাকা লোকজন ক্যারিয়ার নিয়ে বুদ্ধিসুদ্ধি নিতে আসে। ২টা কারণে। এক। আমি একেবারে বেকুবের মতো প্রশ্ন করলেও ঝাড়ি দেই না। উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করার জন্যে আমার চাইতে আপন আর কেউ হয় না। দুই। ওরা আমাকে আপন আপন ভাবে। এর মানে, ওরা বিশ্বাস করে আমি গাধা থেকে মানুষ হইসি। অতএব, আমার বুদ্ধি শুনলে গাধা থেকে মানুষ হওয়া যাবে। ওদের এই আপন করে নেয়া আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, কেউই চিরদিন গর্দভ থাকে না। এবং আমি যে কতো উন্নত জাতের ছাগল ছিলাম, সেটাও মনে পড়ে যায়। আমি আপনমনে হাসতে থাকি; সুখের হাসি।

ওরা আসলে, আমি যত ক্লান্তই থাকি, সময় দিই, কথা বলি। আজকেও এসেছিল। আজকে আমি এয়ারপোর্ট থেকে ফিরেছি রাত ১০টায়, কাল ভোর ৫টায় আবার ছুটতে হবে। আমি ‘না’ বলতে পারি না, তাই অনেকে আপন ভেবে আসে, দুঃখের কথা বলে। আমি মন দিয়ে শুনি, ওদের বিশ্বাস করিয়ে দেই, ওরা দুনিয়ার সবচাইতে দুঃখী মানুষ না। আমি লেখার সময় যেমনই লিখি না কেন, আমার কথাবার্তা বলার ধরণ বেশিরভাগই ছাগলাছাগলা টাইপের বিধায় ওরা আমাকে কিছুতেই দূরের কেউ ভাবতে পারে না। ওরা শান্তিশান্তি অনুভব করে, আমিও করি। কেউ যদি বলে, ও কিছুই পারে না, আমি বলি কেবল বলদরাই সবকিছু পারে। আহা! এতে ওরা বড় খুশি হয়। তবে, আমি শুধু এইটুকুই বলে ছেড়ে দিই না, কিছুই না পারলে কী করলে কিছুই না পেরেও ঝামেলা এড়ানো যায়, সেই বুদ্ধিটাও দিয়ে দেই। কেন দেই? আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ!

এতে কিছু লাভও হয়। পুরোনোদিনের স্মৃতির রোমন্থন হয়। এই যেমন আজকে একটু আগে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল, আমি একসময় দোকানদারি করতাম। আমার গিফটের দোকান ছিল। আমিও আর দশটা দোকানদারের মতো রাস্তা থেকে লোকজনকে ডেকে ডেকে গিফট বেচতাম। (আমি একজায়গায় খালি একটু আলাদা ছিলাম। সেটা হল, শালার পড়াশোনা আমার প্রেস্টিজটেস্টিজ একটু বাড়ায়ে দিসিল, তাই লোকজনকে ডাকতে শরম লাগতো। কেউ দয়া করে দোকানে এলে ভুজুংভাজুং বলা শুরু করতাম আর জিনিস বেচতাম। তবে, আমার দোভানার আসলেই সুনাম ছিল। দোভানা আমার গিফটশপের নাম ছিল। হিউজ আর বেশকিছু রেয়ার কালেকশন ছিল। কিছু জিনিস শুধু আমার দোকানেই পাওয়া যেতো। হলমার্ক আর অর্চিসের অনেক রেগুলার কাস্টমার আমাদের রেগুলার কাস্টমার হয়ে গেসিল, মানে আমরা ভাগায়ে আনসিলাম, কিংবা ওরাই ভেগে আসছিল। দোকান বেচে দিয়েছি অনেক আগে। দোকান নেই, স্মৃতি রয়ে গেছে।) পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে এক টাকা দিয়ে জিনিস কিনে লোকজনকে ভংচং বলেটলে দুই টাকায় বেচতাম। আমার পাশের দোকানের ক্লাস ফাইভ-সিক্স পাসকরা দোকানদারের সাথে আমার কোনো তফাৎ ছিল না। ওরাও লোকজনকে মিথ্যা বুঝিয়েটুঝিয়ে কানের দুল বেচতো, আমিও বেচতাম। সত্যিসত্যি কোনো পার্থক্য ছিল না। ওরা ছিল আমার কলিগ। আমার সবচেয়ে বিদ্বান কলিগটি তৃতীয়বারে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেছিলো আর আমি একবারে পাস করেছিলাম বলে (আমি তখনো অনার্স পাস করি নাই। আমার অনার্স কমপ্লিট না করার ধান্দা ছিল।) আমার পরে উনার সম্মান ছিল সর্বজনবিদিত। ওদের সাথে একটাই পার্থক্য ছিল, কাস্টমারটাস্টমার না থাকলে ওরা হয়তো নখে নেইলপলিশ দিত, আর আমি গল্পের বইটই পড়তাম, গানটান শুনতাম, মুভিটুভি দেখতাম, ফেসবুকে লিখতামটিখতাম। আর কোনো পার্থক্য নাই। সেই রাস্তার দোকানদারটাই পরবর্তীতে বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। তাই কেউ যখন বলে, আমার সাবজেক্ট ভাল না, রেজাল্ট ভাল না, আমার খুব হাসি পায়। আরে বাবা, আমি গ্রাজুয়েশনে মাশাল্লাহ যে রেজাল্ট করসি, সেটা করতে হলে বহু কষ্ট করে অ্যান্টি-পড়াশোনা অভিযান চালাতে হবে। ওই পরিমাণ গাধা হইতে গেলেও কাঠখড় না শুধু, বড় বড় গাছ আর গাদাগাদা খড় পোড়াতে হবে। আমার সাথে এখন কেউ যে টুকটাক সম্মান দিয়ে কথা বলে, সেটাই তো আমার সাত না, সাতকোটি জন্মের ভাগ্য! পাগলারা! চেষ্টা চালায়ে যা! তোরা পাগলা হইলে আমি পাগলাসম্রাট! জীবন যে তোদের কোথায় নিয়ে ছেড়ে দিবে, ইউ ক্যান নেভার টেল!!

আজকে একটা কথা ভাইব্যা বড়ই শান্তি পাইতেসিলাম। পরে বুঝলাম, আমার কপালে শান্তি নাই। অনেকেই আমাকে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করসে, ভাইয়া, আপনি কি অসুস্থ? কিসু লিখেন নাই যে? শোনেন ডিয়ার ভাইবইনেরা, একটা বিষয় আছে যার নাম, রাইটার্স ব্লক। এইটা হইলে রাইটাররা লিখতেই পারেন না। লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন; স্থায়ী কিংবা সাময়িকভাবে। দুনিয়ার বহুত মাতব্বর মাতব্বর রাইটাররা এই প্রবলেমে পইড়া অভিমানটভিমান কইরা দুনিয়া ছাইড়া চইলা পর্যন্ত গ্যাসে। আমি ভাবসিলাম, একটু পার্ট নিই, আমারও ওইটা হইসে। তার মানে, আমিও ইয়ে মানে, রাইটার। পাবলিকের ভালোবাসা আমারে রাইটার সাজতে আর দিল না। নিষ্ঠুর নির্দয় নির্মম পাষাণ বেরসিক পাবলিক। বড়ই পরিতাপের বিষয়!

(এই লেখাটি গত ২০ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে লেখা)

ভাবনা: ছয়শো আটান্ন

………………………………………………………

প্রিয় ঋভু,

আমি শুধু চাইতে শিখিনি বলে সবকিছুই আমার সামনে এসে কীভাবে যেন চলে যায়। আমি জানি, আমার কথাগুলো শোনার সময় আপনার নেই। তবুও আমি বলবো। শুধু একটাই অনুরোধ, প্লিজ বিরক্ত হবেন না। ও ভালো কথা, আপনাকে প্রিয় ডেকেছি বলে রাগ করেননি তো? কী করবো, বলুন! আমি শুধু আপনাকে ডাকতে পারি না যে! অবশ্য, আপনার হাতে এখনো যে আমার কথায় রাগ করার সময় আছে, এটা বিশ্বাস করার স্পর্ধা এখন আর আমার হয় না।

‘বিয়ে’ শব্দটা জীবনকে এমনভাবে অতিষ্ট করে দেয়! একটা মেয়ের মেয়ে হয়ে থাকাটা বন্ধ হয়ে যায় কখন, জানেন? যখন ওর বিয়ের বয়স হয়, কিংবা যখন ওকে বাড়ির সবাই অন্যঘরে দেখতে চায়। আমাকে বিয়ে দেয়ার সকলের সকল আয়োজন আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমি মেয়ে না, আমি কালো মেয়ে আমি কালো মেয়ে! আমি কেন আমার কল্পনার রাজ্যে আর থাকতে পারছি না? আমি ঠিক করেছি, পালিয়ে যাবো। কেউ সাথে যাবে না, জানি। তবুও। দূরে, অনেকদূরে। দূর পাহাড়ের কোনের এক আশ্রমে। আমি শকুন্তলার মতো থাকবো। আচ্ছা, ওরা কি কালো মেয়ে রাখবে না? ওরাও কি ফিরিয়ে দেবে?

আচ্ছা ঋভু, আপনি কি শুনতে পান না আমি আপনাকেই প্রায়ই চিৎকার করে বলি, “আমাকে একটু সময় দাও, আমি ঠিকঠিক তোমার যোগ্য হয়ে উঠবো। তুমি শুধু আমার পাশে থাকো…. এই নিষ্ঠুর মানুষগুলোর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।” আপনি আমাকে প্রশ্রয় দিতে না পারেন, আশ্রয় তো দিতে পারেন। কী? পারেন না? একটুখানিও? মানুষ রাস্তায় কুকুরছানা কুড়িয়ে পেলে কি ছুঁড়ে ফেলে দেয়? ওইটুকু সামর্থ্য বিধাতা তো আপনাকে দিয়েছেনই। আমার বেলায় যতোটা, আপনার বেলাতে অতোটা কৃপণ তো তিনি নন। এই সাধারণ মেয়ের জন্য আপনি কি পারবেন না অন্তত কার্পণ্যে হলেও বিধাতাকে হারিয়ে দিতে?

হায়রে স্বপ্ন! আমি এখন আর স্বপ্নকে স্বপ্ন বলি না। পাপ বলি। হ্যাঁ, ওটা পাপ। মা বললেন, সেদিন নাকি জ্বরের ঘোরে আমি ‘ঋভু ঋভু’ বলে কাঁদছিলাম। ওটা কী স্বপ্ন? পাপই তো, না? সাধারণ মেয়েরা পাপকে স্বপ্ন ভেবে নিয়ে ভুল করে। আমার স্বপ্ন দেখতে বড্ডো বেশি কষ্ট হয়। আমি আর স্বপ্ন দেখবো না।

এই মুহূর্তে হাতের সেল ফোনটা যদি ভেঙে টুকরো টুকরো করতে পারতাম! ঋভু, তুমি কি বুঝতে পারছ না যে তোমার অস্তিত্ব আমাকে প্রতিটা মুহূর্তেই অস্তিত্বহীন করে দেয়? ইদানীং ভগবানের সাথেও আর অভিমান হয় না। যে অভিমান ভাঙ্গায় না, তার সাথে আবার কীসের অভিমান? আমার ভগবানের কাছে কিছু চাইতেও সংকোচ হয়। এতবার খালিহাতে ফিরে গেলে আর চাইবো কীভাবে, বলুন? যে রূপের আশ্রয় ভগবানও দিতে পারেন না, আপনিই বা কীভাবে দেবেন? আপনার প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই।

শুক বলে আমার কৃষ্ণ জগতের প্রাণ। শারী বলে আমার রাধা জীবন করে দান; থাকে কি আপন প্রাণ?

গোবিন্দ অধিকারীর লেখা গান। গাওয়া গানটা একটু অন্যরকম, কিছুটা এদিকওদিক আছে। শুনেছেন? না শুনলে লোপামুদ্রার কণ্ঠে শুনবেন। কণিকার কণ্ঠেও আছে, লোপারটাই বেশি মিষ্টি। বিশ্বাস করুন, মন ভরে যাবে। একটু কষ্ট করে ভোরবেলায় শুনতে পারবেন না? ভয় পাবেন না, এই কালো মেয়েটা আপনাকে ফোন করে ঘুম ভাঙাবে না। আজকে পূর্ণিমা, জানেন তো? ছাদে যাবেন? যান না! কী সুন্দর জোৎস্না উঠেছে। আমি আর ছাদে জ্যোৎস্না দেখতে যাই না। তাই নরোম আলোর চাদরে আমার ঘর ঢেকে যায়। প্রকৃতি কখনোই অসুন্দরের সৌন্দর্যকে ঈর্ষা করে না। জানেন ঋভু, আমার না ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। এরকম জ্যোৎস্নায় কারেন্ট গেলে বাবা বলতেন, “রেবা, কেয়া, লতা! হারমোনিয়ামটা নিয়ে আয় তো মা।” আমরা বুঝতাম, আজ আর পড়তে হবে না। কী যে খুশি হয়ে উঠতাম! হারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে দোতলার ছাদে ছুটে যেতাম। বাবা শুধু একজনকে ডাকতে পারতেন না, অথবা ডাকতেন না। অথচ বড়দি আমার চেয়ে এগারো বছরের আর ছোড়দি নয় বছরের বড় ছিল, ওরা যখন অনার্সে পড়তো তখন আমি ফাইভ-সিক্সে পড়তাম। এখন প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, বাবা, তুমি যদি আমাকে ফেলে চলেই যাবে, তবে আমাকে ভালোবাসার দায়িত্বটুকু কাউকে দিয়ে যাওনি কেনো? হাসছেন, না? ভাবছেন, ভালোবাসাটাও কি একটা দায়িত্ব নাকি? অধিকার দিয়ে অনুভব করা কাকে বলে জানেন? বোঝেন? আমি জানি। বাবাকে দেখে দেখে আমি ভালোবাসা শিখেছি, ভালোবাসতে শিখেছি। ছোড়দির হারমোনিয়ামটা নিয়ে আমরা ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে চাঁদের কোমল আলোয় ছড়িয়ে বসতাম। আমি এখন আমার পুরোনোদিনের মা’কে খুব মিস করি। মা তখনও আমার আদিখ্যেতাকে ঢং বলতে শিখে যাননি। আমি গাইতাম, “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে…..” এটা থাকতোই। বাবা চাইতেন, এটা থাকুক। আমি গাইতাম, আর বাবা হাত বাড়িয়ে যেন সেই পুরোনো সন্ধ্যার ঠাণ্ডা হাওয়া, দুধের শাদা সরের মতো আলোয় ভরা হাস্নাহেনার মিষ্টি গন্ধ ছুঁয়েছুঁয়ে দেখতেন। মা আঁচলে বেলী ফুলের মালা নিয়ে বাবার বাহুতে মাথা রেখে কীরকম যেন শান্ত হয়ে শুনতেন। আমার নিজেকে মনে হতে থাকতো, চাঁদের আলোয় ভরা মেয়ে চাঁদের আলোয় ভরা মেয়ে। বাবা বলতেন, রেণুকা, তুমি দেখো, আমাদের লতা যে ঘরে যাবে, সে ঘরে রোজ পূর্ণিমা হবে। হায়! বাবা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো, তোমার লতা আজ কতোটা অসহায় হয়ে ঘর খুঁজে ফেরে? ছোড়দি গাইতো, “পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়…..” মাও সাথে গলা ধরতেন। ছোট্টো আমি গুটিসুটি মেরে বাবার কোলে লুকিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতাম বাবার চোখের মণিতে সন্ধ্যাতারারা খেলছে। মায়ের মুখের উপরে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো আঙুল দিয়ে সরানোর বাবা কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা মায়ের আঁচল দিয়ে মুছে নিতেন। আমি এখন গুনগুন করি, “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না……….” ওই কোলটাকে খুব মিস করি। অতোটা নিরাপদ নির্বিঘ্ন নিরুদ্বিগ্ন নিশ্চিন্ত আশ্রয় আরো আছে, এটা অবিশ্বাস করতে শিখে যাওয়ার মতো আজ যথেষ্ট বড়ো হয়ে গেছি বোধ হয়। ঋভু, আপনাকে বলছি না এইসব। কিছুতেই না! আপনি শুনছেন না তো এইসবকিছু?

আজকের দিনে বাবা আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। আমার এখন আর ‘আমাদের’ বলতে ইচ্ছে হয় না, তাই ‘আমাকে’ বলেছি। ভালোবাসাহীনতা মানুষকে বড় বেশি স্বার্থপর করে দেয়। যাকে কেউই ভালোবাসে না, সেই সব থেকে বেশি নির্ভার। স্বার্থপর হতে হলে নির্ভার হতে হয়। আমার মরে যেতেও ইচ্ছে হয় না। যার বাঁচারই মানে নেই, তার মরে যাওয়ার কী মানে? মরে যেতে হলেও তো অভিমান করার জন্য কাউকে না কাউকে লাগে। বাবার সেই কালো ফ্রেমটা এই মুহূর্তে আমার টেবিলে রবি ঠাকুরের ওপরে। আজ এতদিন পর বুঝতে পারছি এতোএতো গান থাকতে ওই দুটো গানই কেন বাবা গাইতে বলতেন! জ্যোৎস্না মনে হয় অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়।

এইসব আপনাকে কেন বলছি!

আগের মত আর ভাবতে পারিনা। ভাবিও না। যা হচ্ছে হোক না! কতোটুকুই বা হবে? কতোটুকুই বা হতে পারে? কতোটুকুই বা হয়? মাঝেমধ্যে চারপাশের সমস্ত কিছুকে মিথ্যা মনে হয়। এই যেমন এখন আপনাকে লিখছি, একটু পরেই হয়তো ভাবনাগুলো অন্যরকম হয়ে যাবে। কী অদ্ভুত, না? কেন এমন হয়? আমি ভাবতেও পারি না। আমার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। হাতপা সমস্ত শরীরমন অবশ হয়ে আসে। ইদানীং আমার কিছুই ইচ্ছে হয় না, অনুভূতিও হয়না। ভাবি, কী দরকার? সবাই যা বলে নিষ্কামভাবে করে যাই, ঠিক না, বলেন? আমি আর অতো ভাবনা ভাববো না, মন খারাপ করে থাকবো না। আই ডোন্ট কেয়ার অ্যানিথিং! লেট ইট গো! শুধু মাঝেমধ্যে মনে হয়, কী যেন একটা করার ছিল কী যেন একটা করার ছিল! দুদিন থেকে আউট অব স্টাডি, আউট অব এভরিথিং। আমার মন যে কিসের গতিতে চলে, বুঝিনা। এই যে আপনাকে লিখছি, লিখতে লিখতেই মনে হচ্ছে, কী ফালতু কাজ করছি! কতোদিন এভাবে লিখেটিখে আপনাকে আর পাঠাইনি আপনি তা কোনোদিন জানতেও পারবেন না। …. জানি, এটাও আপনার কাছে যাবে না। পাঠানোর কথা মনে হলেই আমি ভাবতে থাকি, কী দরকার এইসবের! কী ভাববেন আমাকে! উফফফ! আর পারছি না! যা ইচ্ছে ভাবুন তো…… এই কালো মেয়েটাও নাকি আবার ভাববার কিছু! অনেক কাজ পড়ে আছে। যাই………