ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (১২শ অংশ)

ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (১২শ অংশ)

Sushanta Paul·Tuesday, March 7, 2017·1 minute

ভাবনা: আটাত্তর।

……………………..

ভাল ব্যবহার বা ভাল কথা আমাদের ভাল লাগে না, আমরা লাথি খেতে বড় ভালোবাসি। আমরা মনুষ্যজাতি মূলত লাথিখাওয়া জাতি। প্রাণিজগতে এমন জাতি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা আমাদের সহ্য হয় না, একটা লাথির লোভে আমরা দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরি—কেউ বুঝে ঘুরি, কেউ-কেউ বা না বুঝেই ঘুরি। কেউ সেটা মুখে স্বীকার করি, কেউ-কেউ করি না। যা-ই করি না কেন, লাথির পেছনে সব কাজ ফেলে ঠিকই হন্যে হয়ে ছুটি। সত্যিই আমাদের ভালোবাসে, এমন কেউ যদি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়েও থাকে, ওতে আমাদের কিছুই এসে যায় না, অথচ যার লাথি খেতে ভাল লাগে, যার সাথে আমাদের স্বার্থ লেপ্টে আছে, তার বাসার বাইরের রাস্তায়, আঁস্তাকুড়ের পাশে একটা নেড়িকুত্তাও অসহায়ভাবে হঠাৎ ক্যোঁৎ করে উঠলেও ভ্রাতৃপ্রেমে আমাদের মনটা উতলা হয়ে উঠে। যত ভাল ততই বিতৃষ্ণাজনক, যত খারাপ তত উপাদেয়!—আমরা এই বিশেষ নীতিতে বাঁচি। ভাবি, নাহয় একটু লাথি খেলামই, তবুও তো সুন্দর এই লাথিময় স্বচ্ছন্দ জীবন! কাছের মানুষ ঠিক কথা বললেও বলি, বেশি কথা বল! আর স্বার্থের সাথে জড়ানো মানুষ ভুল কথা বললেও বলি, একদম ঠিক কথাটাই বলেছ! জীবন এমনই এক কঠিন জায়গা যেখানে আন্তরিক ভালোবাসার চাইতেও আন্তরিক চড়ের দাম দিতে হয় বেশি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কারো-কারো আত্মসম্মানবোধটা প্রয়োজনের চাইতেও বেশি, আর কেউ-কেউ আছে, যারা আত্মসম্মানবোধ কী, সেটাই বোঝে না। কাছের মানুষগুলি প্রথম ধরনের মানুষ হলেও আমাদের ভাবনায় আমরা তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে দ্বিতীয় ধরনে নামিয়ে ফেলি, বা নামতে বাধ্য করি। ওরাও নেমে যায়! কী করবে? ভালোবাসে যে! ভালোবাসার দায়ে ওরা মুখ ফুটে হয়তো কিছু বলে না, কিন্তু হৃদয় তো ঠিকই পুড়তে থাকে।

প্রায়ই মনে হয়, যাকে কাছে পেতে চাই, তার কাছের মানুষ না হয়ে যদি স্বার্থের মানুষ হতাম, তবে ঠিকই তাকে কাছে পেতাম। রাতে বিছানায় শুয়ে যখন চোখজোড়া বন্ধ করে এসব ভাবি, তখন মাথায় আসে, আহা, ঈশ্বর যদি এমন কাউকে আমার কাছে এক মুহূর্তের জন্য হলেও পাঠাতেন, যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে সব কষ্ট চলে যেত! এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে হালকা হওয়ার জন্যও কাউকে লাগে। কী অদ্ভুত বেহায়া মানবজন্ম! যে আমাকে চায়ই না, আমি তার ব্যথায় ব্যাকুল! কোনো মানে হয় এসবের?

আসলে এই পৃথিবীতে কোনো মানুষেরই এমন কেউ নেই, যাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে কষ্ট কমিয়ে ফেলা যায় বা অন্তত ভুলে থাকা যায়। আমরা ভুল করে ভাবি, এমন কেউ আছে। নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি না, সময় হলে সেই মানুষটি ঠিকই সামনে এসে চমকে দেবে।…… আসলে, এ সবই মায়া, কেবলই ভ্রম। এমন কারো এই পৃথিবীতে থাকাই সম্ভব নয়। থাকলেও হয়তো সে অন্য কোনো পৃথিবীর বাসিন্দা, যে পৃথিবীর সাথে আমাদের এ জন্মে আর কোনোদিনই দেখা হবে না।

ভাবনা: উনআশি।

……………………..

কথা তো ওইটুকুই। ওই সামান্য কথাটুকুও লিখে পাঠানো যায় না। লিখতে গেলে কিছুতেই হাতের আঙুল চলে না, কথার সুতো মাথায় ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে-খেতে কোথায় যেন দলা পাকিয়ে আটকে থাকে। কোনোভাবে লিখে ফেললেও সেটা অথর্ব কিছু অক্ষর হয়ে চোখের সামনে দিয়ে কোন এক অজানা-অচেনা পথ ধরতে চায়, যে কথাটি যেখানে যাওয়ার কথা, সেখানে না গিয়ে অন্য রাস্তা মাপে। কথার যাত্রাপথটা বড় রহস্যময়, অসংজ্ঞায়িত, অদ্ভুতুড়ে। কতবার লিখেছি পাঠাবো বলে, ওর ইনবক্স পর্যন্ত যায় নি ওটা। এমনও হয়েছে, তিনদিন ধরে কত ধৈর্য ধরে কত-কত ভাবনা গুছিয়ে জড়ো করে আবার নষ্ট করে ফেলেছি। সেন্ড বাটনে আলতো একটা স্পর্শ—কী যে কঠিন হয়ে ওঠে সময়ে-সময়ে! যাকে নিয়ে ভাবছি, সে কেন জানতে পারে না আমার ভাবনার কথা? অথচ, যে ওকে ভাবেই না, কিন্তু এমন নিপুণ অভিনয় করে যায় যেন ওর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে, তাকেই সে তার দামি সময় আর মন দুইই দিয়েটিয়ে বসে থাকে। ফেসবুকে টেলিপ্যাথি ফিচারটা থাকলে দারুণ হতো! জুকারবার্গ সাহেব, ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখুন না প্লিজ। ওরকম কিছু থাকলে আমার মতো মুখচোরারা বড় বাঁচা বেঁচে যেতো। বেঁচে যেতো কিছু ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক যেগুলো জোড়া লাগার আগেই ভেঙে গেছে। কত সম্পর্কই তো গড়ে নিশ্চিতভাবেই ভেঙে যাওয়ার নিয়তে। আর যে সম্পর্কটি গড়লে শুধু এক মৃত্যুতেই ভাঙত, সে সম্পর্কটি গড়া দূরে থাক, ওই দুজন মানুষ কেউ কারো মনের কথাটাই জানতে পারে না কোনোদিন। কী কষ্ট! কী কষ্ট! . . . . . . . একটু থেকে অনায়াসেই বেশি হয়ে যেতে পারতো যে টুকরো-টুকরো হ্যালো! হাই! সেগুলো আমি পাঠাতে পারিনি ওকে। কখনোই না। নিজের সাথেই নিজে ক্রমাগত হাই! হ্যালো! করে কাটিয়ে দিয়েছি দিনের পর দিন। আচ্ছা, সেও কি আমার মতোই? মানে, মুখচোরাদের দলে? ও কেনো এমন হলো? হবে-ই বা যদি, কেনো আমার কথাই ভাবলো, যে কিনা ওর মতোই ‘আমি কেনো নিজ থেকে বলতে যাবো আগে’ এই ইগো মাথায় নিয়ে কী এক তীব্র প্রতীক্ষায় বসে থেকে-থেকে দীর্ঘ বাজে সব ফেসবুক স্ট্যাটাসে ক্লান্তি থেকে মুক্তি খোঁজে? জীবনকে ফেস না করে ফেসবুক করা কত সহজ! এই সহজ কাজটাই সবার মতো আমিও করে যাই, তাই ঠকি বারবার। যে জীবন ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ, সে জীবন ফেসবুক ছেড়ে বাইরে এলেই অসহায় হয়ে পড়ে। আবেগের ঘোড়াগুলি ফেসবুকের দেয়াল কাঁপিয়ে ছুটতে-ছুটতে ক্লান্ত স্থবির হয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে, ওই বেচারাদের জীবনমাঠে আর ছোটা হয় না। জীবন তো জীবন-ই। সিনেমা নয়। কবিতা নয়। উপন্যাস নয়। লেখকের ওই সুখকল্পনা লেখককেও দেয়নি কিছুই। খোঁজ নিয়ে দেখুন না! গল্পের ঘোড়া শুধু গল্পেই আকাশে ওড়ে। জীবনের ঘোড়ার কোনো পাখা থাকে না, তাকে পায়ে ভর করেই দৌড়াতে হয়। সে পায়ে ক্ষত হয়, সে পা অবসাদে ভোগে, সে পা তার মালিককে প্রায়ই বলে, আর পারি না। ও কেনো-ই বা ধরে নিয়েছিল, একদিন ঠিক-ঠিক ‘ঠিক ব্যাপার’টাই ঘটবে? আমরা না ঘটালে কয়টা ব্যাপার ঘটে এখানে? যা ঠিক, তা-ই ঘটে? নাকি, যা ঘটে, তা-ই ঠিক? এর উত্তরটা কে দিতে পারে ঠিকঠাক? ও যাকিছু পেয়েছে, তার কতটা ও ডিজার্ভ করে? বেশিরভাগই তো আর্ন করেছে, তাই না? তাই, এই বিচ্ছেদও ওর অর্জন। সাথে আমারও। হায়! মিলনের সুখ এলো না, অথচ বিচ্ছেদের ব্যথায় কেমন নীল হয়ে আছি!

ভাবনা: আশি।

……………………..

অনেক ভালোকিছু করতে সবসময়ই অনেক সময় দিতে হয়, এমন নয়।

স্ত্রী অ্যানির জন্যে লেখা ‘ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস’ লিখতে জন ডেনভার সময় নিয়েছিলেন ১০ মিনিট। ভদ্রলোক স্কিয়িং করছিলেন, এরই এক ফাঁকে লিখেছেন এই জনপ্রিয়তম গানটা।

হয়তো কথা রাখেনি এমন কারো কিংবা কারো-কারো ওপর অভিমান করে লেখা ‘কেউ কথা রাখেনি’ লিখতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সময় লেগেছিলো ১৫-২০ মিনিট। পত্রিকার ছাপবার জন্যে কবিতা চাইতে আসা এক ভদ্রলোককে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে ‘আপনি একটু বসুন, আমি কবিতাটা নিয়ে এই আসছি’ বলে ভেতরের রুমে পালিয়ে কবি লিখেছিলেন পরবর্তীতে অসংখ্যবার আবৃত্তি হওয়া এই চমৎকার কবিতাটি। অনেকদিন ধরেই সুনীল কবিতাটা দিচ্ছি, দেবো করে-করে বেচারাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলেন। একদিন আগে থেকে খবর না দিয়েই হুট করে সে ভদ্রলোক সুনীলের বাসায় হাজির। অগত্যা, কী আর করা! সুনীলকে বলতে হলো, “হ্যাঁ, লেখা হয়েছে, আমি ঘরের ভেতর থেকে ওটা নিয়ে আসছি।” ওইটুকু মিথ্যেকে পাস করিয়ে দিতে একটা তাজা গরম-গরম কবিতা নিয়ে ওই অল্প সময়ে ভদ্রলোকের সামনে হাজির হওয়ার যে শক্তি, তা সুনীলের ছিল।

সুন্দর কিছু করতে পরিশ্রম কিংবা বুদ্ধিমত্তার চাইতেও আবেগটাই বেশি দরকার। কম সময়ে অনেক কিছু করতে জানাটা মস্তো বড়ো একটা আর্ট। তাই, আলস্যের কোনো দোষ নেই। যতো দোষ, কাজটা করতে না-পারা’র। আমি অলস, কী পরিশ্রমী, সে খোঁজ কেউ কোনোদিন রাখবে না। লোকে শুধু দেখবে, আমি কাজটা করতে পেরেছি কিনা।

তাই, আমি ছুটির দিনে ছুটিতেই থাকি। নিজেকে সুন্দর করার অনেক বুদ্ধিটুদ্ধি অনেকে দেয়। এই যেমন, জিমে যাওয়ার বুদ্ধি। এইরকম আরো অনেককিছু। অনেক কথার মতো এটাও আমি এক কান দিয়ে শুনে মহানন্দে অন্য কান দিয়ে বের করে দিই। কী দরকার বাপু বাহ্যিক অবয়বে নায়কোচিত হওয়ার সাধনায় নিজেকে অমন করে সঁপে দেয়ার? ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমে কাটিয়ে কবে কোন মহাত্মা প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছেন? জগতের কোন প্রকৃত মহানায়কটিকে নায়ক হতে জিমবাসী হতেই হয়েছে? যেকোনো দিক বিবেচনায়ই, আজ পর্যন্ত কখনোই তো নিজেকে কোনো জিম-ম্যানিয়াকের চাইতে কম সুস্থ-সবল জীবন কাটাতে দেখলাম না! ২০-৩০ কেজি বই বহন করতে-করতে বইয়ের দোকানে-দোকানে ঘুরেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হাজার সিঁড়ি ডিঙিয়ে বাতু কেভস্‌-এ উঠে গেছি সবার আগে, বগা লেক-এ পৌঁছতে দলের অন্য যে কারো চাইতে কম সময় নিয়েছি। ওপরে উঠে সবাই যখন বসে-বসে জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে, তখন আমি চারপাশটা ঘুরে-ঘুরে দেখছি। আসল স্ট্যামিনা তো মনে, পেশিতে নয়। মানুষের পরিশ্রম করার ক্ষমতা ও অক্ষমতা, দুইই মূলত মানসিক। জিমে গেলে বিশ্বের সুদর্শনতম পুরুষ হয়ে যাওয়া যাবে নাকি? যার সৌন্দর্যের বিচার পেশির ভাঁজে, অমন স্টুপিডের চোখে সুন্দর হওয়ার সাধনায় ফালতু সময় নষ্ট করার কী মানে? কত কাজ বাকি এ জীবনে! যে চাপটা শরীরে দেবো, সে চাপটা মস্তিষ্কে দিলে বরং চিন্তা করার ক্ষমতা আর মস্তিষ্কের সৌন্দর্য বাড়বে। পেশিবহুল দৈহিক কাঠামোধারী মেধাবী মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি।

আরে বাবা, সুন্দর তো আছিই! সৌন্দর্যের অভাব মানুষকে যতটা অসুন্দর করে, তার চাইতে অনেক বেশি অসুন্দর করে দেয় নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণার অভাব। আরো এক্সকিউজ দাঁড় করাতে হবে? আমার আছে এ্যাত্তো-এ্যাত্তোগুলা রেডিমেড এক্সকিউজ! হাহাহাহা…………..

কবিতা লিখতে হলে, শান্তি নিকেতন লাগবেই, এমন নয়। মাথায় জিনিস থাকা চাই। শান্ত পাহাড়ের গায়ে লেপটেথাকা এক কুটিরে বসে-বসে এক উচ্চশিক্ষিত লোক কবিতা লেখা শুরু করলো এইভাবে—ললাট মোর ভেসে গেলো দুই নয়নের জলে ……. এরপর ভাবতে লাগলো, চোখের পানিতে কপাল ভেজে! ক্যামনে কী! আবার ওই লাইনটা চেঞ্জ করতেও মন চায় না; কতো অসাধারণ একটা কথা আমার অতিউর্বর মাথা প্রডিউস করলো! কী করি কী করি ভাবতে-ভাবতে অনেকক্ষণ পর সে ২য় লাইনটা লিখলো—মোর পা দুখানা তখন বাঁধা ছিলো ডালিম গাছের ডালে। ……. বুঝুন অবস্থাটা!

এই যে এই দীর্ঘ লেখাটার কথাই বলি না কেন! এটা আমি লিখতে শুরু করেছি কোথায়, কীভাবে, কী অবস্থায়, সেটা শেয়ার করাটা ভদ্রোচিত হবে না। তাই শেয়ার করতে পারলাম না। তাই বলে ওভাবে লেখা শুরু করা যায় না, এমন তো নয়!

ফেসবুকে ‘হোয়াটস্ অন ইয়োর মাইন্ড’ এই প্রশ্নের যথাসম্ভব রিফাইন্ড উত্তর দেয় সবাই-ই। সবসময় সিনসিয়ারলি ফিলিংস্ প্রকাশ করলে মাইর খাওয়ারও চান্স আছে। কোনো সুন্দরীকে আপনার রিয়েল ফিলিংস্ বলেই দেখুন না কী হয়! আমার তো প্রায়-প্রায়ই ইচ্ছে হয়, সত্যপ্রকাশের মহান ব্রত নিয়ে স্ট্যাটাসে লিখে দিই, অমুককে চুমু খেতে খুউব ইচ্ছে করছে……..

বন্ধুরা, বেহুদাই বহুত আজাইরা প্যাঁচাল পাড়লাম। হ্যাপি মোমেন্টস্‌! শুভ আলস্য। সুন্দর সময় কাটুক সবার। কোনো সুন্দরমুহূর্ত দুইবার কাটানো যায় না, সবচে আবেগঘন চুমুটা দুইবার খাওয়া যায় না। কোনো সুন্দর কাজই একইভাবে দুইবার করা যায় না। শাহরুখ খান যদি আরেকবার “কি….কি….কি….কিরণ………” এই ডায়লগটা বলেনও, তবুও আর যা-ই হোক, ঠিক ‘ডর’ মুভিটার মতো আরেকবার কিছুতেই হবে না। সুন্দরমাত্রই ইউনিক।

ভাবনা: একাশি।

……………………..

দেখতে খুব বেশি সুন্দর, এমন কারো দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায় নাকি? আমি তাকালাম, তাকিয়ে আছি, যদি কোনোভাবে সে এই ব্যাপারটা ধরে ফেলে, তাহলে তো মহাবিপদ! আর যদি ধরে ফেলতে নাও পারে, তবুও তো কখন ‘ধরা খাই’ এই অস্বস্তিতেই তাকিয়ে থাকতে পারার কথা না। ওরকমভাবে শুধু সিনেমাতেই তাকানো যায়৷ নায়ক নায়িকার, বা নায়িকা নায়কের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে, চোখের পলকটা পর্যন্ত পড়ছে না, এর সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক …… লালালালালা ……. লালালালালা ……. লালালালালা ……. লালালালালা ……. লালালালালা ……. লালালালালা ……. লাআআআ ……. লালালালাআআআ ……. (এই মিউজিকটা কিন্তু একটা হিন্দি মুভি থেকে নেয়া৷ বলুনতো, কোন মুভি?) যারা দেখতে খুব সুন্দর, তাদের বেশিরভাগই কিন্তু অন্যদের দিকে কনফিডেন্স নিয়ে তাকিয়ে থাকতে পারে, কথা বলতে পারে৷ সুন্দর লাজুক মানুষ সংখ্যায় কম। আর ওরকম সুন্দর কেউ তাকিয়ে থাকলে কেমন জানি অস্বস্তি হয়, নিজেকে আরো অসুন্দর মনে হয়, নার্ভাস লাগে৷ আমি এমনিতেই নিজেকে লুকিয়ে রাখে এমন গোছের আত্মসংবৃত মানুষ, লোকের সামনে গেলে তো রীতিমতো গুটিয়ে যাই, তার ওপর অতি সুন্দরী কারো সামনে পড়লে তো মনে হয়, এক্ষুনি মাথাটাথা ঘুরে পড়ে যাবো৷ সেদিন এক অতিসুন্দরীর সাথে দেখা৷ কী অপূর্ব হাসি, চাহনি, দেহপল্লব৷ ওকে দেখলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, মেয়েটা আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। যতই দেখি ততই নিজেকে অসুন্দর গাছে-গাছে বেড়ানো প্রাণী সদৃশ লাগে। মনে হতে লাগল, ও ভাবছে, আমি দেখতে একটু হনুমান-হনুমান টাইপ৷ এইরকম অন্ধ-করে-দেয়া সৌন্দর্য রীতিমতো অসহ্য!! আমি একবার তাকিয়ে আর দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পর্যন্ত করিনি৷ ওর যারই দিকে হাসছিল, তাকেই আমার মনে হচ্ছিলো, ও একটা ছাগল, ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারলে শান্তি পেতাম। ভ্যাড়াভ্যাড়া লুক নিয়ে বসে-বসে তোতলাতে-তোতলাতে অন্যদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম৷ পরে জানলাম, ও আমার এক বন্ধুর বোন এবং জানি না কেনো, আমার নাকি মস্তো বড়ো ফ্যান৷ (শুনে আমার বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে করলো, আমি সত্যি-সত্যি এমন কেউ, যার ফ্যান না হওয়াটাই বড় পাপ!……. OMK! O Mor Khoda!! কেউ আমারে ধইরা মাইরালা!!) বাচ্চারা যেভাবে চিড়িয়াখানার চিড়িয়া দ্যাখে, সেভাবে সে বারবার আমার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছিলো বলে এমনিতেই ভীষণ অস্বস্তিতে ছিলাম, তার উপর এইসব শুনেটুনে ওই শীতেও ঘামতে শুরু করলাম৷ এমন সুন্দর মেয়েও আমাকে চেনে? মানবজনম কি আগে থেকেই এতো সার্থক ছিল, নাকি আজকেই হঠাৎ সার্থক হয়ে গেলো? আমি তো প্রায়ই স্বপ্ন দেখি, জগতের আগুনজ্বলা সুন্দরীরা সবাই আমার ফ্যান! তাহলে কি আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলল? এও সম্ভব?

আমি ওর সাথে কোনো কথাই বলিনি, বলার সাহসই হয়নি৷

চলে যাবার সময়…….

ও হাতজোড় করে বললো, দাদা, আসি৷ নমস্কার৷

(এই এতোক্ষণে খেয়াল করলাম, তার সিঁথিতে একটুখানি সিঁদুর, হাতে শাঁখা৷ দেখে আমার ভ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা করে কান্না করে দিতে ইচ্ছা করলো। হায়! যাকে কখনোই আশ্রয় দিতে পারবো না, তাকে এতোক্ষণ মনে-মনে কী সুখেই না প্রশ্রয় দিয়েছি! আমার মতো অসহায় যুবকের জন্য ঈশ্বরের কি একটুও দয়ামায়া হয় না?)

হুট করেই বলে ফেললাম, ওয়ালাইকুম আসসালাম৷

শুনে ফিক্‌ করে হেসে ম্যাজেন্টা ফুলস্লিভে মুখ ঢেকে সত্যজিতের চারুলতা চলে গেলো৷

ও কী বলল, আর সেটার উত্তরে আমি কী বললাম, এটা বুঝতে বেশ খানিকক্ষণ লাগল। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে বারবারই মনে হচ্ছিলো, আমি দুনিয়ার এক নম্বর ক্ষ্যাত৷ ওয়ালাইকুম বলার আগে মরে গেলাম না কেনো? হে ঈশ্বর! আমারে আরেকটু ইশমার্ট বানাইলে ঘোড়া কি আরেকখানা ডিম বেশি পাড়িতো? হে ধরণী! দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি৷

ভাবনা: বিরাশি।

……………………..

এয়ারপোর্টে ডিউটিতে। তখন ফ্লাইট ছিল না। শেষেরটা ছিল ১২টায়, পরেরটা ৩টায়।

রবি ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ থেকে বানানো সত্যজিতের ‘চারুলতা’ দেখছি। ২ ঘণ্টার মুভি।

আমি বাঙালি মেয়ের উপর ক্রাশ খেতে ভালোবাসি। তাই ঘুরেফিরে পুরনো বাংলা মুভি দেখি। ক্রাশ খাওয়ার ধরন দেখে একটা মানুষের রুচি বোঝা যায়। আমি সনাতন রুচির মানুষ, তাই বারবার পুরনোতে ফেরা। প্রায়-প্রায়ই ক্রাশ খাই। (শেষবার ক্রাশ খেয়েছিলাম, ব্যালাড অব অ্যা সোলজার মুভির নায়িকার উপরে।)

মাঝখানে মেজাজখারাপ করে সুচিত্রার মুভিদেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সুচিত্রা বড় ভয়ানক নেশা। মাথায় এতোটাই জেঁকে বসে যে আর কাউকেই ভালোবাসতে দেয় না।

তবে, চারুলতার মতো আর কোনো বাংলা মুভির চরিত্র আমাকে কখনোই এতোটা মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেনি। এই মুভি দেখার পর মাধবীর সবকটা মুভি খুঁজে-খুঁজে দেখে ফেলেছি।

আমার অবচেতন মন কিছু চরিত্রকে প্রশ্রয় দিয়ে রাখে। সুনীলের মার্গারিট, মুজতবার শবনম, সত্যজিতের চারুলতা, আমার শতাব্দী (এই নামে আমার কেউ নেই। তবুও নামটা আমার অসম্ভব প্রিয়। কেন প্রিয়? তাও জানি না। যেমন মেয়েকে কল্পনা করে সুখ পাই, তেমন কাউকে আমি শতাব্দী নামে ডেকে শান্তি পাই। এ ব্যাপারটার কী ব্যাখ্যা? নাকি, এটা নিছকই প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর রহস্যময় খেলা?) ওরা সবাই মিলে আমাকে ঘিরে রাখে। মাঝে-মাঝে আমার অবচেতন মনকে কিছু পাইয়ে দিয়ে মিথ্যে-মিথ্যে জিতিয়ে দিতে ‘চারুলতা’ দেখি। নাই বা পেলাম তাকে, পেয়েছি ভেবে সুখ পেতে দোষ কীসের?

‘চারুলতা’ দেখার সময় সৌমিত্রকে ঈর্ষা করতে ভালো লাগে। সেদিনও করছিলাম। কথা সেটা না। বিশ্রী ব্যাপার হল, চারুলতা দেখছি; চারুলতাকে ভালোবাসছি, অনুভব করছি, মনের মতো করে এঁকে নিচ্ছি বারবার, ভাল লাগছে, হঠাৎ একটু করে হেসে উঠছি, ঠিক এইসময়ে পাশের রুমে কার যেন মোবাইলে বেজে উঠল, লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স …………..

ওটা কানে আসার পর থেকেই, সামনে দূরবীন হাতে চারুলতা-যাদু, আর এদিকে আমার মাথায় বাজছে…….. লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স লুঙ্গি ড্যান্স ………

উফফ্‌! তুচ্ছ লুঙ্গির কাছেও অসামান্যা চারুলতা হেরে যায়! আমি এরকম? এ-ই আমি?! জঘন্য! অতি জঘন্য! কী হলো আমার? আমি নিজেই নিজেকে চিনতে পারছি না! মুভিদেখা বন্ধ করে দিলাম!! আমি লুঙ্গির কাছে চারুলতাকে হারতে দেবো না। আমার ক্রাশ লুঙ্গির কাছে হেরে যেতে পারে না…..পারে না…..পারে না…..! কিছুতেই না!!

ভাবনা: তিরাশি।

……………………..

(ইহা একখানা একটি বিবাহ (=বিপদ বাড়ানো হলো) পূর্ববর্তী লেখা।)

ছেলেদের একটা বয়স আছে, যে বয়সে ফেসবুকে মেয়েটাকে দেখেশুনে, সামনাসামনি দেখলে পছন্দ হবে না, এটা নিশ্চিত জেনেও মা’কে খুশি করার জন্য পাত্রী দেখতে রাজি হতে হয়। ওরকম কারো প্রপোজাল বাসায় এলে, মেয়েকে সামনাসামনি দেখতে রাজি না হলে বাসায় বকা খাই; মেয়ের ফ্যামিলি ভাবে, ছেলের ফ্যামিলি অহংকারী; কিংবা যে সহৃদয় ব্যক্তি ‘দয়া করে’ প্রপোজালটা পাঠিয়েছেন, উনি নিরাশ, অখুশি এবং বিরক্ত হন। তখন উনাকে খুশি করার জন্য হলেও মেয়ে দেখতে যেতে রাজি হতে হয়, এই ভয়ে—যদি উনি রাগ করে আর কখনো কোনো সম্বন্ধের খোঁজ না দেন!

একটা মেয়েকে দেখার পর ‘না’ বলতে খুব কষ্ট লাগে। দুটো কারণে। এক। আমি যে ২-১ জায়গায় রিফিউজড্‌ হয়েছি, সেখানের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, ‘না’ শোনার কষ্ট কী। দুই। আমি কল্পনা করে নিই, আমার একটা ছোটোবোন থাকলে, একটা ছেলের কাছ থেকে ওরকম একটা ‘না’ ওর কিংবা আমাদের ফ্যামিলির উপর কী বাজে একটা প্রভাব ফেলত। এতে মেয়েটার আত্মবিশ্বাস কমে যায়, এমনকি, কেউ-কেউ নিজেকে অযোগ্য অসুন্দর মনে করতে থাকে। কারো আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়, এমন কোনো কাজ করা আমার খুবই অপছন্দ।

আমি দেখেছি, অনেক মেয়েই প্রেম করে, কিন্তু বাসায় ভয়ে বলতে পারে না। তাই, কোনো মেয়েকে ফেসবুকে দেখেটেখে পছন্দ হয়ে গেলেও, আমি খবর নিই, ও কী সিঙ্গেল, নাকি এনগেজড্‌। পরশ্রীকাতরতা কিংবা পরস্ত্রীকাতরতা, সময়ের অভাবে এর কোনটাই আমার মধ্যে নেই। বেশ কয়েকজন মেয়ের গার্ডিয়ানকে আমি শুধু এইজন্যই খবরটবর নেয়ার পর ‘না’ করে দিয়েছি। ওরা ভেবেছে, আমার কোনো সমস্যা আছে হয়তো। ভাবুক গিয়ে! কিচ্ছু করার নেই। হয়তো ছেলেটা এখনো বেকার, একসময় ভালকিছু করবে, তখন ওরা বিয়ে করবে, মেয়েটা ওই মুহূর্তের প্রতীক্ষায় আছে। সে ছেলের চাকরি নেই, তবুও প্রেম তো আছে। ওইটুকুও হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকবার জন্য আর কী-ই বা থাকে ওর? যার চাকরি নেই, কাজ নেই, কিন্তু একটা প্রেমিকা আছে, ওই প্রেমই তো তার একমাত্র কাজ। সে কাজটাও চলে গেলে, সে হয়ে পড়বে বেকারের বেকার। তখন কী নিয়ে বাঁচবে বেচারা? বাবা-মা’র দুঃখের কথা না হোক, প্রেমিকার মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও তো হাসিমুখে যুগের পর যুগ একটা চাকরির জন্য প্রতীক্ষা করা যায়! আমি চাই, আমি হই না হই, জগতের অন্যসকল প্রাণী সুখী হোক, মঙ্গললাভ করুক। সুন্দরী মেয়েমাত্রই অন্যকারোর গার্লফ্রেন্ড কিংবা এক্সগার্লফ্রেন্ড। এক্স নিয়ে আমার কোনো আপত্তিই নেই, কিন্তু এক্স হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তাকে এক্স হতে সময় দেয়ার পক্ষে। অনেক দাম দিয়ে জীবন থেকে শিখেছি, সময় থাকতে সুন্দরী মেয়েকে নক না করার কিংবা ওরকম কেউ নক করলে ভাব নিয়ে বসে থাকার শাস্তি ভয়াবহ।

আমি সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে খুব একটা দেখি না। গত ১ বছরে নিজের ইচ্ছায়, অন্যকারোর মন এবং মানরক্ষায় কিংবা পরিবারের অনুরোধে ৬ জন মেয়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখেছি। বাবা-মা ছেলেবউ দেখার বয়সে চলে গেছেন। দুদিন পর আমাকে আর কেউ দেখতেও রাজি হবে না; মানে, খুব শিগগিরই আমি রিফিউজড্‌ হওয়ার শেষ সুযোগটুকুও হারাতে যাচ্ছি—এইসব কথাবার্তা শোনার এবং শুনতে-শুনতে প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হওয়ার বয়সে পৌঁছে গেছি। এই বয়সটা নিজের মানিব্যাগ হাল্কা করার বয়স। এই বয়সটা রেস্টুরেন্ট-মালিকের মানিব্যাগ অহেতুক ভারি করার বয়স নয়। এই বয়সটা, আমি পাড়ায় বয়সে সবার বড়, দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হঠাৎ এটা আবিষ্কার করার বয়স। এই বয়স প্রেমের বয়স শেষে বিয়ের বয়সও প্রায় শেষ করে আবার নতুন করে প্রেমের বয়স শুরু করার, প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হওয়ার বয়স। যেসব মেয়েকে একটাসময়ে ভালো লাগতো, কিন্তু কখনোই ইগোপ্রবলেমে কিংবা লজ্জায় বলা হয়নি, তাদের ফুটফুটে বাচ্চাদের কাছ থেকে মিষ্টি আদুরে গলায় ‘আঙ্কেল’ ডাক শোনার বয়স এই বয়স। এই বয়সটা আগের কম বয়সের স্বেচ্ছা-আরোপিত প্রেম-ঔদাসীন্যকে অভিসম্পাত করার বয়স। এই বয়স জোর করে হলেও ভালোলাগানোর ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করার বয়স।

বয়স বাড়ছে। বাড়ুক! কিন্তু সাথে বাড়ছে কেন হতাশা? কেউ বলতে পার?

হায় তিরিশ! তিরিশ পেরুলে কেউ চাকরি দেয় না! তিরিশ পেরুলে কেউ হৃদয় দেয় না!

এই আকালের দিনে একটা গার্লফ্রেন্ড যে কত বড় অ্যাসেট, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানে।

ভাবনা: চুরাশি।

……………………..

(এই লেখায় আমি ফেসবুকের নাম দিয়েছিলাম: ভাবনাদেয়াল।)

আমার একটা অভ্যেস হলো, যে বিষয়টা আমার দরকার নেই, অথবা আমাকে টানে না, সেই বিষয় নিয়ে আমি কোনো আগ্রহই দেখাই না, এমনকি, জানার চেষ্টা পর্যন্ত করি না। এই যেমন, রাজনীতি, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারস্যাপার এইসবকিছু।

চিন্তার এমন সীমাবদ্ধতায় আমি দারুণ খুশি, কারণ আমি দেখেছি, আমার যাকিছু ভালো লাগে, তাকিছু করারই সময় হয় না। এই জীবনটার সবচেয়ে বড়ো দুইটা সমস্যা হলো, জীবনটা ছোটো আর জীবন একটাই। একটা কচ্ছপ ৩০০ বছর ধরে বাঁচে! আর আমরা? দুম্‌ করে মরেটরে যাই! কোনো মানে হয়! ঈশ্বর কী যে করেন না! যা জানার দরকার নাই, তা নিয়েও বসে থাকলে, যা জানতে ইচ্ছে করছে, তা জানবো কখন?

আমাকে সবকিছু জানতে হবে না, এই চিন্তায় আমি বড় আরাম পাই। শান্তি-শান্তি লাগে। যত কম বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো যায়, ততোই শান্তি! এই যেমন, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়রিং এর একখানা জলজ্যান্ত একনম্বর সার্টিফিকেট বগলদাবা করেও কীভাবে ভালো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে হয়, তা আমি জানি না (জানলে তো আমি নিজেই হতে পারতাম!) ব্যাঙ্কে চাকরি পাওয়ার বুদ্ধি জানি না, প্রাইভেট জব পাওয়ার বুদ্ধি জানি না, ননক্যাডার জব পাওয়ার বুদ্ধি জানি না। আমার নিজের চাকরি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো চাকরির ব্যাপারে আমার কণামাত্রও ধারণা নেই। খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্যে আমি প্রথমে ব্যবসা করতাম। এখন চাকরি করি। যে চাকরিটা করি, সে চাকরি ছাড়া আর কোনো চাকরির পরীক্ষা কখনোই দিই নাই। চাকরি জিনিসটা স্রেফ একটা দায়, নিজের ও নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে চাকরি করতে হয়। এর চাইতে ভালকিছু করার ইচ্ছে, উপায় আর যোগ্যতা নেই বলেই চাকরিটা করছি। কেউ আমাকে ‘বেকার’ বলে ডাকার সুযোগটা নিক, এটা আমি চাই না। চাকরি নিয়ে আমার তেমন কোনো ভালোবাসাবাসি কাজ করে না, তাই আমার কখনোই আর কোনো চাকরিবাকরির খোঁজখবর নিতে ইচ্ছে হয়নি। এটাকে আমি পরম সৌভাগ্য বলে মনে করি! এমনিতে মাথায় বুদ্ধি কম, তার উপরে বেশি বুদ্ধি লাগে, এমন জিনিসপত্র নিয়ে বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। আহ্‌! কী শান্তি!!

আমি হিপোক্রিসি সহ্য করতে পারি না, নিজেও করি না। আমি যা পারি না, তা নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি একটুও চিন্তাভাবনা না করেই সরি বলে দিই: জানি না। এতে নিজেকে হাল্কাহাল্কা লাগে! কিন্তু, সমস্যা হলো, বেশিরভাগ লোকই তাদের প্রশ্নের উত্তরে একটা ভুল উত্তর হলেও শুনতে চায়। আবার এদিকে, আমার যা জানি না, তা নিয়ে কখনোই কিছু বলি না। কেউ আশা করে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তাকে ফেরানো যাবে না, এমন তো নয়! পারি না, এইটুকু বলার সততা তো প্রত্যেক মানুষের থাকা উচিত! আমাকে যখন কেউ অন্য চাকরি নিয়ে জিজ্ঞেস করে নিরাশ হয়, তখন সে হয় দুর্ব্যবহার করে, অথবা ভাবে, আমি ভাব দেখাচ্ছি।

আপনি বিশ্বাস করে ফেললেন, অমুক ভালকিছু করছে। অতএব, আপনি ধরেই নিলেন, সব ভালোকিছুর খবর তার কাছে রেডিমেড পেয়ে যাবেন! এতো বুদ্ধি মাথায় রাখেন, সাথে ওরকমটা না ভাবার বুদ্ধিও একটু রাখতে পারেন না? আমার কাছে অবশ্য ভালোকিছু বলতে আর যা-ই হোক, চাকরি কখনোই নয়। চাকরি মানেই, যন্ত্রণাদায়ককিছু। চাকরির ব্যাপারটাতে কোনো মহত্ত্ব বা দারুণ কিছু নেই। চাকরি স্রেফ একটা প্রয়োজন। এ প্রয়োজন এমনই এক প্রয়োজন, যা না মিটলে অন্য সকল প্রয়োজনই অর্থহীন হয়ে পড়ে।

দেখি, আপনি বিল গেটসকে চালডালের ব্যবসাপাতির খবরাখবর জানতে চেয়ে একটা মেইল করুন তো! রিপ্লাইও তো পাবেন না! আমি তো বিনীতভাবে আমার অপারগতা প্রকাশ করে অন্তত দেখিয়ে দিই, কার আছে গেলে আপনার কাজটা হবে! বিল গেটসের চাইতে আমি ভদ্র না, বলেন? হাহাহাহা…….. আমার মুখবই দেয়ালে (নামটা আপনার ব্যাপক অপছন্দ হইসে না? আচ্ছা যান, নামটা বদলে রাখলাম, ভাবনাদেয়াল। এইবার ঠিকাসে?)

এইসব কথা এলো কেনো? আজকে সকালে একজন ফোন করে ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষায় কীভাবে ভালো করা যায়, সেটার বুদ্ধি চাইলেন। আমি বিনীতভাবে ‘এই ব্যাপারে আমার কোনো আইডিয়া নাই’ বলতেই বড়োবড়ো কথা শুনিয়ে দিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন। শালার পাব্লিক! নিজের বিয়েটা ছাড়া অন্য সবকিছুতেই ফ্রি কামলা খোঁজে!!