ব্যাচেলর্স ডে

ধরে নিই, আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি। আজকের দিনটা যেকোনও দিনের চাইতে বয়সে ৪ বছরের ছোট। ছোটরা ছোট তো, তাই ছোটদের সবাই ফাঁকি দেয়। ওরা নিজেরাও একটু কম বোঝে, ভুলভাল বোঝে। বয়সের প্রভাব। ২৯ ফেব্রুয়ারিকেও সবাই ঠকিয়েই যাচ্ছে। ও নিজেও নিজের দোষে ঠকছে। কীরকম? বলি দুএকটা।

এক। আজকে কারও-কারও জন্মদিন। ওদের মন ভাল নেই। কেন? সবার জন্মদিন আসে বছরে একবার, ওদেরটা আসে ৪ বছরে একবার। সবাই যে সময়ে ৪টা কেক কাটে, সে সময়ে ও কাটে ১টা। ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ কথাটি ও শোনে ৪ বছর প্রতীক্ষায় থাকার পর। অন্যরা যে সময়ের মধ্যে এই সুন্দর উইশটি পায় ১০০ বার, ও পায় ২৫ বার। এভাবেই চলে কম-কম জন্মদিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে-যাওয়ার আয়োজন।

দুই। যার জন্মদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি, তার জন্মদিন কেউ ভোলে না। সবাই মনে রেখে দেয়, অপেক্ষা করে থাকে কখন আসবে সেইদিন যেইদিন বার্থডে ট্রিটটা নেয়া যাবে ৪ গুণ গর্জিয়াসভাবে। বন্ধুর পকেট থেকে পয়সা খসানোর পৈশাচিক আনন্দ মিস করতে কে-ই বা চায়? জন্মদিন আসে, খরচ আসে। কিন্তু হায়, বছর-বছর তো আর বেতন বাড়ে না, অথচ লিপ ইয়ারের জন্মদিনের খরচ হয়ে যায় ৪ গুণ!

তিন। আমরা যারা চাকরি করি, তাদের বেতন নির্ধারণ করা হয় এটা মাথায় রেখে যে, বছরের ৩৬৫ দিন আমরা কাজ করবো এবং সে কাজের জন্য আমাকে ওই পরিমাণ বেতন দেয়া হবে। কীরকম? ধরা যাক, আপনার মাসিক বেতনকে ১২ দিয়ে গুণ করলে আপনার বেতন হবে ৩৬৫ হাজার টাকা। এর মানে হল, আপনার বেতন দৈনিক ১ হাজার টাকা। যে বছরটা লিপ ইয়ার, মানে ৩৬৬ দিনে, সেই বছরের বাড়তি দিনের জন্য আপনি কী পাচ্ছেন? সেইদিনের পারিশ্রমিকটা কোথায়? সেইদিন কি কাজের চাপ অন্যদিনের চাইতে কমে যাচ্ছে? ভেবে দেখুন, সে দিনটাতে বেতন পাচ্ছেন না, কিন্তু কাজ ঠিকই করতে হচ্ছে। সেইদিন আপনি কাজ করছেন কোনও বেতন ছাড়াই! কেন করবেন? কোন মমত্ববোধ থেকে? চাকরি জিনিসটা কে কবে কোথায় ভালোবেসে করেছে? আপনার প্রতিষ্ঠানের মুনাফাঅর্জন কিংবা সেবাপ্রদান কি সেইদিন শূন্য? আপনার শ্রমে আপনার প্রতিষ্ঠানের লাভ হচ্ছে। কিন্তু আপনার কাজের মূল্যায়ন কোথায়? ২৯ তারিখের অফিস মানেই ভূতের বেগার খাটা। আমি তো মনে করি, আজকের জন্য আপনার একটা খাম প্রাপ্য, সে খামে থাকবে ১০০০ টাকা। সে টাকা মাসের শেষে দেয়া যাবে না, কারণ ওতে কিছু দাপ্তরিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে, আর আপনি আপনার ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। টাকাটা দেয়া হোক এখুনি, এই মুহূর্তেই!

চার। ব্যাংকে টাকা রাখছেন। সে টাকা ব্যাংক কাজে লাগাচ্ছে নানান ব্যবসায়, মুনাফা করছে। আর আপনাকে সে মুনাফার সামান্য কিছু অংশ দেয়া হচ্ছে সুদ হিসেবে। সুদটা দেয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ব্যাংকের বিভিন্ন স্কিমের মাধ্যমে। ব্যাংক সময়ের হিসেব করে ক্যালেন্ডার ইয়ারের ভিত্তিতে। সে হিসেবে ব্যাংক এবং আপনার মধ্যে যে চুক্তিপত্র, সেটি অনুযায়ী ব্যাংক আপনার টাকা ব্যবসায়ে খাটাবে এবং মুনাফা করবে বছরের ৩৬৫ দিন। এর বিনিময়ে আপনি নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ পাচ্ছেন। কিন্তু যে বছরটা ৩৬৬ দিনে, সে বছরের বাড়তি দিনে ব্যাংক যে বাড়তি সময় ব্যবসা করে বাড়তি মুনাফা আয় করছে, সেটার কোনও অংশ কি পাচ্ছেন আপনি? আপনার টাকায় ব্যবসা করে আপনাকে সে ব্যবসার মুনাফার ন্যায্য অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবেই। আমার প্রশ্ন হলো, লিপ ইয়ারের সুদ কেন অন্য বছরের সুদের চাইতে বেশি হবে না? হোক সামান্য, তবুও তো! প্রাপ্য স্বীকৃতি পেলে সবারই তো ভাল লাগে!

পাঁচ। যারা কায়িক শ্রম করে, মানে, শ্রমজীবী, তাদের জন্য আজকের দিনটা স্রেফ পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর শোষণের উপলক্ষ ছাড়া আর কিছুই নয়। ওদের প্রতিদিনের বেতনে সংসারের প্রতিদিনের খরচ মিটে। মাসভিত্তিক বেতন কাঠামোর মধ্যে থেকে ওরা আজকের দিনে কাজ করে শুধু মালিকের সম্পদ বৃদ্ধিতে। আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হল দুইটি: শ্রমিকশ্রেণির অবদানের প্রতি যে শ্রদ্ধাপ্রদর্শন এবং শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়। সে বিবেচনায় দিনটি ১ মে না হয়ে ২৯ ফেব্রুয়ারিই হওয়া উচিত। সেদিন ছুটির দিন বিধায়, দারিদ্র্য সীমানার নিচে বসবাসকারী যে সমস্ত শ্রমিক দৈনিক ভিত্তিতে বেতন পায়, তাদের অর্থনৈতিক অধিকারের দিকটি আরও বেশি নিশ্চিত হতো এই যুক্তিতে যে তারা প্রতি ৪ বছরে অন্তত ৩ দিন বেশি কাজ করে বেশি আয় করার সুযোগ পেত। আরও একটা মজার কাজ করা যেতে পারে ২৯ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ঘোষণা করার পর। সেদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হবে না। এতে কী হবে? যে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ দৈনিক ভিত্তিতে পারিশ্রমিক পায়, তারা এই ২৯ ফেব্রুয়ারিতেও কাজের বিনিময়ে টাকা ঠিকই পেত, কিন্তু চাকরিজীবীরা সেইদিন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতো। এতে একদিনের জন্য হলেও সিস্টেমের কারণেই ওদের কাজের আর্থিক মূল্য, যারা শ্রমজীবী না, তাদের তুলনায় বেশি হতো। কারণ অন্যরা যেখানে কাজ করছে বিনামূল্যে, সেখানে ওরা কাজ করছে পূর্ণমুল্যে। ওদেরকে এভাবে করে সম্মানিত করানো যায়।

ছয়। আমরা যারা ভাড়া বাসায় থাকি, তারা ২৯ ফেব্রুয়ারি গ্যাস এবং পানির সুবিধা ভোগ করি কোনও বাড়তি টাকা না দিয়েই। অথচ সেইদিন গ্যাস এবং পানির মোট খরচ অন্যদিনের চাইতে তো আর কমে যায় না। ফলে, দেশের এই দুইটি সম্পদের রিজার্ভের একটা বড় অংশ বিনামূল্যেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য সরকার কোনও রাজস্ব পাচ্ছে না। সম্পদের এমন অর্থের যোগানমুক্ত ব্যবহারের ফলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। সেইদিনের জন্য প্রতি ৪ বছর অন্তর অন্তর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নাগরিকদের কাছ থেকে নেয়া হলে একটা বিশাল অংকের টাকা কিন্তু পাওয়া যেত। সে টাকায় একটা ব্রিজ নির্মাণ করা যাক, কয়েকটা বড় শহরের স্যানিটেশন এবং ড্রেইনেজ সিস্টেমকে উন্নত করা যায়।

সাত। তাইওয়ানে ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখকেই ২৯ তারিখ ধরে জন্মদিন পালন করা হয়। হংকং এবং ইংল্যান্ডে মার্চের ১ তারিখে ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখের সকল আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করা থেকে শুরু করে জন্মদিনের সাথে সম্পর্কিত সকল আইনি কার্যক্রমও এই নিয়মে চলে। এতে অবশ্য কখনও-কখনও কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যেখানে অন্যদের সাথে সেইদিন জন্মনেয়া লিপলিং কিংবা লিপ-ইয়ার বেবিদের কিছু-কিছু ক্ষেত্রে দাপ্তরিক ঝামেলায় পড়তে হয় কিংবা সেবাগ্রহণে দেরি হয়ে যায়। এ ব্যাপারটি চলছে অনেকদিন ধরেই।

আট। যাদেরকে প্রতিবছর জন্মদিন পালন করতে হয় না, তাদের ক্ষেত্রে ‘বয়স বাড়ে’ ৪ বছর পর পর। ওদের বয়স ১ করে বাড়ে না, এক লাফে বাড়ে ৪। যদি এরকম কারওর নামে উইল করা হয় এবং সে উইলে সম্পত্তিপ্রাপ্তির কোনও বয়স নির্দিষ্ট করে দেয়া থাকে, তবে সে সম্পত্তি পেতে কিছু আইনি ঝামেলায় পড়তে হতে পারে দুটো কারণে। কীরকম? ধরা যাক, কোনও লিপলিং তার পিতার সম্পত্তি পাবে যখন তার বয়স হবে ২১। যদি ২১ বছর বয়স হতে ওকে আরও ৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়, এবং এর আগেই তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন, তবে সে তার পিতার মৃত্যুর পরপরই বৈধভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারছে না। কিংবা এরকমও হতে পারে, তার বয়স ২১ হলোই না, সরাসরি ১৯ থেকে ২৩ হলো। তখন কী হবে? যিনি উইল করেছেন, তিনি তো আর নেই। শার্লক হোমস-এও আমরা এমন একটি ঘটনা দেখি।

নয়। আয়ারল্যান্ডে ২৯ ফেব্রুয়ারিকে পালন করা হয় ব্যাচেলর্স ডে হিসেবে। অবশ্য এই আইরিশ ট্র্যাডিশনটি ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে এখন আরও কয়েকটি দেশেও চলে গেছে। ব্যাচেলর পুরুষদের জন্য দিনটি বেশ কিছু বিপত্তিও নিয়ে আসে। দুএকটি বলি। সেইদিন মেয়েরা নাচে এবং পছন্দের ছেলেটিকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করে। যদি ছেলেটি মেয়েটির বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়, তবে মেয়েটিকে দামি রেশমি গাউন কিংবা পশমের কোট কিনে দিতে হবে। কোনও-কোনও জায়গায় এই রীতিও আছে, মেয়েটিকে রিফিউজ করলে অনেক টাকাপয়সা দিতে হয়, কিংবা ওর পছন্দের পোশাক কিনে দিতে হয়। ইয়োরোপে উচ্চবংশীয় এবং অভিজাত সমাজে মেয়েটিকে ১ ডজন গ্লাভস কিনে দিতে হয়ে যাতে করে ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে এঙ্গেজমেন্ট রিং না পরতে পারার আঙুলে-অস্বস্তি ভালভাবেই ঢেকে রাখতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য ইলিনয়ের অরোরা শহরে ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে কোনও অবিবাহিতা মেয়ে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে কোনও অবিবাহিত পুরুষকে গ্রেপ্তার করতে পারে, এমনকি ৪ ডলার জরিমানাও করতে পারে! গ্রিসে মনে করা হয়, ২৯ ফ্রেব্রুয়ারি বিয়ে করা ভাল নয়। কোনও-কোনও জায়গায় পুরো লিপ ফেব্রুয়ারি জুড়েই চলে মেয়েদের জন্য প্রপোজ ডে, মানে, ২৯ দিনই প্রপোজ ডে! আহা! ২৯ ফেব্রুয়ারি! কত রঙের আর ঢঙের মেলা বসে এইদিন! মেয়েদের জন্য চাঁদের হাট, ছেলেদের জন্য গরুর হাট!

আমি আর বলবো না, এখানেই থামছি। আজকের দিনের ১০ম ব্যবচ্ছেদটি আপনিই করুন না!

Content Protection by DMCA.com