বিশ্বাস করেছি বলে

নিজেকে কতোটা লুকিয়ে রাখা যায়? কতো আর যুদ্ধ করে নিজেকে বোঝানো যায়? আর কতোবার নিজেকে পরাজিত দেখা যায়? নাহ্‌! আর পারছি না। জীবনের কাছে আমি বারবার হেরে যাচ্ছি। জীবনে অনেক কষ্ট করে আজকে এই পর্যন্ত এসেছি। তারপরও ভাগ্যের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছি। জীবনে যাদেরকে অনেক বেশি বিশ্বাস করেছি, তারাই আমার জীবনের অনেক বড় ক্ষতি করে চলে গেছে। তাদের কোনো ক্ষতি আমি কখনো চাইনি। সবসময় ভেবেছি কোনো কাজের শেষ না দেখে সেটা ছাড়ব না। অথচ, আমার প্রায় সব কাজই অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে।

জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি, যখন আমার বেঁচে থাকার অর্থটাই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। তিন বছর পরে আবার মানুষের খেলার শিকার হলাম আমি। বন্ধু ভেবে যাকে জীবনের কথা বললাম, সে-ই আমাকে সবার কাছে একজন নিম্ন পর্যায়ের মানুষ হিসেবে প্রচার করলো। আমি কি কেবল ধোঁকা খেতেই জন্ম নিয়েছি? আমার কি কিছুই দেবার নেই এ পৃথিবীকে?

সেইবারের সেই ধাক্কাটা আর সামলে উঠতে পারলাম না। তৃতীয় বর্ষের ফলাফলটা খুব খারাপ হল। কোনোরকমে পাস করে গেলাম। চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা ভালই দিয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না শেষ রক্ষা করতে। ফার্স্ট ক্লাস এলো না। ২.৯৩ পেলাম। বাবা-মা’র আশাগুলো এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। তাই এখন আমাকে শুনতে হচ্ছে সেই সব কথা, যার জন্যে আমি দায়ী ছিলাম না। জীবনের সাথে যুদ্ধ করতেকরতে আজ আমি হেরে গেছি। খুব ইচ্ছে ছিলো ভাল একটা চাকরি করে বাবা-মা’কে দেখবো। আমার ভাইয়া জন্ম থেকেই অটিস্টিক। তার ভার আমার বাবা-মা’কে আজীবন বহন করে চলতে হবে। তার কাছ থেকে আমাদের পরিবারের কিছুই পাওয়ার নেই। আমি সবসময়ই ভাববার চেষ্টা করেছি, শুধু একটা ছেলে না, মেয়েও তার বাবা-মা’র দায়িত্ব নিতে পারে। আমি পারলাম না………..বাবা-মা’র মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম না। ভাইয়া নাহয় শারীরিক কারণে বাবা-মা’কে কিছু দিতে পারবে না, কিন্তু আমি তো শক্তসমর্থ মানুষ। আমিও কেন ভাইয়ার মতোই বাবা-মা’র কষ্টের কারণ হয়ে যাচ্ছি?

ফাইনাল দেয়ার পর আইবিএ’র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, আমি কিছুই পারব না। সবকিছু অনেক কঠিন লাগছে। ভেবে পাচ্ছি না কীভাবে কী করব। ব্যাংকে পরীক্ষা দিতে হলে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস থাকতে হয়। আমার তো তাও নেই। আমি কী করব? চোখের সামনে অন্ধকার দেখছি। চোখ বন্ধ করলে মাথা কাজ করে না।………আমার জীবনটা কি এখানেই থেমে যাবে? আমার চোখের সামনে কোনো আলো নেই। উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি পাচ্ছি না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে। পায়ের নিচে দাঁড়ানোর মতো মাটি নেই। পাশে এমন কাউকেই পাচ্ছি না, যার কাছ থেকে দুটো ভাল কথা শুনতে পারি। এমনিতেই আমার মনের জোর অনেকের চাইতেই অনেক কম। তার উপর এতটা আহত হৃদয়ে বেঁচে আছি! এক বিশাল সমুদ্রে যেন তরীবিহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

এখন আমি কী করবো? আইবিএ’র জন্য পড়বো? নাকি বিসিএস-এর জন্য? বিয়ে করে নিজেকে আর নিজের নতুন সংসার নিয়ে থাকবো, সে উপায়ও নেই। বাবা-মা’কে যে আমাকেই দেখতে হবে। যদি বিয়ের পর নতুন মানুষটা আমার বাবা-মা’র দেখাশোনা করতে না দেয়, তখন? বাবা-মা’কে না দেখে নিজের জীবন নিয়ে নিজের মতো করে থাকবো—সে জীবন আমার কাছে পশুর জীবন! আমি কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। বারবার মনে হচ্ছে, আমি হেরে গেছি, আমি কিছুই পারবো না। ভাইয়া সবার দিকেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, কখনো হাসে। ইদানিং ভাইয়ার চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, ভাইয়া যেন আমাকে পরিহাস করছে। আমার সব থেকেও কেন এমন পঙ্গু হয়ে যাচ্ছি?

ছোটো থাকতে মোটামুটি ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম। তাই বাবা-মা’র আশাটাও অনেক বেশি ছিলো। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলাম। কিন্তু সেখানেও একটি অপূর্ণতা রয়ে গেছে। অনেক আশা করেছিলাম যে গোল্ডেন এপ্লাস পাব। কিন্তু আসেনি। অনেক কষ্ট করে করেছিলাম…….হল না। আমার সাথের আমার সব ফ্রেন্ড পেয়েছিলো। তারপরও মেনে নিয়েছিলাম। জীবনে বাঁচতে হলে মেনে নিতে হয়। তাছাড়া আর উপায়ই বা কী? সামনে ভাল কিছু হবে এই আশাটা মনের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে কাজ করছিলো। যেই কলেজে পড়ার স্বপ্ন ছিলো, সে কলেজে ভর্তি হতে পারলাম না, অন্য কলেজে ভর্তি হলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে। মানুষ যেখানে থাকুক, যে অবস্থাতেই থাকুক, যতটুকু নিয়েই থাকুক, তা নিয়েই তো স্বপ্ন দেখে বাঁচে। স্বপ্ন ছাড়া বাঁচা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়।

নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম……..

প্রাইভেট পড়ার সময় একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের সাথে সামনাসামনি কথা বললাম। ফ্রেন্ড হিসেবে তাকে বিশ্বাস করলাম। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করার চরম মূল্যটা তখনই দিতে হল। আমার পুরো পৃথিবীটাকে এক মুহূর্তেই এলোমেলো করে দিল। একটা মেয়ের ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্ন কিভাবে একটা মানুষ এইভাবে শেষ করে দিতে পারে! কিছু মানুষ কেবল নামেই মানুষ! মানবিকতা মনুষ্যত্ব, এসবের কিছুই না রেখে অনেকেই বেঁচে থাকতে পারে। ওরা দেখি ভালও থাকে। তবে কি খারাপরাই বেশি ভাল থাকে?

বুঝতে পারছিলাম না কী করবো? কোথায় যাবো? কার কাছে একটু আশ্রয় পাবো? এ পৃথিবীতে কাকে বিশ্বাস করলে ঠকতে হবে না?

আমার সাথে এ কী হল! কিছুই বুঝতে পারছিলাম না………..ধীরেধীরে বুঝতে পারলাম আমি কী হারিয়ে ফেলেছি………মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লাম।

সেই সময়টা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ সময়…….জানি না কীভাবে সেই সময়টা আমি পার করেছি।

আজও নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি, কারণ সেই সময় আমার পাশে যদি বাবা-মা না থাকতো, তাহলে আজ আমি এই অবস্থানে থাকতে পারতাম না।

কিন্তু সেই সময়ের দিনগুলো আমি আজও ভুলতে পারি না। আমি জীবনে প্রথম আমার বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। সেইদিন আমার বাবা বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। সেই মুহূর্তটা আমার কাছে কেমন ছিলো, তা আমি বলে বুঝাতে পারব না। ভাগ্য আমার সাথে এক নিষ্ঠুর খেলা খেলে যাচ্ছিল।

ওই সময়েই ছিলো আমার ভর্তি পরীক্ষা। আর তখন আমার দিনগুলো কাটছিলো হসপিটালের বেডে। ঠিক তখনি আমার নানা মারা গেলেন। আমার মা মৃত বাবার মুখ দেখতে যেতে পারলো না। তার কাছে যে তখন সবকিছুর উপরে ছিলো তার মেয়ের জীবন। সে তার বাবাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারলো না………আজো ভাবি, কত কঠিন একটা মেয়ের জীবন! একদিকে মৃত বাবা, আরেক দিকে মৃতপ্রায় মেয়ে! মেয়ে হয়ে জন্মালে কত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়!

তখন মনে হচ্ছিল, আমি কেনো বেঁচে আছি? আমি তো এইরকম জীবন চাইনি। তাহলে আমার সাথে কেন এমন হল! আমি তো কখনোই কারুর কোনো ক্ষতি করিনি, তবে আমার সাথেই কেনো এমন হল? কেন আর দশজনের থেকে আমার জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেল! কোনো উত্তরই খুঁজে পাই না। হয়ত ভুলটা আমারই ছিলো, মানুষকে বিশ্বাস করাটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আজ বুঝি, মানুষকে বিশ্বাস করা যতটা ভুল, তার চাইতে বড়ো ভুল হল, মানুষকে সব কিছুতেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করা। আমাদের ধীশক্তি দেয়া হয়েছে যে যা বলে কিংবা করে, সেটাকেই বিশ্বাস করে ফেলার জন্য নয়। কোন পরিস্থিতিতে কাকে কেন কতোটা বিশ্বাস করবো, সেটা বোঝাটা খুব জরুরি। সবাইই হয়তোবা বিশ্বাস করার মতো, কিন্তু কেউই সব ব্যাপারেই বিশ্বাস করার মতো না।

ভর্তি পরীক্ষার কথা বলি। প্রথমবার পরীক্ষাটা দিতে গেলাম অনেকটা কেবল দেয়ার জন্যই। এখনো মনে আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে পরীক্ষার হলে গিয়েছিলাম। আমাকে পায়ে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল না, জাহাঙ্গীরনগরে আর জগন্নাথে হল। কিন্তু স্বপ্ন যে ছিলো অন্যরকম। পরেরবারের জন্য অপেক্ষা করলাম। একেকটা দিন যাচ্ছিল একেকটা বছরের মতো। শরীরে কিংবা মনে পড়ার মত কোনো শক্তি ছিলো না। জীবনটাকে মেনেই নিতে পারছিলাম না। সে সময়ে কারো সাথেই আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো না। সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। সবাই তাদের স্বপ্নের দিকে এগোচ্ছিল, আর আমার স্বপ্নটা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তারপরও একটা বিশ্বাস রেখে কিছুটা প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। ডুবে যাচ্ছে যে মানুষটা, তারও এক ধরনের আশা থাকে।

অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলাম। নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিয়তি আমার সাথে সেই নিষ্ঠুর খেলাটা তখনো শেষ করেনি। সেই ছেলে আমার পিছু ছাড়ল না। সে ঢাকা কলেজে পড়তো। শুরু হল আমাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছে পুরনো সব কথা ছড়ানো শুরু হল। সে যখন দেখলো কোনোভাবেই আমাকে দুর্বল করতে পারছে না, তখন কিছুটা থামল। সে পিছু ছাড়লেও কষ্ট আমার পিছু ছাড়ল না। আমি প্রতিনিয়ত নানান কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছিলাম। ভার্সিটির তিনটা বছর পার করলাম এইসব কষ্টের বোঝা নিয়ে। মনে স্বপ্ন ছিলো, আমি পাস করার পর যে করেই হোক, মা-বাবা’র মুখে হাসি ফোটাবো।

সে সময় হঠাৎ করেই জীবনের কষ্টগুলো যেন দূর হয়ে গিয়েছিলো একজনের জন্য। মনে হল, সবাই তো আর খারাপ হতে পারে না। তাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। তাই কোনো কমিটমেন্টে যাওয়ার আগে তাকে আমার সব কথা বলতে চাইলাম। আমি কাউকে ঠকাতে চাইনি। তাই সবই তাকে বললাম। বললাম, এ জীবনে যাকে প্রথমবারের মতো বন্ধু ভেবেছি, সে-ই আমাকে গ্রুপ স্টাডির কথা বলে রেইপ করেছে। তার আঘাতের নীলদাগ এখনো আমি আমার শরীরে বহন করে চলেছি। সবই বললাম তাকে। নিজের অসহায়ত্বের কথা বললাম, একটু আশ্রয় চাইলাম তার কাছে। আমি সে সময় সত্যিই কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছিলাম। জীবনে কখনো বাবা-মা বাদে অন্য কারো কাছে একটুও আশ্রয় পাইনি। আমি সবসময়ই চেয়েছি নিজের মতো করে ভাল থাকতে। পারিনি। ভাল থাকতে চাওয়ার শাস্তি কম নয়। নিজের জীবন থেকে জানি, সেইভাবে বদলে যাওয়াটাই সবচাইতে সহজ, যে বদলটা আমি না বুঝেই চেয়েছি। সে বদল থেকে আগের জায়গায় ফেরাটা ভীষণ কঠিন! যা দেখতে ভাল মনে হয়, যা ভাবতে ভাল মনে হয়, তা আর কতটুকুইবা ভাল!

যা-ই হোক, সে ছেলে আমার সব সত্য জেনেই আমার পাশে থাকতে চাইল। তখন জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হতে লাগল। এই সুখটুকু যে আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে তা আমি বুঝতে পারিনি। কিছুদিন পর তার আসল রুপটা বুঝতে পারলাম। মারাত্মক পর্যায়ের মানসিক নির্যাতন শুরু হল। আমি জানি না একজন মানুষ আরেকজনকে কীকরে এতটা অপমান করতে পারে! আমাকে সে রাস্তার মেয়ে বানিয়ে দিল। সবাইকে তা বলতে লাগল এমন সব কথা, যা মেনে নেয়াটা কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়…….আমি জানি না সে কেন এমন করতে লাগল……..আমি তো তাকে আমার জীবনে আসতে বলিনি……সে-ই এসেছিলো সব জেনেবুঝেই। আমি প্রথমে রাজি হইনি, সে-ই আমাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। আমি তো তার কাছে কিছু গোপন করিনি! তবে কেন?

আসলে কাউকেই নিজের সব কিছু বলতে নেই। গোপন গোপনই রাখতে হয়। জীবনে যা-ই কিছু হোক না কেন, সবই তো জীবনেরই অংশ। যে সত্যকে মেনেও নেওয়া যায় না, আবার ফেলেও দেওয়া যায় না, সে সত্যকে কখনোই সামনে নিয়ে আসা ঠিক নয়। নিয়ে এলে জীবনে আরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য যোগ হয়, যা খুব সহজেই এড়ানো যেত, যদি সে সত্যকে আড়ালে রেখে দেওয়া যেত। সবাই সব সত্য জানার যোগ্য নয়।

তখন আমার তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিটা দিন তার অপমান শুনতে হত। আমি নিরুপায় ছিলাম। আমি ফোন না ধরলে সে আমার বাসায় ফোন করার কথা বলত। তাকে আমি বোকার মতো আমার মায়ের নাম্বার দিয়ে দিয়েছিলাম। আমি যে কী করব, কাকে কী বলব, কিছুই মাথায় আসছিলো না। পুরো ডিপার্টমেন্টে আমি আলোচনায় চলে এসেছিলাম। প্রতিটা পরীক্ষার আগে আমাকে তার সাথে আমার দেখা করতে হত। তখন আমি হলে থাকতাম। সে আমার সিনিয়র ছিলো। কিন্তু রিঅ্যাড নেয়ার কারণে আমাদের সাথেই পড়তো। তার কথা হচ্ছে, সে পরীক্ষা দিবে না। তাই আমিও পরীক্ষা দিতে পারব না। প্রত্যেকটি পরীক্ষা আমি আগের দিন রাতে পড়ে দিয়েছি। কী পড়েছি, কী লিখেছি, কীভাবে লিখেছি তার কোনো বোধশক্তি আমার ছিলো না। আমার বিষয় যেহেতু পরিসংখ্যান ছিলো, তাই আমার পক্ষে একরাতের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেয়া ছিলো শুধুই বোকামি। তবু কোনো এক রহস্যময় অন্ধত্বের কারণে আমি সবকিছুই মেনে নিয়েছিলাম।

এভাবেই চলছিলো। একসময় যখন সে আমার মাকে নিয়ে নোংরা কথা বলা শুরু করল, তখন আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। কখনো তার জঘন্য বাজে কথার বিপরীতে আমি কিছু বলিনি। প্রথমবারের মতো আমি বলে দিলাম এইভাবে আর সম্ভব না। কিন্তু তার কথা শুনে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। তার কথা, আমাকে সে কখনোই ছাড়বে না। কারণ আমাকে নাকি সে যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবে ব্যবহার করতে পারবে। আমি নাকি প্রতিবাদ করতে জানি না।

ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করব। জীবনটাকে খুব ছোট লাগছিলো। কেন যে বেঁচে আছি, সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। জেদের বশে সুইসাইড করার অ্যাটেম্পটও নিলাম। কিছু প্রকৃত বন্ধুর কারণে সেই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন, তা টের পেলাম। যাকে নিয়ে বাঁচার আশায় তার হাত ধরেছিলাম, সে-ই আমাকে মৃত্যুর স্বাদ দিলো।

খুবই অবাক হয়েছিলাম, যখন জানতে পারলাম, আমার এই খবর জেনে তার প্রতিক্রিয়া ছিলো, আমি নাটক করছি। আমার মত মেয়েরা নাকি সব পারে………ছেলেরা কীকরে পারে মেয়েদের সম্পর্কে এমন জঘন্য কথা অবলীলায় বলে দিতে?

আমি আবারও ধোঁকা খেলাম। পাস করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। স্রষ্টার কাছে শুধু একটা প্রার্থনাই করছিলাম আমার বাবা-মা’র মুখটা যাতে ছোট না হয়। তিনি শুনলেন আমার কথা। আমি পাস করলাম কোনোরকমে; বলতে গেলে অনেকটা অলৌকিকভাবেই। ফাইনাল ইয়ারে অনেক কষ্ট করলাম। কিন্তু পারলাম না……….

আর আট-দশটা মেয়ের মত যে আমি ভাবতে পারি না। আমার জীবন যে ওদের মত না। আমাকে সবার সাথে ভাল থাকার অভিনয় করে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। প্রতিটি সাধারণ মেয়েকেই তা-ই করে যেতে হয় হয়তো। আমি যে জীবনের সাথে আর যুদ্ধ করতে পারছি না। খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি আমার জন্য কিছু চাই না। আমি শুধু চাই আমার বাবা-মা’র মুখে হাসি দেখতে। আমি ছাড়া যে ওদের কেউ নেই! আমি তাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না আমার সাথেই কেন এমন হল? আমি তো জীবনে কখনো কারো কোনো ক্ষতি চাইনি। আমার অপরাধ কী ছিলো? আমি তো ভালোবেসেছিলাম। তবে কি কাউকে বিশ্বাস করা কিংবা ভালোবাসা অপরাধ? ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে বাঁচা নাকি সব কষ্টের মূল। কিন্তু যে ভুল মানুষ, সে ভুল প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তো তাকে ঠিক মানুষই মনে হয়!

জানি না কতটুকু গুছিয়ে বলতে পেরেছি……..চোখের সামনে সবকিছু ভেসে আসে। কখনো কাউকে বলতে পারিনি এইসব কথা। আজ কী মনে করে জানি সব লিখে ফেললাম! আমি জানি না আমার সব কিছু জেনে আপনি আমাকে খারাপ ভাবছেন কিনা!

আমি খারাপ কি ভাল, সে তর্কে আমি যাবো না। অতোটা শক্তি কিংবা সময়, কোনোটাই আমার আর নেই। আমি এখন বেঁচে আছি শুধুই আমার বাবা-মায়ের জন্য—এইটুকুই জানি! যদি কোনোদিন এই দুইটি দুঃখী মানুষের জন্য কিছু করতে পারি, সেদিন যদি মৃত্যুও আসে, আমি হাসিমুখে মেনে নেবো!