আমার অর্জনের ঝুলিটায় কী কী জমা হয়েছে জানতে চেয়েছিলে। বলছি, শোনো। এ জগতের যা-কিছু নিষিদ্ধ, সমাজগর্হিত, রীতিবিরুদ্ধ, সভ্যতার প্রতিটি সীমাই লঙ্ঘিত, তা-কিছুই আমার কাছে নিয়মসিদ্ধ। ওসব আমি পরমযত্নে লালন করি, সমাজ, সভ্যতা, জাত, ধর্ম, এমনকী পৃথিবীর বিরুদ্ধেও যেতে পারি আমি বড়ো অনায়াসেই, ওতেই আমার স্বস্তি ও সুখ! অবাক হলে? মনে মনে বুঝি হচ্ছ তৈরি, খুব কথা শোনাবে, তাই? ভাবছ বুঝি এমন লজ্জা ফেলে দুম-দুমা-দুম কী করে এসব যাচ্ছি বলে? মুখ ঘুরিয়ে এখুনিই তুমি পালাবে বুঝি? দাঁড়াও দাঁড়াও! একটু জিরোও! তোমার তিন বছরের মেয়েটাকে যদি কখনও কাঁদতে দেখো, তখনও কি তুমি হাসতে পারো? ধরো, এই জগতের সব নিয়মেই লেখা আছে, তোমার সন্তানের কান্না শুনেও তোমায় হাসতে হবে! তখনও পারবে, বলো? তখন কি চাইবে না মন, সব নিয়মের টুঁটি চেপে ধরে নিজের সন্তানের অশ্রুর ভাগটা নিতে? তখন চাইবে না কি নিজের সবটা বিকিয়ে হলেও একটুকরো হাসি কিনতে? পৃথিবীর কী হবে তখন? সভ্যতাই-বা কোথায় যাবে? ধর্মের কল নড়বে কী করে? পুরো স্বজাতিকেই নিলামে তুলতে কাঁপবে না বুক এতটুকুও? তোমার কাছে সন্তান যার নাম, তা যে অনেকের কাছে কেবলই বোঝা! হ্যাঁ, এই দেশেই…এই দেশেই ঘটেছে এমন! নিজের সন্তানকে বিকিয়ে দিয়ে জঠরজ্বালায় কত লোকই তো খাবার কিনেছে! ভাবছ বুঝি এ আর এমনই-বা কী? একটু নাহয় হেসেই নেবে! কী? শুনে বড্ড বিঁধছে বুঝি? তোমার কাছে যা অসহ্য ঠেকে, সে তো সুখের হতেই পারে অন্য কারও কাছে! তাই না, বলো? তাহলে কেন চাইছ বলো সব ডুবিয়ে একচিলতে হাসি কিনতে? নিয়ম নিয়ম চেঁচিয়ে তুমি এতটাই তবে কাঙাল হলে! কেবল একটুখানি হাসতেই তো বলেছি, তাতেই এতটা নাকাল হলে! কী গো তুমি! অমন বিজ্ঞ মানুষ, বাণ যদি হয় এত ঠুনকো তোমার, আঘাতটা তবে হানবে কীসে? অনুভূতির পিঠ চাপড়ে সভ্যতা আর গড়বে কে, বলো! ক্রম-আত্মহননের প্রতিটি স্বীকারোক্তি দু-হাতে দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে দূরে ফেলে, মানুষের কল্যাণে কলমটা আবারও ধরতে হবে! উচ্চস্বরে আওয়াজটা আজ তুলতে হবে আর বলতেই হবে, এরাই যে এ জাতির পাপচিহ্ন, কলঙ্কশাপ! একসমুদ্র চোখের জলে আগে শুদ্ধ তো হও, তার পরেই নাহয় এমন সমাজশুদ্ধির কাজে নেমো! চোখের সামনে হৃদয় যা পাবে, তার সবকটিই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঁজলা ভরে রক্তপান করলে পরেই ধর্মের পথ সিদ্ধ হবে, তাই না, বলো! কখনও আমায় বোলো না গো অমন করে সিদ্ধ হতে, তোমার যেমনি অসহায় লাগে, আমারও ঠিক তেমনিই লাগে, জানো! তোমার যা-কিছু, আমার কাছে তার সবই সন্তানসম, হয়ও যদি তা ছাই-ধূলি শুধু এ সংসারে! ভাবছ হয়তো, নিয়মের বাইরে আমি গিয়েছি কেন, এ যে ঘোর অন্যায়, প্রাপ্য আমার শাস্তিই কেবল! সমাজ, সভ্যতা, জাত…এরাই তো আমার নিথর দেহে প্রাণ ঠুকেছে, চলে তাদের উলটো-স্রোতে ভালো থাকতে চাইছি আমি কোন সাহসে! শান্তি, স্বস্তি…আমি ওসব পাবো কোন অধিকারে! নাহয় মেনেই নিলাম, হ্যাঁ, সত্যিই তো তা-ই, দুবর্ল হলে পরে করতেই যে হয় নৈবেদ্য নিবেদন...অপাত্রেও! এ সবই আমার জানা আছে ঢের! সময় যখন ফুরোবে, তখন উপরে গিয়ে বোলো বিধাতাকে, গেল জন্মে ভুল নাহয় একটু হয়েই গেছে, এবেলাতে যেন ক্ষমা করে দেয়! শেষকথাটি শুনে রাখো, নিষিদ্ধ ভালোবাসার শুদ্ধতম স্বীকারোক্তিটুকু কেবল আমার জন্যেই তুলে রেখো ঠিক! তখন আবার বোলো না যেন সমাজ তোমায় পরিয়েছে শেকল! যে সমাজে আমরা ছিলাম, তা বুঝি ছিল গড়া তোমার মনে? না কি আমার মনেই?